Friday, July 31, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 16 শ্রী শ্রী হরিচাঁদের তিরোভাবে ভক্ত মনোভাব প্রসঙ্গ

 

নর দেহ ছাড়ি হরিগুরুচাঁদে যায়।


দেশ বাসী নর নারী করে হায় হায়।।


কেহ বলে ছেড়ে গেল সোনার মানুষ।


বাঁচিয়া থাকিতে কেহ করি নাই হুষ।।


কেহ বলে ‘অকস্মাৎ হল ইন্দ্র পাত।


বিনা মেঘে শিরে হল দৃঢ় বজ্রাঘাত।।


কেহ বলে ‘নমঃশূদ্র জাতি ডুবে গেল।


আপদে বিপদে রক্ষা কে করিবে বল।।


আর জনে কহে “ভাই বড় দুঃখ মনে।


হরি বিনা রোগে শোকে বাঁচিব কেমনে।।


মহাব্যাধি লয়ে এল শ্রী হরির ঠাঁই।


শ্রী মুখের আজ্ঞা মাত্র ছাড়িত বালাই।। “


কেহ বলে “ ভাই সবে শোন দিয়া মন।


মহাপাপী সবে মোরা অতি অভাজন।।


তাই যদি নাহি হবে তবে বল দেখি।


এমন সোনার হরি কেন দিল ফাঁকি।।


নারী গণে জনে জনে করে আলাপন।


“ওলো দিদি কেন মোর হল না মরণ।।


কত দিন দেখিয়াছি শ্রী হরি চাঁদেরে।


রূপের ঝলকে হায় মন প্রাণ কাঁদেরে।।


দূর হতে মনহরা রূপ দেখিয়াছি।


মন খুলে মনো কথা কিছু না বলেছি।।


আজি কালি করি দিদি বলা হল নারে।


হরি চলে গেছে কথা আর বলি কারে।।


কোন লোকে বলে “ভাই,মোরা সবে অন্ধ।


এত দিন মনে কত করিয়াছি সন্দ।।


অকথা কু কথা কত বলিয়াছি তাঁরে।


হরি বিনে আজ দেখ যেন শূন্য ঘরে।।


থাকিতে মানুষ মোরা কেহ চিনি নাই।


শান্তি পতি বিনে বল কোথা শান্তি পাই।।


হরি যবে ছিল বেঁচে করেছি বিদায়।


অমূল্য পরশ মণি হারানু হেলায়।।


থাকিতে মানুষ বেঁচে কেহ নাহি চায়।


ছেড়ে গেলে সবে মিলে করে হায় হায়।।


দিন মানে সূর্য জ্বলে আকাশের গায়।


‘অসয্য অগ্নির কুণ্ড ‘ বলি লোকে কয়।।


সূর্য যবে ডুবে যায় কালো রাত্রি আসে।


সেই কালে বিশ্ববাসী সূর্য ভাল বাসে।।


যুগে যুগে পলে পলে নরে করে ভুল।


ফল খায় ডালে বসি নাহি চেনে মূল।।


রাম এল কৃষ্ণ এল এল গোরা রায়।


নর – রূপ – ধারী হয়ে অবতীর্ণ হয়।।


মানুষের সাথে মিশি মানব আচারে।


মানুষের খেলা খেলে থাকিয়া সংসারে।।


অন্ধ নরে মনে করে এই বুঝি মানুষ।


বোঝে না’ক এ মানুষ নয় সে মানুষ।।


আপনার মত তারে সবে মনে করে।


নিজ তুল্য মনে করে দেয় তাঁরে দূরে।।


নর রূপে নর সাথে করে নর খেলা।


যারা জানে তারা দেখে সেত প্রেম লীলা।।


নর রূপ ছাড়ি যবে প্রভু ফাঁকি দেয়।


নরে তবে বুঝে পরে করে হায় হায়।।


মনে ভাবে এই ভুল আর না করিব।


এবারে আসিলে প্রভু ধরিয়া রাখিব।।


ছলা কলা লীলাময় পুনঃ নরাকারে।


দেখা দেয় নর হয়ে আমাদের ঘরে।।

হয়ে সন্দ করে দ্বন্দ “এই কিরে সেই। “


তেমন মোহন রূপ এর দেখি কই?


চুল চিরে স্ববিচারে করে আনাগোনা।


ভুল করে পুনঃ তাঁরে চিনিতে পারেনা।।


সৃষ্টি মূলে আদি ভুল ব্রহ্মের বিকার।


ভুলে ভরা সসাগরা জগৎ সংসার।।


যার ভুল কাটিয়াছে চোখে নাহি কালি।


আব্রহ্ম তাহাতে ভরা দেখে যে সকলি।।


ভুলে তারে নাহি পায় ভুল ভুলে যায়।


নর মধ্যে সেই দেখে হরি রসময়।।


সেই ত দেখেছে সত্য সোনার মানুষ।


সেই মানুষের রসে হয়েছে বেহুঁশ।।


লীলা সাঙ্গ করিলেন প্রভু হরিচন্দ্র।


‘সব বলে অস্ত গেল পূর্ণিমার চন্দ্র’।।


জীব কালে যারা কভু দেখে নাই চাহি।


তারাও কাঁদিয়া কহে কেন দেখি নাহি।।


ঘরে ঘরে জনে জনে করে আলাপন।


হায় হায় কিবা হবে উপায় এখন।।


সবে বলে গুরুচাঁদে বলি “বড় কর্ত্তা।


তাঁর কাছে মিলিবে কি সেই সব বার্ত্তা।।


কেহ বলে বড় কর্ত্তা বলে যারে ডাকি।


হরিচাঁদ তারে কিছু দিয়া গেছে নাকি?


হরিচাঁদ পুত্র বটে তিনি মহাশয়।


তবু বল মূল সম ডাল কভু হয়?


কেহ বলে “ শোন ভাই কথা বল ফাঁকা।


আগুন কি রাখা যায় কাপড়েতে ঢাকা।।


হরিচাঁদ যদি কিছু দিয়া থাকে তাঁরে।


ক্রমে পরিচয় পাবে তার ব্যবহারে।।


কেহ বলে “ওরে ভাই কিবা দিবে হরি।


তাঁর শক্তি নিল সব ভক্তে লুট করি।।


হীরামনে দেখেছে ত জলে হেঁটে যায়।


গোলক পাগল দেখ মহাশক্তি ময়।।


মৃত্যুন গোঁসাই ছিল, ছিল দশরথ।


টুণ্ডা প্রভু শ্রী লোচন গোঁসাই সাক্ষাৎ।।


আর যত ম’তো ছিল আরো আছে বেঁচে।


সবে মিলে হ ‘রি হতে শক্তি লুটে নিছে।।


বড় কর্ত্তা দেখ নাই সে ধার ধারে না।


উনি যেন দিন রাত কি করে ভাবনা।।


বড় কর্ত্তা সেই শক্তি কোথা পাবে বল।


মোট কথা হরি গেলে সব চলে গেল”।।


কেহ বলে ‘ওরে ভাই বাজে বকো ‘ নারে।


ফাঁকা ফাঁকা কথা বলে পরে ঠকোনারে।।


সিংহে জন্ম দেয় সিংহ, বাঘে দেয় বাঘ।।


যেমন বাপের বেটা ধরে সেই রাগ।


কিবা বল বড় কর্ত্তা কি শক্তি পেয়েছে।।


হরিচাঁদ তোমারে কি বলে কিছু গেছে?


পরমার্থ তত্ত্ব দেখ নহে ত সরল।


বুদ্ধি দিয়ে তার শেষ কেবা পায় বল?


তোমার আমার ভাই কতটুকু জ্ঞান।


তাহা ছাড়া ধর্ম্ম পথে মোরা যে অজ্ঞান।।


বাহির দেখিয়া কভু বিচার চলে না।


না দেখি অন্তর, জ্ঞানী বচন বলে না।।


কথা শুনে আর জনে বলে ক্রোধ ভরে।


জ্ঞানের কথা ত ভাই বলিলে প্রকারে।।


যেমনি বাপ তেমনি বেটা বলিলে ত সব।


পশু মধ্যে সত্য বটে নরে কি সম্ভব?


ঈশ্বর বিদ্যাসাগর শুনিয়াছি নাম।


বিখ্যাত পণ্ডিত তিনি অতি গুণধাম।।


প্রাতঃস্মরণীয় বলি কহে নাম তাঁর।


কেমন তাঁহার পুত্র বল একবার।।


সে সব ছাড়িয়া তবে ধর্ম্ম পথে কই।


কৃষ্ণ পুত্র কেবা ছিল বল শুনে লই।।


মহারাজ যুধিষ্ঠির ধর্ম্ম অবতার।


কেবা তাঁর পুত্র ছিল কেমন প্রকার?

বঙ্গ দেশে রাজা ছিল নাম সীতারাম।


কেবা তার পুত্র ছিল কিবা তার নাম।।


প্রতাপ আদিত্য নাম হিন্দু রাজ চূরা।


বিখ্যাত বসন্ত রায় ছিল তার খুড়া।।


প্রতাপের পুত্র কেবা জান নাকি তাই।


যেমনি বাপ তেমনি বেটা কোথা পেল ভাই!


বড় ঘরে বড় ভাব যদি দাও ছেড়ে।


এক ভাব সবখানে আছে দেশ জুড়ে।।


তাই ভেবে দুই কথা বলিয়াছি ভাই।


বড়কর্ত্তা গুরুচাঁদে নিন্দা করি নাই।।


হাসিয়া বলিল তবে দ্বিতীয় সুধীর।


সামান্য দুইটি কথা শোন বাক্য বীর।।


যেমনি বাপ তেমনি বেটা বলি নাই ভুল।


ডালে ডালে ঘুরে তুমি দেখ নাই মূল।।


ধর্ম্ম ক্ষেত্রে রাজ বংশে গৃহস্থ-আশ্রমে।


যেমনি বাপ তেমনি বেটা দেখ ক্রমে-ক্রমে।।


পরাশর মুনি পুত্র ব্যাস মহামুনি।


তিনি এক অবতার শাস্ত্রের কাহীনি।।


তাঁর পুত্র শুকদেব গুণে সীমা নাই।


অবিকারী মায়াত্যাগী সাধু শাস্ত্রে পাই।।


মুনি বংশে মুনি জন্মে অসংখ্য প্রমাণ।


কশ্যপের ঘরে অবতার শ্রী বামন।।


ভৃগু পুত্র ভার্গব সে এক অবতার।


ভরদ্বাজ – পুত্র দ্রোন বিদিত সংসার।।


মৃত্যুজয়ী অশ্বত্থামা পুত্র হল তার।


বিশ্বামিত্র মহামুনি গাধীর কুমার।।


অর্জুনের পুত্র নাম অভিমন্যু বীর।


গৌতমের পুত্র সতানন্দ ধর্ম্মে স্থির।।


সূর্য বংশ চন্দ্র বংশ বিখ্যাত ভারতে।


বংশ পরিচয় আছে নানা গ্রন্থ মতে।।


অজ পুত্র দশরথ তার পুত্র রাম।


রাম পুত্র লব কুশ বীর অনুপম।।


চন্দ্র বংশে যত ছিল মহারাজা গণ।


গুণে শীলে হীন কেহ ছিল কি কখন?


নমঃশূদ্র কুলে দেখ হরি বংশ হতে।


কোন বংশে নহে শ্রেষ্ঠ দেখ কোন মতে।।


যত যত রাজ বংশ আছে দেখ ভাই।


বংশ মূলে মুনি ঋষি ইথে ভুল নাই।।


আমি শুনিয়াছি কথা হরি গেছে বলে।


নমঃশূদ্র কুলে রাজা হবে কালে কালে।।


হরি বাক্য কভু নাহি হইবে লঙ্ঘন।


হরি বংশে হবে রাজা নিয়তি লিখন।।


এই বংশে পূর্ব্বে পূর্ব্বে জন্মিল যাহারা।


সাধু কি সন্যাসী সবে প্রেমে মাতোয়ারা।।


সজ্জনের সাধনাতে হরি এল বংশে।


তাঁর বাক্য মিথ্যা নাহি হবে কোন অংশে।।


বড় কর্ত্তা কোন ভাবে চলে দেখ তাই।


সকলের মধ্যে থেকে যেন তা’তে নাই।।


ইতর জনের মত কভু কোন দিন।


বাক্য কিবা কার্যে তারে দেখিয়াছ হীন?


কোন দোষ কোন দিনে যারে স্পর্শে নাই।


তাঁর মধ্যে কিবা শক্তি বল দেখি ভাই।।


তা ‘তে বলি হরি কারে কিবা দিয়া গেছে?


সেই তত্ত্ব পরচার হবে ক্রমে পিছে।।


সেই তত্ত্ব দিয়ে ভাই কোন কার্য নাই।


তামাক সাজিয়া আন টেনে বাড়ি যাই।।


এই ভাবে ঘরে ঘরে চলে আলাপন।


এবে শুন ভক্তগণে কি করে মনন।।


যেই দিন হরিচাঁদ লীলা সম্বরিল।


তারক গোস্বামী বটে কাছে নাহি ছিল।।


বড়দিয়া বন্দরেতে কবি গান তরে।


আছিলেন শ্রীতারক গানের আসরে।।


সারা রাত্রি গান করে সেই মহাশয়।


অতি প্রাতেঃ কেহ আসি সংবাদ জানায়।।

নদী তটে আছে বটে শ্রী হরি ঠাকুর।


তারকেরে দেখিবারে ইচ্ছা সে প্রভুর।।


শ্রুত মাত্র এই বাণী তারক সুজন।


সভা ফেলি দ্রুত পদে করেন গমন।।


দূর হতে দেখে প্রভু আছে দাঁড়াইয়া।


ভুবন মোহন রূপে আঁধার নাশিয়া।।


প্রেমে ভোর অশ্রু লোর বহিছে নয়নে।


স্বেদ কম্প পুলকাশ্রু সাত্ত্বিক লক্ষণে।।


বৎস- হারা ধেনু যথা বৎসে দেখা পায়।


অথবা তটিনি যথা সাগরেতে ধায়।।


সেই মত হরি প্রতি ছুটিছে তারক।


হরি দরশনে প্রাণে অনন্ত পুলক।।


বাহু প্রসারিয়া ছুটে আনন্দে মাতিয়া।


মনে ভাবে বক্ষে হরি রাখে সাপুটীয়া।।


“এই বুঝি হরি অঙ্গ ধরিলাম বুকে।”


মহোল্লাসে হস্ত বেড়ি ধরিল তাঁহাকে।।


কই কোথা কেহ নাই এ যে শূন্য বুক।


বজ্রাহত প্রায় সাধু রহে হয়ে মূক।।


বড়ই আশ্চর্য লাগে সাধুর হৃদয়।


কিবা হ’ল কি দেখিনু ভোজবাজী প্রায়।।


এই চোখে দেখিয়াছি এই বালু পরে।


দাঁড়াইয়া ছিল হরি অপরূপ ধরে।।


জীবন্ত মূরতী ধারী নাহিক সন্দেহ।


সেই রূপ হৃদি মধ্যে হেরি অহরহ।।


এই হরি কোথা গেল শূন্যে মিলাইয়া।


কি ছল ছলিল প্রভু আমাকে ডাকিয়া।।


ভাবিতে ভাবিতে সাধু বালু ‘ পরে চায়।


বালু পরে পদ চিহ্ন দেখিবারে পায়।।


পদ চিহ্ন হেরি তার দূরে গেল সন্দ।


কেন্দে কয় “ হায় হায় মোর ভাগ্য মন্দ।।


বড়ই অভাগা আমি দৃষ্টি শক্তি নাই।


পেয়ে ধন হারা ইহা কাহারে জানাই।।


কেন হেন দেখিলাম ভাবিছে তারক।


বুঝি বা ছেড়েছে হরি এই মর্ত্ত লোক।।


ইতি উতি মনে ভাবি সেই মহাশয়।


কাঁদিতে কাঁদিতে সাধু পড়িল ধরায়।।


ভক্তের দুঃখ হেরি শূন্য বাণী ভরে।


দয়াময় হরিচাঁদ বলিল তাঁহারে।।


“সত্য সত্য বুঝিয়াছ তারক রসনা।


লীলা সাঙ্গ করিয়াছি তুমি তা জাননা।।


কায়া ছাড়িয়াছি বটে নহে তাহা ভুল।


শক্তি আছে গুরুচাঁদে এই জান মূল।।


পরাজ্ঞানী তুমি জানি ভকত নিপুণ।


বৃথা শোক কর সাধু ভাবিয়া বিগুণ।।


কাট মায়া ধাঁধাঁ ভক্ত দেখ দিব্য চোখে।


গুরুচাঁদ কায়া মধ্যে পাইবে আমাকে”।।


এত বলি শূন্য বাণী হল অন্তর্দ্ধান।


শোক সম্বরিয়া সাধু শেষ করে গান।।


গৃহে ফিরি তাড়াতাড়ি দেরি নাহি কৈল।


ওড়াকান্দী শ্রী ধামেতে উপনীত হৈল।।


গুরুচাঁদে দেখি সাধু ফুকারিয়া কাঁন্দে।


শ্রী তারকে দেখি ছলে বলে গুরুচান্দে।।


“তারক হে! দেখ চাহি হরি গেছে ছাড়ি।


কি কারণে তবে আর এস এই বাড়ি।।


তোমাদের সে ঠাকুর আর বেঁচে নাই।


ছেড়ে গেছেন হরিচাঁদ ক্ষীরোদ গোঁসাই।।


আর কেন তবে সবে আস ওড়াকান্দী।


কার গুণে রবে সবে প্রেমে হয়ে বন্ধি।।


আমিত সংসারী লোক সংসারে আবদ্ধ।


কোন গুণে বলো সবে করিব বা বাধ্য।।


হরি গেছে আার ওড়াকান্দী কিছু নাই।


খুঁজিয়া সে হরিচাঁদে লহরে সবাই।।


শ্রী গুরুর মুখে শুনি হেন খেদ বাণী।


পদে পড়ে সে তারক লোটায় ধরণী।।


কেন্দে বলে গুরুচাঁদে জগৎ গোঁসাই।


কে বলে গিয়াছে হরি, হরি যায় নাই।।


পরাণ হরণ হরি এই খানে দেখি।


তোমা মধ্যে হরিচাঁদ দেয় ঝিকিমিকি।।


তোমার মধ্যেতে হরি রহিয়াছে মিশি।


“ হরি গুরুচাঁদ, মিলি হল পূর্ণ শশী।।


পিতা পুত্র অভিন্নাত্মা দোহে এক প্রাণ।


তারিলে জগৎ জীবে সাধিলে কল্যাণ”।।


গলে বস্ত্র জোড় হস্ত করি সে তারক।


স্তব করে মনোসাধে হইয়া পুলক।।

 

“প্রণমি চরণে জগৎ শরণে


অনাদি কারণে আমি।


জগৎ পালক ব্রহ্মাণ্ড নায়ক


কলুষ হারক স্বামী।।


গুণময় বিভু অখিলের প্রভু


গুণে নাই কভু সীমা।


আমি অতি মূঢ় না জানি নিগূঢ়


চরণে চাহিনু ক্ষমা।।


কিবা কব জানি সেই কথা শুনি


ওহে গুণমনি হরি।

করিবে করুণা এ মূঢ় বাসনা


কেমনে ধারনা করি।।


বানী বাগেশ্বরী বর্ণনাতে হারি


পদ সার করি দাসী।


সূর্য চন্দ্র পুজে প্রদীপের সাজে


আপন গরজে আসি।।


চামর দোলায় পবন সদায়


সাগর ধোয়ায় পদ।


যত নদী নদ করি কলনাদ


ছুটে প্রেম গদ গদ।।


শাখে ডাকে পাখি তোমারে নিরখি


কুসুমের আঁখি ফুটে।


শিশিরের কণা হয়ে অশ্রু কণা


তোমার চরণে লুটে।।


অতল সলিলে প্রলয়ের জলে


ধরাকে রাখিলে ঢাকা।


ধরাকে জাগাতে মৎস রূপেতে


মেলিলে জলেতে পাখা।।


দশ অবতার এস বারবার


হরে ধরাভার সুখে।


দুষ্টেরে নাশিতে সাধুকে রাখিতে


আসিলে ধরার বুকে।।


অবতার যায় আসে পুনরায়


জীবে দিয়ে যায় শিক্ষা।


পূর্ণ অবতার হয় নাই আর


এই বারে হবে রক্ষা।।


পূর্ণানন্দ হরি সফলা নগরী


ক্ষীর সিন্ধু ছেড়ে এলে।


যশোবন্ত ঘরে পূর্ণার উদরে


নর রূপ ধারী হলে।।


প্রথম আবাদ ওহে হরিচাঁদ


ঘুচালে আপদ সবে।


দেবের বঞ্চিত দানব লাঞ্ছিত


ব্রহ্মার কাঙ্খিত ভাবে।।


ক্ষেত্র সু প্রস্তুত যশোবন্ত সুত


পেল অবধূত তোমা।


মিশিল তোমাতে এ বিশ্ব জগতে


নাহিক গুণেতে সীমা।।


হরি গুরুচাঁদ পূর্ণিমার চাঁদ


সুধার আস্বাদ দিলে।


তারিলে জগত জগতের নাথ


সবে তোমাগত চলে।।

পতিত যাহারা হয়ে সর্বহারা


বাদলের ধারা চোখে।


ডাকে দিবারাতি অগতির গতি


বেদনার ছবি মুখে।।


হয়ে কৃপাবন্ত ও হে প্রাণকান্ত


করিবারে শান্ত সবে।


অনাথ আতুর কান্দিল প্রচুর


আসিলে ঠাকুর ভবে।।


নিজে গৃহী সাজে গৃহীজন মাঝে


করে হরি রাজে লীলা।


মানুষের সাথে মিলিয়া সবাতে


কৃপাদণ্ড হাতে খেলা।।


সব নীতি দিয়ে গৃহীকে সাজায়ে


নিজে দেখাইয়ে দিলে।


পূর্ণ শিক্ষা লাগি ওহে সর্ব্বত্যাগী


গৃহধর্ম্ম ভোগী হলে।।


গুণে সীমা নাই নির্গুণ গোঁসাই


আমি বুঝি নাই তত্ত্ব।


জানে হীরামন গোলক লোচন


সঁপে দেহ মন মত্ত।।


কিবা কর খেলা অনন্ত মেখলা


ক্ষীরোদের বেলা ভূমে।


আনন্দে মাতিয়া ক্ষীরোদ আসিয়া


চরণে পড়িয়া চুমে।।


আকাশ বিচিত্র সাজিয়াছে ছত্র


নাহি কেহ মাত্র আর।


আপনা আপনি করেছ মেলানী


সৃষ্টি ছিনিমিনি সার।।


পলকে গড়িয়া পলকে ভাঙ্গিয়া


পলকে ধরিয়া বুকে।


ভাঙা গড়া খেলা কর নিত্য বেলা


বসিয়া একেলা সুখে।।


রূপ গুণহীন আপনাতে লীন


কারণ – বিহীন কান্ত।


ইচ্ছা – রস দিয়ে ব্রহ্মাণ্ড সৃজিয়ে


আপনা ছড়ায়ে শান্ত।।


জীব কুল যত পলে পলে কত


তোমাতে আগত দেখি।


জীব করে কর্ম্ম জীব কহে ধর্ম্ম


জীবে রাখে মর্ম্ম শিখি।।


তোমার বিকার সৃষ্টির আকার


তুমিত সার জানি।


যাহা কিছু হয় সকলি তোমায়


ও হে গুণময় গুণি।।


মোদের ব্রহ্মাণ্ড ক্ষুদ্র এক ভাণ্ড


কত যে ব্রাহ্মণ্ড আছে।


কেবা তাহা জানে বিভু তুমি বিনে


কেবা কোন খানে বাঁচে।।


তোমার কারণে বিবিধ বচনে


যতই রচনে লিখি।


কিছু নাহি হয় যাহা তাহা রয়


মনে ভাবি হায় একি?


গুণাতীত গুণী লোটায়ে ধরণী


করি জোড় পাণি বন্দি।


কোন কথা নাই জগৎ গোঁসাই


ভূমে লুটে তাই কাঁন্দি।।


যাহা ইচ্ছা কর অধম নফর


কাঁপে থর থর ভয়ে।


বিশ্বময় হরি নররূপ ধারী


রূপের মাধুরী লয়ে।।


নর জ্ঞান করি এত দিন ধরি


হয়ে অহংকারী সবে।


করিয়াছি হেলা চলে যায় বেলা


খেলেছি কু খেলা ভবে।।

 


অনাদির নাথ কোটী দণ্ডবৎ


কৃপা দৃষ্টি পাত কর।


ভুবন পালক দাস যে তারক


অজ্ঞান পাবক হর।।

 


স্তব শুনি গুরুচাঁদ কহে প্রীত মনে।


“শুনহে তারক চন্দ্র আমার বচনে।।


তোমার হৃদয় ভরা ভক্তি-প্রেম-রসে।


হরি প্রেম বিরহেতে নাহি পাও দিশে।।


তাঁর কান্তি, তাঁর প্রেম সদা হৃদে ভাসে।


বিশ্ব-ভরা দেখ শুধু হরি -প্রেম রসে।।


ভক্তি বন্যা ডুবায়েছে তোমার হৃদয়।


যাহা কিছু দেখ চোখে সব হরিময়।।


হরি প্রেম খেলা আমি কিছু নাহি জানি।


তার ঘরে লভি জন্ম নিজে ধন্য মানি।।


তোমাদের সেই হরি ছিল কোন জন।


এইখানে এল হরি কিসের কারণ।।


তোমারা বা কোনভাবে তাঁরে দেখেছিলে।


কোন সে পরম ধন তাঁরে কাছে পেলে।।


সেই সব তত্ত্ব আমি কিছু নাহি জানি।


হরি ছিল দিবা তুল্য আমি যে রজনী।।


তবে এক বাঞ্ছা বটে আছে মোর মনে।


ইচ্ছা আছে সেই ধর্ম্ম পালিব জীবনে।।


মহাপ্রেম বন্যা ঢেউ তুলিয়া জগতে।


মম পিতা এসেছিল শ্রী হরি রূপেতে।।


সেই প্রেম বন্যা আজ দেখহে চাহিয়া।


ছুটিতেছে দেশে দেশে নাচিয়া নাচিয়া।।


যেই ঢেউ তোলে সেই জানে তার মর্ম্ম।


আমরত নহে বাপু ঢেউ-তোলা কর্ম্ম।।


সেই সাথে দিতে তাল আমার বাসনা।


আমার বাসনা শোন তারক রসনা।।


তোমরা রয়েছ যত শ্রী হরির গণ।


তোমাদের ভাব আমি বুঝিনা কখন।।


যদিবা তোমরা সবে আস এই বাড়ী।


আমাতে জানিবে সবে বাড়ীর প্রহরী।।


শ্রী হরির বাড়ী গণি তোমাদের ঘর।


কোন দাবী নাহি মোর বাড়ীর উপর।।


এস কিম্বা যাও চলি কোন বাধা নাই।


তোমাদের তালে তাল দিতে আমি চাই।।


আমি ত সংসারী লোক পুত্র কন্যা আছে।


আমার থাকিতে হবে তা’দের পাছে।।


যা কিছু পেয়েছ সবে ঠাকুরের ঠাঁই।


সেই সব তত্ত্ব মোর কিছু জানা নাই।।


তোমাদের সে ঠাকুর তোমরা তাঁহার।


কোন ধার নাহি ধার তোমরা আমার।।


সকলে হরির গণ তোমরা স্বাধীন।


তোমাদের কাছে ভক্তি মুক্তি সব হীন।।


নহিত ঠাকুর আমি আমাতে কি আছে।


বৃথা কেন এলে ছুটে তুমি মোর কাছে”।।


এত যদি গুরুচাঁদ বলিয়া বচন।


তারক কহিলা তবে করিয়া রোদন।।


“কৃপাময় আর ছলা করিওনা কভু।


নিশ্চয় জেনেছি তুমি অখিলের বিভু।।


আমার ঠাকুর আছে কভু যায় নাই।


তোমার মধ্যেতে ধরা ক্ষীরোদের সাঞী।।


বুঝি বা না বুঝি প্রভু তবু এই কই।


তোমা মধ্যে হরিচাঁদ আছে বসে ওই”।।


নীরবে তারক কান্দে ঠাকুর নীরব।


ভক্ত ঠাঁই ভক্তাধীন মানে পরাভব।।


এবে শুন কি করিল গোস্বামী গোলক।


হরি বিনে দেহে দহে জলন্ত পাবক।।


সদা মন উচাটন গোস্বামী বেড়ায়।


কোন স্থানে তিল মাত্র শান্তি নাহি পায়।।


ইতি উতি চলে সাধু চোখে নাহি ঘুম।


কদাচিৎ বাক্যালাপ নীরব নিঝুম।।

গোস্বামীর ভ্রাতুষ্পুত্র নাম মহানন্দ।


নামে গানে মত্ত যেন প্রভু নিত্যানন্দ।।


একদা নিরালে বসি সেই মহাশয়।


কর জোড় করি তবে গোস্বামীকে কয়।।


“ভয় পাই প্রভু পাদ করিতে জিজ্ঞাসা।


তথাপি রাখিতে নারি মনের পিপাসা।।


যেই হতে হরিচাঁদ দেহ রাখিয়াছে।


সেই যেন তব প্রাণ কোথা চলে গেছে।।


কায়া মাত্র ছায়া সম যেন রাখিতেছে।


দয়া করি বল কেন এ ভাব ধরেছে?


তব মুখে পূর্ব্ব কালে শুনেছি বারতা।


সাধুর জীবন মৃত্যু নহে দুই কথা।।


শোকেতে কান্দেনা তারা সুখেতে না হাসে।


সুখ দুঃখ সমভাব তাহাদের পাশে।।


তবে কেন হরি বিনে শোকেতে কাতর।


শূন্য মনে সারা গাত্র কাঁপে থর থর।।


দয়া করি যদি প্রভু বলহে কারণ।


সুস্থ হয় শান্তি পায় এ দাসের মন।।


মহানন্দ বলে যদি এ হেন বচন।


গোস্বামী গোলক কহে দুঃখে ভরা মন।।


“ শুন শুন মহানন্দ ওরে বাছাধন।


কি কারণে দেখ মোর মলিন বদন।।


সুখ দুঃখ এক কথা চিত্তের বিকার।


সাধুগণ নহে কভু বাধ্য যে তাহার।।


দারা পুত্র স্বজনাদি সম্বন্ধ যা রয়।


সে সব বিয়োগে বটে মনে দুঃখ হয়।।


অসার সংসার ইথে নাহিক সম্বন্ধ।


তাহে সুখ দুঃখ শুধু মায়া পাশে বদ্ধ।।


আর দেখ স্বজনাদি হইলে বিয়োগ।


কিছুকাল আত্মজনে করে দুঃখ ভোগ।।


কালে কালে সেই দুঃখ দু ‘ দিনে ফুরায়।


শোক – ব্যথা ভুলে সবে হাসি কথা কয়।।


ক্ষণিকের শোক – ভোগ ক্ষণিকে বিলয়।


মোর বুকে যেই শোক সেই শোক নয়।।


এ যে কি আগুন পোড়া নাহি পাই দিশে।


দহিছে আমাকে সদা হরি – হারা বিষে।।


শত পুত্র শত পত্নী যদি ছেড়ে যায়।


তথাপিহ এই শোকের তুলনা না হয়।।


শোক দুঃখাতীত ছিল প্রাণের ঠাকুর।


দেখিলে সে মুখচন্দ্র দুঃখ হত দূর।।


সে যে মোর কেবা ছিল কহনে না যায়।


অহর্নিশি প্রাণ পোড়ে বুক ফেটে যায়।।


স্বজনাদি বলে যারে নর সাধারনে।


সম্বন্ধ পাতিয়া কত সুখ পায় মনে।।


সাধুজনে জানে তাহা ক্ষণিকের মায়া।


তাই পাশরিতে পারে সুখ – দুঃখ ছায়া।।


যেই মায়া করে নর দারা পুত্র প্রতি।


যেই মায়া পতি পদে রাখে তার সতী।।


কৃপনের যেই মায়া নিজ ধন পরে।


যেই মায়া করি মাতা বক্ষে পুত্রে ধরে।।


ততোধিক মায়া মোর আছে হরি প্রতি।


এ মায়া অক্ষয় মায় মোর চির সাথী।।


স্বজনাদি জানি সব অলিক কল্পনা।


কল্পনার পিতা হরি নাহিক তুলনা।।


স্বজন বিয়োগ ব্যথা দু ‘ দিনে ফুরায়।


চিরসাথী বান্ধবেরে কি সে ভোলা যায়?


ভোলার প্রাণের ধন কিসে ভুলি তাঁরে?


তাঁরে ভোলা সব ভোলা ভুলি কি প্রকারে?


আমি জানি কোন ধর্ম্ম শুন দিয়া মন।


যেই ধর্ম্মে সতী পূজে ‘ শিবের চরণ।।


পিতৃগৃহে পতি নিন্দা শুনিয়া জননী।


অশুচি ভাবিয়া তনু ত্যাজিল তখনি।।


শুচি – শুদ্ধা হেন সতী যাঁরে ছাড়ি যায়।


মহাকাল হ ‘লে বাকি শোকে মৃত প্রায়।।

 

গুণমণি সতীদেহ স্কন্ধেতে ধরিয়া।


ঘুরিল পাগল শিব জগত ভরিয়া।।


সুদর্শন চক্রে তবে প্রভু নারায়ন।


খণ্ডে খণ্ডে সতীদেহ করেন খণ্ডন।।


ভবেশ বুঝিলা স্কন্ধে সতীদেহ নাই।


বিরস বদনে ভোলা ঘন ছাড়ে হাই।।


আপনার মাঝে ভোলা আপনি ডুবিল।


মহাযোগে হয়ে মগ্ন সমাধিস্থ হ’ল।।


এ দিকেতে মহাসতী পার্ব্বতী রূপেতে।


গিরিরাজ পুরে এল জগত তারিতে।।


আলোক সম্ভূতা কন্যা রূপে সীমা নাই।


গিরি ভাবে কন্যা যোগ্য বর কোথা পাই।।


সতী জানে পতি তাঁর আছে যোগাসনে।


জন্মে জন্মে পতি ভোলা, অন্যে নাহি জানে।।


খেলা ছলে চলে দেবী কানন ভিতরে।


দূর হ’তে ভোলানাথে আনন্দে নেহারে।।


দেখ মাত্র জগন্মাতা পতিকে চিনিল।


দেহ মন প্রাণ দেবী পদে সমর্পিল।।


পতি পেতে ভুল পথে সতী লাজ পায়।


লভিলা কৈলাস পতি তীব্র সাধনায়।।


জন্ম ফিরে গেল তবু সতী নাহি ফিরে।


যেই পতি সেই পতি জন্ম জন্মান্তরে।।


অতীতের সেই ধর্ম্ম সদা জাগে মনে।


যেমনি মা তেমনি ছা ‘ শাস্ত্রের বচনে।।


বর্ত্তমানে দিকে দিকে দেখি ব্যভিচার।


পতিহারা পতিরূপে মাগে অন্য নর।।


শাস্ত্র বাক্য বলি কহে কতই যুক্তি।


পতি হারা লালসায় ভজে অন্য পতি।।


প্রাণনাথ প্রাণকান্ত প্রভু হরিশ্চন্দ্র।


সে বিনে দিবসে রাত্রি, চক্ষু মোর অন্ধ।।


শ্রী হরির বিরহ বিষে অসহ্য যাতনা।


হরি বিনে পোড়া প্রাণ বুঝি বা বাঁচেনা।।


শ্রী হরির পোষা পাখী মোরা যত জন।


হরি বিনে তিলে তিলে হবে যে মরণ।।


আমি জানি গুরুচাঁদ এল কোন জন।


ব্রহ্মা বিষ্ণু করে ধ্যান তাঁহার চরণ।।


তবু মনে হয় মোর যেই দেহ দিয়া।


হরিপদ পূজিয়াছি পরাণ ভরিয়া।।


সেই দেহ সেই রূপ ভিন্ন অন্য রূপে।


নাহি দিব না পারিব দিতে কভু সঁপে।।


এই দেহ এই প্রাণ হরিচাঁদ নিছে।


আর না বিকা’ব প্রাণ আর কা’র কাছে।।


হরি সম্বরিতে রূপ, সেই রূপ নাই।


এই রূপ ছেড়ে তবে আমি সাথে যাই।।


হরি শক্তি দিয়া গেছে প্রভু গুরুচান্দে।


আমি দিয়া যাব শক্তি তো’কে মহানন্দে।।


আমি যথা সেবিয়াছি শ্রী হরির পদ।


সেই ভাবে পূজা কর প্রভু গুরুচাঁদ।।


এত বলি শ্রী গোলক নীরব হইল।


নীরবে শ্রী মহানন্দ কাঁদিতে লাগিল।।


মহানন্দ দেখে ভেবে ভাবনা যে মিছে।


ছেড়ে গেছে শ্রী গোলক ছায়া মাত্র আছে।।


ইহ পরে সে গোলক দেশে দেশে ঘুরি।


ঘরে ঘরে এল ঘুরি বলে হরি হরি।।


প্রাণ শূন্য দেহ বল রহে কত দিন।


নিদারুণ শূলে তার দেহ করে ক্ষীণ।।


ইতি উতি ঘুরি প্রভু শ্রী গোলক চন্দ্র।


মৃত্যু কালে করিলেন তারকের সঙ্গ।।


জয়পুর গ্রামে আসি তারকের ঘর।


দেহ রক্ষা করিলেন কোলের উপর।।


উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক প্রায় এক জ্যোতিঃ উঠি।


আকাশ ভেদিয়া চলে পূর্ব্ব দিকে ছুটি।।


তারক দেখিল জ্যোতিঃ যায় পূর্ব্ব দিশি।


মহানন্দের অঙ্গেতে হল মিশামিশি।।

 

সেই মহানন্দ তবে হ’ল শক্তিমন্ত।


হরি লীলামৃতে আছে সে সব বৃত্তান্ত।।

গুরুচাঁদ পদে নিষ্ঠা রাখি মহাশয়।


দিবানিশি ঘরে ঘরে হরিনাম বিলায়।।


শ্রী গুরুচাঁদেরে জানে সাক্ষাৎ ঈশ্বর।


হরি গুরুচাঁদ তত্ত্ব করিত প্রচার।।


তাহার যতেক লীলা বিবিধ প্রকারে।


প্রচারিত হরি লীলামৃতের ভিতরে।।


এবে পুনঃ মূল সূত্রে করিব বারতা।


অন্য কোন ভক্তে তবে বলে কোন কথা।।


বারশ ‘ পঁচাশি সালে জৈষ্ঠ মাস হল।


শ্রী রামভরত সাধু পুনঃ ফিরে এল।।


ওড়াকান্দী এসে দেখে হরি দেহে নাই।


ভূমিতে পড়িয়া সাধু কেন্দে ছাড়ে হাই।।


মহাপ্রভু গুরুচাঁদ নিকটে আসিল।


তাঁর দরশনে ব্যথা দ্বিগুণ বাড়িল।।


কেন্দে বলে “বড় দাদা বাবা গেল কোথা।


তাঁরে বিনে এ জীবনে বেঁচে থাকা বৃথা।।


তুমি ত জানিতে দাদা ভাঙ্গিবে কপাল।


তবে কেন ছেড়ে দিলে পরম দয়াল।।


তুমি যদি জোর করে বলিতে তাঁহারে।


নিশ্চয় যেত না হরি ছাড়িয়া সবারে।।


কোটী জন্ম সুকৃতির ভাগ্য ছিল ভাই।


অযোধ্যা হইতে বঙ্গে এসে তাঁরে পাই।।


ভুবন মোহন বেশে দেখিলাম তারে।


কোন গুণে গুণমণি ভুলা’ল আমারে।।


রাম মন্ত্রে উপাসনা ছিল যে আমার।


হরিচাঁদে দেখে গেল চিত্ত – অন্ধকার।।


মন প্রাণ হরি মোর করিল উতলা।


তাঁরে বিনে মনো ব্যথা কারে যায় বলা ?


রাম নামে দেহে বল হাতে ছিল যষ্ঠি।


মনে হত নাশিবারে পারি এই সৃষ্টি।।


তখন বুঝিনি দাদা সেই বল বৃথা।


সকল বলের বল হরিচাঁদ পিতা।।


তাঁরে দেখে গেল বল যষ্ঠি গেল পড়ে।


কাঙ্গাল সাজিনু আমি সব সজ্জ্বা ছেড়ে।।


কাঙ্গাল করিল মোরে কাঙ্গালের নাথ।


আত্মা কেড়ে নিয়ে করে মোরে আত্মসাৎ।।


হরিচাঁদে আত্মা দিয়া দেশে দেশে ঘুরি।


মনে হয় বিশ্ববাসী আমার প্রহরী।।


মনে ভাবি আমি মূঢ় এতই অজ্ঞান।


কেন ভয় করি? পিছে আছে হরিচাঁন।।


প্রাণের দোসর ভাই রসিক সুজন।


সেই মোরে দেখাইল হেন রত্ন ধন।।


এমন বান্ধব আর নাহি ত্রিভুবনে।


দিনমানে রাত্রি হল হরিচাঁদ বিনে।।


আ রে রে পাপিষ্ঠ প্রাণ দেহে কেন র’স্।


হরিপদে দাসী সেজে কার দাসী হ’স্।।


আ রে রে নয়ন অন্ধ দেখি কিবা আর।


হরিরূপ বিনে দেখি সব অন্ধকার।।


আরে আরে জড় জিহবা কিবা ক’স্ কথা।


হরিচাঁদ বিনে গাবি কার গুণগাঁথা।।


ওহো রে দুর্ব্বল হৃদি কি বসাবি বুকে।


স্পর্শ মনি হরিচাঁদ যদি নাহি থাকে।।


আরে আরে বদ্ধ কর্ণ কিবা গান শুনি।


যদি নাহি বাজে হৃদে হরিচাঁদ ধ্বনি।।


পাষাণ পরাণ মোর নাহি দয়ামায়া।


নিষ্ঠুর হইয়া রহে নাহি ছাড়ে কায়া।।


ত্রিভুবনে বন্ধু নাই এবে তাই দেখি।


হরি – শূন্য এ জীবনে বেঁচে কেন থাকি”।।


আছাড়ি পাছাড়ি সাধু করে কান্দাকান্দি।


বলে “অন্ধকার হল ক্ষেত্র ওড়াকান্দী “।।


তবে প্রভু গুরুচাঁদ বাহুড়ি আসিল।


শ্রী রাম ভরতে তবে কহিতে লাগিল।।


“শুন মিশ্র অবিমিশ্র নহে ত জীবন।


জন্মিলে মরিতে হবে বিধির লিখন।।


হরিচাঁদ গেছে চলি কথা মিথ্যা নয়।


যুগে যুগে এই ভাবে খেলা তাঁর হয়।।


তাঁহারি সৃজিত বিশ্ব সে বিশ্ব চালায়।


তাহা হয় যাহা ইচ্ছা করে ইচ্ছাময়।।


মোরা ত পুতুল মাত্র সে যে খেলোয়াড়।


খেলুক যে খেলা ইচ্ছা হয়েছে তাঁহার।।


মনে ভাবিতেছে হরিচাঁদ আজি নাই।


মোর মনে বলে ইহা ঠিক নহে ভাই।।


যাঁর আজ্ঞা ক্রমে চলে চন্দ্র সূর্য তারা।


যাঁরে দেখে ঢালে মেঘ সুধা-বারি ধারা।।


যাহার ইঙ্গিতে বায়ু বহিছে সদায়।


কল কল নদী নদ যাঁর গুণ গায়।।


প্রভাত আলোক দেখি যার মধু হাসি।


সন্ধ্যার আঁধারে রহে কাল রূপ রাশি।।


প্রচণ্ড মধ্যাহ্নে দেখি যাঁর রুদ্র মূর্ত্তি।

পাহাড় ধ্যানেতে মগ্ন রেখে যাঁহে আর্ত্তি।।


জননীর বুকে সুধা যে -জন জোগায়।
ফলে ফুলে বসুধারে হাসায় নাচায়।।
জীব প্রতি স্নেহ প্রীতি দয়া, ক্ষমা রূপে।
ভায়ার্ত্তের বুকে যেবা ভয় হয়ে কাঁপে।।
কল্পনারে দিয়ে রূপ জগৎ গড়ায়।
অনু পরামানু জুড়ে সে যে বিশ্বময়।।
সে কেন ছাড়িয়া যাবে এই কোন কথা।
“ সে নাই সে নাই “ ভাই ভাব তুমি বৃথা।।
কোথা আছে সেইজন খুঁজে তারে দেখ।
ব্যাকুলতা দূর করে সুস্থ হয়ে থাক “।।
গুরুচাঁদ মুখে শুনি এই তত্ত্ব বাণী।
প্রণমি শ্রীপদে সাধু দাঁড়াল অমনি।।
বলে “দাদা আমি আঁধা বোধশক্তি নাই।
দয়া করে মোরে তবে রাখ তুমি ভাই।।
শ্রী গুরু ডাকিয়া বলে “থাক থাক থাক।
প্রাণ ভরি ‘ হরিচাঁদে হেথা বসে ডাক।।
সুস্থির হইয়া সাধু রহে ওড়াকান্দী।
হরি বলে ঘুরে ফিরে উঠে কান্দি কান্দি।।
এবে শুন কোন্ কথা কহে হরিপাল।
কোন্ ভাবে দয়া করে পরম দয়াল।।
তাঁহার রচিত কথা বড়ই মধুর।
তাঁরে বহু কৃপা কৈল শ্রী হরি ঠাকুর।।
ধন্য শ্রী পরম সাধু নাম হরিপাল।
স্বচক্ষে দেখিল যিনি পরম দয়াল।।
কুম্ভকার বংশে জন্ম যশোহর জিলা।
তারে নিয়ে হরিচাঁদ করে কৃপালীলা।।
হরিলীলামৃত গ্রন্থে কবি রসরাজ।
লিখিয়াছে শুনিয়াছে ভক্ত সমাজ।।
উদ্দেশে মতুয়া হ’ল সেই মহাশয়।
সূর্যনারায়ন সাধু তারে পদ কয়।।
ওড়াকান্দী যাবে বলি করে আনাগোনা।
যাব যাব বলি শীঘ্র যাওয়া হ’ল না।।
এমন সময় প্রভু দেহ তেয়াগিল।
হরিপাল শুনি বার্ত্তা মনে ব্যথা পেল।।
মনে ভাবে কি দুর্ভাগ্য আমি অভাজন।
জীবমানে না দেখিনু প্রভুর চরণ।।
বুকে ব্যথা পুষি, সাধু ইতি উতি ধায়।
কল্পনাতে হরিরূপ সতত ধেয়ায়।।
কাষ্ঠ কাটিবারে তার নৌকা কতখান।
দক্ষিণেতে বাদা মধ্যে করিল প্রয়াণ।।
কিবা সে চক্রির চক্র বোঝা বড় দায়।
দৈব চক্রে নৌকা তার জলে ডুবে যায়।।
গদাই নামেতে সেথা দুষ্ট একজন।
ইচ্ছা করে তার ধন করিতে হরন।।
নানা ছলে সেই খল হরিপালে নিল।
ব্যাঘ্রের কবলে ফেলি নাশিতে ইচ্ছিল।।

নানা ছলে সেই খল হরিপালে নিল।


ব্যাঘ্রের কবলে ফেলি নাশিতে ইচ্ছিল।।

ব্যাঘ্র দেখি হরিপাল সব বুঝি লয়।


বিপদে পড়িয়া ডাকে “ কোথা দয়াময়!


পরম নির্ভর সাধু করে এক মনে।


উপনীত হরিচাঁদ ভক্তের কারণে।।


ভক্তের স্কন্ধেতে বসি পদ দোলাইয়া।


ইঙ্গিতে তাড়াল ব্যাঘ্র সদয় হইয়া।।


কমলা – সেবিত পদ শিবের সম্পদ।


প্রতি লোমকূপে ফুটে আছে কোকনদ।।


নিটোল মধুর হেরি চরণের শোভা!


কল কল নাচে গঙ্গা সাধু মনোলোভা।।


চরণ পরশে এল হরিপালে হুস্।


কেন্দে বলে “কেবা তুমি সোনার মানুষ “।।


স্কন্ধে থেকে প্রভু বলে “শুন হরিপাল।


আমাকে চিনিবে যদি কাট মায়াজাল।।


ওড়াকান্দী হ’তে আমি আসিয়াছি হেথা।


বুঝিতে পারিবে পরে সেই সব কথা।।


মনে মনে যার রূপ ভেবেছ সদায়।


ওড়াকান্দী গেলে তার তত্ত্ব মিলে যায় “।।


এত বলি হরি তবে মিলা’ল বাতাসে।


প্রেমে পুলকিত হরিপাল দেশে আসে।।


মনে ভাবে হরিপাল এই কোন কথা।


হরি চলে গেছে শুনি এ কোন বারতা।।


হরি যদি গিয়ে থাকে ওড়াকান্দী হতে।


আমাকে রাখিল কেবা গহন বাদাতে।।


হতে পারে কায়া কান্তি ছাড়িয়াছে হরি।


নিশ্চয় রয়েছে হরি ওড়াকান্দী বাড়ী।।


“শুনিয়াছি প্রভু পুত্র গুরুচাঁদ যিনি।


শ্রীধামের কর্ত্তা এবে হয়েছেন তিনি।।


সন্দেহ আমার মনে বাড়িয়াছে বটে।


কোন গুণে গুরুচাঁদ বসে হরি – পাটে।।


হয় হরি অশরীরী আছে ওড়াকান্দী।


নয় গুরুচাঁদ দেহে হইয়াছে বন্ধি”।।


ইতি উতি মনে ভাবি সাধু হরিপাল।


যাত্রা করে ওড়াকান্দী চক্ষে বহে জল।।


উপনীত শ্রীধামেতে বহু লোক সঙ্গে।


দেখে গুরুচাঁদ আছে হাসির তরঙ্গে।।


খল খল হাসি ওঠে বালক সমান।


অপরূপ কান্তি দেখি হরি লয় প্রাণ।।


হস্ত নাচাইয়া প্রভু বলে তত্ত্ব কথা।


শুনিলে জুড়ায় হিয়া দূরে যায় ব্যথা।।


অপলক দৃষ্টে চাহি সাধু হরিপাল।


বুক বেয়ে ছোটে তার নয়নের জল।।


মনের সংশয় তার দূর হয়ে গেল।


গুরুচাঁদে হরিচাঁদ নিশ্চয় বুঝিল।।


অকস্মাৎ দণ্ডবৎ করে ভূমে পড়ে।


প্রভু কয় একি দায় তুলে ধর ওরে।।


জিজ্ঞাসা করেন প্রভু ‘তুমি বাপু কেটা ‘?


হরিপাল বলে আমি গোলকের বেটা।।


নাম মোর হরিপাল বাড়ী যশোহর।


দয়া করি কর মোরে আপন নফর ‘।।


হাসি হাসি বলে প্রভু করিয়া রহস্য।


গুটি কত কথা বাপু বলিব অবশ্য।।


জন্ম তব পাল বংশ উচ্চ বংশ জাত।


কেন ক্ষুদ্র নমঃশুদ্রে কর প্রণিপাত ?


শুন শুন হরিপাল বলি তব ঠাঁই।


এমত অবিধি কার্য আশা করি নাই।।


তোমাদের আছে মনে জাতিতে কুলীন।


হীন জনে প্রণমিয়ে কেন হও হীন ?


প্রভু যদি এই কথা বলে তার আগে।


শেল-সম সেই কথা হরিপালে লাগে।।


কেন্দে কয় “রসময় কি আর বলিব।


তুমি যে বিশ্বের প্রভু তুমি জান সব।।


যুগে যুগে এসে তুমি কত কথা বল।


ভুলে গিয়ে নরগণে মানেনা সকল।।

কলিকালে লীলাছলে এলে নদীয়ায়।


নররূপে শচী ঘরে হলে গোরা রায়।।


ভক্তির কন্টক পঞ্চ কর নিরুপণ।


জাতি বিদ্যা রূপ আর মহত্ব যৌবন।।

“জাতি-বিদ্যা-মহত্বঞ্চ রূপ যৌবনমেবচ।


পঞ্চৈব ভক্তি কন্টকাঃ যত্নেন পরিবর্জ্জয়েৎ “।।

সাধ্য মত ভক্ত গণ বর্জ্জন করিবে।


তবে প্রেম রূপা রাধা হৃদয়ে বসিবে।।


উচ্চ কুলে জন্ম লয়ে করি যে বড়াই।


উচ্চ বৃক্ষ ঝড়ে ভাঙ্গে ফল প্রাপ্তি নাই।।


কুলে বড় রূপে বড় বিদ্যাতে মহৎ।


যৌবনের গর্ব্বে মত্ত যতেক অসৎ।।


কুলে দেখি কুল নাই অকুলেতে ভাসি।


অকুলে কাণ্ডারী পাই ওড়াকান্দী আসি।।


আর সেই যুগে বল অপূর্ব্ব বারতা।


কোনজনে আছে ভক্তি, ভক্তি রহে কোথা।।


তৃণ হতে হীন হবে অমানীকে মান।


তরু – সম সহিষ্ণুতা হরি গুণগান।।

“তৃণাদপি সুনীচেন, তরুরিব সহিষ্ণুতা।


অমানীন মানদেন কীর্ত্তনীয়া সদা হরিঃ “।।

উচ্চ কুল বলি প্রভু বলিল যাহারে।


তৃণাদপি শ্লোক স্পর্শ করে না তাঁহারে।।


এই জীবনের প্রভু কোন মূল্য নাই।


তৃণাদপী শ্লোক মর্ম্ম ভক্ত হ’তে পাই।।


তাহার প্রমাণ প্রভু মহাজনে বলে।


হরি ভক্তি বিনা জন্ম যায় যে বিফলে।।

“ হরি ভক্ত হয়ে বরং বাঁচে পঞ্চ দিন।


বৃথা সে সহস্র কল্প হরি ভক্তি হীন “।।

— শ্রী শ্রী হরি লীলামৃত

আজি বঙ্গে যত দেখি উচ্চ উচ্চ কুল।


জাতি গর্ব্বে মত্ত হয়ে নাহি চিনে মূল।।


তাদেরি পূর্ব্ব পুরুষে লিখে গ্রন্থ মালা।


পিতৃ পুরুষের বাক্য কে কবে মানিলা।।


শাস্ত্র গ্রন্থ পুরাণাদি কহিছে প্রমাণ।


হরি ভক্তি হীন দ্বিজ নাহি পাবে ত্রাণ।।


উচ্চ বর্ণ ঘৃণা করি কহে নীচ বর্ণ।


চণ্ডালাদি আখ্যাদেয় এমনই জঘন্য।।


সেও যদি কর্ম্ম গুণে হরিভক্ত হয়।


দ্বিজ হতে শ্রেষ্ঠ গণি নমি তার পায়।।

“চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠঃ হরি ভক্তি পরায়নঃ।


হরিভক্তি বিহীনশ্চ দ্বিজোহপি শ্বপচধমঃ “।।

কুলে কিবা করে প্রভু মূলে সব মিলে।


স্বর্গে হয় ঘন্টা ধ্বনি রুহিদাস খেলে।।


হরি ভক্ত শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা করিবার তরে।


কৃষ্ণ বলে যুধিষ্ঠিরে রাজসূয় পরে।।


নকুলের মুখে শুনি অদ্ভুত বারতা।


কৃষ্ণ বলে “যুধিষ্ঠির শুন মোর কথা।।


অশ্বমেধ রাজসূয় অতিথি সেবন।


সবা হতে শ্রেষ্ঠ হয় সাধুর ভোজন।।


দেব দৈত্য, যক্ষ রক্ষ নর আদি কত।


রাজা রাণী, ব্রাহ্মণাদি রাজ পুরোহিত।।


সকলের করি সেবা পায় নাই ফল।


রুহিদাস খেয়ে দিল সর্ব্ব-সিদ্ধি-ফল।।


কুলে গোত্রে এরা সবে ছিল বটে হীন।


ভক্তি গুণে হল তারা সবার প্রবীণ।।


এই মত লক্ষ লক্ষ সাধু দিবারাত্রি।


যাঁর পদ তীর্থ আসে হয়ে আছি যাত্রী।।


সাধু – জন – মন – ধন অতুল রতন।


অকুলের কুল তুমি শ্রী গুরুচরণ।।

 কুলে নাহি পাব কুল তব কুলে যেতে।


কুল – হারা কুল পাবে তোমার কুলেতে।।


কুল ফেলে কুলে এসে তব কুলে রই।


কুলে আর কুল প্রভু আছে বল কই ?


কুল হারা হরিপালে পদকুলে রাখ।


করুণা করিয়া কান্ত! কৃপা নেত্রে দেখ।।


ভক্তমুখে শুনি বাণী ভক্ত পরাণ।


বলে হরিপাল তুমি পালের প্রধান।।


হরিধনে দেখিবারে মনে ছিল আশ।


বল হরি হবে হরি! ধন,মান, যশ ‘।।


গুরুচাঁদ আজ্ঞা ক্রমে হরিপাল তবে।


ঘরে ঘরে হরিনাম বিলাইল সবে।।


সকলে জানিল হরিচাঁদ যায় নাই।


গুরুচাঁদ মধ্যে দেখে ক্ষীরোদের সাঁই।।


হরিচাঁদ গুরুচাঁদ অভেদ হইল।


দীন মহানন্দ বলে হরি হরি বল।।

 

প্রণাম নমি পদে কবি গুরু শ্রী তারক চন্দ্র।


যাঁর শিরে সদা রাজে প্রভু হরিশ্চন্দ্র।।


গুরুচাঁদ মধ্যে হরিচাঁদে যে দেখিলা।


হরি – প্রেম – রসে ডুবি বিশ্ব মাতাইলা।।


অমর লেখনী যাঁর রচে লীলামৃত।


দন্তে তৃণ ধরি পদে করি দণ্ডবৎ।।


কৃপা করি কবি গুরু দেহ আশির্ব্বাদ।


পদ চিহ্ন হেরি যেন পুরে মনোসাধ।।


আমি ত অজ্ঞান গুরু! নাহিক সাধনা।


শ্রী গুরু – চরিত লিখি মনের বাসনা।।


তব কৃপা বিনে দেব সেই সাধ্য নাই।


কর কৃপা কৃপাময় কৃপা ভিক্ষা চাই।।


জ্ঞান বুদ্ধি বিদ্যা আজি কিছু মোর নাই।


দয়া হ’লে সেই বলে যদি কিছু পাই।।


নরদেহ যবে ছিলে পবিত্র মূরতি।


দরশনে বুঝি নাই এমনি দুর্ম্মতি।।


আজি দেহে নাই তুমি দয়াল ঠাকুর।


তব বাসে আসিয়াছি ভ্রমি বহুদূর।।


শূন্যগৃহে প্রতি ধুলিকণা আজি কহে।


দেহ নাই শুধু স্মৃতি এই গৃহে রহে।।


তোমার স্মরণে দেব বুকে বাজে ব্যথা।


ওগো প্রভু দয়া ক’রে কহিবে কি কথা?


কথা কও রসরাজ চাহ হাসিমুখে।


কাতর সন্তানে ডাকে দুঃখ নিয়া বুকে।।


তোমার দয়ার শুনি তুল্য দিতে নাই।


তব দয়া পাব হেন সাধ্য কোথা পাই?


মম গুরু শ্রী গোপাল সাধু শিরোমণি।


তব দয়া পেয়ে ধন্য ইহা আমি জানি।।


তোমার কৃপার পাত্র তাঁরে বাসো ভালো।


তাঁর গুণে কবি গুরু মোরে দেহ আলো।।


শ্রী গুরু-চরিত দেখি মহা সিন্ধু প্রায়।


উত্তরিতে সেই সিন্ধু সাধ্য মোর নয়।।


কৃপাতরী দয়া করি আজি মোরে দেহ।


পদানত দাস বলি মোরে তুমি লহ।।


হরি লীলামৃত গ্রন্থ যে ভাবে রচিলে।


শ্রী গুরু-চরিত লেখ বসি হৃদি-মূলে।।


কিবা বুঝি কিবা জানি, কিবা কহি ছাই।


বোঝা জানা কহা মোর কিছু ঠিক নাই।।


ভরসা কেবল মোর গোপালের দয়া।


সেই গুণে যদি প্রভু দেহ পদ ছায়া।।


আসিয়া তোমার বাসে তাই এই দিনে।


দীন মহানন্দ কান্দে পড়িয়া চরণে।।


ভরসা নাহিক আর তব দয়া বিনে।


কর দয়া রসরাজ নিজ – দয়া – গুণে।।

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 15 শ্রী শ্রী হরিচাঁদের তিরোভাব ও শ্রী শ্রী গুরুচাঁদের শক্তি স্থিতি

জগতের হিত তরে        প্রভু নর দেহ ধরে।

যুগে যুগে আসি করে জীবের কল্যাণ।

আদর্শ যে ধরে তার       করুণার পারাবার

তাঁহাকে করি আঁধার হয় অধিষ্ঠান।।

লোক মুখে শুনি কথা  আছে তাতে যৌক্তিকতা

শক্তি নাকি যথা তথা, নারে রহিবারে।

সিংহ দুগ্ধ মেটে ভাণ্ডে   রাখে যদি কোন ভণ্ডে

পাত্র ভাঙ্গি সেই দণ্ডে দুগ্ধ যায় পড়ে।।

স্বর্ণ পাত্র হলে পরে        সিংহ দুগ্ধ তাহা ভরে

কষ্ট নাহি রাখিবারে শুনি এই কথা।

কোন সত্য কথাচ্ছলে     এই বাণী যায় বলে

গূঢ় অর্থ তার তলে আছে বটে গাঁথা।।

পাত্র গুণে শক্তি রয়        অপাত্রেতে নষ্ট হয়

তাই সাধু শাস্ত্রে কয় নিগূঢ় কাহিনী।

সিংহ দুগ্ধ যাহে রয়       স্বর্ণ পাত্র সে নিশ্চয়

মেটে পাত্রে নাহি রয় মোরা তাই শুনি।

ক্ষীরোদ বিহারী হরি      হ’ল পূর্ণ লীলাকারী

এল সফলানগরী এই বঙ্গ দেশে।

জানাতে গার্হস্থ্য ধর্ম       গৃহ ধর্ম সার মর্ম

একত্রিত জ্ঞান কর্ম ঋষি গৃহি বেশে।।

প্রথমে আবাদ কৈল        পাপ কলি নাশ হৈল

বদ্ধ জীব ধরা পৈল প্রেমের খেলায়।

ক্ষেত্র হল সুপ্রস্তুত          দেখি যশোবন্ত সুত

গুরুচাঁদে অবধূত নিজে ডাকি লয়।।

মানব আচারে যাহা       পালন করিল তাহা

কত দয়া দেখ আহা জীবগণ প্রতি।

আদর্শ মানব রূপে         গুরুচাঁদ বিশ্ব ভূপে

হেরিয়া নয়ন কূপে পায় মহাপ্রীতি।।

উত্তর সাধক তাঁরে        ইচ্ছিলেন করিবারে

এ ভাব জানি অন্তরে করে সেই মত।

বুঝিয়া প্রভুর ভাব         গুরুচাঁদ মহাভাব

বাসনা ত্যজিয়া সবে পায় মনোরথ।।

বার’শ চুরাশি সাল        মধুর বসন্ত কাল

ঘোর কুজ্ঝটিকা জাল বিদায় মাগিল।

উত্তর আয়ন আসে        আলোকে বসুধা হাসে

মধুর ফুলের বাসে জগত ভরিল।।

সিংহাসন ছাড়ি হায়      শীত যেন চলি যায়

অভিষেকে রাজা হয়, নবীন বসন্ত।

দেখি সেই রূপ প্রায় হরি দেহ ছাড়ি যায়

পশি গুরুচাঁদ কায় পূর্ণ শক্তিমন্ত।।

ভক্ত কান্দিয়া কয়         “বল প্রভু দয়াময়

তোমা বিনা কি উপায় হবে মো’ সবার।

সূর্য বিনা যথাকাশ        যজ্ঞ বিনা পীতবাস

বায়ু ছাড়া যথাশ্বাস এমনি আকার।।

মনি হারা যথা ফণী       চক্ষু যথা হারা মণি

বল্লভ হারা রমণী প্রাণ হারা কায়া।

তুমি বিনে হরি মনি       দিবসে হ’ল যামিনী

এ যেন লতিকা ধ্বনি হারা বৃক্ষ ছায়া।।

মো’ সবে ত্যজিবে যদি   এত প্রেম গুণনিধি

কেন তবে দেখাইলে ওহে গুণমণি।

তোমা যদি হারা হই      কেমনে বা ঘরে রই

অসহ বিরহ-জ্বালা দিবস রজনী।। য

দি প্রভু যেতে চাও       মো’ সবারে সঙ্গে লও

দারা পুত্র সব বৃথা তুমি যেথা নাই।

পরাণ-পরাণ তুমি         অন্তরের অন্তর্যামী

পরাণ বিহনে ব্যাথা কোথায় জুড়াই।।

তাই বলি ওহে নাথ       সবাকারে লও সাথ

তব সঙ্গে রহি যদি কোন দুঃখ নাই।

যখনে ত্যজিবে দেহ       আর না বাঁচিবে কেহ

বিচ্ছেদ বিরহ দাহে পুড়ে হবে ছাই।।

কত কথা পড়ে মনে       প্রতিদিন প্রতিক্ষণে

কতই করেছ দয়া কিছু না চাহিতে।

সুখে দুখে সবা সনে       রয়েছে আপন জ্ঞানে

বুঝেছ বুকের ব্যাথা কিছু না কহিতে।।

এমন পরম বন্ধু           এমন করুণা সিন্ধু

হয় নাই হবে নারে কভু এ জগতে।

মন জেনে বলে কথা    মুখ দেখে বোঝে ব্যাথা

মন চুরি করি লয় আঁখি পালটিতে।।

মোরা সবে ঘোর অন্ধ     তুমি যে পরমানন্দ

আনন্দ আলোকে প্রভু ধাঁধা দিলে কাটি।

অকূল সাগর বুকে    মো’ সবারে বুকে রেখে

পরম আদরে নাথ পালিয়াছ খাঁটি।।

তুমি যদি ছেড়ে যাবে      বল আর কেবা ভবে

সম্পদে বিপদে নাথ রক্ষিবে সবারে।

তোমা বিনে সবে মোরা   পড়ে রব জ্যান্তে মরা

দিন মণি হীন যেন গভীর আঁধারে।।

নিবেদন রাঙ্গা পায়       মোদেরে ঠেলনা পায়

তব পায় সবে পায় যাহা কিছু পায়।

তুমি হরি কল্প বৃক্ষ        শোভে ফল লক্ষ লক্ষ

সর্ব্ব সিদ্ধি ফলদাতা তুমি রসময়।।

মোরা কিছু নাহি চাই     শুধু যে তোমারে চাই

আপন কেহ যে নাই তুমি বিনে ভবে।

তুমি যদি যাবে ছেড়ে      প্রাণ সব নিবে কেড়ে

জ্বলিবে সকল হিয়া দুরন্ত বাড়বে।।

দয়া করি ফিরি চাও      কৃপা নিধি কথা কও

মোদের সহিতে রহ জগৎ জীবন।

কিংবা কর এই কাজ     হান শিরে ঘোর বাজ

এক সঙ্গে হোক তবে সবার মরণ।।

যে দেশে নাহিক হরি   সেথা থেকে কিবা করি

শূন্য দিবা বিভাবরী শ্রী হরি বিহনে।

প্রাণ যদি চলি যায়        শূন্য দেহে কিবা রয়

কিবা কাজ দিবে বল অন্ধের নয়নে।।

তোমাগত মোরা সবে তুমি বিনে কিবা হবে


জল ছাড়া মীন প্রাণ বাঁচিবে কেমনে।


দারা পুত্র পরিজন তুমি বিনে অকারণ


সকলে ফেলিয়া আজি মিশিব চরণে।।


তুমি যাবে এই কথা শেল সম বাজে ব্যথা


শক্তি শেল হতে হ’ল আঘাত কঠিন।


যাবে যাও বাঁধা নাই মোরা সবে সাথে যাই


চিরকাল আছি মোরা তোমার অধীন।।


তুমি হরি যেথা যাবে মো ‘ সবারে সঙ্গে নিবে


এই নিবেদন পদে বিশেষে জানাই।


একা তুমি নহ কভু মোরা পদে আছি প্রভু


যেথা যাবে রাঙ্গা পদ সেই দেশে যাই।।


আর ভুলাওনা হরি মোরা কি বুঝিতে পারি


কোন ছলে কোন খেলা খেলিছ জগতে।


তুমি যে কে কেবা চিনে তব তত্ত্ব কেবা জানে


অজানা অচেনা ধন নেমেছে ধরাতে।।


কোটী জন্ম ভাগ্য গুণে পাই তোমা হেন ধনে


মন সাধে রাঙ্গা পদে পারিনি পূজিতে।


তুমি যে পরম ধন শিবের অসাধ্য ধন


তব স্তব করে দেব দেবীর সহিতে।।


যেই ভাগ্য গুণে মোরা পেয়েছি অধরে ধরা


সেই ভাগ্য বলে মোরা রাখিব তোমাকে।


তোমাকে রাখিব মোরা এযে শুধু গর্ব্ব করা


তুমি রবে দয়া করে আপনি আজিকে।।


এই পদে নিবেদন যশোবন্ত প্রাণধন


ভক্তের মুখ চাহি করহে করুণা।


আমাদের কথা রাখ দয়া করে হেথা থাক


মোদেরে ছাড়িয়া এবে প্রভুগো যেওনা।।


শুনিয়া দুঃখের বাণী দুঃখ হরা গুণমণি


ভক্তে ডাকিয়া বলে শুন ভক্ত গণ!


ধরিয়া মানব দেহ বাঁচিয়া রহেনা কেহ


বিধাতার এই নীতি না হবে লঙ্ঘন।।


অসম্ভব কথা এই দেহ ধরে মৃত্যু নেই


মৃত্যুর অধীনে মাত্র জীব দেহ ধরে।


মরণ পরম সত্য মৃত্যু বুকে এই তত্ত্ব


অনিত্য সংসারে সব সৃষ্টির বিকারে।।


পিশাচী মায়ার ছলে জীব নিত্য থাকে ভূলে


জনমে আনন্দ করে মরণের ভয়।


মরণ পরশ মণি নিত্যের বসায় আনি


জীবের জীবাত্ম মায়া সব ঘুচে যায়।।


বৃথা শোক কর সবে শোক দুঃখ এই ভবে


সকলি মায়ার খেলা জানিবে সুধীর।


মরণেরে কর পূজা হও সবে মহাতেজা


মায়া ছেড়ে হও সবে মৃত্যুঞ্জয়ী বীর।।


মায়া রঙ্গ চোখে লেগে শোক দুঃখ বুকে জাগে


মিথ্যা সব ধাঁধাঁ বাজি মায়ার ছলনা।


আমি যবে ছেড়ে যাই তার মধ্যে সত্য নাই


মায়ার কুহকে ভুলে ও কথা বলনা।।


মাটি দিয়ে দেহ গড়া মূল্য নাই এক কড়া


মূল্য হীন মিথ্যা নিয়ে করো টানাটানি।


দেহ মধ্যে যেবা রয় তাঁর নাহি হবে লয়


তাঁর সাথে কর সবে সত্য জানাজানি।।


শুন সবে যাহা বলি আমি নাহি যাব চলি


মায়ার খোলস দেহ মিলিবে মাটিতে।


গুরুচাঁদ দেহে রবো হরিগুরুচাঁদ হবো


গুরুচাঁদ মধ্যে মোরে পাইবে দেখিতে।।


যেই ভাবে মোরে মানো তাই গুরুচাঁদে জানো


যাহা চাবে তাহা পাবে মনোনীত যত।


গুরুচাঁদে রবে শক্তি তাঁহে সবে কর ভক্তি


অনায়াসে পাবে মুক্তি দেবতা বাঞ্ছিত।।

( “ আমি নাহি ছেড়ে যাব জানিও বিশেষ।


গুরুচাঁদ দেহে এই করিনু প্রবেশ।। “ )

শ্রী শ্রী হরি লীলামৃত।।

মতুয়ার এই নীতি নিত্য পথে করে গতি


অনিত্য সংসার চক্রে কিছু মান্য নাই।


শান্তি নিয়ে তার খেলা শক্তিকে করিয়ে ভেলা


শক্তি সিন্ধু মাঝে চলে মাতিয়া সবাই।।


শক্তি যেথা স্ব প্রকাশ মতুয়ার এ বিশ্বাস


শক্তিময় প্রভু তার রহে তার মাঝে।


আপনি নোয়ায় মাথা শকতি রয়েছে যেথা


বীর্যের সাধক তারা কথা কিংবা কাজে।।


মতুয়া জানিবে প্রাণে নররূপে এইখানে


মানুষের মাঝে তার প্রাণের ঠাকুর।


মানুষে মিশিয়া রয় মানুষের রূপ লয়


মানুষের সাথে লীলা বড়ই মধুর।।

“ মানুষে আসিয়া মানুষে মিশিয়া


করিব মানুষ লীলে।


সেইত সময় চিনিবে আমায়


পুনঃশ্চ মানুষ হলে।। “


——শ্রী শ্রী হরি লীলামৃত

সেই মানুষেতে নিষ্ঠা হলাদিনী নামেতে শ্রেষ্ঠা


প্রেমরূপা কহে তাঁরে শক্তিময়ী রাধা।


দু’য়ে এক একে দুই পুরুষ প্রকৃতি দুই


এক আত্মা বাটি দোহে করে আধা আধা।।


দোঁহে দোহাকারে চাহে দোঁহে এক কথা কহে


দোঁহে এক পূর্ণ করে নিষ্ঠা নামে সতী।


মতুয়া জীবনে তাই দেব দেবী কেহ নাই


প্রাণে প্রাণে টানাটানি চলে নিতি নিতি।।


সাযুজ্যাদি মুক্তি তিন মতুয়ার পক্ষে হীন


বাৎসল্যাদি পঞ্চ রসে নহে তো ভিক্ষারী।


মতুয়া চাহে না কারে সকলে চাহে তাহারে


মতো ‘ ছুয়ে সবে ধন্য গুণে বলিহারী।।


কভু তারে ভাবে দাস কভু নিজে সাজে দাস


প্রাণ ভরি কভু তারে করে আশির্বাদ।


কভু ক্ষোভে কথা কয় কভু ধরণী লোটায়


অসীম ভাবেতে ভাবে যত তার সাথ।।

আমার এক চাকর আছে ভাই,


মনের ভাব জেনে সে কর্ম্ম করে,


এমন নফর দেখি নাই।


—- অশ্বিনী গোঁসাই

হরি তোমায় করি আশির্বাদ


এবার পুরুক তোমার মনোসাধ —–


—– অশ্বিনী গোঁসাই

মিশিতে ঠাকুর সনে কোন কালে কোন দিনে


চাহে না মতুয়া কভু ইহ পরকালে।


ঠাকুর — ঠাকুর রহে মতুয়া ঠাকুরে চাহে


চিরকাল দুইজনে টানাটানি চলে।।


মতুয়া ঠাকুর চিনে তাঁর ভাব ভঙ্গি জানে


তাই কায়া মাত্র নহে পরাণের হরি।


যবে হরি কথা কয় প্রকাশ্যে বা নিরালায়


মতুয়া তাঁহারে চিনে ফেলে অশ্রুবারি।।


মতুয়া জীবনে তাই হরি শূন্য কথা নাই


তার হরি আছে সদা মানুষে মিশিয়া।


সদা ফেরে তাঁরে খুঁজি এই ভাব সোজাসুজি


বিরহ অনল রাখে সজাগ করিয়া।।


মন মানুষের সাথে ঘাটে মাঠে কিংবা পথে


যদি দেখা হয় তার সে পরমানন্দ।


মতুয়া কাঁদিয়া কয় এই মোর রসময়


আপনি লোটায় পদে নাহি রাখে দ্বন্দ্ব।।


মতুয়ার এই বাণী অনন্ত রসের খনি


আসিয়াছে ধরাপরে নাহি যাবে ফিরি।


সদা করে লুকাচুরি ঘর হতে ঘর ছাড়ি


মোরা করি খোঁজাখুঁজি তাঁর পাছে ঘুরি।।

তাঁর মত কহে যেঁই তাঁর মত সহে যেঁই


তাঁর মত দহে যেঁই তাঁরে জানি সেই।


কায়া নাহি দেখি চোখে কায়া ফেলে দেখি তাঁকে


তাঁরে নিয়ে নাচি কান্দি তাঁরে প্রাণ দেই।।


তাঁর বাণী তাঁর বাণী তাঁর বলে তাঁরে জানি


তাই তাঁ’রে ভেবে মোরা তাঁর হই।


তাঁর মাঝে তাঁরে পাই আর কারে নাহি চাই


তাঁকে নিয়ে মোরা তার কথা সদা কই।।


মোর ঠাকুর মরে না মোর ঠাকুর সরে না


মোর ঠাকুর ভরে না সদা পূর্ণ রয়।


তিনি পূর্ণানন্দ হরি মোরা তাকে ডাকি “পুরি “


আছে হরি রবে হরি নাহি হবে লয়।।

রাম হরি কৃষ্ণ হরি শ্রী গৌরাঙ্গ হরি।


হরিচাঁদ আসল হরি পূর্ণানন্দ হরি।।

— শ্রী শ্রী হরি লীলামৃত।

মানুষেতে এই নিষ্ঠা মতুয়া শক্তির স্রষ্টা


অখণ্ড শক্তির কেন্দ্র মতুয়া হৃদয়।


তাই মতুয়া নির্ভিক শৌর্যে বীর্যে যেন শিখ


প্রেমে ভোলা খোলা প্রাণ শ্রী গৌরাঙ্গ প্রায়।।


এক জাতি এক প্রাণ সবে ডাকে হরিচাঁন


একই তরঙ্গে ভাসে একই সাগরে।


নাহি দেব – দেবী পূজা দীক্ষা শূন্য মহাতেজা


একই মহা মন্ত্রে বলে সবে জাগরে।।


কিবা বেদ কিবা স্মৃতি কিবা শিক্ষা রীতি নীতি


যা ‘ বলে ঠাকুর মোর সেই সর্ব্ব সার।


নাহি চাহি মোক্ষ ধাম হাতে কাম মুখে নাম


চরিত্র পবিত্র রাখা সাধনা সবার।।


দেহে বল প্রাণে বল নাহি চাহে ফলাফল


পরম গুরুর ডাকে সবে দেয় সাড়া।


নামে রুচি জীবে দয়া মানুষেতে নিষ্ঠা দিয়া


অসীম বীর্যের তেজে দেহমন ঘেরা।।

“জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।


ইহা ভিন্ন যত ক্রিয়া সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।”

— শ্রী শ্রী হরি লীলামৃত।

ঈশ্বর আর সংসারে মিল এত দিন পরে


মতুয়া জীবনে হ’ল পুর্ণ পরাকাষ্ঠা।


গৃহস্থ সন্যাসী মিশি একাসনে রহে বসি


এক ক্ষেত্রে মিলে সব ধর্ম্ম, কর্ম্ম, নিষ্ঠা।।


বেদাতীত এই ভাব কি রূপে হল সম্ভব


তার ইতিহাস কহি শ্রী গুরু কৃপায়।


আমি কহি কহি ভুল শ্রী গোপাল আদি মূল


তাহা কহি সেই জানে যা’ মোরে কহায়।।


দশ অবতার হয় হিন্দু শাস্ত্রে এই কয়


মৎস্য,কু্র্ম্ম, আদি করিকরি বরাহ বামন।


নৃসিংহ পরশুরাম, সঙ্কর্ষণ বলরাম


পরম – আরাম রাম জগত মোহন।।


বুদ্ধ, কল্কি, এই দশ অবতার স্বপ্রকাশ


পুনঃ সাধু কহে অষ্টবিংশ অবতার।


শ্রী কৃষ্ণ চৈতন্য গোরা কপিল আখিল জোড়া


বেদব্যাস নামে মুনি মুনির কুমার।।


নানা তত্ত্ব সারোদ্ধার অষ্টবিংশ অবতার


অসীম গুণের ধাতা অবতার সবে।


বিচার করিলে মনে অবতার প্রতি জনে


পূর্ণ গুণে পরিপূর্ণ সবে নাহি হবে।।


হরিতে ধরার ভার করিতে জীব উদ্ধার


যুগ অনুসারে আসে যুগ অবতার।


যতটুকু প্রয়োজন সেই গুণে সে ওজন


তাই নিয়ে নামে প্রভু ধরার উপর।।


অনন্ত জলাধি জলে ধরা ডোবে সীমাতলে


মৎস্য রূপে প্রভু তাই ধরা উদ্ধারিল।


বারি পরে জাগে ধরা কূর্ম্মরূপে পৃষ্ঠে ধরা


কূর্ম্ম অবতারে প্রভু সে কর্ম্ম সাধিল।।

এই আদি যুগক্ষণে জীব নাহি কোনখানে


জীবোদ্ধার ক্রিয়া তাই না হল প্রকাশ।


অসুর শক্তির চাপে ধরা থরহরি কাঁপে


জল তলে ডুবে ধরা হয়ে হতাশ্বাস।।


রাখিতে ধরার প্রাণ দুষ্টে দিতে দণ্ড দান


দন্ত অস্ত্রে রিপু নাশি ধরাকে তুলিল।


ধরা হল ভাসমান জীব হল অধিষ্ঠান


দেবাসুর দ্বন্দ্বে ধরা ত্রাসিত হইল।।


জিতেন্দ্রিয় দেবগণ সত্য নীতি আলম্বন


পরমাত্মা তত্ত্বে মত্ত আছিল সবাই।


অসাম্য আশ্রয় করি অসুর সাজিল অরি


দেবশক্তি নষ্ট করে করিয়া বড়াই।।


ধরাকে রাখিতে শান্ত অসাম্য করিতে অন্ত


অসুরে সংহার করে নৃসিংহ মূরতি।


দৈত্যপুত্র সে প্রহ্লাদ সাম্য তত্ত্বে পেল সাধ


সুরাসুর দ্বন্দ্ব নাশি পাইল পীরিতি।।


আদরিণী কন্যা ধরা তার ভার দূর করা


অসম আসুর শক্তি হয় বিনাশিতে।


ধরাভার হরা হয় রিপুকুল হয় ক্ষয়


সমেস্থিত সাধুজন শান্তি পায় চিতে।।


যত জীব বৃদ্ধি পায় তাঁর কাজ বাড়ে তায়


ভূভার হরণ পরে জীবের তারণ।


সমেস্থিত সাধুজন রক্ষাপায় সর্ব্বক্ষণ


অসম অসুর যত করে বিনাশন।।


মহাবলী দৈত্য বলি অসম সাধনে বলী


বলদর্পে ত্রাসে ধরা দেবতা লাঞ্ছিত।


দেবতা কাঁদিয়া কয় অসুরের যন্ত্রণায়


দেবশক্তি লুপ্তপ্রায় দৈত্য ভয়ে ভীত।।


বিপদ তারণ হরি মোরা সবে দুঃখে মরি


কি উপায় হবে প্রভু তব কৃপা বিনে।


আশুতুষে তুষি বলি সাজিয়াছে মহাবলী


ভয়াকুল দেবকুল জীবনে বাঁচিনে।।


দেব ডাকে ঊভরায় ধরা ভারাক্রান্ত হয়


তাই পুনঃ অবতারে হ’ল প্রয়োজন।


ভূভার হরিতে হয় সাধুজনে রক্ষা পায়


দুষ্টেরে নাশিতে তাই আসিল বামন।।


নরের আকার পায় তবু পূর্ণ নর নয়


অপূর্ণ আকার দেখি বিভূতি প্রকাশ।


আকারে সাজিল পূর্ণ ক্ষাত্র শক্তি করে চূর্ণ


ভৃগুরাম রূপে করে ক্ষত্রিয় বিনাশ।।


নর বসে ধরা পরে রাজ্যধন সৃষ্টি করে


ক্ষেত্র পতি সাজি রহে ক্ষত্রিয় আখ্যান।


ধনে আনে মদগর্ভ দ্বিতীয় অসুর পর্ব্ব


অহং চূর্ণ করে প্রভু বীরত্বে প্রধান।।


এই সব অবতারে ভূভার হরণ করে


আর করে সাধুজনে সতত রক্ষণ।


জীবে কিছু নাহি চাহে রক্ষ মাং রক্ষ মাং কহে


রসতত্ত্ব এতকাল না পেল শিক্ষণ।।


নাশে ত্রাস রিপু নাশ নাশে সে ধরায় ত্রাস


আশ্বাস সাধুতে পায় এই মাত্র নীতি।


জীবে কিছু নাহি দান নিজে সব ভগবান


জীবের কল্যাণ দিতে পরম পীরিতি।।


জীবে কিছু দিবে বলে জন্মিলেন রাজকুলে


মানব জীবন নীতি পালিল আপনে।


পিতৃসত্য রক্ষিবারে রাজ্য ধন ত্যজ্য করে


চতুর্দশ বর্ষ ধরি রহিলেন বনে।।


জানকি জননী সতী পতি ধ্যান পতি গতি


নারীকুলে এই শিক্ষা দানিলা যতনে।


ভ্রাতৃভক্ত সুলক্ষণ মানিলেন শ্রী লক্ষণ


ব্রহ্মচারী ব্রতধারী অকপট মনে।।


জীব দান পেল এবে নাম করে উচ্চরবে


পরব্রহ্ম সনাতন রাম নাম সুধা।


নাম্মী গুণে নাম কয় নাম নিয়ে ফল পায়


মিটাইতে চাহে সবে জীবনের ক্ষুধা।।

রাম নামে পাপ হরে রাম নাম যেবা করে


মৃত্যু অন্ত্যে স্বর্গ প্রাপ্তি বৈকুন্ঠে গমন।


ফলাশয় করে নাম ফলদাতা রাম নাম


ফল দাতা নামে নাই প্রেমের লক্ষণ।।


রাজ ধর্ম্ম নর ধর্ম্ম সমাজ শাসন কর্ম্ম


নিজের জীবনে প্রভু দেখাল আদর্শ।


সত্য ধর্ম্ম পরচার নাহি হ ‘ল এই বার


অকলঙ্কা সীতা ছাড়ি প্রভু যে বিমর্ষ।।


সমাজ জীবন গড়ি জীবে করে আড়াআড়ি


হিংসা, দ্বেষ ক্ষুদ্রতায় হল প্রর্দুভাব।


জাতি হল জন্মগত মানুষের মান হ’ত


সাধু শূদ্রে মৃত্যু দণ্ড হলরে সম্ভব।।


দুঃখে বুক ফাটি যায় প্রভু রাম দয়াময়


মরমের ব্যথা নিয়ে লীলা সম্বরিল।


আপন জীবনে যাহা পালিলেন কেহ তাহা


পালিল না জীবগণে কেহ না মানিল।।


প্রভু চিন্তা করে মনে দেখাইব জীবগণে


আদর্শ “মানব “ জীব হতে পারে বটে।


দ্বাপরে মথুরা পুরী অবতীর্ণ কৃষ্ণ হরি


নাচিলেন বনমালী যমুনার তটে।।


পাণ্ডু রাজা পুণ্য বাণ নর রূপে অধিষ্ঠান


তাঁর ঘরে পঞ্চ ভ্রাতা “পাণ্ডব “ ব্যাখ্যান।


আদর্শ গৃহীর ধর্ম্ম দেখাইল সেই মর্ম্ম


মাতা,পিতা, ভ্রাতা পুত্র স্বামীর সন্ধান।।


ক্ষাত্রগর্ব্ব নষ্ট করি সমতা আনতে হরি


ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল সবে সমযোগ দেয়।


যেই দুষ্ট নাহি মানে কুরুক্ষেত্র মহারণে


দুষ্টেরে নাশিতে প্রভু সবে করে ক্ষয়।।


পাপী আধার মাত্র ভিন্ন পথে পাপ সুত্র


ভুল হ’ল পাপী ম’ল পাপ বেঁচে রয়।


কুরুবংশ ধ্বংস হয় পাপ হয়ে নিরাশ্রয়


যদু বংশে পূর্ণ রূপে হইল উদয়।।


কৃষ্ণ হয় অবতার কিছুদূর অগ্রসর


নাম ধর্ম্ম পরচার জগতে হইল।


সাধক সন্যাসী যারা কৃষ্ণে নাহি মানে তারা


গোপগোপী নীচ জনে সুধা রস পেল।।


সংসারে আবদ্ধ নর প্রেমে নহে তৎপর


মোহ নাশি প্রেম দিতে এল শ্রী গৌরাঙ্গ।


ঘর ছাড়ি কাঁদি কয় তোরা কে কে নিবি আয়


অফুরন্ত প্রেম ধরে নামের তরঙ্গ।।


আদর্শ গৃহস্থ ধর্ম্ম কৃষ্ণ হতে সে মর্ম্ম


প্রেম ধর্ম্ম সর্ব্ব জনে কভু না কহিল।


কেঁদে কয় গোরা রায় ঘরে কিছু নাহি হায়


নাম মধ্যে যেই প্রেম সেইত আসল।।


সত্যে করি দুই ভাগ কহে দুই মহাভাগ


দুই ভাগে হয়ে ভাগ জীবে দ্বন্দ্ব করে।


পূর্ণ সত্য এক সাথে জীবগণে দেখাইতে


হরিচাঁদ অবতীর্ণ সফলানগরে।।


গৃহাশ্রম করি মূল ভাঙ্গিলেন সব ভুল


সর্ব্বনীতি গৃহস্থরে শিখাল যতনে।


তাঁর ভক্ত মধ্যে তাই সর্ব্বনীতি গড়ে ভাই


সর্ব্বনীতি রহে মিশি ভক্তের জীবনে।।


হাতে কাম মুখে নাম প্রাণা রাম হরি নাম


দণ্ডে দণ্ডে করে ভক্তে প্রেমের নেশায়।


কর্ম্ম করে বীর রাগে সর্ব্ব কর্ম্ম যোগে লাগে


বালকের মত পুনঃ হাসি কথা কয়।।


কিবা নামে কিবা প্রেমে কিবা কর্ম্মে কি বিশ্রামে


কোনগুণে হীন নহে মতুয়ার গণ।


রামকৃষ্ণ যাহা করে তাহা আজি ঘরে ঘরে


করিছে মতুয়া সবে পতিত তারণ।।


ধর্ম্ম কর্ম্ম সমন্বয় ইহ পূর্ব্বে নাহি হয়


ওড়াকান্দী হরিচাঁদ তাহা যে করিল।


পূর্ণ নীতি এই বার হইয়াছে পরচার


জগত – তারণ মন্ত্র জগতে আনিল।।

মানুষ সবার শ্রেষ্ঠ ভেদাভেদ ইষ্ঠানিষ্ট


কর্ম্মগুণে মান পায় জন্ম গুণে নয়।


যে জন মতুয়া হয় সেই এই কথা কয়


জন্মগত জাতি কথা তারা নাহি কয়।।


পবিত্র চরিত্র যেই তার কোন তুল্য নেই


হোক না সে জন্মগত ক্ষুদ্র বা মহান।


যেই হরি ভক্ত হয় ম ‘তো পড়ে তার পায়


তারে দেখি চোখে তার বহে প্রেমবান।।


অভক্ত আপন জন ম’তো দেয় বিসর্জ্জন


ভক্ত যারা তারা হয় পরম আত্মীয়।


মন মানুষের খেলা করে যেবা সারা বেলা


সেই সে পরম বন্ধু প্রিয় হতে প্রিয়।।


শয়নে ভোজনে কিবা কি রজনী কিবা দিবা


ভক্ত হয় মতুয়ার নয়নের মনি।


প্রেম প্রীতি পরাকাষ্ঠা এই মানুষেতে নিষ্ঠা


মতুয়া জীবনে এই মূল মন্ত্র জানি।।


এই নিষ্ঠা মতুয়াকে কি ভাবে কেমনে রাখে


কিছু মাত্র সেই কথা বলিবারে চাই।


এমন মধুর ভাব অপূর্ব্ব ভ্রাতৃ স্বভাব


এতকাল ধর পরে কেহ দেখে নাই।।


মতুয়া চলিতে পথে কেশদাম নাচে মাথে


মনে মনে করে গান হরিচাঁদ গীতি।


দ্বিতীয় মতুয়া যদি পথেতে মিলায় বিধি


উভে দরশনে উভে হর্ষান্বিত অতি।।


নাহি কোন পরিচয় তবু দাদা বলি কয়


ভূমি তলে গড়াগড়ি করে যে আনন্দে।


বয়ান ভাসিয়া যায় আলিঙ্গন করি রয়


প্রেমে জড়াজড়ি করি বুকে বুক বান্ধে।।


নাহি চেনে দেব দেবী ঘট, পট, কিংবা ছবি


জানে মানে মনে প্রাণে শুধু হরিচাঁন্দে।


সতী যথা পতি মানে নদী ধায় সিন্ধু পানে


শ্রী হরি বিরহে তারা মনে মনে কান্দে।।


যদি হরিচাঁন্দ কয় মরণের নাহি ভয়


অগ্নি মাঝে প্রবেশিতে পারে যে মতুয়া।


মরণ দলিয়া পায় নেচে নেচে ম’তো ধায়


যদি হরি আজ্ঞা দেয় ইঙ্গিত করিয়া।।


শঙ্কা শূন্য ভরা বুক শূর তেজে দীপ্ত মুখ


এক মহামন্ত্র কন্ঠে জয় হরিচাঁদ।


গৃহে বনে কি শ্মশানে দিবা কিম্বা রাত্রি ক্ষণে


সমভাবে চলে ফিরে গণেনা প্রমাদ।।


নারী জাতি জানে মাতা সুদূরে নোয়ায়ে মাথা


মাতৃজ্ঞানে আলাপন করে মিষ্ট ভাষে।


মানামান সমজ্ঞান মতো শুধু দেখে প্রাণ


ডাকিলে সরল প্রাণে ম’তো সেথা বসে।।


পর দুঃখে দুঃখী যত শ্রী হরি চাঁন্দের ম’তো


নিঃস্বার্থ তাদের মত দেখা নাহি যায়।


বিপদে পড়িলে কেহ ডাকিয়া করিলে স্নেহ


দয়াল মতুয়া চলে ছুটিয়া তথায়।।


কিবা দিবা বিভাবরী শুধু বলে হরি হরি


অবিরত অশ্রুবারি ফেলে তার লাগি।


খেতে পেলে তবে খাই না দিলেও ক্ষতি নাই


শয্যা যদি নাহি মিলে তবে রাত্রি জাগি।।


না মাগে কোনই অর্থ নাহি চিনে কোন স্বার্থ


একমাত্র স্বার্থ শুধু পর উপকার।


ছাড়ি গৃহ ছাড়ি জায়া দিয়ে মন প্রাণ কায়া


বিপদ তারণ নাম করিছে প্রচার।।


শান্ত দান্ত কৃপাবন্ত মতুয়া পরম শান্ত


উলঙ্গ শিশুর মত উলঙ্গ পরাণ।


শান্ত সিন্ধু প্রায় স্থির ভাব কত সু গম্ভীর


ভিন্ন চিত্র দেখা যায় অতীব মহান।।


সিন্ধু যদি ক্ষুদ্ধ হয় শান্ত ভাব দূরে যায়


উত্তাল তরঙ্গ দল মত্ত হয়ে ছোটে।


ম’তো যবে ক্ষেপে যায় কেবা তারে মেপে লয়


মুহূর্তে প্রলয় কাণ্ড ধরা পরে ঘটে।।

দুই ক্ষণে এই ভাব দেখি মতুয়া স্বভাব


নাম সংকীর্ত্তনে অন্য গুরু নিন্দা শুনে।


বাড়বাগ্নি সম জলে মহাবেগে ছুটে চলে


টল টল নড়ে ধরা মতুয়া নাচনে।।


কর্ম্ম ব্যাস্ত ঝরে ঘাম তবু মুখে হরি নাম


দিব্যজ্যোতিঃ অনুপম মতুয়া বদনে।


ঝর ঝর বারি ঝরে যবে হরিচাঁদ স্মরে


বিরহি উথলি ওঠে মতুয়ার প্রাণে।।


যদি কোন অসজ্জন গুরুনিন্দা আলাপন


মতুয়া নিকটে করে অবহেলা ভরে।


পরাণ ফাটিয়া যায় কে রক্ষিবে বল তায়


বীর মূর্ত্তি ধরি ম’তো দণ্ড দান করে।।


জীবন মরণ বল মতুয়া জানে যে ভাল


মৃত্যু হাতে ধরি করে পুতুলের খেলা।


মন প্রাণ গুরু পদে মতুয়া রেখেছে বেঁধে


বাচন মরণ সব করে অবহেলা।।


এক মানুষেরে জানে সেই মানুষেরে মানে


মনের মানুষ করি তারে রাখে প্রাণে।


মন মানুষের ভাব তার কান্তি যে স্বভাব


যার মধ্যে দেখে ম’তো তারে তাই মানে।।


এই মানুষেতে নিষ্ঠা ম’তো ধর্ম্ম পরাকাষ্ঠা


মনে প্রাণে ম’তো সব এই নীতি মানে।


যত জীব হল সৃষ্ট নর তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ


সকল জীবের ইষ্ট করে নরগণে।।


মানুষে সাধনা করে চিৎ শক্তি রাখে ধরে


আব্রহ্ম জুড়িয়া তাহা করে নিত্য খেলা।


অন্যে জীবে নহে সাধ্য মানুষে করিল সাধ্য


চিৎ শক্তি তাই বাধ্য আপনি হইলা।।


মানুষের মধ্যে তাই তাঁর শ্রেষ্ঠ রূপ পাই


তার শক্তি নর মাঝে অধিক বিকাশ।


এই কৃপা নরে পেয়ে আছে জীব শ্রেষ্ঠ হয়ে


তাই দেখি নর মাঝে তাহারই প্রকাশ।।


ম’তো এই সত্য জানে তাই মানুষেরে মানে


যেই মানুষেতে দেখে মনের মানুষ।


সেই পদে সব দান ধন মান মন প্রাণ


ম’তো জানে সেই শ্রেষ্ঠ প্রধান পুরুষ।।


নর রূপে হরিচাঁদ করে পতিত আবাদ


দীন হীন উপেক্ষিত আছিল যাহারা।


পিয়ে সে চাঁদের সুধা মিটাইল সব ক্ষুধা


ঢেলে দিল জীবনের দুঃখের পসরা।।


সর্ব্বাশ্রম এক সাথে পবিত্র প্রেমের সুতে


গাঁথি দিল হরিচাঁদ পূর্ণ অবতার।


পূর্ব্বে যাহা ছিল ক্ষুণ্ণ এবারে করিল পূর্ণ


পূর্ণনন্দ পূর্ণ হরি শ্রী হরি আমার।।


নিষ্ঠা রাখি হরিচাঁদে সকল মতুয়া কাঁদে


“ওহে প্রভু তুমি বিনে কি হবে উপায়।


আমি নাহি যাব চলে বারে বারে হরি বলে


গুরুচাঁদ দেহে আমি রহিব নিশ্চয়।।


শ্রী হরির এই বাণী যতেক মতুয়া প্রাণী


নত শিরে সবে মানি লইল মাথায়।


শ্রী গুরু চরিত্র মাঝে সব দিনে সব কাজে


কিসে সত্য হল বাণী দিব পরিচয়।।


এবে শুন বলি কথা অপূর্ব্ব মধুর গাঁথা


শুনিলে সে সব কথা জীব ধন্য হয়।


হরিচাঁদ তিরোধানে তার কিছু পূর্ব্বক্ষণে


হরি অগ্রে গুরুচাঁদ হইল উদয়।।


কর জোরে করি রয় মুখে কথা না জুড়ায়


পিতৃ পদ দৃষ্টি রাখি বিনয় বচনে।


বলে তাতঃ নিবেদন চাই চরণে শরণ


পতিত তারণ তুমি এসেছ ভুবনে।।


অনাদির আদি তুমি ক্ষিরোদ বিহারী স্বামী


বড় কৃপা করি জীবে জগতে আসিলে।


জীবগণে এত দিনে পায় নাই যেই দিনে


তুমি এনে সযতনে জীবেরে তা’ দিলে।।

তব কথা কি বলিব কেমনে তোমা চিনিব
অজানা অচেনা ধন তুমি গুণাতীত।
তব কথা যাহা কই তাহা বলা হয় কই
অপূর্ণ সকলি কই বিরিঞ্চি বাঞ্ছিত।।
কত কৃপা মম পরে জন্ম দিলে তব ঘরে
আপনার করি মোরে দেখ চিরদিন।
ভীত মনে দূরে থাকি তব লীলা খেলা দেখি
জন্ম জন্ম তব পদে আছে মম ঋণ।।
মনে ভাবি এই কথা কোন কথা দিয়ে পিতা
তোমরে তুষিব হেথা আমি অভাজন।
এমন কি গুণ আছে যে গুণে আসিব কাছে
কোন কথা দিয়ে পাব তোমা হেন ধন।।
এমন কি কথা জানি পা ‘ব তোমা ‘ গুণমণি
বাণী যেথা হারা বাণী তাঁরে কিবা কব।
সকলি জানত তুমি অনাদি অনন্ত স্বামী
মূঢ় হতে মূঢ় আমি কিসে তোমা পাব।।
জীব লাগি নর ভাব ঘুচাতে সব অভাব
অপরূপ মহাভাব ব্রহ্মা অগোচর।
নর ভাবে কায়া ছাড়ি তুমিত ছাড়িবে হরি
বল পিতঃ কিবা করি আমি অতঃপর।।
কোন ভাবে কোন পথে চলিব জীবন পথে
ধর্ম্ম মানি কোন মতে পিতা তাই বল।
তোমার ভকত যারা নামে গানে মাতোয়ারা
কোন ভাবে এবে তারা চলিবে সকল।।
তব আশির্বাদ বিনে কিছু নাই এ জীবনে
নিদ্রা কিম্বা জাগরণে তাহাই সম্বল।
চাহি কোন আশীর্বাদ পূর্ণ ব্রহ্ম হরিচাঁদ
তব মনে যাহা সাধ হউক সফল।।
উন্নত পাদপ তলে জীবে রহে দলে দলে
ভয় অবহেলি চলে সহায়ের গুণে।
ঝঞ্ঝা বায়ু শীতাতপে আশ্রয় করি পাদপে
জীব কুল কাল যাপে’ নিঃসন্দেহ মনে।।
বৃক্ষ যদি পড়ি যায় আশ্রয়ের শেষ হয়
করে সবে হায় হায় হেরি অন্ধকার।
তব অদর্শনে পিতা প্রাণে বাজে বড় ব্যাথা
আমরা দাঁড়াব কোথা বল একবার।।
কাণ্ডারী বিহীন তরী অকূলে ডুবিয়া মরি
তুমি যে কাণ্ডারী হরি যদি নাহি রবে।
তোমা বিনে মরি প্রাণে স্থান নাহি কোন খানে
কৃষ্ণ হারা বৃন্দাবন – তুল্য দশা হবে।।
তুমি হরি ইচ্ছা ময় কে রোধে তব ইচ্ছায়
তবু প্রাণে ইচ্ছা হয় করি নিবেদন।
যেও না যেও না হরি প্রাণে মারি নর নারী
সকলে তোমার হরি যাচে শ্রী চরণ।।
একান্ত ছাড়িবে যদি বল ওহে গুণনিধি
চঞ্চল সংসার নদী লঙ্ঘিব কেমনে ?
মোর নাহি কোন শক্তি নাহি জ্ঞান নাহি ভক্তি
কাতরে সকল উক্তি করিহে চরণে।।
উক্তি শুনি পুত্র মুখে শ্রী হরি চাহিয়া দেখে
আপনি ডাকিয়া তারে কহিল বচন।

“মনে কিবা চিন্তা কর আমার বচন ধর


তুমি কিছু নহ পর শ্রী গুরুচরণ।।
যাহা কিছু প্রয়োজন সকলি হবে স্মরণ
যাহা কিছু কর মন সকলি মিলিবে।
মম পিতা যশোবন্ত কহে মোরে যে বৃত্তান্ত
কহি তাহা আদ্যপান্ত শুন ভক্তি ভাবে।।
দেহত্যাগ পূর্ব্ব ভাগে সবে ডাকি তাঁর আগে
মধুর বচনে বলে “শুন পুত্রগণ!
দেহধারী হলে পরে যেতে হয় পরপারে
অলঙ্ঘ্য নিয়ম এই নিয়তির লিখন।।
মন মধ্যে বুঝি তাই আর বেশি দেরী নাই
যাত্রা কালে বলি যাই পবিত্র কাহিনী।
পাপ থাকে কোনখানে পাপে ধরে কোন জনে
পাপে রক্ষা কোন গুণে বলিব এখনি।।।

আপন জীবন পথে এই নীতি রেখ ‘ সাথে


শুভ ফল পাবে তাতে নাহি হবে আন।


দুঃখ তাপ দূরে যাবে প্রেমানন্দে সুখে রবে


প্রাণ মধ্যে প্রাণারাম হবে অধিষ্ঠান।।


পাপ দূরে নাহি রয় পাপ জাগে নিজালয়


নিজ ঘরে জীবচয় পাপে ডুবে মরে।


নারী রূপে মায়াবিণী সাজিয়াছে আদরিণী


তার ছলে ভুলে প্রাণী নিত্য পাপ করে।।


সদাচার বলে কারে সৎ আছে যে আচারে


সৎ থাকে সদাচারে পবিত্র নিয়মে।


ঋতুকাল ভিন্ন কালে নারী সঙ্গ যদি মিলে


ব্যাভিচারী তারে বলে ধর্ম্মনীতি ক্রমে।।


মাতৃতুল্য পর নারী হৃদয়ে ধারনা করি


জগতের নর -নারী পূজিবে অন্তরে।


পর নারী সঙ্গ আশা করে যেই সর্বনাশা


ধন ধর্ম্ম আশা নির্ম্মুল সংসারে।।


দূরে থাক পর নারী নিজ নারী সঙ্গ করি


হতে পারে ব্যভিচারী মানব সকল।


ঋতুকালে নারী সঙ্গ মানিবে পবিত্র ধর্ম্ম


ইহা ভিন্ন সঙ্গ কর্ম্মে ফলে বিষফল।।


পবিত্র চরিত্র রাখি নর হয় মহাসুখি


সদা থাকে কমলাখি হৃদয়ে তাহার।


দিন মাত্র সঙ্গ করে সন্তান লভিতে পারে


সেই ধন্য এ সংসারে পালি সদাচার।।


কিন্তু দেখ মহাভুল নরে নাহি জানে স্থুল


নষ্ট করে আদি মূল মজে ব্যভিচারে।


ভাবিয়া আপন দারা নিত্য ব্যভিচারে সারা


নিজ নারী সঙ্গে যারা না মানে বিচারে।।


তা’তে বলি এই কথা পাপ নহে দূরে কোথা


পাপ বাস করে হেথা আপনার ঘরে।


আনায়াসে নারী মিলে আপনার গৃহ তলে


নর পশু কুতূহলে মজে ব্যভিচারে।।


পর নারী পেতে আশা সময়েতে সে দুরাশা


আপনার ঘরে বাসা পাপে ডাকি দেয়।


সহজ পাপের খেলা মিলায় পাপের মেলা


ঘরে পরে পাপ খেলা করিয়া বেড়ায়।।


পাপে নষ্ঠ গৃহ ধর্ম্ম নষ্ঠ জ্ঞান নষ্ঠ কর্ম্ম


নরে এই মূল মর্ম্ম জানে কদাচন।


ব্যভিচার মহাপাপ ইহ হতে মনস্তাপ


জীবনের অভিশাপ না মিলে এমন।।


দূর হতে দূরে রহ আপনারে সামলাহ


মনে রাখ অহরহ পবিত্র আচার।


কিবা ঘরে কিবা পরে ব্যভিচার হতে দূরে


থাক সদা সদাচারে মানিয়া বিচার।।


ব্যভিচার যেই নর কিছুতে নাহি উদ্ধার


পূর্ব্ব পূরুষেতে তাঁরে করে অভিশাপ।


সামাল সামাল তাই চরিত্র পবিত্র চাই


ইহা হতে ধর্ম্ম নাই প্রবল প্রতাপ।।


আর কিবা বলি তোমা বিদ্যাদান, দয়া ক্ষমা


হরি নাম ঘরে ঘরে করিবে প্রচার।


পুত্র কন্যা বিদ্যাদানে রূপে শীলে কিংবা গুণে


পালিবে সকল জনে না হয়ে কাতর।।


এত বলি হরিচাঁদ করিলেন দেহ ত্যাগ


ভাগ্যবান মহাভাগ দেখিল স্বচক্ষে।


নীলাভ উজ্জ্বল জ্যোতিঃ কোটি সূর্য সম ভাতি


ছুটি গুরুচাঁদ প্রতি লাগে তার বক্ষে।।


শক্তি পেয়ে গুরুচন্দ্র শোভে যেন পূর্ণ চন্দ্র


ধ্বনিল জীমূত মন্দ্র মহাকাশ কোলে।


বিশ্ব কাঁপে থর থর নাচে যেন বিশ্বম্ভর


নাচিল দিক অম্বর প্রেমানন্দ রোলে।।


হরি দেহ পরি রয় শক্তি নাহি হয় লয়


অপূর্ণ পূরিয়া যায় পূর্ণানন্দ স্রোতে।


নাহি দুঃখ নাহি শোক অন্তরে আসে পুলক


বিশ্ববাসী যত লোক লাগিল হাসিতে।।

হরি পুর্ণ গুরুচাঁদে ধরা নত শিরে বন্দে


ভাবে দীন মহানন্দে বসে কিবা করি।


শ্রী গুরু গোপাল চন্দ্র পেল সেই প্রেমানন্দ


সাধু পিয়ে মকরন্দ বলে হরি হরি।।