Saturday, July 25, 2020

হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের বাণী ও কর্ম কি শুধু নমঃদের জন্য?

 

    

এক সময়ের বুদ্ধের ভারতবর্ষ, বর্তমানে ব্রাহ্মণ্যবাদের ভারতবর্ষে পরিনত হয়েছে। কারণ,  ব্রাহ্মণ্যবাদের মূলনীতি দাঁড়িয়ে আছে জাত ব্যবস্থার উপর। এই জাত ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ সবার উপরে আর বাকীরা স্টেজ বাই স্টেজ নিচে। যেটা ব্রাহ্মণ্যরাই বানিয়েছে।

    ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বা সাহিত্য ক্ষেত্রে বা অন্য যেকোন ক্ষেত্রে যখন পারদর্শিতার উল্লেখ করতে হয়, তখন তাকে বলা হয় ‘দলিত’ নেতা বা নেতৃ, দলিত সাহিত্যিক (যদিও দলিত শব্দটি অসাংবিধানিক।  সাংবিধানিক শব্দ তফশিলী জাতি, যেটা কেউ আর না বলে পারলে বলে না) ।  কারণ, এরকম সর্বক্ষেত্রে চলছে। অর্থাৎ আপনি যেখানেই জাবেন, জাত আপনার পিছু ছাড়বে না। আর এটা তফশিলীদের ক্ষেত্রেই বেশি প্রযোজ্য হয়। তবে ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে কিন্তু সর্বভারতীয় কথা বা এই ধরণের কথা ব্যবহৃত হয়।

     যে বাবা সাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকর এত বড় বিদ্যান হওয়া সত্বেও তাঁকে পন্ডিৎ বলা হয়না। পন্ডিৎ কে? না, ব্রাহ্মণ হলেই পন্ডিৎ। বাবা সাহেব দেশের জন্য যে সংবিধান রচনা করেছেন- সেই সংবিধানের সুবিধা সমগ্র সরকারী চাকরিজীবীরা ও মহিলারা ভোগ করছেন; এবং  সেটা উচ্চবর্ণের লোকেরাই বেশির ভাগ। তবুও কিন্তু বলার সময় বলা হয় তিনিও নাকি দলিত নেতা। তিনি দলিতদের জন্য সব সুবিধা দিয়েছেন সংবিধানে। এরকম কথার বহু উদাহরণ আছে।   

 

     তবে এই একই ধরণের গন্ডীবদ্ধতা দেওয়া হচ্ছে মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুর ও শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রদূত গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রতি। এই মহামানব দ্বয় নাকি শুধুমাত্র নমঃ(শূদ্র)দের জন্যই কাজ করেছেন। একটা কথ মনে রাখা দরকার যেকোন মহামানবের কর্মধারা সকলের কল্যানের জন্যি সাধিত হয়।

   এবার আমরা বিশ্লেষণ করে দেখি, এই মহামানব দ্বয়ের কর্মধারা কি শুধু নমঃদের জন্য? নাকি

সার্বজনীন?

     প্রথমেই আলোচনা করা যাক, হরিচাঁদ ঠাকুরের কর্ম ও বাণী প্রসঙ্গে-

    তারক সরকার রচিত শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত কাব্য গ্রন্থ থেকে এক এক করে উধৃতি তুলে ধরছি।

প্রথমেই আসি হরিচাঁদ ঠাকুরের সমগ্র জীব ও মানব জাতির উদ্দেশ্যে বলা বাণীটি বিশ্লেষণে-

জীবে দয়া নামে রুচি, মানুষেতে নিষ্ঠা।

ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।। -শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ নং ১১

তিনটি বাণীকে তিনি তুলে ধরছেন এই মহাবাণীর মধ্যে দিয়ে।

এক-জীবে দয়াঃ- অর্থাৎ সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের প্রতি দয়াশীল হ’তে হবে। একটা গাছ লাগালে তাকে প্রত্যেক দিন জল দিতে হবে, তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। অর্থাৎ তাকে লালন পালন করতে হবে। প্রাণী জগতের দিন দুঃখীর প্রতি যত্নবান হতে হবে। তাদের দুঃখ মোচনের কাজে নিজেকে নিবৃত থাকতে হবে।

দ্বিতীয়- নামে রুচিঃ- এই নাম শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘নাম’ মানে হরিনাম কৃষ্ণনাম নয়। এখানে নাম শব্দটির অর্থ হচ্ছে-বিজ্ঞান। মানে বিশেষ জ্ঞান। আর রুচি-মানে অনুরাগ। অর্থাৎ একত্রে নামে রুচি কথাটির অর্থ হচ্ছে- বিজ্ঞানের প্রতি অনুরক্ত হওয়া। যে বিশেষ জ্ঞানকে ধারণ করে মানুষ অতি প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান কালেও যাকিছু সহজ সুন্দর সেটাকে  উপভোগ করতে পারছে। হরিচাঁদ ঠাকুর সেই জীবের প্রতি ভালবাসা, বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগ করতে বলেছে।

 আর তৃতীয়- মানুষেতে নিষ্ঠা- অর্থাৎ মানুষের প্রতি ভালবাসা, বিশ্বাস রাখা। তাকে আপন করে নেওয়া। তার সঙ্গে কোন ভেদাভেদ না করা।

আর এই তিনটি অমোঘ বাণী ব্যতিরেকে সব কিছুকে তিনি ভ্রষ্ঠ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর এই ভাবনার মধ্যে কোন বিশেষ জাতির প্রতি নির্দেশ আছে কি? নাকি তিনি সমগ্র মানব জাতির প্রতি এই অমোঘবাণী তুলে ধরেছেন?

আর একটা কথা হরিচাঁদের এই অমোঘ বাণীর প্রায় ৭০ বছর পরে বিবেকানন্দ বলেছেন-

জীবে প্রেম করে যে জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।


তো এই বিবেকানন্দের কথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেলেও হরিচাঁদের বাণীকে কেন বদ্ধ করে রাখা  হয়েছে? আর হরিচাঁদ ঠাকুর যখন প্রায় ৭০ বছর আগে এই কথা বলেছেন, সে কথার কেন প্রচার পায়নি?  

হরিচাঁদ ঠাকুরের আর একটা বাণীকে আমরা দেখি-

সর্ব্ব ধর্ম্ম লঙ্ঘি এবে করিলেন স্থূল।

শুদ্ধ মানুষেতে আর্তি এই হয় মূল।। -শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ নং ১১

এখানে হরিচাঁদ কি ঠাকুর বোঝাতে চেয়েছেন? সমস্ত ধর্মকে লঙ্ঘন করে এসে তিনি নির্ণয় গ্রহণ করলেন যে, মানুষের প্রতি ভালবাস হচ্ছে মূল। সব ধর্মের উর্ধে হচ্ছে মানব ধর্ম। সেটাই সবার সেরা ধর্ম।

এর পর তিনি বলেছেন-

নীচ হয়ে করিব যে নীচের উদ্ধার।

অতি নিম্নে না নামিলে কিসের অবতার।।-শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ ১৫  

যে ব্রাহ্মণী বিষমতার ব্যবস্থা মানুষকে জন্মগত কারণে উচ্‌ নীচ্‌ বানিয়েছে। যে নীচ্‌ মানুষদের সমস্ত মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে পশুর পর্যায়ে নামিয়ে রেখেছে; সেই নিপীড়িত মানুষদের উদ্ধার করার জন্য তো আমাকে নীচে নেমেই তাদের উদ্ধার করতে হবে। সেটা যদি করতে না পারা যায়, তাহলে আর কিসের মানবতা? এখানে এই নিপীড়িতদের উদ্ধারের যে আর্তি সেটা কি শুধুমাত্র কি  জাতি বিশেষের জন্য? নাকি তিনি বিশ্বের সমগ্র বঞ্চিতদের নিপীড়িতদের উদ্ধারের জন্য আহবান জানিয়েছেন?

     সমস্ত মানুষের জীবন জীবিকা তার পরিবারকে কেন্দ্র করে। তাই ঠাকুর হরিচাঁদ পারিবারিক        জীবনে সুখে থাকার জন্য বলেছেন-

করিবে গৃহস্থ ধর্ম লয়ে নিজ নারী। -শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ নং ৮

অর্থাৎ সংসার জীবনে সুখে থাকার জন্য নিজের স্ত্রীকে নিয়েই গৃহধর্ম পালন করতে বলেছেন। আর তিনি বলেছেন- “পরনারী মাতৃতুল্য মিথ্যা নাহি কবে।

                পর দুঃখে দুঃখী সচ্চরিত্র সদা রবে।। -শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ নং ৮

অর্থাৎ একদিকে তিনি যেমন বলেছেন- নিজের জীবন সঙ্গীনীকে নিয়ে সুখে সংস্র করবে। আবার অন্যদিকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, অন্য নারীদেরকে মাতৃ জ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে এবং সর্বদা সত্য কথা বলতে। এরপর তিনি আরো বলেছেন-নিজে যেমন মিথ্যা কথা বলবেনা, তেমনি চরিত্রের সচ্চতা বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ চরিত্রবান হ’তে হবে। আর অন্যের দুঃখকে নিজের দুঃখ মনে করে সেই দুঃখীর প্রতি উদার হয়ে ভালবাসা দিয়ে তার দুঃখ মোচনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে।

বলুনতো এখানে এসব কথা কি কোন জাতি বিশেষের জন্য বলা হয়েছে? নাকি সকলের মঙ্গলের জন্য এসব কথা বলা হয়েছে?

    হরিচাঁদ ঠাকুরের একটা বিখ্যাত বাণী হচ্ছে-

“হাতে কাম, মুখে নাম।” -শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ নং ৮


এখানে হরিচাঁদ ঠাকুর কর্মহীন অসলসতাকে দূর করে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আর এই কাজ হতে হবে বাস্তব বা বিজ্ঞান সম্মত। আমি আগেই বলেছি ‘নাম’ অর্থ বিজ্ঞান হিসাবে দেখানো হয়েছে। তাই কাজ করতে হবে। আর সেই কাজ হবে বিজ্ঞান ভিত্তিক। কোন অলীক, অযৌক্তিকতা নয়। সম্পূর্ণ বিজ্ঞান সম্মত হতে হবে।

    হরিচাঁদ ঠাকুর একটা মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠার জন্য বিভিন্ন বাণী দিয়ে গেছেন। তিনি সংসার জীবনকে সব থেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। আর মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্টতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই তিনি বলেছেন-

যত যত তীর্থ আছে অবনী ভিতরে।

সত্যবাক্য সম কক্ষ হইতে না পারে।। -শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ নং ৩২

আবার দখুন, তিনি সত্য কথার উপর কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি কি বলেছেন, সারা বিশ্বে যত তীর্থস্থান বা ধর্ম স্থান আছে, সেই তীর্থ স্থানের পবিত্রতা থেক একজন সত্যবাদী অধিক উচ্চস্থানের অধিকারী।

আবার তিনি এই চরিত্র সম্পর্কে বলেছেন-

দেহের ইন্দ্রিয় বশ করেছে যে জন।

তার দরশনে সব তীর্থ দরশন।। -শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ নং ৩২

অর্থাৎ আপনাকে সৎ, পবিত্র হওয়ার জন্য মনের কালিমা দূর করার জন্য তীর্থ ভ্রমনের দরকার নেই। তার থেকে যিনি ইন্দ্রিয় সংজমী, সৎ ব্যক্তি; তার সান্বিধ্য পেলে আরো বেশি উপকৃত হবেন।

আবার আমরা জীবনের উদ্ধার কর্থা সম্পর্কে লীলামৃতে দেখতে পাই-

“যে যাহারে ভক্তি করে সে তার ঈশ্বর।” -শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ নং ১

আর শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত-এ দেখতে পাই-

“বিশ্ব ভরে এই নীতি দেখি পরস্পর।

যে যাহারে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।।” শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ৫৭২

এখানে ঈশ্বরের ব্যাখ্যাটাকে কিন্তু গতানুগতিকতার ঊর্ধে গিয়ে বাস্তবতাকে তুলে ধরে বলা হয়েছে  যে, যে যাহাকে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর। অর্থাৎ ঈশ্বর এখানে কোন অলীক কেউ নন। ঈশ্বর হচ্ছেন উদ্ধার কর্তা। আর এই উদ্ধার কর্তাকেই লোকে ভক্তি শ্রদ্ধা করেন।  

      তো এই নীপীড়িত বঞ্চিতদের উদ্ধার কর্তার কথা যদি বলতে হয়, তাহলে আমরা দেখতে পাই- মহামানব গৌতম বুদ্ধ, হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, বাবা  সাহেব ড. ভীম রাও আম্বেদকর, পেরিয়ার, গুরু নানক, গুরু রবিদাস, মাতা সাবিত্রিবাই ফুলে, মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে ইত্যাদি। আবার বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এরকম দেখতে পাই- যেমন- মার্টিন লুথার, জন আব্রাহাম লিঙ্কন, নেলসন মেন্ডেলা ইত্যাদি।

এই মহামানবেরা নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষদের  অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাই এই মহামানবেরা এই অর্থে ঈশ্বর বা উদ্ধার কর্থা।

    হরিচাঁদ ঠাকুরের কাছে শ্রেষ্ঠ ধর্ম কি? তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে,

“ঠাকুর কহেন বাছা ধর্ম কর্ম সার।

সর্ব ধর্ম হ’তে শ্রেষ্ঠ পর উপকার।।” -শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ নং ১৫০

দেখুন, কতবড় গভীর ভাবনা। পর উপকার করা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ ধর্ম। আর বাকী সব ধর্ম-কর্ম হচ্ছে তুচ্ছ, অসার।

এরকম অসংখ্য বাণীকে আমরা দেখতে পাই লীলামৃতের মধ্যে। এবার আমরা আরো একটা বাস্তব কথাকে তুলে ধরছি।

“অঙ্গ ধৌত বস্ত্র ধৌত ছাপা জপমালা।

বহিরঙ্গে বাহ্য ক্রিয়া সব ধুলা খেলা।।

যত দিন নাহি ঘুচে চিত্ত অন্ধকার।

তত দিন শৌচাচার ডুবাডুবি সার।।” -শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ নং ১০৬

ধর্মপ্রাণ মানুষেরা বহিরঙ্গের শুভ্রতার নিয়ে ক্রিয়া কর্ম করে। সব সময় কোণ আরাধ্যের নাম করে। কিন্তু হরিচাঁদ ঠাকুর কি বলেছেন? যতদিন চিত্ত বা মনের অন্ধকার বা গ্লানী দূর না হবে ততদিন যতই শৌচাচার পালন করুক না কেন সে সবে কোন কাজ হবে না।

অর্থাৎ যতদিন সঠিক জ্ঞানের আলো ভিতরের অজ্ঞানতার অন্ধকারকে দূর না করতে পারবে ততদিন কোন কাজ হবে না। কাজ করতে হ’লে সৎ, সত্যবাদী , ইন্দ্রিয় সংজমী ও পরোপকারী না হতে পারলে চিত্তের অন্ধকার দূর হবেনা।  

    হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর কর্ম ধারায় নারীকেও সমান অধিকার দিয়ে কোন ভেদাভেদ না রেখে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কাজ করেছেন। যার জন্য আমরা দেখতে পাই নারী-পুরুষ উভয়ে মিলেমিশে এক সঙ্গে হরিচাঁদ ঠাকুরের বন্দনা করে।

 তিনি কর্ম বিমুখতাকে মোটেই পছন্দ করেন না। তিনি সকলকে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। এইভাবে বহু বাণী ও কর্ম আমরা দেখতে পাই। যেখানে কোন বিশেষ জাতি নয়, ধর্ম নয়, সমাজ নয়, তিনি সমগ্র বিশ্বের মানব জাতির জন্য কাজ করে গেছেন।

     এবার আমরা আসি, হরিচাঁদ ঠাকুরের সুযোগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের বাণী ও কর্মধারার বিশ্লেষণে-

     গুরুচাঁদ ঠাকুরের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার আন্দোলন। তাই তিনি জীবনের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য প্রথমেই ঘোষণা করেন-

 “খাও বা না খাও তা’তে কোন দুঃখ নাই।

ছেলে পিলে শিক্ষা দেও এই আমি চাই”।।  -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৪৪  

 ছেলে মেয়েকে দিতে শিক্ষা

  প্রয়োজনে করিবে ভিক্ষা। 

অর্থাৎ আপনি পেটের খুদা মিটাতে সক্ষম কি না সেতা আমার কাছে বড় প্রশ্ন নয়। বড় প্রশ্ন হচ্ছে আপনার সন্তানদেরকে শিক্ষিত করে তোলা। আর এর জন্য আপনাকে প্রয়োজনে ভিক্ষা করতে হলেও করবেন। কিন্তু সন্তানকে অশিক্ষিত করে রাখবেন না।

এবার বলুন তো এই কথা কি কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য? নাকি বিশ্বের সকল মানুষদের শিক্ষিত করার জন্য এই উদাত্ব আহ্বান?

তিনি অশিক্ষাকে মারন ব্যধির সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন-

অজ্ঞান ব্যাধিতে ভরা আছে এই দেশ।

জ্ঞানের আলোকে ব্যাধি তুমি কর শেষ।। -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৩৭

অর্থাৎ এই অজ্ঞানতার ব্যাধিতে দেশ ভরে আছে। একমাত্র জ্ঞানের আলো দিয়েই  এক অজ্ঞানতাকে দূর করা যাবে।

মানুষ সব সময় মুক্তির সন্ধান করে। গুরুচাঁদ ঠাকুর মানুষের এই মুক্তি লাভের জন্য বলেছেন-

তাই বলিভাই       মুক্তি যদি চাই 

     বিদ্যান হইতে হবে।

পেলে বিধ্যাধন       দুঃখ নিবারণ

     চির সুখি হবে ভবে।।       -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৩০

      মুক্তি এখানে কোন মুক্তি? মুক্তি হচ্ছে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে বেরিয়া এসে জ্ঞানের আলোতে মুক্তি। সেই মুক্তির জন্য আপনাদের বিদ্যান হতে হবে। তাহলে মুক্তি পাবেন। আর সব দুখের নিবারণ ঘটবে।আপনি চির সুখি হ’তে পারবেন।  

    শিক্ষা অর্জনকে তিনি এত মহত্বপূর্ণ মনে করেছেন, যার জন্য তিনি বলেছেন-

বিদ্যা ছাড়া কথা নাই বিদ্যা কর সার।

বিদ্যাধর্ম, বিদ্যাকর্ম, অন্য সব ছার।।  -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১০৮

অর্থাৎ ধর্ম কর্ম সব কিছুর মূল হচ্ছে বিদ্যা। বাকী সব গুরুত্বহীন।  তাই সকলে এই অমূল্য  সম্পদকে অর্জন করুন।

বলুন তো শিক্ষা গ্রহণের বিষয়ে আর ক’জন এরকম দীপ্ত ঘোষণা করেছেন? যে বিদ্যাই ধর্ম কর্ম ও সার। বাকী অন্য সব অসার। তবুও কেন আমরা দেখতে পাই তাঁর এই বাণী প্রচার বিমুখতায় রুদ্ধ হয়ে আছে?

এবার দেখা যাক গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই শিক্ষা আন্দোলনের ভাগীদার কারা ছিলেন? আর তিনি কাদের জন্য কাজ করছেন-

শিক্ষা আন্দোলন যবে প্রভু করে দেশে।

ভক্‌ত সুজন যত তার কাছে আসে।।

নমঃশূদ্র তেলী মালী আর কুম্ভকার।

কপালী মাহিষ্য দাস চামার কামার।।

পোদ আসে তাতী আসে আসে মালাকার।

কতই মুসলমান ঠিক নাহি তার।।

সাবাকে ডাকিয়া প্রভু বলে এই বাণী।

“শুন সবে ভক্তগণ আমি যাহা জানি।।

নমঃশূদ্রকুলে জন্ম হয়েছে আমার।

তবু বলি আমি নাহি নমঃর একার।।

দলিত পীড়িত যারা দুঃখে কাটে কাল।

ছুঁস্‌নে ছুঁস্‌নে বলে যত জল-চল।।

শিক্ষা-হারা দীক্ষা-হারা ঘরে নাহি ধন।

এই সবে জানি আমি আপনার জন।।”  -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৪৪

   এই শিক্ষার আন্দোলন যখন গুরুচাঁদ ঠাকুর শুরু করেন তখন ঠাকুরকে যারা শ্রদ্ধা করতেন বা তাঁর কথা মেনে চলতেন এরকম বিভিন্ন জাতির লোকেরা ঠাকুরের কাছে আসেন; যেমন- তেলী, মালী কুম্ভকার, কাপালী, মাহিষ্য, দাস, চামার, কামার, পোদ (পৌন্ড্র), তাতী, মালাকার। এছাড়া  অগণিত মুসলমানও ঠাকুরের কাছে আসে। এদের সবাইকে গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেন, “তোমরা আমাকে ভক্তি শ্রদ্ধা কর। কিন্তু আমি যা জানি সেটা হচ্ছে আমি জন্মগত কারণে নমঃ জাতির মধ্যে  জন্মগ্রহণ করলেও আমি কিন্তু শুধু নমঃদের নই। আমি তাদের, যারা পদদলিত, পীড়িত, অত্যাচারিত, যাদের সব সময় দুঃখ-কষ্ট নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। যাদেরকে দেখলে উচ্চবর্ণীয়রা অচ্ছুৎ বলে ঘৃণা করে। যাদের পেটে খাবার নেই। শিক্ষার আলো যাদের মধ্যে পৌঁছায়নি। যাদের সহায় সম্বল বলে কিছুই নেই। তারাই হচ্ছে আমার আপন জন।  

     সমাজ নারীকে যখন পণ্যদ্রব্য মনে করে তার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে; তাকে মানুষ নয়, নারী বলেই গণ্য করে; সেরূপ সামাজিক সংকটের মূহুর্তে আমরা হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুরের কি প্রতিফলন দেখতে পাই নারী দের সম্পর্কে?

শুনেছি পিতার কাছে আমি বহুবার

নারী পুরুষ পাবে সম অধিকার।।

সমাজে পুরুষ পাবে যেই অধিকার।  

নারীও পাইবে তাহা করিলে বিচার।।

তিনি বলেন, আমি আমার পিতার কাছে অনেক বার শুনেছি যে, নারী পূরুষদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ করা যাবেনা। উভয়ে সমান অধিকার পাবে। অর্থাৎ পুরুষ যে অধিকার পাবে নারীও সেই অধিকার সমানভাবে পাবে।

এবার বলুন তো সে যুগে দাঁড়িয়ে এরকম দৃপ্ত কন্ঠে নারীর অধিকার নিয়ে ক’জনে ঘোষণা করেছেন? এ সব কথা কি বিশ্বের সমস্ত নারীদের অধিকারের জন্য নয়?

   একবার গুরুচাঁদ ঠাকুরের সংগ্রামের সাথী অস্ট্রলিয়ান মিশনারী সি. এস. মীড্‌ সাহেবের জীবন সঙ্গীনী Alice Pappin, গুরুচাঁদ ঠাকুরের সামাজিক কর্ম-কান্ডে আপ্লুত হয়ে, অনুপ্রাণীত হয়ে তাঁকে ‘ধর্মপিতা’ বলে সম্বোধন করেন। তবে তিনি আবার গুরুচাঁদ ঠাকুরের কাছে জানতে চান যে-

“আমি আপনাকে পিতা বলেছি, তাই আমি আপনার কন্যা। কিন্তু আমিতো অন্য ধর্মের। তাই আপনি কি আমার হাতের খাবার খাবেন?”

 তখন গুরুচাঁদ ঠাকুর জানান,

“শুন কন্যা, গুণে ধন্যা, আমার বচন। 

জাতি-ভাগ মোর ঠাঁই পাবে না কখন।।

 নরাকারে ভূমন্ডলে যত জন আছে।

‘এক জাতি’ বলে মান্য পাবে মোর কাছে।।

আমার পিতার ভক্ত আছে যত জন।

এক জাতি বলে তারা হয়েছে গণ।।

লোকাচারে তার কেহ কায়স্থ ব্রাহ্মণ।

‘মতুয়ার’ মধ্যে তাহা নাহি নিরূপণ।।

নমঃশূদ্র, তেলী মালী, ব্রাহ্মণ কায়স্থ।

ইস্‌লাম, বৈদ্য জাতি-রোগে সিদ্ধ-হস্ত।।

মতুয়া সকলে এক, জাতি-ভেদ নাই।

বিশেষতঃ কন্যা হ’লে নাহিক বালাই।। গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ২০০/২০১

অর্থাৎ “জাতিগত কারণে বা ধর্মীয় কারণে সে যে জাতি বা ধর্মেরই হোক না কেন আমার কাছে তার কোন অস্তিত্ব পাবেনা কখন। এই বিশ্বে যত লোক আছে, সকলে আমার কাছে ‘এক জাতি’  অর্থাৎ মানব জাতি বলে গণ্য হবে। আমার পিতা ঠাকুর হরিচাঁদের যত ভক্তরা আছেন তাদেরকে সব সময় এক জাতি বলেই গণ্য হয়েছে; যদিও তারা লোকাচারে কেউ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ বা অন্য জাতির লোক। তবে এটা সত্য যে, বিভিন্ন জাতি বা ধর্মের লোকেরা নিজেদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথাকে প্রাধান্য দেয়। যার ফলে সমাজের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি হয়। যেটা একটা কঠিক সামাজিক ব্যাধি। তবে আবার বলি, মতুয়ারা  সকলে একই জাতি। এখানে কোন ভেদাভেদ নেই। আর অন্য জাতি বা ধর্মে যেমন নারীদেরকে মর্যাদা দেওয়া হয়না, কোন অধিকার দেওয়া  হয়না, সেক্ষেত্রে মতুয়াধর্মের নিময়ানুসারে আমার কাছে নারীরা সব মর্যাদা পাবেন, অধিকার পাবেন। তাদেরকে কখনো পৃথক দৃষ্টিতে দেখা হবেনা বরং তাদের প্রগতির জন্য আমি আরো বেশি করে কাজ করব। যেখানে কোন রকম ভেদাভেদ বা জাতি ধর্মের পরিচয় থাকবেনা।”  

     আসলে হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুরকে নিয়ে এক জাতির মধ্যে গন্ডী বদ্ধ করে রাখার পিছনের আরও বড় কারণ, হচ্ছে যে,- হরিচাঁদ ঠাকুর তার জ্ঞানের উপলব্ধিতে বুঝতে পেরেছিলেন যে, বেদের মধ্যে যে জাতি ভেদের বিজ রোপন করা হয়েছে, মানুষকে উচ, নিচ্‌ ভেদাভেদ করে এক শ্রেণীর মানুষকে পশুর থেকেও নিচ্‌ করে রেখেছে, আর অলৌকিক ভগবান, স্বর্গ, নরক, আত্মা, পরমাত্মার পংকিলতায় ডুবিয়ে রেখেছে। সে জন্য তিনি দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করছিলেন-

কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলেও খাই।

বেদ বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই।। - হরিলীলামৃত পৃঃ ১০৪

অর্থাৎ তিনি বেদ ও তার বিধানকে সমাজের জন্য কুকুরের উচ্ছিষ্ট থেকেও নিকৃষ্ট মনে করে ছিলেন।

তিনি আবার ঘোষণা করেন-

কোথায় ব্রাহ্মণ দেখ, কোথায় বৈষ্ণব।

স্বার্থ বসে অর্থ লোভী যত ভন্ড সব।।

                 -লীলামৃত ঠাকুরবাড়ি, ঠাকুর নগর প্রকাশ, পৃঃ ৯৪

তিনি ব্রাহ্মণ এবং বৈষ্ণবদের উদ্দেশ্যে কি বললেন?  এরা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অর্থ লোভী ও ভন্ড। অর্থাৎ তারা মানুষকে মিথ্যা পাপ, পুণ্য, স্বর্গ, নরক, আত্মা, পরমাত্মা,  জন্মান্তর ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে আর তার থেকে মুক্তি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে মানুষকে ঠকিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে। এরা সকলেই ভন্ড। ব্রাহ্মণ এবং বৈষ্ণব্দের ধর্মীয় ব্যবসার প্রতি এরকম কুঠারাঘাত করার সাহস আর ক’জন দেখিয়েছেন বলুন তো? আর এর জন্য তারা হরিচাঁদের আদর্শ কি করে প্রচার করতে পারে?

হরিচাঁদ ঠাকুরের এই কথাকে আরো অগ্নি স্ফুলিঙ্গ দান করেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। তিনি বলেন-

“ব্রাহ্মণ রচিত যত অভিনব গ্রন্থ।

‘ব্রাহ্মণ প্রধান’ মার্কা বিজ্ঞাপন যন্ত্র।।” গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ২৩

ব্রাহ্মণরা যত সব গ্রন্থ রচনা করেছে, সবই তাদের গুণ-কীর্তনের জন্য। সব জায়গায় ব্রাহ্মণকেই  শ্রেষ্ঠ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাই তাদের রচিত সমস্ত গ্রন্থ হচ্ছে ‘বিজ্ঞাপন যন্ত’।

     তো আমরা হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের অগণিত বাণীকে পাই যে গুলো সমাজ সংস্কার মূলক। মানুষকে প্রগতির দিশা দেখানোর সোপান।

      কিন্তু শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ্যবাদী জাত ব্যবস্থার শৃংখল দ্বারা তাদের কর্ম ধারাকে গন্ডীবদ্ধ করে রেখেছে। আর এই কাজে প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছে সমাজের কিছু ডিগ্রীধারী পন্ডিত। যে পন্ডিতেরা বিভিন্ন সংগঠনের উচ্চ পদে বসে আছে। আর হরি-গুরুচাঁদের বাণী, কর্ম ও আদর্শকে এগিয়ে না নিয়ে, নিজেদের নাম কেনার জন্য দোকানদার সেজে বসে আছে। আশাকরি, এই ডিগ্রীধারী দোকান্দারদেরকে সুবুদ্ধি সপন্ন মানুষেরা তাড়াতাড়ি চিনতে পারবেন। কারণ, এই ডিগ্রীধারীরাও ব্রাহ্মণ্যবাদের পৃষ্ঠপোষক।

    তাই এই পৃষ্ঠপোষকদের যদি ঘুম না ভাঙ্গে তাহলে সমাজের সুবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ নিশ্চয় একদিন এদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্যকে বানচাল করে দিয়ে দিকে দিকে হরি-গুরুচাঁদের সঠিক ধর্ম-দর্শনকে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছে দেবেন; এই আশা করে সমাপ্ত করছি।

__________________________


লেখক পরিচিতি :- জগদীশচন্দ্র রায়

No comments: