Tuesday, December 1, 2020

মোবাইল চার্জের সাথে এক্সের তুলনা

কারেন্ট নেই জেনেও ফোন চার্জে দেওয়াকে বলে "সরলতা"

কারেন্ট আসার পর ফোনে চার্জ হচ্ছে মনে করা হলো "বিশ্বাস"

তিন ঘণ্টা পর এসে দেখলাম ভুলে সুইচ দেইনি এইটা হলো "বোকামি"

যা হয়েছে বাদ দিয়ে আবার সুইচ দেওয়াকে বলে "ক্ষমা"

সুইচ দেওয়ার সাথে আবার কারেন্ট যাওয়া কে বলে "মন ভাঙ্গা"

কারেন্ট আবার আসতে দেরি হবে ভেবে ফোন সাথে নিয়ে বাহিরে যাওয়া হলো "কনফিডেন্ট"

তিন ঘণ্টা পর বাড়িতে  এসে শুনলেন বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই কারেন্ট এসেছে , এইটা হলো "কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা"😹😹😹

আবার তড়িঘড়ি করে চার্জে লাগানোর সাথে কারেন্ট যাওয়াকে বলে "ছ্যাকা"

কারেন্ট আসতে পারে ভেবে তিনঘন্টা বাড়িতে  বসে থাকা হলো "অপেক্ষা"

তিনঘন্টা অপেক্ষা করে নিজের উপর বিরক্ত হয়ে মন খারাপ করাকে বলে "ডিপ্রেশন"

মোড়ে কারেন্ট আছে, ওখানে চার্জ দেওয়া যাবে ভেবে বাড়ির থেকে বেরিয়ে যাওয়া হলো "বিকল্প ব্যবস্থা"

মোড়ে যাওয়ার অর্ধেক রাস্তায় গিয়ে বুঝলেন কারেন্ট এসেছে , একে বলে "প্রাক্তন ফিরে আসা"

বাড়িতে যাবেন কিনা মোড়ে যাবেন এইটা চিন্তা করা হলো "কনফিউস

বাড়ির কাছাকাছি আসতেই আবার কারেন্ট যাওয়াকে বলে "প্রাক্তনকে বিশ্বাস করে বাঁশ খাওয়া"

এরপর মোড়ে যাওয়ার পর কারেন্ট আসা দেখেও বাড়িতে না আসা হলো "প্রাক্তনকে বিশ্বাস না করা"

রাত বারোটা পর্যন্ত মোড়ে বসে থেকে বাড়িতে এসে যখন শুনলেন আর কারেন্ট যায় নি, এটাই "এক্সকে বিশ্বাস না করে ভুল করা"

এত কিছুর পর করেন্টকে মনে মনে গালি দেওয়া হলো "এক্সের পরিণতি"
😂😂😂😂

Wednesday, November 25, 2020

বিশ্বের_সবচেয়ে_বড়_ও_অদ্ভূত_রান্নাঘরঃ-


জগন্নাথ পুরী মন্দিরের রান্নাঘরকে বলা হয় পৃথিবীর অদ্ভুত ও বড় রান্নাঘর । কেন এই রান্নাঘর অদ্ভুত তা আপনাদের কাছে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরছি ।
পুরীতে আমরা কম বেশী সবাই যাই তাই তার রান্নাঘরের লীলা আমরা কম বেশি সবাই জানি । এখানে আরও বিশদে আলোচনা করা হলো।
-----------------------------------------------------------------------------------
১. এই রান্নাঘরে বিবিধ দ্রব্য রান্না করার জন্য কোন বিদ্যুৎ বা যন্ত্র ব্যবহার করা হয় না । উন্মুক্ত কাঠের আগুনের উপর অনেকগুলো তেলের ল্যাম্প বা বাতি ঝুলিয়ে রাখা হয় আর তার নিচেই সেবকরা এসেই রান্না কার্য সম্পন্ন করে ।
.
২. এ রান্নাঘরে এত দ্রুত রান্না করা হয় যে শুধুমাত্র একদিনের প্রস্তুতিতে একসাথে প্রায় দশ হাজার লোক বসে প্রসাদ পায় । আর এমনিতে পাঁচ হাজারের উপর দর্শনার্থী প্রসাদ পেয়ে থাকে ।
.
৩. এই রান্নাঘরটি ৯টি ভাগে বিভক্ত । যাদের দুটি ভাগ ২৫০০ বর্গফুট করে এবং বাকি ৭টি ভাগ এ দুটির চেয়ে একটু ছোট হবে । এ রান্নাঘরে রয়েছে ৭৫২টি মাটির তৈরি চুলা যার প্রত্যেকটি দৈর্ঘ্যে তিন বর্গফুট করে এবং উচ্চতায় প্রায় ৪ ফুটেরও বেশি ।
.
৪. চুলাগুলোতে একটির উপর একটি পাত্র বসানো হয় এভাবে প্রায় নয়টি পাত্র থাকে । শুধুমাত্র এ পাত্রগুলোর নিচে অবস্থিত আগুনের মাধ্যমেই উপরের পাত্র থেকে শুরু করে শেষে নিচের পাত্রটির রান্না অদ্ভুদ ভাবে সম্পন্ন হয় । এই রান্নাঘরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত রয়েছে এক হাজার সেবক । তার মধ্যে ৫০০ সেবক রয়েছে কেবলমাত্র চুলাতে রান্না করার জন্য সহায়ককারী হিসেবে ।
.
৫. এখানে কোন পুরাতন পাত্রে রান্না করা হয় না, প্রতিদিন নতুন নতুন পাত্রে রান্না করা হয়, তাই একদল খালি মাটি দিয়ে পাত্র বানায়, আরেক দল তা সরবরাহ করে রান্নাঘরে নিয়ে যায় । আরেকদল পাত্রগুলো ধৌত করে, আরেকদল পাত্রে জলভর্তি করে চুলাতে নিয়ে যায় |
.
৬. রান্না করার জন্য এখানে গঙ্গা আর সরস্বতী নদী (এটা একটা রূপক, পাথর বাঁধানো জলের দুটি নালী, যা সারা দিন নদীর ন্যায় ক্রমাগত জল পরিবহন করে) রান্নাঘরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে যা বাহির থেকে দেখা যায় না যা সত্যিই অদ্ভুত !!!!
.
৭. কেউ কেউ সব্জি ধৌত করছে আর কেউ কেউ সব্জি কাটছে আর কেউ মসলা তৈরি করছে । রান্নাঘরে যে সেবকরা থাকে তাদের বয়স যখন ১২ বছর হয় তখন থেকে তারা ট্রেনিং এ নেমে পড়ে এভাবে তারা বংশানুক্রমে প্রাপ্ত নির্দিষ্ট সেবা সারাজীবন ধরে অর্থাৎ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করে থাকে ।
.
৮. এই রান্নাঘরে ১০০টির উপর আইটেম রান্না করা হয় যা দুটি ভাগে বিভক্ত । এ দুটি ভাগকে পাক্কা এবং সুক্কা নামে ডাকা হয় । পাক্কা বলা হয় সে খাবারগুলো যেগুলো সিদ্ধ করা যেমন ডাল, চাল, খিচুরী এবং সমস্ত রকমের সবজি । অপরদিকে সুক্কা বলা হয় বিস্কিট, মিষ্টান্ন আর বিভিন্ন ধরনের পিঠা ।
.
৯. জগন্নাথের জন্য যেসমস্ত ফল ও সবজি ব্যবহার করা হয় সেগুলো দু হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে । শুধুমাত্র স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সবজি ও ফলই জগন্নাথের জন্য ব্যবহৃত হয় । অন্য কোন অঞ্চল থেকে উৎপাদিত দ্রব্য জগন্নাথের জন্য ব্যবহার করা হয় না ।
.
জগন্নাথ দেব আর লক্ষ্মী দেবীর কৃপায় ধন্য এই রান্না ঘর । তাইতো পুরীর এ রান্নাঘরকে অদ্ভুত রান্নাঘর বলেই অভিহিত করা হয় ।

*** জয় জগন্নাথ ***

Sunday, November 1, 2020

পশ্চিমবাংলার তৃতীয় শ্রেনীর ছাত্রছাত্রীদের নাস্তিক হিন্দুরা দেখেন কি শিখাচ্ছে( নিম্নের ছবিতে প্রদর্শিত হল) । এদের থেকে সনাতন ধর্ম কিভাবে রক্ষা পাবে? মানুষ কেন বিধর্মী বা নাস্তিক হবে না।মেয়েরা কেন লাভ জিহাদের স্বীকার হবে না???

 পশ্চিমবাংলার তৃতীয় শ্রেনীর ছাত্রছাত্রীদের নাস্তিক হিন্দুরা দেখেন কি শিখাচ্ছে( নিম্নের ছবিতে প্রদর্শিত হল) । এদের থেকে সনাতন ধর্ম  কিভাবে রক্ষা পাবে? মানুষ কেন বিধর্মী বা নাস্তিক হবে না।মেয়েরা কেন লাভ জিহাদের স্বীকার হবে না???  আজ এভাবে সমস্ত নাস্তিকের অপ শিক্ষা পদ্ধতির জন্য সনাতন ধর্ম ধ্বংসের মুখে।

উত্তরঃ

🚩সনাতন ধর্ম মানুষের তৈরি কোন বিশ্বাস নয়।এটি একটি বিজ্ঞান।যার আলোচনা আপনাকে এ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করবে।প্রকৃত ধর্ম মনুষ্য সৃষ্ট হতে পারে না।শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হচ্ছে -
"ধর্ম তু সাক্ষাৎ ভগবৎ প্রনীতং"

অনুবাদঃধর্ম ভগবানের প্রনীত বিধান।

যেমন একটি দেশ সংবিধান অনুসারে চলে,ঠিক তেমনই ভগবানের দ্বারাই ধর্ম ও শাস্ত্র প্রদত্ত হয়েছে।

🚩সনাতন ধর্ম মানে একটি বিশ্বাস নয়।এটি একটি ব্যবহারিক বিষয়।যার অনুশীলনে প্রত্যক্ষ জ্ঞান আপনি পেতে পারেন।

🚩যেমন  কুরুক্ষেত্রের রনাঙ্গনে ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে গীতার জ্ঞান প্রদান করেন, তা এখনো বর্তমান।

🚩আমাদের সনাতন ধর্ম বেদ,গীতা, উপনিষদের উপর দন্ডায়মান।

🔷তাহলে এখানে মনুষ্যসৃষ্ট কি হতে পারে??????

🚩 এসমস্ত নাস্তিক মানুষগুলো    হিন্দুদের কেন তীরবিদ্ধ করে???? কারন ওরা জানে হিন্দুরা ধর্ম সম্পর্কে অনভিজ্ঞ।তারা তো মুসলমান নয়, যে ধর্মকে অবমাননা করলে আমাদের গলা কাটতে আসবে ,রক কাটতে আসবে ।

🚩 হে  তথাকথিত পন্ডিত নাস্তিক,আপনি সনাতন ধর্মকে নয়,মুসলিম,খ্রীষ্টান ধর্মকে নিয়ে  এ মন্তব্য করুন,তাদের মোল্লা,ফাদার নিয়ে করেন,একচেটিয়া একটা ধর্মকে নয়।দেখেন বাপ দাদা চোদ্ধ গুষ্টিকে ঐ মোল্লারা 
শশ্মানে পাটিয়ে দিবে।অথবা দিন দুপরে আপনার আত্মীয়ের গলা কেটে দিবে।এ নাস্তিকতা শুধু ভারতে খাটবে।

🏆 এখনো সারা পৃথিবীর মানুষ ভারতকে তীর্থ ভুমি হিসেবে জানে,কেননা এখানে জন্ম নিয়েছেন,ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন অবতার।

⭐⭐ রামচন্দ্র আবির্ভাব স্থান অযোধ্যা, শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব স্থান মথুরা এখনো বর্তমান।এছাড়া আরো অনেক তীর্থ ( দ্বারকা,বৃন্দাবন,নৈমিষারণ্য অহবিলা ইত্যাদি)

🚩গলা যদি মাথায় না রাখতে চান,তাহলে দয়া করে এসমস্ত বিষয়   ইসলাম ধর্ম বা অন্য ধর্মকে নিয়ে লিখেন।দেখেন আপনার মাথা দেহে আছে কিনা???  

🚩পরিশেষে সনাতন ধর্ম কখনও জল্পনা কল্পনার বিষয় নয়। এটি একটি   চিরন্তন সত্য ও ব্যবহারিক বিষয়।যার সত্য ও অভ্রান্ততা এ জগতে আমরা দেখতে পাই।তাই সনাতন ধর্ম একটি বিজ্ঞান।জীবের শ্বাশত সনাতন ধর্ম নিয়ে নাস্তিক বিজ্ঞানীদের জল্পনা-কল্পনার অবকাশ এ জগতে নেই।

          
               🚩 জয় শ্রীকৃষ্ণ, জয় শ্রীরাম  🚩

Friday, October 9, 2020

এই আঘাতও যেন চরম আত্মতৃপ্তির পূর্ণাঙ্গ প্রতিচ্ছবি

শরীরের আঘাত দেখুন আর মুখে অভিব্যক্তি দেখুন। এই আঘাতও যেন চরম আত্মতৃপ্তির পূর্ণাঙ্গ প্রতিচ্ছবি। আপনি আমি যখন শহরের ঠান্ডাঘরে তাত্ত্বিকভাবে পদের জন্য, নির্বাচনের টিকিটের জন্য শকুনির মতো চাল চেলে যাচ্ছি।ঠিক তখনই এইসব অখ্যাত যোদ্ধারা শাসক আর শাসকের পোষ্য পুলিশের চোখে চোখ রেখে লড়াই করে চলেছে। 

না এদের না আছে পদলোভ,না আছে বিখ্যাত হবার বাসনা, আছে কেবল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে, মেরুদণ্ড সোজা রেখে লড়াইয়ের মানসিকতা। 

না এদের নাম কেউ মনে রাখবেনা তবু অন্যায়ের প্রতিবাদে এদের উত্থান যুগে যুগে হবে।এরাই হিন্দুশক্তি এরাই ভবিষ্যৎ আমাদের সমাজের।

এদের মতো হাজার হাজার অখ্যাত, অজ্ঞাত হিন্দুযোদ্ধাদের প্রণাম করি আর শ্রদ্ধা জানাই হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে।♥♥♥

Tuesday, September 29, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 97 নিখিল বঙ্গ নমঃশূদ্র সম্মেলন বা খুলনা কনফারেন্স

তের শত চৌদ্দ সালে অসাধ্য সাধন বলে


নমঃশূদ্রে রাজকার্য্য পায়।


শ্রীগুরু চাঁদের সুত শশীবাবু অগ্রদূত


পরে পরে আর সবে ধায়।।


কুমুদ বিহারী ধন্য ‘ডেপুটি’ পদের জন্য


উচ্চ আশা মনে ছিল তাঁর।


‘‘স্বদেশী ভাবনার্যস্য’’ সুফল ফলে অবশ্য


মনে প্রাণে ভাবে বারে বার।।


ওড়াকান্দী গুরুচাঁন্দে বিনয়ে চরণ বন্দে


মনোগত কথা তাঁরে কয়।


গুরুচাঁদ বল দিয়ে মীডের সাহায্য নিয়ে


মনস্কাম তাঁর পূর্ণ হয়।।


আর যাঁরা ছিল সাথ মোহন আর সাধানাথ


অন্যজন নাম সিদ্ধেশ্বর।


রাজ কার্য্য সবে পায় সবে ধন্য ধন্য কয়


নমঃ জাতি হইল উদ্ধার।।


জাতি গ্রাণে পে’ল বল যতনমঃশূদ্র বল


দুর্ব্বলতা ফেলে দিল দুরে।


জাতির শিক্ষার তবে প্রভু বলে বারে বারে


তত্ত্ববোঝে এতকাল পরে।।


পড়িল শিক্ষার সাড়া সব নমঃশূদ্র পাড়া


বিদ্যুৎ তরঙ্গ যেন ছোটে।


পঞ্চদশ বর্ষ মধ্যে নমঃশূদ্র আনে সাধ্যে


শিক্ষা সঙ্গে রাজনীতি বটে।।


জাতি তরে আন্দোলন করে কত সম্মেলন


সারা বঙ্গ জুড়ি ঢেউ চলে।


যত কিছু আন্দোলন যত হয় সম্মিলন


গুরুচাঁদ সকলের মূলে।।


তেরশ’ তিরিশ সালে নমঃশূদ্র সবে বলে


‘‘নমঃশূদ্র যত আছে বঙ্গে।


খুলনা জেলায় এসে সম্মেলন কর শেষে


এস সবে বস এক সঙ্গে।।


আর সবে ডাকি কয় ‘‘স্বজাতির এ সভায়


সভাপতি কারে করা যায়?


লিখি দাও নিজমত নিমন্ত্রণ পত্র সাথ


যাতে কার্য্য সুসমাথা হয়।।’’


প্রতি জেলা হতে কয় ‘‘আমাদের মনে হয়


ওড়াকান্দী গুরুচাঁদ যিনি।


তাহা হতে সমধিক যোগ্য কেহ নহে ঠিক


যোগ্যতম সভাপতি তিনি।।’’


খুলনা জিলার বাসী মনে তাতে বহু খুসী


বহু চেষ্টা করিলেন তাঁরা।।


কর্ম্মাধ্যক্ষ সীতানাথ মুকুন্দ বিহারী সাথ


দুই জনে হাতে হাত ধরা।।


প্রতিভার প্রিয় বীর শ্রীনিরোদ বিহারীর


দিবারাত্র কাটিছে চিন্তায়।


কি কি বস্তু আলোচনা করিবেন সব জনা


কোন কথা কে কি ভাবে কয়?

 

 

সুবক্ত বলিয়া মান্য শ্রীরাই চরণ ধন্য


বাগহাট শহরেতে বাস।


ব্যবসা মোক্তারী তাঁর শক্তি ছিল রচনার


গ্রন্থ এক করিল প্রকাশ।।


শ্রীরাজেন্দ্র মালাকার অতি শুদ্ধ শান্ত নর


ওকালতী করে বাগহাটে।


সম্মেলন হবে বলে তার যাতায়াত চলে


যত সব নেতার নিকটে।।


এই ভাবে দিন গত হল সব সুপ্রস্তুত


ক্রমে দিন ঘনাইয়া আসে।


মুকুন্দ বিহারী যিনি উচাটন হন তিনি


সভা লাগি বহুত তরাসে।।


মুকুন্দের পরিচয় বলি কিছু এসময়


ধন্য বটে সেই মহাজন।


হাইকোর্টে ওকালতী করিতেন মহামতি


কষ্ট সহে জাতির কারণ।।


খুলনা জিলায় জন্ম শুন বলি সেই মর্ম্ম


বাগহাট মহকুমাধীনে।


ঈশ্বর মল্লিক নাম পিতামহ গুণধাম


এক বাক্যে সবে যাঁরে চেনে।।


প্রসন্ন মল্লিক নাম পিতা তাঁর গুণধাম


শান্ত ধীর অতি জ্ঞানবান।


লভিলেন ষড় পুত্র বলিতেছি সেই সূত্র


শিক্ষা ক্ষেত্রে সবে ভাগ্যবান।।


কুমুদ মুকুন্দ দুই শুন পরে পরে কই


অতুল নীরোদ দুই জন।


ক্ষীরোদ পুলিন দোঁহে সবে এক সঙ্গে রহে


ষড় যত্ন অতি সুশোভন।


গুরুচাঁদ কুমুদেরে নিজগুণে দয়া করে


তাই পেল ডেপুটীর পদ।


কুমুদ দেখাল পথ সবে চলে তার সাথ


গতি ধারা কেবা করে রদ?


মহাকর্মী শ্রীমুকুন্দ মনে নাহি রাখে সন্দ


স্মৃতি শক্তি অতীব প্রখর।


কর্ম্মেতে উঠাল তাঁরে কর্ম্ম ও চরিত্র জোরে


মন্ত্রী তাঁরে করে বঙ্গেশ্বর।।


আদি মন্ত্রী নমঃ কুলে ব্যপ্ত রবে ধরাতলে


পূর্ব্ব জন্ম কর্ম্মফল ভাল।


সুতীক্ষ্ণ প্রতিভাশারী চিন্তা বলে মহাবলী


নীরোদ বিহারী ধন্য ছিল।।


আইন সভায় তিনি আসিলেন রণ জিনি


শক্তিশালী উচ্চ হিন্দু সাথে।


আদি নমঃ সভ্যপদ ব্যবস্থা সভার মাঝ


ভীষ্মদেব এল মনোনীতে।।


দৈব দেখ বলবান কিছু পরে মতিমান


যৌবনেতে প্রাণ ছাড়ি গেল।


মনে ভাবি কেন হায় কুসুম শুকায়ে যায়


ঝরে যদি কোন বা ফুটিল?


সুবিজ্ঞ আইনজীবি পরম সুন্দর ছবি


অতুল নামেতে যেই জন।


ঠাকুর বংশের কন্যা নলিনী নামেতে ধন্যা


পত্নীরূপে করিল গ্রহণ।।


এবে সাবজজ তিনি আইনেতে মহাজ্ঞানী


পঞ্চমেতে ক্ষীরোদ বিহারী।


ডেপুটীর পদে আছে পুলিন বিহারী পাছে


আছে এবে মন্ত্রীপদ ধরি।।


গুরুচাঁদ ইহাদেরে গিয়াছেন কৃপা করে


আশীর্ব্বাদ করিলেন কত।


কেবল সুখের দিনে পূর্ব্ব কথা রাখে মনে


নর-নীতি চির পরিচিত।।


সে সব বৃত্তান্ত ছাড়ি মূল গ্রন্থ ভাব ধরি


সম্মেলন কথা কিছু কই।


যাঁর কৃপা বলে নরে পায় সব এ সংসারে


তাঁরে ফেলে কিবা লয়ে রই?


আসিল সভার দিন গুরুচাঁদ ভক্তাধীন


ভক্ত সঙ্গে সভা প্রতি ধায়।


মন্মথ রঞ্জন যিনি প্রভুর সঙ্গেতে তিনি


আনন্দেতে চলিল সভায়।।


জ্ঞানী ভক্ত যঞ্জেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর


হইলেন প্রভুজীর সাথে।


এ দিকেতে খুলনায় সবে পথ-পানে চায়


সভাপতি আসে কোন পথে?


লোক জন সর্ব্বদায় ষ্টীমার ঘাটেতে যায়


ক্ষণে ক্ষণে আনে সমাচার।


স্বেচ্ছাসেবী কর্ম্মী যত ঘুরিতেছে অবিরত


কিবা দিবা কিবা অন্ধকার।।


সুচিত্রিত অশ্বযান ঘাটে রাখে অধিষ্ঠান


বহিয়া আনিতে সভাপতি।


সেতাগণে সারি সারি ঘাটের মঞ্চের পরি


দাঁড়াইল সবে হৃষ্ট মতি।।


হেনকালে কিছু দুরে নদীর বক্ষের পরে


দেখা গেল ষ্টীমার খানি।


দৃষ্টি মাত্রে সবে কয় ‘‘জয় সভাপতি জয়’’


বহুক্ষণ করে জয় ধ্বনি।।


ধীরে ধীরে আসি তটে ষ্টীমার বাঁধিল ঘাটে


গুরুচাঁদ নামিলেন ধীরে।


সবে দৃষ্টি করে তাঁয় অপরূপ দেখা যায়


দেখে সবে জয় ধ্বনি করে।।


নেতাগণ অগ্রসর হইলেন মঞ্চোপর


দন্ডবৎ কর নত শিরে।


প্রভুজী সুহাস হেসে অতিশয় মিষ্টি ভাষে


সবারে কুশল প্রশ্ন করে।।


মুকুন্দ বিহারী যিনি করে কর ধরি তিনি


অশ্বযানে উঠাল প্রভুরে।


প্রভু তাঁরে ডাকি লয় তাই তিনি সঙ্গে রয়


মন্থথ উঠিল একত্তরে।।


স্বেচ্ছাসেবী কর্মী যারা দুই সারি রহে তারা


সারি দীর্ঘ প্রায় বিশ রশি।


গাড়ী চলে ধীরে ধীরে দুই ধারে উচ্চেঃস্বরে


জয়ধ্বনি করে সবে আসি।।


‘‘জয় গুরুচাঁদ জয় জয় সভাপতি জয়


জয় নমঃশূদ্র জয়’’ কহে।


বিরাট মিছিল দেখি অপলকে মেলি আঁখি


নর নারী সবে চেয়ে রহে।।


এ ভাবে মিছিল করে সমস্ত শহর ঘোরে


দলে দলে ছোটে নর নারী।


ঠাকুরের নাম শুনে রূপ দেখে দু’নয়নে


প্রণাম করিছে কর জুড়ি।।


এই ভাবে কিছু পরে সভা মন্ডপের ধারে


মিছিল করিল সবে ভঙ্গ।


আশ্রয় নির্দ্দিষ্ট যথা গুরুচাঁদ চলে তখা


মুকুন্দ বিহারী নিল সঙ্গ।


এই ভাবে রাত্রি যায় পর দিন সভা হয়


সভাপতি গুরুচাঁদ হ’ল।


বঙ্গবাসী প্রধানেরা নমঃশূদ্র সবে যারা


সভামধ্যে সকলে আসিল।।


সভাপতির যে ভাষণ পড়িলেন যেই জন


নিরোদ বিহারী তাঁর নাম।


কোকিল-নিন্দিত স্বরে সে ভাষণ পাঠ করে


বসে শোনে যত গুণধাম।।


এমন সুন্দর সভা রূপে গুণে মনোলোভা


জ্ঞানী গুণী মহাত্মা-মিলন।


এর পূর্ব্বে কোন দিনে দেখে নাই কোন জনে


নমঃকুলে হেন আয়োজন।।


কোন কোন মহাত্মায় এই সবা ক্ষেত্রে রয়


সংক্ষেপেতে দিব পরিচয়।


আনন্দ সাধক যিনি বরিশালে নেতা তিনি


সভাক্ষেত্রে হইল উদয়।

আসিলেন সনাতন নেতা তিনি অন্যজন


পিরোজপুরেতে তাঁর বাস।


ষড়ানন সমাদ্দার সোহাগদলেতে ঘর


উকীল শ্রীভীষ্মদেব দাস।।


যশোহরে বাস জানি বসন্ত পন্ডিত যিনি


সঙ্গে এল আর কতজন।


আসিল যাদব ঢালী মুখে হরি হরি বলি


গুরুচাঁদে করিয়া স্মরণ।।


ঢাকার শহরে বাস শ্রীরজনী কান্ত দাস


একসঙ্গে রেবতী মোহন।


শ্রীজগত সরকার ঢাকার শহরে ঘর


ত্রিপুরার জগত মন্ডল।


আর ছিল বহুতর কত নাম কব আর


সাধ্য নহে কহিতে সকল।।


বেথুড়িয়া গ্রামে বাস যজ্ঞেশ্বর বিশ্বাস


প্রভু সঙ্গে আসিল আনন্দে।


আসিল গোপাল সাধু তারা মধ্যে যেন বিধু


ভক্ত সহ গুরুচাঁন্দে বন্দে।।


এই সম্মেলন হতে নমঃশূদ্র কোন পথে


চালনা করিবে রাজনীতি।


যাহা বলে দয়াময় সভা মধ্যে পাঠ হয়


তাতে সবে জানা’ল স্বীকৃতি।।


সেই সব নীতি কথা প্রকাশ করিব হেথা


যাহা বলে প্রভু দয়াময়।


গুরু যদি দয়া করে তবে বলা যেতে পারে


মোর সাধ্যে তাহা কভু নয়।।


‘‘নমঃশূদ্র জীর্ণ দীন বিদ্যাহীন চিরদিন


রাজা মহারাজ কেহ নয়।


নাহি জানে রাজনীতি বল কিসে হবে সাথী


উচ্চ হিন্দু যে যে পথে যায়?


অন্ন-চিন্তা ভয়ঙ্করী অন্য চিন্তা কিসে করি?


মনে মনে মরি সবে জ্বলে।


গাছের আগায় এসে যারা সুখে আছে বসে


বড় বড় কথা তারা বলে।।


সে-পথ তাদের জন্য আমাদের পথ ভিন্ন


সেই পথে সবে মোরা চলি।


ভোগ হলে জাগে ত্যাগ, কিছু নাই কিসে ত্যাগ?


‘‘ভোগ চাই’’ এই মাত্র বলি।।


বিদ্যা চাই ধন চাই বসন ভূষণ চাই


হতে চাই জজ ম্যাজিষ্ট্রেট।


সাগর ডিঙ্গাতে চাই দেখি সেথা কিবা পাই


কেন রব মাথা করে হেট?


অসহযোগের নীতি নিলে আজ মাথা পাতি


এই জাতি কভু উঠিবেনা।


চিরকাল অন্ধকারে সেই যে রহেছে পড়ে


অন্ধকার আর ঘুচিবেনা।।


অবশ্য দে্শের তবে যাঁরা প্রাণপাত করে


ধন্য তাঁরা মানব জীবনে।


দেশ-প্রীতি দেশ-সেবা কভু ঘৃণা করে কেবা?


তারতম্য রয়েছে বিধানে।।


স্বাধীনতা যদি আসে, তা হতে কি শ্রেষ্ঠ আছে?


বুঝিনা যে এত অন্ধ নই।


তবে যে নামিনা পথে, বহু বাধা আছে তাতে


এড়াইতে পারি বাধা কই?


তর্কের খাতিরে বলি অনুন্নত জাতি গুলি


এক সঙ্গে দিল যোগ দলে।


কি কাজ করিবে তারা? পাবে কোন কার্য্য-ধারা?


কিবা গিয়াছে দাঁড়াইবে ফলে?


ক’জন চাকুরে তারা? আদালতে ঘোরা ফেরা


কতজনে করিতেছে তারা?


স্কুল-ছাড়া কথা হলে বলা যায় কুতুহলে


প্রায় সবে বিদ্যালয়-ছাড়া।।

 

 

তাতে বলি এই নীতি অনুন্নত যত জাতি


তাহাদের পক্ষে নাহি খাটে।


উচ্চ উচ্চ বর্ণ যারা স্কুল আদালতে ভরা


এই নীতি তাহাদের বটে।।


কিন্তু কি আশ্চর্য্য ভাই! তারা বেশী ছাড়ে নাই


প্রায় সবে আছে চাকুরীতে।


আদালতে মোকদ্দমা নিত্য তারা করে জমা


স্কুল খোলা দেখি সর্ব্বক্ষেত্রে।।


এই সব দেখে দেখে লও ভাই সবে শিখে


কোন ভাবে চলিছে সংসার।


বুদ্ধিহীন সরলতা আর নাহি চলে হেথা


কুট-বুদ্ধি বটে দরকার।।


স্বাধীনতা কথা ভাল, নেয়া ভাল দেয়া ভাল


ভাল তাতে নাহিক সন্দেহ।


‘‘কথা মালা’’ যাহা বলে পড়িয়াছে বাল্যকালে


সেই কথা ভুলিওনা কেহ।।


বাঘের গলায় হাঁড় টেনে যদি কর বার


পুরস্কার এক মুঠা ছাই।


যত সব মহাভাগ করিতেছে আত্মত্যাগ


তোমাদের জন্যে কিছু নাই।।


শুন বলি সে প্রমাণ যত সব মতিমান


আত্মত্যাগ করিছে ভারতে।


স্বাধীনতা পাবে যবে কারা উপকৃত হবে?


সেই কথা পার কি বলিতে?


কর্ত্তা আজ যারা যারা সে দিন একত্রে তারা


রচনা করিবে শাসন তন্ত্র।


রাজাদের সে সভায় তোমাদের স্থান নয়


তোমরাত শুধু বাদ্য যন্ত্র।।


যুদ্ধকালে প্রয়োজন বাদ্য যন্ত্র অগণন


যুদ্ধ শেষে কে করে সন্ধান?


যদি থাক সেনাপতি তবে হতে পারে গতি


সেই গুণে তুমি আজ আন।।


যে যে গুণে সেনাপতি কোথা পাবে এই জাতি?


শিশু মাত্র জাগরণ-পথে।


যৌবনের পূর্ণ বেগে যারা আজ চলে আগে


তুলনা কি চলে তার সাথে?


আসিবে যৌবন যবে তোমারো সে ভাব হবে


কালগুণে চলিবে আপনি।


আজ তাতে কার্য্য নাই তাই বলি শুন ভাই


ভুলে যাও সে সব কাহিনী।।


জাতির উন্নতি লাগি হও সবে স্বার্থত্যাগী


দিবারাত্রি চিন্তা কর তাই।


জাতি ধর্ম্ম, জাতি মান জাতি মোর ভগবান


জাতি ছাড়া অন্য চিন্তা নাই।।


কিবা বিদ্যা, কিবা ধনে কিবা শিল্পে, কি বিজ্ঞানে


রাষ্ট্রনীতি ক্ষেত্রে রাজ-কাজে।


সবখানে থাকা চাই তা ভিন্ন উপায় নাই


রাজবেশে সাজ রাজ-সাজে।।


নর নারী দুইজনে প্রতি কার্য্যে প্রতিক্ষণে


তালে তালে হও অগ্রসর।


অলসতা দেও ছেড়ে বল সবে বজ্র স্বরে


‘‘আগে চল নাহি অবসর।।’’


এই বাণী সমর্থন করিলেন সর্ব্ব জন


অন্য সবে বলিলেন কত।


প্রভুর ভাষণ শুনে যত নমঃশূদ্র গণে


ধন্যবাদ করে শত শত।।


সভা ভঙ্গ হল যবে প্রভুজী ডাকিয়া তবে


বলিলেন মুকুন্দের ঠাঁই।


‘‘বাবুজী শুনন কথা কার্য্য শেষ হল হেথা


মনে করি দেশে চলে যাই।।


মুকুন্দ বিহারী তায় দেখালেন সুবিনয়


প্রভু সঙ্গে চলিলেন ঘাটে।


স্বেচ্ছা-সেবী ছিল যারা সঙ্গে সঙ্গে চলে তারা


চলে প্রভু অশ্বযানে উঠে।।

সকলে বিনয় করে প্রভুকে বিদায় করে


অতঃপর প্রভু গেল দেশে।


যবে গৃহে উপস্থিত কুসংবাদ বিপরীত


দেশবাসী জানাইল এসে।।


দূরে পদ্মবিলা গাঁয় উপস্থিত কু-সময়


মুসলমানে করিছে কল্পনা


শাস্তি দিবে নমঃশূদ্রে ফেলি চক্রব্যুহ মধ্যে


এবে বলি সেই সে ঘটনা।।

 


গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 96 যাদবের ওড়াকান্দী গমন ও শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের চতুর্ভুজ মুর্তি দর্শন

তারকের সঙ্গে সঙ্গে যাদব আসিল।


শ্রীধাম ওড়াকান্দী আসি পঁহুছিল।।


বারুণীর তীর্থক্ষেত্রে শান্তির আশায়।


দলে দলে কত লোক আসিতেছে হায়।।


দিকে দিকে শোনা যায় সোর শব্দ গোল।


আর কিছু নয় শুধু ‘‘বল হরিবোল।।’’


প্লাবনে বন্যার স্রোতে যথা বারি ধায়।


ধাম প্রতি সেই মত সবে ধেয়ে যায়।।


শ্রীধামের প্রতি যত হ’ন অগ্রসর।


গোস্বামীর ভাবে ক্রমে ঘটে ভাবান্তর।।


অবিরল নেত্র জল বক্ষ বাহি ধায়।


ভাবের তরঙ্গে যেন ঢলে পড়ে যায়।।


মনে হয় এইবার হইবে পতন।


প্রতিবারে সে যাদব করেন ধারণ।।


প্রেমের আগুণে যারা তারকের প্রাণ।


আরো জ্বলে শ্রীধামের যত কাছে যান।।


তারকের পরশনে যাদবের দেহ।


অসাড় অবশ যেন করি দিল কেহ।।


কেটে যেন গেল তার নয়নের ঘোর।


কেহ যেন কোন দুঃখে প্রাণ হ’ল ভোর।।


এই ভাবে ক্রমে তবে ধামে উপস্থিত।


যাদবের চিত্ত হ’ল প্রেমে পুলকিত।।


সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করি ধুলিতে পড়িল।


দয়া করে সে তারক তাহারে ধরিল।।


ডাক দিয়া যাদবেরে গোস্বামীজী কয়।


‘‘মানুষ দেখিবি যদি মোর সাথে আয়।।’’


এত বলি করে ধরি টানিয়া চলিল।


শ্রীগুরুচাঁদের ঠাঁই উপস্থিত হল।।


তারক সাষ্টাঙ্গে তাঁরে করিল প্রণাম।


চোখ ভরে জল তাঁর বহে অবিরাম।।


যাদব ভুমেতে পড়ি প্রণাম করিল।


আপনার অগোচরে নয়ন ঝরিল।।


মস্তক উঠায়ে যবে করে দরশন।


মহাভাবে যাদবের পূর্ণ হল মন।।


কি যে কি দেখিল তাহা বলিবার নয়।


যে দেখেছে যে বুঝেছে তাঁরে কিবা কয়।।


যাদব চাহিয়া দেখে গুরুচাঁদ কই?


চতুর্ভূজ মুর্তিধারী কেবা বসে অই।


কনক বরণ ছবি চতুর্ভুজ ধারী।


শঙ্খচক্র গাদা পদ্ম চারি হস্তে তাঁরি।।


মূর্তি দেখি যাদবের দেহে নাই বল।


অঝোরে তাঁহার চোখে ঝরিতেছে জল।।


ক্ষণমাত্র দেখা দিয়ে রূপ লুকাইল।


ফুকারিয়া সে যাদব কাঁদিয়া উঠিল।।


গুরুচাঁদ ডাকি তবে তারকেরে কয়।


‘‘সামাজিক কারে ধরে আনিলে হেথায়?’’


তারক কহিল ‘‘বাবা সকলি তোমার।


দয়া করে যাদবেরে করহে নিস্তার।।’’


গুরুচাঁদ ডাকি বলে যাদবের প্রতি।


‘‘ওড়াকান্দী মান্য করো’’ যাদব সুমতি।।’’


এই ভাবে যাদবের হল পরিচয়।


ভক্তি বলে চতুর্ভুজ মুর্তি দেখা পায়।।


বহুভাবে তাঁরে দয়া করে গুরুচাঁন।


আরে কিছু বলি আমি তাঁহার আখ্যান।

 

শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের বিরাট রূপ ধারণ

যাদব মল্লিক আর শ্রীযাদব ঢালী।


একসাথে দোঁহে মিশে হয়ে কুতুহলী।।

 

 

উভয়ে বিশেষ প্রাজ্ঞ বংশেতে প্রধান।


দুইজনে এক সঙ্গে ওড়াকান্দী যান।।


একবার ওড়াকান্দী গেল দুই জনে।


প্রণাম করিল দোঁহে প্রভুর চরণে।।


প্রভুর আনন্দ হল দেখি উভয়েরে।


বলিলেন বহু কথা তাদের গোচরে।।


তত্ত্বকথা আলাপনে কাটাইল নিশি।


প্রেমানন্দে শোনে দোঁহে আঁখি জলে ভাসি।।


প্রভাতে উভয়ে গেলে পুকুরের পাড়ে।


এক সঙ্গে চলে দোঁহে সঙ্গ নাহি ছাড়ে।।


পশ্চিম পাড়েতে দোঁহে বসে এক খানে।


পূর্ব্ব পাড়ে গুরুচাঁদ চলে নিজ মনে।।


হেন কালে সে যাদব করে নিরীক্ষণ।


পুকুরের পাড়ে কেহ ছিলনা তখন।।


সুদীর্ঘ বিরাট বাবু অতীব সুন্দর।


দীর্ঘ বাহু দীর্ঘ পদ অতি ভয়ঙ্কর।।


দৃষ্টিভ্রম ভাবি তেহ নয়ন মুছিল।


আরবার সে বিরাট বপুকে দেখিল।।


বার বার দেখি তার সন্দেহ ভাঙ্গিল।


হতজ্ঞান সে যাদব ভূমিতে পড়িল।।


যাদব মল্লিক তারে শুশ্রুষা করিল।


জ্ঞান পেয়ে সে যাদব সকলি কহিল।।


নর নহে গুরুচাঁদ বিরাট পুরুষ।


যাদব কহিল কথা যবে পে’ল হুষ।

 

শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ সর্ব্বদর্শী

যাদবের জ্যেষ্ঠ পুত্র কার্ত্তিক সুজন।


গনপতি নামে পুত্র কনিষ্ঠ যে জন।।


তারকের বরে জন্ম নাম গণপতি।


সংক্ষেপে বলিব তার জন্মের ভারতী।।


একমাত্র পুত্রে সুখী নহে তাঁর নারী।


তারকে প্রণাম করে পুত্র বাঞ্ছা করি।।


তারক যাদবে বলে ‘‘পুর্ণ বর্ষকাল।


নারী হতে দূরে থাকে থাকগে নির্ম্মল।।’’


যাদব বলিল তাহা মোটে সাধ্য নয়।


পারিব না, এই কতা বলিনু নিশ্চয়।।’’


বারে বারে শ্রীতারক বলিলেন কথা।


বারে বারে যে যাদব নাড়িলেন মাথা।।


শক্তির আধার সাধু কবি রসরাজ।


গম্ভীরে বলিল কথা যেন পড়ে বাজ।।


‘‘বারে বারে মোর কথা তুই না শুনিলি।


আচ্ছা দেখি কাম-শক্তি কত বড় বলী।।


বর্ষাকাল তোর দেহে কাম নাহি রবে।


চেষ্টা করে এইবারে দেখ গিয়ে তবে।।’’


অব্যর্থ গোস্বামী বাক্য কেবা করে আন।


বর্ষমধ্যে যাদবের নাহি কামজ্ঞান।।


এই সাধনার ফলে জন্মে গণপতি।


তার পেয়ে সুখী হল যাদব সুমতি।।


এবে শুন মূল সূত্র যাহা বলি পদে।


সর্ব্বদর্শী গুরুচাঁদ বলে কি প্রকারে?


কার্ত্তিকের পুত্র হল যাদবের সুখ।


ওড়াকান্দী যেতে মন হইল উন্মুখ।।


ঠাকুরের বাণী আছে ‘জন্মিলে নন্দন।


ইলিশ মাছ দিয়া কর সাদুর ভোজন।।


কন্যা জন্মিলে কাতলা মাছ দিতে হয়।


এই কার্য্যে পুত্র কন্যা আয়ু যশঃ পায়।।’’


সেই ভাবে ওড়াকান্দী যাদব চলিল।


চারটি ইলিশ মাছ পথেতে কিনিল।।


সঙ্গে তার দুই কাৎলা নিল মহাশয়।


মল্লিক যাদবচন্দ্রে সঙ্গে করি লয়।।


এদিকেতে ওড়াকান্দী কুটুম্ব আসিল।


চাঁদসী ডাক্তার তারা সবে জানে ভাল।।

 

প্রভুর আশ্চর্য্য লীলা নরে বোঝা ভার।


অন্তঃপুর হতে সবে কহে সমাচার।।


কুটুম্ব এসেছে বাড়ী তাতে মাছ নাই।


বড়ই লজ্জার কথা মাছ কোথা পাই?


প্রভু কয় ‘‘ওরে অন্ধ! চুপকরে থাক।


কি দিয়ে কি করে হরি বসে থেকে দেখ।।


কল্পবৃক্ষ-মূলে বসে গেলনা পিপাসা।


অবিশ্বাসী জনে দেখ নাহি মেটে আশা।।


মাছ মাছ করে সবে চিন্তা করিতেছে।


আমি দেখিতেছি যেন মাছ আসিতেছে।।


কিবা ছাই চিন্তা তোরা করিস বসিয়া।


তাঁরে ভেবে একবার থাকনা চাহিয়া।।’’


বলিতে বলিতে দুই যাদব আসিল।


ছয় মাছ এক সাথে আনিয়া ফেলিল।।


তাহা দেখি সকলের লাগিল বিস্ময়।


মনে ভাবে সর্ব্বদর্শী প্রভু দয়াময়।।


গোমস্তা শ্রীযজ্ঞেশ্বর বিশ্বাস সুজন।


একান্তে যাদবে ডাকি কহে বিবরণ।।


শুনিয়া যাদব হল প্রেমে পুলকিত।


বলে ‘‘প্রভু গুরুচাঁদ ঈশ্বর নিশ্চিত।।’’


উঠিল ভাবে ঢেউ ভক্তের হৃদয়।


ভাবে মুগ্ধ ভক্তগণ রজনী কাটায়।।


প্রভাতে চলিল প্রভু বাহিরে প্রাঙ্গণে।


নতুন একটী গৃহে হতেছে সেখানে।।


প্রভুর কর্ম্মের কেহ নিশানা না পায়।


কোন ভাবে কি যে করে নরে বোঝা দায়।।


একখানে গর্ত্ত করি কাটিলেন মাটি।


গর্ত্ত ভর্ত্তি করে পুনঃ করে পরিপাটি।।


কাটি কাটা কার্য্যে যেন পেতেন আনন্দ।


গর্ত্ত কেটে পুনরায় গর্ত্ত করে বন্ধ।।


যার যে স্ববাব তাহা ছাড়িতে না পারে।


সেইভাব বোঝা যায় তাঁর ব্যবহারে।।


স্বর্ণকাশী ছেড়ে যাঁর শ্মশানেতে বাস।


ধনরত্নে বল তাঁর মিটাবে কি আশ?


দিবারাত্রি স্রোতাকারে লক্ষ নরনারী।


দানরত্ন দ্রব্য কত আনে ভুরি ভুরি।।


দয়া করে নেয় বটে প্রভু গুরুচান।


কিন্তু কোন দ্রব্য বলে নাহি তাঁর টান।।


আপন স্বভাব যাহা তাই থাকে ধরি।


আট হস্ত মরিমিত ধূতি রহে পরি।।


আহারে বিহারে কিংবা শয়নে গমনে।


সর্ব্বত্যাগী সন্ন্যাসীর ভাব সর্ব্বখানে।।


ভাতে ভাত তার মধ্যে সিদ্ধ কিছু চাই।


পরম আনন্দে তাহা সেবেন গোঁসাই।।


প্রভু সেজে বসে তাঁর আজ্ঞা-করা নাই।


সব কাজ সব খানে দেখেন গোঁসাই।।


বাড়ী পরে যে যেখানে যেই গাছ আছে।


প্রত্যহ প্রভুজী যান সকলের কাছে।।


সকলেরে দেয়া প্রভু স্নেহের পরশ।


প্রভুর পরশে গাছ সতেজ সরস।।


কাটিকাটে কৃষাণেরা প্রভু যায় কাছে।


নিজ চোখে দেখে কাজ কেমন হতেছে।।


জগতের ভার বয় যেই পদ্ম করে।


গার্হস্থ্য গন্ডীর মধ্যে আছে তাই ধরে।।


ভাঙ্গা-গড়া খেলা যাঁর অসীম ব্রহ্মান্ডে।


গর্ত্ত কেটে গর্ত্ত ভরে গৃহ-কর্ম্ম-কান্ডে।।


এবে শুন নবগৃহে কি কান্ড ঘটিল।


যেতে যেতে প্রভু তবে যাদবে ডাকিল।।


ডাক শুনি দুইজনে শীঘ্রগতি ধায়।


অল্প পরে সেই গৃহে হইল উদয়।।


প্রভু বলে ‘‘দুইজনে কর বসে কাজ।


‘কৃষ্ণকথাকিচু আমি বলিতেছি আজ।।’’


নুতন ঘরের পোঁতা নহেক সমান।


সমান করিতে বলে প্রভু গুরুচান।।

দুই সাধু সেই কাজ করিতেছে জোরে।


প্রভু বলে ‘‘কাজ নাই জোরে কাজ করে।।


গৃহে বসে কাজ করা নাহিক অভ্যাস।


চিরকাল দোঁহে সুখে করিতেছ বাস।।


অনভ্যাসে জোরে কাজ যদি কর হেথা।


কষ্ট করে হাতে পরে হাতে পারে ব্যাথা।।


ধীরে ধীরে কাজ কর আমি বসে রই।


কাজ কর আর শোন কৃষ্ণকথা কই।।’’


দয়া দিয়ে কথা কয় দয়ার সাগর।


উভয়ের চক্ষে বারি ঝরে ঝর ঝর।।


সহানুভূতিতে-মাখা এই কৃপা বাণী।


নরনারী সকলেরে কাছে রাখে টানি।।


যত ভক্ত ওড়াকান্দী করেন গমন।


সেথা গিয়ে তারা সবে ভাবে মনে মন।।


কর্ম্ম যদি করি প্রভু নিকটে আসিবে।


হাসি হাসি কাছে বসি কত কি কহিবে।।


সে যে কি আনন্দ তাহা বলা নাহি যায়।


প্রেমানন্দে কাজ করে সকলে সদায়।।


এর মধ্যে শিক্ষা দেখ কতই মধুর।


কর্ম্মছাড়া ভাল নাহি বাসেন ঠাকুর।।


কর্ম্মী যারা ধর্ম্মী তারা বহু ভাগ্যবান।


গুরুচাঁদ বলিতেন তাহার প্রমাণ।।


‘‘কাজ যে করে সে কাজী কাজে পরিচয়।


অকেজো অলস হলে তারে পাজী কয়।।


একস্থানে এক সাধু থাকিত সদায়।


চুপ করে থাকে প্রায় কথা নাহি কয়।।


অন্য কোন কর্ম্ম নাহি করেন গোঁসাই।


কর্ম্ম মধ্যে এক কাজ দেখিত সবাই।।


ঝিনুক লইয়া হাতে সেই মহাজন।


সর্ব্বদা মৃত্তিকা তিনি করেন খনন।।


যদি কেহ প্রশ্ন করে সাধুজীর ঠাঁই।


মাটি খুঁড়ে কিবা হয় বলুন গোঁসাই?

হাসিয়া বলিত সাধু ‘‘শোন বাবা মোর।


প্রভুর রাজ্যেতে আমি কেন হব চোর?


দুইখানি হাত দিছে তিনি দয়া করে।


হাতের খাজনা দেই কিছু মাটি খুঁড়ে।।’’


কর্ম্মের প্রাধান্য লাগি এ প্রমাণ কয়।


হাতে হাতে প্রভু তার দিত পরিচয়।।


এবে শোন ‘‘কৃষ্ণ কথা’’ প্রভু যা’ কহিল।


তারকের উপাখ্যান আরম্ভ করিল।।


তারকের নিষ্ঠা ভক্তি বলিলেন সব।


শেষে ডাকি বলে প্রভু ‘‘শোন হে যাদব।।’’


তারকের মূল্য এই নমঃ নাহি জানে।


তাঁহারে চিনিত সব উচ্চ হিন্দুগণে।।


রাজা রাজচক্রবর্ত্তী যতেক সুজন।


তারকের মান্য ছিল তাঁদের সদন।।’’


এত বলি দয়াময় বলে পুনরায়।


‘‘তারকের ভক্তি ছিল লোচনের পায়।।


সুরসিক সাধু ছিল গোস্বামী লোচন।


শোন বলি আমি তবে এক বিবরণ।।


কত শক্তিধারী ছিল লোচন গোঁসাই।


শোন তবে সেই কথা আমি বলে যাই।।


একবার সে তারক গান গাহিবারে।


উপস্থিত হ’ল গিয়ে কালনা বাজারে।।


সঙ্গে তার ছিল বটে বারটী দোহার।


এক সঙ্গে উঠা-বসা একত্রে আহার।।


জলপানি লাগি দিল চিড়া পাঁচ সের।


তিন সের গুড় দিল পাকা ওজনের।।


হেনকালে উপনীত গোস্বামী লোচন।


তাঁরে পেয়ে মহাসুখী হ’ল সর্ব্বজন।।


সবে ভাবে গোস্বামীজী আজি কি কারণে?


ভিক্ষা লাগি যাবে দূরে থাকুক এখানে।।


আমাদের সঙ্গে তাঁর হইবে আহার।


তাঁরে কাছে পেয়ে হবে আনন্দ অপার।।

মনোকথা খুলে পরে গোস্বামীকে কয়।


শুনিয়া গোস্বামী হ’ল প্রীত অতিশয়।।


একজনে বলে ‘‘প্রভু করি নিবেদন।


অগ্রভাগে জল পান করুন এখন।।


যত ইচ্ছা চিড়া গুড় করুন আহার।


প্রসাদ সকলে মোরা পাব অতঃপর।।’’


হাসিয়া গোস্বামী বলে ‘‘বড়ই উত্তম।


চিড়া-যুদ্ধে দন্ত আজি দেখাবে বিক্রম।।’’


এত বলি একা একা গোস্বামী সুজন।


চিড়া গুড় সবটুকু করিল ভক্ষণ।।


অবশেষে পাত্র ধরে করে চাটাচাটি।


কোনখানে কিছু নাই সব পরিপাটি।।


হেনকালে পাকশালে অন্নাদি ব্যাঞ্জন।


দোহারেরা সবে মিলে করিল রন্ধন।।


স্থান করি কোলাবাসী ভোলানাথ ধায়।


গোস্বামীকে ডাকিবারে হইল উদয়।।


গিয়া দেখে গোস্বামীজী আপনার করে।


চাটাচাটি করিতেছে পাত্রখানি ধরে।।


বিস্মিত হইয়া ভোলা কহিছে তাঁহারে।


‘‘কিবা কার্য্য কর প্রভু পাত্রখানি ধরে?’’


সাধু কয় ‘‘ভোলানাথ যে দয়া করিলে।


বহুদিন এ-খাওয়া জোটেনি কপালে।।’’


ভোলা কয় ‘‘মহাশয় খেয়েছ কি সব?’’


লোচন হাসিয়া বলে ‘‘ক্ষিদের গৌরব।।


শোন শোন ভোলানাথ শাস্ত্রের বচন।


কিছু জমা নাহি রাখে কোন কোন জন?


সাধু আর পাখী দেখ বড়ই পবিত্র।


যাহা পায় তাহা খায় জমা নাহি মাত্র।।’’


কথা শুনি ভোলানাথ মানিল বিস্ময়।


গোস্বামীর পানে চাহি তবু ধীরে কয়।।


‘‘হয়েছে প্রস্তুত অন্ন শুনহে গোঁসাই।


ক্ষুধা যদি থাকে তবে চল গিয়ে খাই।।’’


শুনিয়া লোচন বলে হাসিয়া হাসিয়া।


‘‘ক্ষুধা নিয়ে কষ্ট কেন পাইব বসিয়া?’’


এত বলি উপনীত হল পাকশালে।


দ্রুতগতি ভোলানাথ পিছে পিছে চলে।।


পাকশালে গিয়ে তবে বলিছে গোঁসাই।


‘‘এমন সুখের দিন আর পাই নাই।।’’


সূর্য্য নারায়ণ যিনি ডুমুরিয়া বাস।


উপস্থিত হইলেন গোস্বামীর পাশ।।


হীরামন শ্রীলোচন এই দুই জনে।


‘‘মাসী’’ বলে ডাকে সদা সূর্য্য নারায়ণে।।


আনন্দে গোঁসাই ডেকে বলিল তাহারে।


‘‘আন মাসি অন্ন দেও বসিব আহারে।।


কত যে দয়াল মাসি তোমরা সকলে।


কি আর বলিব বল সেই কথা বলে।।


সুস্বাদু করেছ খাদ্য আয়োজন বেশ।


সব মোরে এনে দেও করে ফেলি শেষ।।’’


গোস্বামীর কান্ড দেখি ভোলাত অজ্ঞান।


মহা ক্রোধে বলে ভোলা ‘‘সবে সাবধান।।


এই বেটা মানুষ ত নহে কদাচন।


এই মাত্র সব চিড়া করেছে ভক্ষণ।।


মানুষের পক্ষে ইহা কেমনে সম্ভবে?


দৈত্য কি দানব হবে বুঝিলাম ভাবে।।’’


ভোলানাথে ক্রুদ্ধ দেখি গোস্বামীর সুখ।


হেসে হেসে বলে কথা করিয়া কৌতুক।।


‘‘না, না, ভোলা চিন্তা তুমি করিও না আর।


সব ভাত খেতে কষ্ট হবে না আমার।।’’


বারে বারে বলে ভোলা একি রে দুর্ভোগ।


টুন্ডারে রাখিয়া হল কপালের ভোগ।।


হেনকালে শ্রীতারক হ’ল অগ্রসর।


বলে ‘‘ভোলা আর নাহি কর কটুত্তর।।


গোস্বামীর লীলাখেলা তুমি নাহি জান।


ভক্তি ভরে ভাত ডাল সব ধরে আন।।

অতঃপর দোহারেরা মিলিয়া সকলে।


গোস্বামীর পাতে অন্ন সব দিল ঢেলে।।


অনায়াসে গোস্বামীজী খাইল সকল।


তারকের চক্ষে জল ঝরে অবিরল।।


আহারান্তে গোস্বামীজী করিল প্রস্থান।


অনাহার সে তারক তথা করে গান।।


সেদিন কেমন গান হইল তথায়।


বর্ণনা করিতে তাহা নাহি পারা যায়।।


মোহিত হইল সব সভাবাসী জন।


অপূর্ব্ব ভাবের বন্যা বহে সর্ব্বক্ষণ।।


এমনি সুকবি ছিল তারক সুজন।


তাঁর গানে মুদ্ধ হত নর নারীগণ।।


কিন্তু এক কথা আজি বলিবারে চাই।


আমিও বলিব ছড়া শুনে রাখ তাই।।


আমি যা বলিব আজ ছড়ার কাহিনী।


সে-ছড়া তারক কভু কাণেও শোনেনি।।


কিছু দেরী কর সবে আসিছে সময়।


আমার ছড়ার বস্তু আসিবে হেথায়।।’’


এত বলি দয়াময় স্তব্ধ হয়ে রহে।


উভয় যাদব স্তব্ধ কথা নাহি কহে।।


হেনকালে শোন সবে অপূর্ব্ব ঘটনা।


যাদব গোস্বামী যাহা করিল রটনা।।


এক নারী ত্বরা করি আসিয়া সেখানে।


কান্দিয়া পড়িল গিয়া প্রভুর চরণে।।


মহা ক্রোধে গুরুচাঁদ কাঁপে থর থর।


কেশে ধরে টেনে তারে করিছে প্রহার।।


প্রহার করিয়া প্রভু তারে ছেড়ে দেয়।


আরক্ত নয়নে তারে প্রভু ডেকে কয়।।


‘‘ওরে দুষ্টা, বুদ্ধি নষ্টা, আজ কান্দ’ কেন?


যার গায়ে তেল দিলে সে দুষ্টেরে আন।।


যার গুণে ছেলে পেলি তার গায়ে ছাই।


ব্যাভিচারী দুষ্টে এনে করেছ গোঁসাই।

তার গায়ে তেল দাও তারে কর সেবা।


যার ছেলে তারে তুমি পেয়েছ কি হাবা?


যার গুণে পুত্র এল তার মান্য নাই।


আসল পুত্রের কর্ত্তা পুত্র নিচ্ছে তাই।।


চলে যা পাপিনী তুই রক্ষা নাই আর।


পুত্র মরে গেলে আমি কি করিব তার?’’


প্রভুর মুখেতে শুনি এ হেন বচন।


উভয় যাদব তবে ভাবে মনে মন।।


‘‘কি কারণে করে প্রভু হেন ব্যবহার?


কোন ভাবে জানি মোরা সেই সমাচার?’’


অন্তর্য্যামী প্রভু সব জানিয়া অন্তরে।


বলিতে লাগিল কথা চাহি উভয়েরে।।


‘‘শোন দোঁহে কিবা কব এজাতির কথা?


অন্ধ জাতি কভু নাহি চেনে পবিত্রতা।।


এই যে রমণী দেখ অতীব সরলা।


নাহি বোঝে দুষ্টে করে কত ছলা কলা।।


এক দুষ্ট এর গৃহে আছে অধিষ্ঠান।


গুরু সেজে মহাসুখে সেবা পূজা পান।।


ব্যাভিচারী সেই দুষ্ট আছে সাধু বেশে।


এ পাপিনী তার সঙ্গে জল তেল ঘষে।।


তেল-ঘষা যত দুষ্ট তারা ভাল নয়।


ব্যভিচারী সেই জন জানিও নিশ্চয়।।


এই কার্য্য এই নারী করেছে যেদিনে।


পুত্র তার পড়িয়াছে বিষম তুফানে।।


জ্বররূপে কাল এসে তারে নিতে চায়।


দেখহ এখনে এসে ধরে মোর পায়।।


আমি কি করিব বল এ কোপ কালের।


তেল ঘষাঘষি কর এই তার জের।।’’


এত বলি ক্রোধে প্রভু রমনীরে কয়।


‘‘এই কথা সত্য কিনা বল এ সভায়।।


কতকষ্টে তোর স্বামী গৃহকর্ম্ম করে।


তার পায় কোন দিন তেল দিলি নারে।।

কোথাকার ভক্ত দুষ্ট কিছু ঠিক নাই।


তারে পেয়ে অনায়াসে বলেছে গোঁসাই।।


বিষ কচু তোরা যত রঙ্গিনী রমণী।


তোদের ও কান্নাকাটি কিছু নাহি মানি।।


তোমরাও শোন কিন্তু যতেক গোঁসাই।


তেল ঘষাঘষি মতে আমি কিন্তু নাই।।


ব্যাভিচারী ভেকধারী বৈরাগী যাহারা।


নাচানাচি ঘষাঘষি করে থাকে তারা।।


হরিঠাকুরের পুত্র আমি বলে যাই।


নারী দিয়ে তেল-ঘষা এই মতে নাই।।


পরনারী মাতৃজ্ঞান সম্মান দেখাবে।


কোন লোভে কোন ক্ষণে স্পর্শ না করিবে।।


আমার এ কথা-ছাড়া যারা কাজ করে।


তারা কিন্তু মতো নয় বলিনু সবারে।।


এই দোষ তারকের ঘটে একবার।


আমি তাহা দুর করি করে তিরস্কার।।


দতবধি তারকের ভ্রম ভেঙ্গে গেল।


জীবনে সে সব কর্ম্ম আর না করিল।।


সামাল, সামাল, তাই সামাল যাদব।


সামাল, সামাল হও হরিভক্ত সব।।’’


সামালের এই বাণী প্রভু চিরদিন।


উচ্চারণ করে গেছে সারা রাত্রি দিন।।


প্রভুর বচন শুনি কেন্দে বলে নারী।


‘‘যাহা বল সব সত্য দয়াময় হরি।।


সেই ব্যক্তি দুষ্ট আমি তাহা বুঝি নাই।


দয়া করে কর ক্ষমা এই ভিক্ষা চাই।।


এক দিন তার অঙ্গে তৈল মাখিয়াছি।


এখনে বুঝিয়া দেখি অন্যায় করেছি।।


আর না করিব প্রভু হেন মন্দ কাজ।


দয়া করে এ বিপদে রক্ষা কর আজ।।’’


প্রভু কয় ‘‘নয়, নয়, শুধু মাপ নয়।


মাপ নিতে গেলে তার কাজ দিতে হয়।।


আমি যাহা বলি যদি পারিস তা করতে।


নিশ্চয় পুত্রকে তোর দেবনা মরতে।।


এক্ষুণি চলে যা বাড়ী না ছেড়ে নিরিখ।


আমি যাহা বলে দেই মনে রাখ ঠিক।।


বাড়ী গিয়ে ঝাঁটা নিয়ে ভন্ড তপস্বীরে।


বেদম মারিবি ঝাঁটা দুই হাতে ধরে।।


মার খেয়ে ভন্ড যদি পালাইয়ে যায়।


তারঘাড়ে উঠে জ্বর পালাবে নিশ্চয়।।’’


প্রভুর বচন শুনি সাহস আসিল।


শীঘ্র গতি গৃহ প্রতি সেই নারী গেল।।


উভয় যাদব তাহে উচাটন মন।


কি জানি কি ঘটে তার নাহি নিরুপণ।।


উভয়ের দিকে চাহি প্রভু হাসি কয়।


‘‘কি মধুর কৃষ্ণকথা শুনিলে হেথায়?’’


যাদব কান্দিয়া কয় ‘‘দয়াল আমার।


হে কৃষ্ণকথা কভু শুনি নাই আর।।


কি কি কৃষ্ণ করে গেল এই মা্ত্র শুনি।


কিছু মাত্র চোখে তার কখন দেখিনি।।


হাতে হাতে ফল দিলে সর্ব্বফল দাতা।


এর চেয়ে কি শুনিব আর কৃষ্ণকথা?’’


এই ভাবে দিন কেটে রজনী আসিল।


নাম গানে মতুয়ারা আনন্দে ভাসিল।।


পরদিন অতি প্রাতেঃ এল সেই নারী।


অঝোরে ঝরিছে তার দুই চোখে বারি।।


প্রণাম প্রভুর পায় বলিছে কান্দিয়া।


‘‘তোমার দয়ায় বাবা এসেছি ফিরিয়া।।


তোমার আজ্ঞার মতে করিয়াছি কাজ।


জ্বর ছেড়ে গেছে রাত্রি, খোকা ভাল আজ।।’’


প্রভু কয় ‘‘যা চলে যা’’ আর ভয় নাই।


আর যেন রাখিস নারে ওসব গোঁসাই।।’’


উভয় যাদব হ’ল বিস্মিত তখন।


অশ্রুভরা চোখে দেখে প্রভুর চরণ।।

সর্ব্বদর্শী গুরুচাঁদ সব কিছু দেখে।

মায়া জালে মহানন্দ আপনারে ঢাকে।।

ভক্ত শ্রীযাদবচন্দ্র মল্লিকের উপাখ্যান

যশোহর জিলাধীনে পদুমা নিবাসী।


প্রিয় ভক্ত যাদবের বহু গুন রাশি।।


মল্লিক উপাধি তাঁর অতি মহাশয়।


অনুক্ষণ হরিনাম করিয়া বেড়ায়।।


তাঁহার পিতার নাম শ্রীচন্ডি চরণ।


ঠাকুরের কৃপা পেল শোন কি কারণ।।


যেই কালে হরিচাঁদ অবতীর্ণ হয়।


সাহেবের নীলকুঠী ছিল সে সময়।।


নীল চাষ কার্য্যে লাগে বহুৎ মজুর।


মনে মনে ভাবে তাই ইংরাজ চতুর।।


দেশমধ্যে বেছে নেয় যতেক প্রধান।


তারা সবে করে দেয় মজুর চালান।।


অবশ্য অর্থের প্রম্ন আছে তাতে কিছু।


সর্দ্দরের চারি আনা মজুরের পিছু।।


এ জগতে একভাব দেখি সর্ব্বদায়।


চোরা-ব্যবসায় চুরি সবখানে রয়।।


সাহেব করিয়া চুরি ফাঁকি দিতে চায়।


সর্দ্দার শিখিয়া চুরি ব্যবসা চালায়।।


জমিদার গোমস্তারে কি দেয় বেতন?


তিন টাকা মহিনায় ভরণ পোষণ।।


কি ফল দাঁড়ায় তাতে সবে ভাল জানে।


প্রজাকে লুটিয়া খায় নায়েব কখনে।।


ব্যবসায়ী আর তার যতেক দালাল।


গরীবেরে লুটে খেয়ে করে পয়মাল।।


নীল চাষে নাহি ছিল এই ভাব ছাড়া।


মজুরের স্কন্ধে সব ‘‘সুখের পায়রা।।’’


সর্দ্দার দালাল হ’ল চন্ডী একজন।


ডানলপ সাহেবের খাইত বেতন।।


নদীয়া জেলায় মধ্যে সে কৃষ্ণনগর।


মজুর চালান হত মাস মাসান্তর।।


অগ্রিম আনিত টাকা মজুরের লাগি।


বিশ বলে দশ দেয় সাথে রেখে ভাগী।।


যেই দামে টাকা আনে সাহেবের কাছে।


অর্দ্ধ দামে লোক দিয়ে চুরি করে পাছে।।


পঞ্চাশজনের লাগি আনে শত টাকা।


পঞ্চাশে পঞ্চাশ দিয়ে বাকী মারে ফাঁকা।।


ইহা ছাড়া লোক পিছু চারি আনা আছে।


মোট কথা যত টাকা অর্দ্ধ তার বাঁচে।।


এসব চুরির কান্ড সাহেব জানে না।


পাছ দিয়ে হাতী গেলে চেয়েও দেখে না।।


পাপের বেসাতী বল কয়দিন চলে।


‘‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’’ শাস্ত্রে তাই বলে।।


একবার টাকা নিয়ে ভাগীদের সাথে।


চন্ডীর বিবাদ হ’ল নানাবিধ মতে।।


বন্ধু যারা শত্রু তারা হ’ল একদিনে।


জানা’ল চুরির কথা সাহেবের স্থানে।।


সাহেব জানিয়া তাতে হইল আগুন।


ফৌজদারী করে দিল বিচার দরুণ।।


গুরুতর অপরাধ আইনেতে লেখা।


অগোচরে ফাঁকি দিয়ে নেয়া হ’ল টাকা।।


জেলের হুকুম তাতে হইবে নিশ্চয়।


অন্ধকার দেখে চন্ডী নাহিক উপায়।।


বিপদে বান্ধব বল কেবা হ’বে তার?


সম্মুখে দেখেছি চন্ডী অকুল পাথার।।


মৃত্যুঞ্জয় গোস্বামীজী ওড়াকান্দী যায়।


কালীনগরীতে বাস করে সে সময়।।


পদুমা কালীনগর গ্রাম পাশাপাশি।


চন্ডী উদয় হ’ল কালীনগর আসি।।

 

মনোব্যাথা কহিতেছে মৃত্যুঞ্জয় ঠাঁই।


মৃত্যুঞ্জয় বলে ‘‘চল ওড়াকান্দী যাই।।


হরি বিনে বন্ধু নাই বিপদের কালে।


চল দেখি দয়াময় কোন কথা বলে।।’’


বিপদ এমন করে কিবা চমৎকার।


বিপদের কালে নাহি থাকে অহঙ্কার।।


চিরকাল চন্ডী করে ম’তোদের ঘৃণা।


বিপদে পড়িয়া মনে সে ভাব আসে না।।


মান ফেলে চলে চন্ডী মনে অতি ভয়।


কি জানি কি হরিচাঁদ কোন কথা কয়।।


নানা কথা মনে ভাবি সে চন্ডীচরণ।


উপনীত ওড়াকান্দী বিষাদিত মন।।


প্রভুর নিকটে রাখে কিছু জরিমানা।


প্রভু বলে ‘‘ঐ টাকা আমিত নেবনা।।


গরীবেরে ফাঁকি দিয়ে আনিয়াছ টাকা।


ওটাকা নিরেট নয় ওর মধ্যে ফাঁকা।।’’


কথা শুনি সে চন্ডীর দুঃখ হ’ল মনে।


অমনি লোটায়ে পড়ে প্রভুর চরণে।।


কা্ন্দিয়া কান্দিয়া কহে ‘‘ওহে দয়াময়।


অপরাধ ক্ষমা করে করহে উপায়।।’’


প্রভু কয় ‘‘ওই কথা বল কিসে হয়।


মাপ দিলে দিতে পারি কি দিব উপায়?


তবে বলি এই দোষে মুক্তি পেতে চাও।


যারা যেই টাকা পাবে তারে তাই দাও।।


তাতে যদি তারা সুখী হয় তবোপরে।


উপায় মিলিবে তাতে বলিনু তোমারে।।’’


চন্ডী বলে ‘‘টাকা নাই খরচ হয়েছে।


নিশ্চই বুঝিনু শাস্তি এ কপালে আছে।।


শুনেছি তোমার নামে মরা বেঁচে যায়।


এ মরা বাঁচায়ে নহ ওগো দয়াময়।।’’


প্রভু কয় যাও তবে কোন ভয় নাই।


রক্ষা হবে বটে কিন্তু মতো হওয়া চাই।।


আর এক কাজ তুমি অবশ্য করিবে।


সকলের কাছে তুমি মাপ চেয়ে লবে।।


মতুয়া ডাকিয়া গৃহে কর হরিনাম।


সাধু যদি মাপ করে মিলে মোক্ষধাম।।’’


প্র্রভুর আশ্চর্য্য লীলা কিছু নাহি বুঝি।


পাপীকে তরাতে প্রভু সর্ব্বকালে রাজী।।


প্রভুর আদেশ মত চন্ডী সব করে।


সংবাদ পাইল চন্ডী কিছুদিন পরে।।


আপনা হইতে দাবী সাহেব তুলেছে।


আর পাঁচ শত টাকা পুরস্কার দেছে।।


ইহার কারণ যাহা হ’ল লোকাচারে।


সেইটুকু বলিমাত্র সভার ভিতরে।।


সেইবারে সাহেবের বহুলাভ হ’ল।


লাভ দেখে মহাসুখে চন্ডীকে ছাড়িল।।


সকলের পিছে কিন্তু হরির করুণা।


বুদ্ধিমান মোরা যারা সে সব মানিনা।।


সেই হতে চন্ডী হল মতুয়া সুজন।


পাপচারী ব্যবসায় না করে কখন।।


তার পুত্র সে যাদব বহু নিষ্ঠাবান।


ওড়াকান্দী বলে সদা কান্দে তাঁর প্রাণ।।


গৃহেতে বিবাদ করে গেল ওড়াকান্দী।


প্রভুর চরণে গিয়ে পড়িলেন কান্দি।।


প্রভু বলে ‘রে যাদব এই বাড়ী থাক।


আমার পালের গরু সব তুই রাখ।।’’


আজ্ঞা পেয়ে সে যাদব ওড়াকান্দী রয়।


মহাপ্রভু হরিচাঁদ দেহ ছেড়ে যায়।।


বহু স্নেহ গুরুচাঁদ করিতেন তাঁরে।


আপন বাড়ীর লোক ভাবে সদা তারে।।


কিছুকালে পরে সাধু নিজ বাসে যায়।


ঠাকুরের নাম লয়ে ঘুরিয়া বেড়ায়।।


যাদব ঢালীর সঙ্গে বহু প্রীতি ছিল।


বহু স্থানে দুই জনে নাম প্রচারিল।।

পবিত্র চরিত্র সাধু অহঙ্কার নাই।


তাঁর কৃপা পেয়ে ধন্য নকুল গোঁসাই।।


গুরুচাঁদ তাঁরে বড় বাসিতেন ভাল।


হরি কথা উচ্চারণে আঁখি ছল ছল।।


ভ্রমণের জন্য প্রভু পশ্চিমেতে যায়।


অবশ্য উদয় হত গ্রাম পদুমায়।।


এসব পবিত্র সাধু দেশের গৌরব।


কোন দিনে নাহি ম্লান হবে সে সৌরভ।।


যাদব মল্লিক ধন্য পবিত্র গোঁসাই।


সাধুর চরণে আমি প্রণাম জানাই।।

 



 

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 95 শ্রীমৎ যাদব চন্দ্র গোস্বামীর জীবন কথা

ধন্য শ্রীযাদবচন্দ্র গোস্বামী সুজন।


নত শিরে কর জোড়ে বন্দিনু চরণ।।


রসরাজ শ্রীতারক যাঁরে কৃপা করে।


মোর শক্তি নাহি তাঁর গুণ বর্ণিবারে।।


যশোহর জিলা মধ্যে কালিয়া থানায়।


লোহারগাতীর গ্রামে শুভ জন্ম হয়।।


বার শত আশি সাল মাসেতে কার্ত্তিক।


শুভ ক্ষণে জন্ম হ’ল জ্ঞানের প্রতীক।।


নমঃশূদ্র কুলে জন্ম বংশেতে প্রধান।


ঢালী বংশ অবতংস অতি গুণবান।।


বাল্যকালে বাংলা মতে করে অধ্যয়ন।


বড়ই মেধাবী ছাত্র যাদব সুজন।।


যাহা শুনে যাহা পড়ে সব মনে থাকে।


‘শ্রুতিধর’ বলি তারে ছাত্রগণে ডাকে।।


বাংলা শিক্ষা শেষ হলে সেই মহাভাগ।


বিদ্যা শিক্ষা পাঠ তবে করিলেন ত্যাগ।।


পিতার আদেশে তেঁহ সংসারে পশিল।


বুদ্ধি গুণে অল্প দিনে উন্নতি করিল।।


বয়সে যুকব বটে জ্ঞানেতে প্রবীণ।


জ্ঞানী বলি মান্য তাঁর আছে চিরদিন।।


এই ভাবে যবে চলে সেই মহাশয়।


শ্রীতারকচাঁদের নাম শুনিবার পায়।।


কালিয়া নামেতে গ্রাম বেশী দূরে নয়।


তথাকারে রসরাজ হলেন উদয়।।

 

যাদব চলিল তথা পরম কৌতুকে।


ইচ্ছা তার গান শোনে মনের পুলকে।।


গান শুনি মূর্ছাশো গেল যাদব সুজন।


ধীরে ধীরে পরে গৃহে করিল গমন।।


বারশ চুরানব্বই সালের ঘটনা।


কালিয়ায় গান করে তারক রসনা।।


উদাস হইল চিত্ত শান্তি কিছু নাই।


তারকেরে মনে করে সদা ছাড়ে হাই।।


কি গান করিল কবি হরিল পরাণ।


বেদনায় বুক ফাটে চোখে বহে বান।।


বয়সে কিশোর মাত্র চেনে না সংসার।


বিধির নির্ব্বন্ধে স্কন্ধে এল সব ভার।।


বার শ’ পচানব্বই সালে পিতা তার।


নাবালক পুত্র রেখে গেল ভবপার।।


সংসারের বোঝা সাধু নিল নিজ শিরে।


নাবালক ভাই গণে পালে যত্ন করে।।


যার যে মানুষ তার চেনা আছে আগে।


চেনা জনে চিনিতে বা কতক্ষণ লাগে।।


অক্ষয়, তারক আর বহু ভক্তগণ।


লোহারগাতীর গ্রামে করে আগমন।।


ভাবময় ভাবুকেরা ভাবে মত্ত রয়।


ভাব দিয়ে ভাব করে ভাবে টেনে লয়।।


তারক এসেছে শুনে যাদব ছুটিল।


রবি-রশ্মি পেয়ে যেন কমল ফুটিল।।


ত্বরা করি উপস্থিত হ’ল সেইখানে।


দেখে গিয়ে গোস্বামীর মত্ত নাম গানে।।


নাম গান সাঙ্গ হ’ল এমন সময়।


যাদব প্রণাম করে তারকের পায়।।


নবীন শ্যামল কান্তি বয়সে তরুণ।


তারে দেখি গোস্বামীর চিন্তার উদয়।


এ হেন কিশোর মুর্ত্তি ছিল বা কোথায়?


শুধু দৃষ্টি করে প্রভু কথা নাহি কয়।


প্রাণে প্রাণে আকর্ষণ করিল তাহায়।।


যাদব চাহিয়া দেখে করুণ নয়নে।


শ্রীতারক দৃষ্টি করে চেয়ে তার পানে।।


কি যেন মোহিনীভরা দৃষ্টি চোখে তাঁর।


তাহা দেখে যাদবের জ্ঞান নাহি আর।।


কালিয়ার স্মৃতি প্রাণে জাগিয়া উঠিল।


সহসা যাদব চন্দ্র পলাইয়া গেল।।


বিদায় হইয়া গেল তারক গোস্বামী।


যাদব ভাবিল মনে ‘‘কি করিলাম আমি।।’’


পূর্ব্ব হতে তার মন উদাসী সাজিল।


উদাসীর মনে ব্যথা দারুণ বাজিল।।


কি দিয়ে ভুলা’ল মোরে তারক সুজন।


দেহ ফেলে গেছে চলে বুঝি মোর মন।।


দিবা নিশি হা হুতাশ জাগিতেছে প্রাণে।


কোথা গেলে শান্তি পাব কিছুত বুঝিনে।।


শাস্ত্রে বলে ‘‘ধর্ম্ম বিনে কোন শান্তি নাই।


বৈষ্ণব সাজিয়া দেখি যদি শান্তি পাই।


এত ভাবি সে মহাত্মা বৈষ্ণব আচারে।


একাদশী উপবাস, মালা জপ করে।।


দুই লক্ষ জপ করে একাদশী দিনে।


আহারেতে নিরামিষী তৈল নাহি স্নানে।।


এত যে কঠোর নীতি পালিছে সদাই।


কিমাশ্চর্য্য! প্রাণে মাত্র বিন্দু শান্তি নাই।।


কালিয়া সমাজে ভক্ত বহু বৈদ্য গণ।


সেই সঙ্গে সে যাদব করিল মিলন।।


শ্রীশবাবু নামে ছিল ভক্ত একজন।


বেন্দা গ্রামে গুরুনাথ সেনের ভবন।।


ইহাদের কাছে তেঁহ বলে মনোকথা।


‘কি ভাবে ঘুচাই বল মরমের ব্যথা?’’


তারা বলে ‘‘সুধা মাখা জানি হরি নাম।


সুধা মাখা হরিনাম কর অবিরাম।।’’

 

মনের মানুষে মন হয়েছে যাঁহার।


ব্রতচারে হরিনামে কি করিবে তার?


মন-মানুষের সাথে দেখা যদি হয়।


মনের বেদনা তার সব দূরে যায়।।


তারক হরেছে মন চখের পলকে।


সে বিনে মনের ব্যথা আর ঘুচায় কে?


বৈষ্ণব আচারে চলে হরিনাম করে।


তারকের রূপ কিন্তু ভাসিছে অন্তরে।।


যে যাহারে চিন্তা করে সে যে তার চায়।


চিন্তা-বেড়ি পায়ে দিয়ে কাছে টেনি লয়।।


মাতালের দশা যাহা বসে মদ খায়।


মদের নেশার তলে সব ভুলে রয়।।


নেশা ছুটে গেলে পুনঃ বুকে বাজে ব্যথা।


বারে বারে খায় মদ শান্তি নাহি কোথা।।


যাদবের ভাব হ’ল তেমতি প্রকার।


শান্তি নাই তবু হরি বলে বারে বার।।


এ গ্রাম সে গ্রাম সদা করে সংকীর্ত্তন।


কোনরূপে নাহি শান্ত হ’ল তার মন।।


হেনকালে একদিন এক মহোৎসবে।


আসিল তারকচন্দ্র মত্ত মহাভাবে।।


মহোল্লাসে ভক্তগণে করিছে কীর্ত্তন।


তার মধ্যে শ্রীতারক করিছে নর্ত্তন।।


কিবা সে সোণার নৃত্য কহনে না যায়।


সোণার পুতুল যেন নাচিয়া বেড়ায়।।


সারাঅঙ্গ দিয়ে যেন ভাব উঠে লুটে।


ভাবের বাজার যেন নিয়েছে সে ফুটে।।


মহাভাবে কীর্ত্তনেতে নাচিছে গোঁসাই।


নাচিছে কি কি করিছে কোন সঙ্গা নাই।।


এমন মোহন নৃত্য দেখিল যাদব।


নয়নে পলক নাই মুখে নাই রব।।


নর্ত্তন দেখিয়া মন পাগল হইল।


কোন কিছু না বলিয়া গৃহে ফিরে গেল।

গোস্বামী যতই তারে ধরিবারে চায়।


যাদব পলায় ছুটে ধনা নাহি দেয়।।


দেহ নিয়ে যায় বটে মন পড়ে থাকে।


মনে হয় মনে মনে কেহ যেন ডাকে।।


এবারে পাগল মন কথা নাহি শুনে।


দিবানিশি পড়ে থাকে তারকের ধ্যানে।।


কোথা গেলে তাঁর সাথে হইতে মিলন।


দিবানিশি যাদবের চিন্তা সর্ব্বক্ষণ।।


ভবানীপুরের গাঁয় আনন্দ মন্ডল।


তারকের পদাশ্রিত ভাবের পাগল।।


তার বাড়ী মহোৎসব করে আয়োজন।


আনন্দ যাদবে তাই করে নিমন্ত্রণ।।


মহানন্দ গোস্বামীজী তারক অক্ষয়।


মহোৎসবে উপনীত তিন মহাত্মায়।।


যাদব সাষ্টাঙ্গ গিয়ে করে প্রণিপাত।


শ্রীতারক শিরে তাঁর রাখিলেন হাত।।


চোখে চোখে মনে মনে চিনাচিনি আছে।


বাক্য ছলে পরিচয় হ’ল তাই পাছে।।


তারক শুনিল তার সব পরিচয়।


বহু যত্নে সমাদরে নিকটে বসায়।।


ভোজনের কালে তারে নিকটে বসা’ল।


নিজ হস্তে তার পাতে পায়সন্ন দিল।।


প্রসাদ পাইয়া ধন্য হইল যাদব।


চিত্তে শান্তি হ’ল তার গেল সব ক্ষোভ।।


আচার বিচার তত্ত্ব সকলি ছাড়িল।


দিনে দিনে অনুরাগ প্রাণেতে বাড়িল।।


যে যেখানে শ্রীতারক করেন গমন।


নিজ হতে যাদবেরে ডাকে সর্ব্বক্ষণে।।


গোস্বামীরে ভালবাসে তাঁর কাছে যায়।


ওড়াকান্দী কিবা আছে নাহি জানে হায়।।


যাদবেরে বারেবারে গোস্বামী কহিল।


‘‘আমার সঙ্গেতে তুমি ওড়াকান্দী চল।।’’

যাদব কহিল ‘‘ওড়াকান্দী কিবা আছে?


যাঁর কাছে ছিল ধন সেত চলে গেছে।।’’


তারক বলিল ‘‘হেন বাক্য পুনরায়।


কোন দিনে যেন তুমি বলো না মশায়।।


ওড়াকান্দী কি যে আছে কিবা তার বলি।


আমি বলি ওড়াকান্দী আছেত সকলি।।


বিশ্বাস করিয়া তুমি যাও একবার।


নিজ চোখে দেখা পেলে যাবে অন্ধকার।।’’


মনের সন্দেহ তার তবু নাহি গেল।


হেন কালে তার এক পুত্র জনমিল।।


পুত্র জন্ম পরে তার পবিত্রা রমণী।


‘‘গ্রহণী’’ রোগের চাপে পড়িলেন তিনি।।


ওঝা বৈদ্য ডাক্তারাদি দেখালেন কত।


কোন ক্রমে রোগে নাহি হ’ল প্রশমিত।।


হেনকালে শোনা গেল পাইকপাড়ায়।


‘‘হরি ঠাকুরের বার’’ হয়েছে উদয়।।


বিশ্বেশ্বর নামে এক ব্রাহ্মণ সুজন।


তার দেহে ‘বার’ নাকি করে আগমন।।


রোগী মাত্রে কাছে গেলে রোগে শান্তি পায়।


যাদব পত্নীকে লয়ে তার কাছে যায়।।


যে সব বিধির কথা বলিল সেজন।


কতদিন সেই বিধি করিল পালন।।


ঈষৎ কমিয়া রোগ আর নাহি কমে।


দিনে দিনে ক্ষীণ তনু হ’ল ক্রমে ক্রমে।।


হেনকালে একদিন শ্রীতারক চন্দ্র।


লোহারগাতীতে এল যেন পূর্ণ চন্দ্র।।


যাদবের গৃহে গিয়া দেখিল যখন।


রোগে ভোগে পত্নী তার মলিন বদন।।


তাহা দেখি তারকের দয়া হ’ল মনে।


যাদবে ডাকিয়া বার্ত্তা কহিল তখনে।।


‘‘জননীরে একেবারে ফেলিল মারিয়া।


তোমার কেমন প্রাণ পাইনা ভাবিয়া।।


কোথা যাও কিবা কর নাহি পাও দিশে।


‘বার’ ধরে রোগ সারে বুঝিলে তা কিসে?


ছেড়ে দেও গন্ডগোল কাজে কাজী হও।


বারে বারে বলি আমি ওড়াকান্দী যাও।।’’


এত বলি গোস্বামীজী বিধান কহিল।


সে বিধান মেনে পরে রোগ সেরে গেল।।


বিস্মিত যাদব তাই ভাবিলেন মনে।


‘ওড়াকান্দী যেতে প্রভু মোরে বলে কেনে।।


ওড়াকান্দী কিবা আছে কিছু নাহি জানি।


একমাত্র গোস্বামীরে গুরু বলে মানি।।


বারে বারে ওড়াকান্দী মোরে যেতে কয়।


ঠাকুরের সঙ্গে মোর নাহি পরিচয়।।


কি জানি কি কোন ভাবে কি বলে ঠাকুর।


আমার মনেতে তাই সন্দেহ প্রচুর।।


তবে যদি দয়া করে প্রভু সাথে লয়।


কোনখানে যেতে আমি নাহি পাই ভয়।।


এত ভাবি সে যাদব চুপ করে রয়।


কিছুদিন পরে শুন কি ঘটনা হয়।।


বারুণীর কিছুদিন পূর্ব্বভাগে বটে।


তারক গোস্বামী একা আসিলেন হেঁটে।।


লোহারগাতিতে আসি হইল উদয়।


সেইক্ষণে ডাক দিয়া যাদবেরে কয়।।


‘‘শুন হে যাদব! তুমি আমার বচন।


মোর সাথে ওড়াকান্দী করহে গমন।।


বারুণীর কালে আমি এ পথে আসিব।


আমার সঙ্গেতে তোমা নিশ্চয় লইব।।’’


যাদব স্বীকার করে গোস্বামীর ঠাঁই।


তার সঙ্গে ওড়াকান্দী যেতে বাধা নাই।।


তারকের সাথে পরে সে যাদব গেল।


এবে শুন ওড়াকান্দী গিয়া কি দেখিল?