Thursday, March 5, 2020

হিন্দুদের দুর্বলতা কোথায়?

হিন্দুদের দুর্বলতা কোথায়?


একটু পিছন ফিরে দেখি। যারা উন্মুক্ত তলােয়ার হাতে দুর্বার গতিতে আমাদের দেশে এসেছে, আমাদের পদানত করেছে, শাসন-শােষণ করেছে, লুণ্ঠন করেছে, লক্ষ লক্ষ হিন্দুর জীবন ও ধর্ম নাশ করেছে, নারী ধর্ষণ ও লুণ্ঠন করেছে, মন্দির দেববিগ্রহ ধ্বংস করেছে তাদের আমরা প্রতিরােধ করতে পারিনি। তারা কি অপরাজেয় ছিল? তাদের শক্তিসংখ্যা কুশলতা কি বেশি ছিল? আমরা কি বশ্যতা মেনে নেবার জন্যই বসে ছিলাম?

তারা অপরাজেয় ছিল না। পরাজিত হয়েছে বার বার। রাজা দাহিরের কাছে, পৃথ্বীরাজ চৌহানের কাছে পরাজিত হয়েছে, শক্তি সংগ্রহ করে ফের আক্রমণ করেছে, বার বার। আর আমাদেরই ‘জয়চঁাদ’ রূপী ছিদ্রপথে আমাদের পরাজিত করে পদানত করেছে। আর বাকি রাজারা দূর থেকে দেখেছে, কেউ বিদেশী বিধর্মী শত্রুকে পরাস্ত করতে একযােগে এগিয়ে আসেনি। আল বেরুণী তাই আশ্চর্য হয়ে লিখেছেন, “সুলতান মামুদ বার বার আক্রমণ করছে লুঠ করছে, হিন্দুরা যুদ্ধ করছে, হাজারে হাজারে প্রাণ দিচ্ছে, কিন্তু আক্রমণকারী লুঠ করে ফিরে গেলে ফের হিন্দুরা উদাসীন হয়ে যাচ্ছে। ফের আক্রান্ত হতে পারে, এ ভাবনাই যেন তাদের নাই।” ...‘ভারতীয়রা মনে করত, তাদের মতাে কোনাে দেশ হয় না, জাতি হয় না, ধর্ম হয় না, বিজ্ঞানও হয় না। ...ভারতীয়রা নিজেদের জ্ঞান গােপন রাখতে, এক বর্ণ অপর বর্ণের কাছে। বিদেশীদের কাছেও তারা জ্ঞান গােপন রাখতাে।” ...“ভারতীয়রা সবসময় বিশৃঙ্খলার মধ্যে বাস করত।” হিন্দুরা শক্তির অভাবে নিজ ক্ষতি করেনি, করেছে চেতনার অভাবে।

নাম ও পদবীতে হিন্দু-মুসলমান’ গ্রন্থে শ্রী খগেন্দ্রনাথ ভৌমিক ভারতে হিন্দুর পতনের অনেক কারণের মধ্যে প্রথম কারণ হিসাবে বলেছেন, “...ভারতে হিন্দু রাষ্ট্র ও রাজত্বের পতন ও অবসানের প্রধান কারণ ব্যক্তিগত সাহস বা শৌর্য-বীর্যের অভাব নয়; সে কারণ রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব ও সংঘশক্তির অভাব, এবং তার হেতু অনেক। কৌম চেতনা, আঞ্চলিক চেতনা, সামন্ততন্ত্র, বর্ণবিন্যাসের অসংখ্য স্তরভেদ, সংকীর্ণ স্থানীয় রাষ্ট্রবুদ্ধি প্রভৃতি...।” ২০০২ খ্রীস্টাব্দে সুলতান মামুদ পেশশায়ারের ছােটো রাজা জয়পালকে যখন পরাজিত করে তখন বাকি হিন্দু রাজারা যদি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতাে তবে হয়তাে ভারতবর্ষ হিন্দু রাষ্ট্রই থেকে যেত। পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করে জয়াদ, রানী দুর্গাবতীর ঈর্ষাকাতর সেনাপতি রানী দুর্গাবতীকে পরাজিত করে, মানসিংহ হিন্দু রাজগণকে পরাজিত করে বিদেশী বিধর্মীর পায়ে উপটৌকন দিয়েছে। হিন্দুরা . শিবাজীর পাশে দাঁড়ায়নি, রানা প্রতাপের পাশে, রানী দুর্গাবতীর পাশে; রাজা প্রতাপরুদ্রের পাশে, এক হিন্দু রাজা অপর হিন্দু রাজার পাশে দাঁড়ায়নি। সম্মিলিত সুলতানী শক্তি বিজয়নগর ধ্বংস করতে পেরেছে, হিন্দু রাজারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। গিয়াসুদ্দিনকে পরাজিত করে হিন্দু রাজা গণেশের উত্থানে মু সলমান মােল্লা, মৌলানা, পীর, দরবেশরা  বিদ্রোহ ও আন্দোলন করে হিন্দুরাজার পতন ঘটাতে পেরেছে কিন্তু বিদেশী বিধর্মী অত্যাচারীর বিরুদ্ধে হিন্দু ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। শুধু তাই নয়, মান সিংহের মতাে হিন্দু বীরেরা ভারতে ইসলামিক রাজত্বের ভিত শক্ত করেছে। ঐতিহাসিক আ র্ন ল্ড টয়নবী লিখেছেন, “মুসলিম রাজত্বে সরকারী প্রশাসনে ব্রাহ্মণ মন্ত্রী এবং নিম্নতর কর্মচারী যুক্ত থাকার ফলে এই বিদেশি শাসন হিন্দুদের কাছে যতদূর বিতৃষ্ণার হবার কথা ছিলাে তা হয়নি। কারণ ব্রাহ্মণ মধ্যস্তরা স্বদেশী হিন্দুদের কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তা জানতাে..?”

শুধু অনৈক্য নয়, প্রতিষ্ঠিত হিন্দুরাই স্বার্থান্ধ হয়ে মুসলমান রাজত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ভারতের মাটিতে। হিন্দুর বিভেদ হিন্দুকে কোনােদিন ঐক্যবদ্ধ হতে দেয় নি, আজও দেয় না। গ্রীক, শক, হুন হিন্দু সমাজে মিশে যেতে চেয়েছিল। গ্রীকরা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম গ্রহণ করেছিল, শক ও হুনেরা ক্ষাত্র অধিকার চেয়েছিল, কিন্তু হিন্দু সমাজ তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। ছােটোজাত-বড়ােজাতের মিথ্যা অহমিকায় তাদের ব্ৰত্য করে রেখেছিল। এরাই মর্যদার স্বার্থে সুলতান মামুদের শরণাপন্ন হয়। মামুদের ঘােষণায় তারা ব্রাহ্মণত্বের অধিকা র পায়। ভারতে ইসলাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় এই গ্রীক, শক, হুনদেরই অবদান সর্বাধিক। তাদের হিন্দু সমাজ গ্রহণ করলে রূপটা হয়তাে অন্যরকম হতাে। এই ব্রাত্য ক্ষত্রিয় হুসেন শাহ হিন্দুর অবজ্ঞা, ঘৃণায় কয়েক লক্ষ্য নাগর ব্রাহ্মণ্য (গ্রীক) ও ব্রাত্যক্ষত্রিয় (শক, হুন) নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তার পর বাংলায় তার হিন্দু নিপীড়ন, ধর্মান্তকরণ সুবিদিত। যেখানে ইসলাম অপরকে গ্রহণ করে শ ক্তিশালী হয়ে উঠেছে, সেখানে হিন্দুর গোঁড়ামী আর ভেদাভেদ হিন্দুকে ক্রমাগত দুর্বল করে গেছে। এই বর্ণ ভেদাভেদ ও গোঁড়ামি এতটাই প্রথিত যে বর্ণ হিন্দুর কাছে সমগ্র দেশ, সমগ্র সমাজের চিন্তা, তাকে রক্ষা করার চিন্তা, তার কাছে তুচ্ছ। তাই হিন্দুর আশার আলাে নিয়ে শিবাজী যখন উঠে এসেছেন, তখনও বর্ণহিন্দুব্রাহ্মণ

তার রাজ্যাভিষেকে রাজি নয়। কারণ, মারাঠারা শূদ্র। তাদের কাছে শূদ্র হিন্দু রাজার চেয়ে অত্যাচারী, দেবমন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংসকারী, হিন্দুর ধর্ম ও জীবন নাশকারী মুসলমান রাজত্বই বেশি গ্রহণযােগ্য যেন।

| হিন্দু ধর্মনেতারা কোনােদিন হিন্দুকে ঐক্যবদ্ধ জাতিরূপে গড়ে তােলার চেষ্টা ততা করেইনি, উপরন্তু বর্ণাশ্রমিক উঁচুনিচু ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, কুসংস্কার দ্বারা হিন্দুকে বিচ্ছিন্ন করে গেছে। বৃহত্তর হিন্দুজাতি থেকে গেছে অবহেলা, অবজ্ঞা অপমানের শিকার হয়ে। স্বামী রামদাস, শিবাজী দেখিয়েছেন অবহেলিত হিন্দুর ঐক্যবদ্ধশক্তির স্ফুরণ। যদি সমস্ত হিন্দু জাতি এক জাতি এক প্রাণ হয়ে গড়ে উঠত তবে আজ এই হিন্দুস্থানের ইতিহাস অন্যরূপ হােত। এটাই আমাদের দুর্বলতা।

No comments: