Tuesday, July 28, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 2 গ্রন্থারম্ভ অষ্টাদশ খ্রীষ্টাব্দে পৃথিবীর অবস্থা

 

‘যদা যদাহি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি’-(গীতা)

 

কাঁদে দেবী বসুন্ধরা হাহাকার রবে।

ধরাবাসী মত্ত সবে যুদ্ধের বাড়বে।।

অষ্টাদশ শত অব্দ গত প্রায় হ’ল।

ফ্রান্স দেশে দাবানল জ্বলিয়া উঠিল।।

ধনিক বণিক আর গর্বি জমিদার।

অবহেলে দীনজনে করে অত্যাচার।।

পশুসম নরনারী বাঁধে পদতলে।

মানবতা চূর্ণ হ’য়ে গেল রসাতলে।।

ধর্ম ধ্বজাধারী সাজি যত পুরোহিত।

ধর্মকে পিষিয়া করে কার্য বিগর্হিত।।

মাতৃত্ব সতীত্ব কহে হাস্যকর নীতি।

নারী জাতি লয়ে করে পাপের বেসাতি।।

বিশ্ব যে সৃজিল তাঁরে গর্বে অবহেলি।

রাজা সাজে বিশ্বকর্ত্তা ধর্ম পদে ঠেলি।।

আমিত্ব প্রভুত্ব মাত্র করে সর্ব সার।

অত্যাচারে বসুন্ধরা কাঁপে থর থর।।

এই বাড় বাগ্নি মাঝে পৃথিবী পশিল।

শান্তি, সুখ, শীতলতা সব দূরে গেল।।

মুষ্টিমেয় অত্যাচারী করে অত্যাচার।

অগনিত নর প্রাণী করে হাহাকার।।

ত্রাহি ত্রাহি কন্ঠে ডাকে “কোথা দয়াময়”।

তোমার সাধের সৃষ্টি পাপে ডুবে যায়।।

ত্রাণ করো ত্রাণ করো জগতের পতি।

কালের করাল করে রক্ষ বসুমতি।।

অসহ্য পাপের ভার ধরা নাহি সহে।

রাতুল চরণ পানে তাই চাহি রহে।।

অনাথ আতুর যত কাঁদে উভরায়।

অসাম্য ভারেতে ধরা ডুবু ডুবু প্রায়।।

হে শান্ত শিবম প্রভু পুরুষ মহান।

ধরাকে রক্ষিয়ে করো জীবের কল্যাণ।।

অগণিত দীনহীন ভাসে অশ্রুনীরে।

প্রভুর আসন টলে অনন্ত সায়রে।।

আপনি নামিল প্রভু নররূপ ধরে।

যুগে যুগে এই নীতি আছে পরস্পরে।।

সাধুর রক্ষণ আর পাতকী সংহার।

ধর্মে রক্ষা করে প্রভু নাশে ধরাভার।।

হিরণ্যকশ্যিপু নাশ করে সত্য যুগে।

রাবনে নাশিল রাম যুদ্ধে ত্রেতা যুগে।।

দ্বাপরে শাসিল কৃষ্ণ কংস শিশুপাল।

কুরুক্ষেত্রে পাপী ধ্বংস যেন পঙ্গপাল।।

প্রাচীন ইহুদি গ্রন্থ দেখ পাঠ করি।

যিহোবা করেছে ধ্বংস যত ধর্ম-অরি।।

ঈশা মুসা আদি করি যত মহাজন।

সবারে পাঠায় প্রভু ধর্মের কারণ।।

আরব দেশেতে যবে ধর্মে দিল পীড়া।

ভাঙ্গিতে চাহিল সবে ধর্ম-ধ্বজা চূড়া।।

শেষ নবী মহম্মদ উদয় হইল।

শস্ত্র শাস্ত্র সঙ্গে করি ধর্ম প্রচারিল।।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে সেই ভাব হল।

অধর্মের কাল ভেরী বাজিয়া উঠিল।।

ফরাসী বিপ্লব বহ্নি ছুটে চারিভিতে।

দেশে দেশে নর-নারী মরে অগণিতে।।

যেই দিকে চাহি শুধু দেখি অত্যাচার।

দিকে দিকে হিংসা হিংসি ভীষণ আকার।।

পাপদাপে ধরা যেন যায় রসাতল।

করুণ নয়নে চাহে বিশ্বের ভূ পাল।।

দেশে দেশে সাঙ্গ পাঙ্গ সবে পাঠাইল।

অধর্ম নাশিয়া তাঁরা জীবে ধর্ম দিল।।

আমেরিকা খন্ডে জন্মে ধর্ম পথে মতি।

জর্জ ওয়াশিংটন নামে বীর মহামতি।।

ইংলেন্ড জার্মানি ফ্রান্সে, ইতালি আরবে।

ভারতে জাপানে চীনে দেখি নানা ভাবে।।

মহান ধর্মের বীর আদর্শ মানব।

জন্ম নিল দেশে দেশে অমৃত স্বভাব।।

বিশেষতঃ বঙ্গদেশে ধর্মগুরু রুপে।

মহান পুরুষ কত ভক্তের স্বরুপে।।

উদয় হইয়া করে ধর্মকে রক্ষণ।

জীবের কল্যাণ কল্পে অসাধ্য সাধন।।

রামকৃষ্ণ আদি আর শ্রী রামমোহন।

দেবেন্দ্র বিবেক আদি ভক্ত অগণন।।

পূর্ববঙ্গে ওড়াকান্দী প্রভু হরিচাঁদ।

অবতার রূপে এলো করি সিংহনাদ।।

কি কারণে হল এত মহদাগমন।

ইতিহাসে সাক্ষ্য দেয় সে সব কারণ।।

“হরিলীলামৃত” গ্রন্থে কবি রসরাজ।

অনেক কহিলা কথা প্রকাশিত আজ।।

বঙ্গীয় সমাজ শীর্ষে মধ্য অন্ত ভাগে।

কলুষ ছুটিয়া চলে অতি দ্রুতবেগে।।

জ্ঞানী অবতার বুদ্ধ সাম্যবাদ আনে।

ভারত একত্র হ’ল একতা বন্ধনে।।

সাম্যবাদী বৌদ্ধ শক্তি অখন্ড প্রতাপ।

তার মধ্যে ক্রমে ক্রমে প্রবেশিল পাপ।।

হিন্দু ধর্মে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ শক্তি রয়।

বৌদ্ধ ধর্ম অভ্যুদয়ে হীন শক্তি হয়।।

সুযোগ খুঁজিয়া তারা ঘুরে যথাতথা।

বৌদ্ধে হীনবল দেখি করিল শঠতা।।

অত্যাচারে অবিচারে যত বৌদ্ধগণে।

নাশিল শাসিল ঘোর কঠোর বিধানে।।

আভিণব পুরাণাদি সৃজন করিল।

মানুষে মানুষে ভেদ বজায় রাখিল।।

ব্রাহ্মণ বর্ণের শ্রেষ্ঠ এই নীতি বলে।

শুদ্র বলি ক্ষুদ্র করে অপর সকলে।।

কথা উপকথা কত সৃজন করিল।

ঘাটে মাঠে গাছে পথে দেবতা গড়িল।।

“স্বরগের চাবি” রাখে ব্রাহ্মণ সুজন।

পদধুলি দানে করে পাপের মোক্ষণ।।

অবশ্য দক্ষিণা কিছু সঙ্গে দিতে হয়।

দশ বিশ যাহা হোক ব্রাহ্মণেই পায়।।

পাপী করে প্রায়শ্চিত্ত শাস্ত্রের বিধান।

বিপ্র আসি মন্ত্র পড়ি দক্ষিণাদি ল’ন।।

মূল্যভেদে বিধানের তারতম্য রয়।

“মধ্বাভাবে গুড়ং দদ্যেৎ” এও নাকি হয়।।

জন্ম মৃত্যু বিবাহাদি কিছু ফাঁক নাই।

পদে পদে বিপ্র পদে কিছু দে’য়া চাই।।

 বিপ্রে স্বর্ণ দিবে আর দিবে ভূমিখন্ড।

বিপ্র যদি তুষ্ট হয় তরিবে পাষণ্ড।।

স্বাধীন চিন্তার পথ এ হেন প্রকারে।

বন্ধ করে বিপ্রদল শুধু স্বার্থ তরে।।

অনন্ত শক্তির কেন্দ্র মানবের মন।

পাপ ভয়ে স্বর্গ লোভে করে আচ্ছাদন।।

নির্জ্জিত মানব হেথা কাঁদে চারিদিকে।

“অস্পৃশ্য” বলিয়া বিপ্র ছোঁয়না তাহাকে।।

ব্রাহ্মণ রচিত যত অভিনব গ্রন্থ।

“ব্রাহ্মণ প্রধান” মার্কা বিজ্ঞাপন যন্ত্র।।

“ব্রাহ্মণ দেবতা” তাই ব্রাহ্মণের মান্য।

হরি নাকি ধরেছিল ভৃগু পদচিহ্ন।।

তন্ত্র মন্ত্র ভেল্কি ভোজ রচি দিনে দিনে।

গূঢ়ার্থ বাহির করে স্বার্থের সন্ধানে।।

‘বিপ্র যদি লোভে পড়ি করে পাপ কর্ম।

তথাপি তাহার মান্য’ এই নাকি ধর্ম।।

এ মতে সমাজ ধর্ম গেল রসাতলে।

ব্রাহ্মণ কহিলে কথা “বেদ বাক্য” বলে।।

নারকীয় লীলাখেলা সমাজে পশিল।

বিপুল তান্ডবে দেশ রসাতলে গেল।।

দলিত গলিত যত পতিত মানব।

ব্রাহ্মণের কুটচক্রে মৃত প্রায় সব।।

রক্ষিতে পতিত জনে সাম্যবাদ তন্ত্রে।

গৌরাঙ্গ অর্পিল প্রেম হরিনাম মন্ত্রে।।

ব্রাহ্মণ চন্ডাল সবে হল একাকার।

জাতি জাতি টানাটানি ঘুচিল সবার।।

একদেশে একজাতি এক ভগবান।

মরুর বুকেতে বহে প্রেমের তুফান।।

মানুষে মানুষ মিশে প্রেমে গলাগলি।

যবন ব্রাহ্মণ সবে করে কোলাকুলি।।

ব্রাহ্মণ ধর্মেতে পুষ্ট যত দুষ্ট গণ।

এসব দেখিয়া হ’ল বিষাদে মগন।।

টিকি আন্দোলন করি শাস্ত্র বাণী কয়।

প্রাণ যায় “সোভি আচ্ছা” স্বার্থ ছাড়া দায়।।

স্বার্থ বলি দিতে তারা রাজি নহে কভু।

বিপদে পড়িলে বটে হয় কিছু কাবু।।

বিপদের জাল যবে ছিন্ন হয়ে আসে।

সর্প সম উচ্চ শির তোলে মহারোষে।।

অনর্পিত যেই ধন গৌরাঙ্গ আনিল।

নামে প্রেমে মেখে তাহা জীবে বিলাইল।।

প্রেম ভয়ে ভীত হয়ে ব্রাহ্মণ সকল।

দূরে দূরে থাকে শুধু করে কোলাহল।।

যখনে গৌরাঙ্গ করে লীলা সম্বরণ।

ব্রাহ্মণের কূট বুদ্ধি জাগিল তখন।।

গৌরাঙ্গের ভক্তগণে বৈরাগী কহিয়া।

ভিন্ন করি রাখে সবে সমাজ গড়িয়া।।

“বৈরাগী বৈরাগী” বলি তুচ্ছ করি সবে।

সমাজ বন্ধন ভঙ্গ করিল তান্ডবে।।

“কলিচক্র” বলি ভক্ত করে হাহাকার।

গৌরাঙ্গের ধর্ম বুঝি গেল ছারেখার।।

জাতিভেদ মূলচ্ছেদ যে ধর্ম করিল।

ব্রাহ্মণের কূটচক্রে ভিন্ন ভিন্ন হল।।

হইল আউল মতে বাউল বিপক্ষ।

দরবেশ দেখে নাড়া গালি দেয় রুক্ষ।।

ভিন্ন ভেদ বৈষ্ণবেতে বড়ই মজার।

ব্রাহ্মণ “বৈষ্ণব” হলে পূজ্য সবাকার।।

ব্রাহ্মণ বাটিতে পারে ভোগাদি নৈবেদ্য।

স্পর্শ করে শুদ্র তাহা নাহি হেন সাধ্য।।

পবিত্র বৈষ্ণব ধর্মে পড়ে কুটিনাটি।

দেহ শুচি করে বটে মনে থাকে মাটি।।

হরিনাম “মহামন্ত্র” বলে গেল যারা।

দীক্ষা জন্যে “কর্ণমন্ত্র” গড়ে নিল তারা।।

প্রেমে ভোলা শ্রীচৈতন্য নামে ডুবে রয়।

কোথা গেল উপবীত কেবা তত্ত্ব লয়।।

 তাহার ভকত সাজি পরে কতজন।

মোটা সুতা গলে কৈল পৈতার সৃজন।।

নিজ নারী পরিহরি প্রভু কেঁদে গেল।

পরনারী-ব্যভিচারী “বৈষ্ণব” সাজিল।।

বৈষ্ণবের মূল ধর্মে পড়ে গেল ত্রুটি।

ব্রাহ্মণের মনে ছিল এই কুটি নাটি।।

সমাজ বন্ধন ক্রমে হইল শিথিল।

জনে জনে ভাগে ভাগে সমাজ পঙ্কিল।।

এ হেন দুর্গতি দেখে জীবের জীবনে।

অবতীর্ণ হরিচাঁদ সুযুক্তি বিধানে।।

নররূপে অবতীর্ণ পালে নর নীতি।

গৃহস্থ সাজিয়া করে গৃহেতে বসতি।।

ঠেকিয়া জীবের দায় নরদেহ ধরে।

নর ধর্ম পালে প্রভু নরের আকারে।।

উত্তর সাধক শূণ্য অবতার হয়।

অবতার চলি গেলে শক্তি চলি যায়।।

আরও নিগূঢ় তত্ত্ব উঠে মম মনে।

ভক্তগণ ছিল পূর্বে অবতার সনে।।

প্রভুর মনের ভাব কিছু নাহি জানি।

যে বাণী বাখান তিনি বলি সেই বাণী।।

পূর্ণ শক্তি ধরিবারে ভক্তের সাধ্য নয়।

যাঁর শক্তি তাই তাঁর সাথে চলি যায়।।

কিছুকাল ভক্ত দল করে কাঁদাকাঁদি।

প্রভুকে রাখিতে চায় গ্রন্থ মধ্যে বাঁধি।।

মানুষ চলিয়া যায় সাঙ্গ হয় লীলা।

ইতিহাসে লিখি রাখে তার যত খেলা।।

তাই বুঝি প্রভু মোর এই অবতারে।

পিতা পুত্র অভেদাত্মা এল ধরা ‘পরে।।

হরিচাঁদ গুরুচাঁদ দেহ ভিন্ন রয়।

দুই দেহে এক খেলা আপনি খেলায়।।

হরিচাঁদ রূপে করে প্রথমে আবাদ।

বীজ বুনি ফল দেখে প্রভু গুরুচাঁদ।।

চারি যুগে গৃহবাসী পিছে পড়ে ছিল।

হরি-গুরুচাঁদ সবে উদ্ধার করিল।।

প্রেম ভক্তি দিয়ে হরি গৃহীর পরাণে।

গৃহীন্যাসী কি সন্নাসী আনে এক খানে।।

গড়িয়া ধর্মের রাজ্য সবে প্রজা করি।

গুরুচাঁদে ভার দিয়া চলি গেলা হরি।।

গুরুচাঁদ প্রভু তাহে পিতৃ ইচ্ছা মানি।

গৃহধর্ম তত্ত্ব কহি মাতা’ল অবনী।।

উদার অসীম তত্ত্ব গুরুচাঁদ কহে।

যেই মানে সেই জানে মোহ নাহি রহে।।

গৃহস্থে দেখা’তে পথ জীবে দিতে শান্তি।

অবতীর্ণ গুরুচাঁদ কমনীয় কান্তি।।

গৃহধর্ম পালি’ প্রভু জীবেরে শিখায়।

গৃহী বড় হলে পরে কত বড় হয়।।

উদার আদর্শ হেন হবে না’ক আর।

গৃহস্থ জনের বন্ধু শ্রী গুরু আমার।।

এস ভাই গৃহবাসী দিন চলে যায়।

গেল দিন হয়ে লীন পড় রাঙ্গা পায়।।

এমন দয়াল বন্ধু পাবে না’ক আর।

মোহ ছাড়ি ধর পাড়ি চল ভবপার।।

শঙ্কাহারী ত্রীপুরারী গুরুচাঁদ এল।

হরি হর অভেদাত্মা ধরাতে নামিল।।

সেই পদ স্মরি সবে বল হরি বল।

দীন মহানন্দ যাচে প্রেমামৃত ফল।।

আবির্ভাব

 

“ভজ মন! হরি হর অভেদাত্মনে।

চরণে শরণে ভয় নাই মরণে।।”

( কবি রসরাজ)

 

বার শ’ তিপান্ন সাল ফাল্গুনী পূর্ণিমা।

অবতীর্ণ গুরুচাঁদ অপার মহিমা।।

 দোল পূর্ণিমার তিথি হোলির বাসর।

ফাগে ফাগে রাঙা হ’ল দিগ দিগন্তর।।

ফাগেতে রঞ্জিত রবি উঠে পূর্ব ভিতে।

হরি বলে ভক্ত দলে লাগিল নাচিতে।।

মহাপ্রভু হরিচাঁদ বসিয়া প্রাঙ্গণে।

প্রভুকে সাজাল যত ভক্ত নারীগণে।।

চরণে করিল কেহ ফাগের লেপন।

কুসুমের দলে করে মস্তক বন্ধন।।

কপোলে, কপালে দিল রক্ত ফাগরেখা।

করতলে দিল ফাগ রক্ত চন্দ্রলেখা।।

চন্দন বাটিয়া করে শ্রীঅঙ্গে লেপন।

হুলু ধ্বনি হরি ধ্বনি মঙ্গলাচরণ।।

উভ করি বাঁধে কেহ শিরেতে কবরী।

বিন্দু বিন্দু ফাগ দেয় তাহার উপরি।।

ধূপ দীপ আনে কেহ কুঙ্কুম চন্দন।

“নমো হরিচন্দ্র” বলি করে আবাহন।।

গোকুলে খেলিল খেলা যেমন গোপিনী।

ওড়াকান্দী ভক্ত নারী করিল তেমনি।।

মৃদু মৃদু হাসে প্রভু হোলির আনন্দে।

হাসি দেখি পাগলিনী ভক্ত নারী কান্দে।।

এদিকে নাচিছে ভক্ত কীর্ত্তনে পাগল।

অবিরাম করে নাম হরি হরি বল।।

ব্রজ নাচে নাটু নাচে নাচে বিশ্বনাথ।

আনন্দে গোলক নাচে করে কক্ষাঘাত।।

রুদ্রতালে নাচে ভক্ত বীর হীরামন।

কুমারের চক্র প্রায় ঘুরিছে বদন।।

হুঙ্কার ছাড়িয়া ঘুরে গোবিন্দ মতুয়া।

মৃত্যুঞ্জয় বলে হরি দু’বাহু তুলিয়া।।

নাটুয়ার নৃত্য করে মঙ্গল গোঁসাই।

দশরথ বলে হরি ঘন ছাড়ে হাই।।

প্রভুকে ঘিরিয়া সবে করে লম্ফ ঝম্ফ।

বীর দাপে ধরা কাঁপে যেন ভূমিকম্প।।

লোচন গোস্বামী এল বলে হরি হরি।

আপনি উঠিয়া প্রভু আনে হস্তে ধরি।।

মহাপ্রভু বলে তবে লোচনের ঠাঁই।

“এমন পবিত্র দিন আর দেখি নাই।।

তোমাকে পাইয়া আজি বড়ই আনন্দ।

বল প্রভু ইহা হ’তে কিবা প্রেমানন্দ।।

হাসিয়া লোচন বলে ওগো অন্তর্যামী।

কি হেতু আনন্দ কর সব জানি আমি।।

মহেশ্বর মহাকাল এ পবিত্র দিনে।

আসিয়া উদয় হবে তোমার ভবনে।।

পরম বৈষ্ণব ভোলা মত্ত হরিনামে।

ভোলাকে তুষিতে ভক্ত মত্ত নামে প্রেমে।।

আজি নিশি ছিনু প্রভু সফলা নগরে।

শেষ যামে দেখিলাম স্বপনের ঘোরে।।

আকাশ ভেদিয়া যেন এক মহাজ্যোতিঃ।

নামিয়া তোমার গৃহে পরশিল ক্ষীতি।।

সেই জ্যোতিঃ আসি তব পদে লোটাইল।

পদস্পর্শে সেই জ্যোতিঃ মূর্তিমন্ত হৈল।।

গৌরাঙ্গ বরণ কান্তি ঢল ঢল আঁখি।

রূপ দেখি মনে বলে বসে বসে দেখি।।

করজোড় করি মূর্তি তোমা’ পিতা বলে।

আপনা সম্বরি তুমি মূর্তি মধ্যে গেলে।।

আশ্চর্য মানিয়া আমি উঠিনু শিহরি।

নিদ্রাটুটি গেল মোর বলে হরি হরি।।

প্রভাতে উঠিয়া তাই ভাবি মনে মনে।

অদ্য জন্ম লবে ভোলা তোমার ভবনে।।

ভোলার রাতুল পদ দেখিব বলিয়া।

ছুটিয়া এসেছি হেথা তোমাকে স্মরিয়া।।

প্রভু বলে গোঁসাইজী রহ সাবধান।

অন্যে যেন নাহি পায় তত্ত্বের সন্ধান।।

হাসিয়া লোচন বলে “তুমি মম গুরু।

তব আজ্ঞা শিরোধার্য বাঞ্ছা কল্প তরু।।

 হেনকালে এক নারী এসে ত্বরা করি।

বলে ‘শুভ সমাচার শুনহে শ্রীহরি।।

আদ্যাশক্তি শান্তিদেবী তোমার ঘরণী।

চন্দ্রসম পুত্র কোলে পেয়েছে এখনি।।

নাচিয়া নাচিয়া বলে গোস্বামী লোচন।

“বিশ্বগুরু” এল নেমে শ্রীগুরু চরণ।।

ভক্ত সবে গুরুচাঁদ তাহারে কহিবে।

ধন্যরে কলির জীব সকলে তরিবে।।

আনন্দে উতলা যেন প্রভু হরিচন্দ্র।

ভক্ত গণে ডাকি বলে শুন ভক্ত বৃন্দ।

ক্ষান্ত কর নাম গান শুনহে বচন।

দেখ সবে অদ্য কেবা এসেছে এখন।।

কথা শুনি ভক্তগণে ক্ষান্ত করে নাম।

লোচনের প্রতি রহে চেয়ে অবিরাম।।

লোচনে দেখিয়া সবে ভাবে মনে মনে।

দেখিতে বলিল প্রভু এই মহাজনে।।

ভকতের ভাব দেখি শ্রী লোচন কয়।

“মুক্তা ফেলি কাচ পানে বল কেবা চায়।।

শুনহে ভক্ত সবে শুভ সমাচার।

শান্তি মাতা কোলে পেল প্রভু দিগম্বর।।

এই কথা শ্রী লোচন যখনি বলিল।

আনন্দে ভক্ত সবে নাচিয়া উঠিল।।

প্রসূতি গৃহের পানে সবে ছুটি যায়।

গৃহের নিকটে থাকি শুনিবারে পায়।।

আব্ আব্ মত শব্দ গৃহ মধ্যে হয়।

ববম্ ববম্ শব্দ যেন শোনা যায়।

আরও আশ্চর্য এক সকলে দেখিল।

শত সূর্য রশ্মি যেন গৃহেতে ফুটিল।।

পিছু পিছু হরিচাঁদ আসিয়া দাঁড়ায়।

রশ্মি আসি প্রভু পদে আপনি লুকায়।।

এই দৃশ্য দেখি ভক্ত বলে হরি হরি।

প্রেমানন্দে ভূমে পড়ে করে গড়াগড়ি।।

ভক্ত নারী উলুধ্বনি করে অবিরত।

ভক্ত মুখে চলে ছুটে হরিধ্বনি স্রোত।।

আনন্দে ভকত যত করে নানা খেলা।

লম্ফ ঝম্ফ করে কেহ ভাবেতে উতলা।।

ভাবোন্মাদ হীরামন হাসে অট্টহাসি।

লম্ফদিয়া শ্রী গোলক পৃষ্ঠে পড়ে আসি।।

প্রেমের আলাপে তারে কহে হীরামন।

আমি কি বৃষভ নাকি শিবের বাহন।।

ভাবালাপ শুনি বলে গোস্বামী গোলক।

আপনা বৃষভ বলি হাসাইলে লোক।।

এ নহে কৈলাশ কিম্বা নহে স্বর্ণ কাশী।

জানো নাকি ওড়াকান্দি কিসে ভালবাসি।।

শত গোলকের চেয়ে ধন্য ওড়াকান্দি।

শত ব্রহ্মা শত শিব রহে হেথা বন্দি।।

আমার সোনার চাঁদ প্রভু হরিচাঁদে।

মনপ্রাণ সঁপে পদে রেখেছে যে বেঁধে।।

সে কেন শিবের হবে সামান্য বাহন।

মূল না জানিয়া তাই বল এবচন।।

এই ওড়াকান্দি আজ যেবা আসিয়াছে।

ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব আদি ক্ষুদ্র তাঁর কাছে।।

এতেক কহিল যদি গোস্বামী গোলক।

হীরামন ভূমে লুটে হইয়া পুলক।।

দুই সাধু জড়াজড়ি পড়াপড়ি করে।

আনন্দে মাতিয়া ভক্ত নৃত্য করে ঘিরে।।

কোন ভক্ত ফাগ গুলি পাত্রেতে করিয়া।

উভয় সাধুর গাত্রে দিতেছে ঢালিয়া।।

দেখিয়া ভক্তে করে উচ্চ হরি ধ্বনি।

বজ্র স্বরে গেল যেন ভেদিয়া মেদিনী।।

ভাবের প্রলাপ কত কহে ভক্ত সবে।

মৃত্যুঞ্জয় বৃহস্পতি আরোপের ভাবে।।

উচ্চ কন্ঠে ডেকে বলে সাধু মৃত্যুঞ্জয়।

“তোরা কি করিস সবে ভাবে বোঝা দায়।।

দেবগুরু বৃহস্পতি আমি আসিয়াছি।

তোদের আচার দেখে আশ্চর্য মেনেছি।।

এসেছে দয়াল হরি হরিচাঁদ রূপে।

ক্ষীরোদের নাথ মর্তে নরের স্বরূপে।।

কাঁদা কাঁদি করি তোরা কি কর্ম করিস।

বুঝে নাহি পাই আমি কাজের হদিশ।।

প্রেমেতে বসতি করে হ্লাদিনী যে শক্তি।

তারে পূজি সুখী সবে তাতে অনুরক্তি।।

দেবী বাণী প্রভু প্রিয়া অবিদ্যা নাশিনী।

তাঁরে ভূলি কিবা পূজ শকতি হ্লাদিনী।।

বেদরূপে জন্মে বাণী প্রভুর শ্রীমুখে।

কন্যারূপে বক্ষ মধ্যে রাখিয়াছি তাঁকে।।

বাণী পূজা বাণী সেবা কর সবে আজি।

ভাবের প্রলাপ ছাড়ি হও কাজে কাজি।।

এত যদি ভাবালাপে কহে মৃত্যুঞ্জয়।

মহাভাবে হীরামন বলিছে তাঁহায়।।

“ওরে বেটা বৃহস্পতি কোথা তোর বাড়ি।

কোন মুখে এলি বেটা দিতে হেথা আড়ি।।

বিদ্যার জননী নাকি তোর সরস্বতী।

মোর প্রভু হরিচাঁদ সরস্বতী-পতি।।

বিদ্যা কি অবিদ্যা মোরা কিছু নাহি মানি।

সর্ব সার মূল তত্ত্ব হরিচাঁদে জানি।।

তোর যে জননী বিদ্যা সেবাদাসী হয়ে।

দিবানিশি প্রভুপদে রয়েছে পড়িয়ে।।

হ্লাদিনী ব্যাধিনী প্রায় প্রভু পদে রয়।

এমন চরণ যদি চোখে দেখা যায়।।

তার কিসে লাগে বল বাণী কি হ্লাদিনী।

মূল ছেড়ে ডাল লয়ে কর টানাটানি।।

ভক্তি মুক্তি নাহি চাই চাহিনা সম্পদ।

যদি বাবা হরিচাঁদ দেয় রাঙ্গা পদ।।

ভক্তের আলাপ শুনি দয়াল ঠাকুর।

ভক্ত গণে ডাকি বলে বাক্য সুমধুর।।

“শুন শুন সাধুগণ আমার বচন।

ভাবালাপ করে সবে আনন্দে মগন।।

সর্ব সিদ্ধি দাতা হয় হরি ভক্ত গণ।

তোমাদের কাছে তাই এই আবেদন।।

যেই পুত্র করিয়াছে হেথা আগমন।

তাঁর গুণে মুক্তি যেন পায় নরগণ।।

এই বংশ তার গুণে যেন ধন্য হয়।

তারে দেখে দুঃখী তাপী যেন শান্তি পায়।।

হরিভক্ত গণ সবে করো আশির্বাদ।

শ্রী গুরুচাঁদের যেন পুরে মনোসাধ।।

প্রভু যবে এই কথা বলে ভক্ত ঠাঁই।

কাঁদিয়া ভকতে বলে দয়াল গোসাই।।

তোমার লীলার তত্ত্ব মোরা কিবা জানি।

যাহা কও যাহা দেও তাই মাত্র মানি।।

সর্ব ফলদাতা হয় তোমার চরণ”।।

এই ভাবে গুরুচাঁদ অবতীর্ণ হ’ল।

ধরার কলুষরাশি দুরে চলে গেল।।

অবতীর্ণ গুরুচাঁদ পরম রতন।

হরি-গুরুচাঁদ প্রতি হরি বল মন।।


No comments: