Tuesday, July 28, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 4 বাল্য লীলা ও বিদ্যাভ্যাস

 

গুরুচাঁদ জন্ম নিল হরিচাঁদ ঘরে।

শান্তি মাতা আনন্দিত মুখচন্দ্র হেরে।।

অনিমেষ হেরে মুখ দুটি আঁখি ভরে।

সতত চুম্বেন দেবী কোমল অধরে।।

আধ আধ স্বরে যবে মা মা বলি ডাকে।

স্মৃতি হারা শান্তি মাতা পুত্রে সারে বুকে।।

ক্রমে ক্রমে দিন গত সপ্তম বরষে।

গুরুচাঁদ করে খেলা মনের হরষে।।

অদ্ভুত শিশুর খেলা লাগে যে বিস্ময়।

ধীর স্থীর সুগম্ভীর মহা ভাবময়।।

যতেক খেলার সাথী আছে তাঁর কাছে।

খেলিবে কি ভয়ে ভয়ে, সবে রহে পিছে।।

যেই আজ্ঞা গুরুচাঁদ করে সাথী প্রতি।

আজ্ঞা মত করে কাজ তরান্বিত অতি।।

বাহ্য দৃষ্টে মনে হয় বড়ই কঠিন।

বয়সে বালক বটে কার্যেতে প্রবীণ।।

অন্তরের অন্তঃস্থলে বড়ই দয়াল।

যেই জন ভালবাসে সে পায় নাগাল।।

একদা ঘটনা এক শুন মন দিয়া।

কোমল পবিত্র কত গুরুচাঁদ হিয়া।।

অনাথ বালক এক ভিক্ষার কারণে।

গ্রাম পথে চলি যায় আপনার মনে।।

দুরন্ত বালক কত জুটি এক সাথে।

অনাথ বালকে বেড়ি ধরে তার হাতে।।

একাকী পাইয়া তারে করে অত্যাচার।

নিরুপায় সে অনাথ করে হাহাকার।।

তাহার ক্রন্দনে হাসে দুরন্তের দল।

থুথু দেয় মুখে তার এত বড় খল।।

দূর হতে গুরুচাঁদ তাহা দৃষ্টি করি।

অন্তরে বেদনা পেয়ে আসিল বাহুড়ি।।

ষষ্ঠ বর্ষ বয় ক্রম হবে যেই কালে।

মহা ক্রোধ করি প্রভু দুষ্ট গণে বলে।।

“আরে রে দুরন্ত সব এ কেমন কথা।

একা পেয়ে অনাথেরে দেও তারে ব্যথা”।।

ভাল যদি চাও তবে দূরে যাও সরে।

তা না হলে শাস্তি দেব কঠিন প্রহারে।।

সংহার মূরতি দেখি দুরন্তের গণ।

ভীত হয়ে দ্রুত গতি করে পলায়ন।।

তবে প্রভু অনাথেরে সাথে করি চলে।

উপনীত নিজালয়ে জননীর স্থলে।।

বলে মাগো এই জন বড়ই কাঙ্গাল।

মার খেয়ে দেখ এর চোখে বহে জল।।

একে খেতে দাও অন্ন, আর ভিক্ষা দাও।

আমার মনের দুঃখ জননী ঘুচাও।।

গুরুচাঁদ মুখে শুনি এই মধু বাণী।

আনন্দে কোলেতে তাঁরে করেন জননী।।

বলে ডেকে “যাদুমনি তব দয়া জোরে।

আনাথের দুঃখ গেল আজ চিরতরে।।

ক্ষীরোদ বাসিনী দেবী এ বাক্য কহিল।

অনাথ বালকে ডেকে অন্ন খেত দিল।।

ভোজানান্তে অনাথেরে কহিলা জননী।

“কিবা ভিক্ষা নিবে আর যাও যাদুমনি।।

সে অনাথ মাতৃবাক্যে ফিরে গেল ঘরে।

গিয়ে দেখে খুরা তার গেছে পরপারে।।

তাহার যতেক বিত্ত আছিল প্রচুর।

অনাথ বালকে পেয়ে দুঃখ হল দূর।।

বয়স সপ্তম বর্ষ পরিপূর্ণ হল।

হরিচাঁদ গুরুচাঁদে নিকটে ডাকিল।।

বলে শুন বাপ ধন বলি তব ঠাঁই।

নমঃশূদ্র কুলে দেখ বিদ্যা শিক্ষা নাই।।

 আমার প্রাণের ইচ্ছা তোমাকে পড়াই।

বিদ্যার অমূল্য মূল্য জগতে শিখাই।।

কথা শুনি গুরুচাঁদ অতি হর্ষ ভরে।

বলে “বাবা অই ইচ্ছা আমার অন্তরে”।।

পদ্মবিলা বাসী সাধু দশরথ নাম।

ছাত্র গণে শিক্ষা দিত সেই গুণধাম।।

তার গৃহে ছিল বটে এক পাঠশালা।

দশরথ দেয় শিক্ষা তথা দুই বেলা।।

একদিন দশরথ আসি ওড়াকান্দী।

বসিলেন শ্রী হরির পাদ পদ্ম বন্দি।।

হরিচাঁদ বলে শুন সাধু দশরথ।

তব কাছে বলি আমি মম মনোরথ।।

আমার নন্দন দেখ শ্রী গুরু চরণ।

উহাকে বিদেশে দিব বিদ্যার কারণ।।

তব গৃহে পাঠশালা আছে অনুপম।

আমি নাহি জানি তার কিসে কি নিয়ম।।

মম পুত্র গুরুচাঁদে সাথে করি লও।

বাঙ্গলা মতের শিক্ষা তাহারে শিখাও।।

কথা শুনি দশরথ আনন্দে কহিল।

“জীবন সার্থক মোর আজিকে হইল।।

তবে শুভ দিন এক দশরথ দেখে।

গুরুচাঁদে সঙ্গে নিল মনের পুলকে।।

গৃহে রাখি যত্ন করি বিদ্যা শিক্ষা দেয়।

গুরুচাঁদ দেখা মাত্র সব শিখি লয়।।

ক্রমে ক্রমে দশরথ উদাসী সাজিল।

গুরুচাঁদ তাই পদ্মবিলা ছাড়ি এল।।

মল্লকান্দী গ্রামে ঘর শ্রী গোলক নাম।

শ্রী হরির প্রিয় ভক্ত অতি গুণধাম।।

তাঁহার চরিত্র কথা কবি রসরাজ।

বর্ণিলেন শ্রী শ্রী হরি লীলামৃত মাঝ।।

গোলকের পুত্র নাম গিরি কীর্ত্তনীয়া।

গুরুচাঁদে বাসে ভাল মন প্রাণ দিয়া।।

উভয় বয়সে তুল্য চরিত্রে তেমতি।

গিরিধর সাজিলেন গুরুচাঁদ সাথী।।

তবে সে গোলকে ডাকি হরি দয়াময়।

বলে শুন হে গোলক যাহা মনে লয়।।

মম পুত্র গুরুচাঁদে বিদ্যাশিক্ষা তরে।

রাখিবারে চাই বাপু তোমাদের ঘরে”।।

গোলক পুলক চিত্তে বলে “ওহে নাথ।

তব করুণায় করি কোটী দণ্ডবৎ।।

শ্রী গুরু চরণ যদি মোর বাড়ি রয়।

আমি ছার মোর বংশে সবে ধন্য হয়”।।

অতঃপর গুরুচাঁদ মল্লকান্দী গ্রামে।

বিদ্যা শিক্ষা করে থাকি গোলকের ধামে।।

শ্রী গুরুচরণ আর সাধু গিরিধর।

এক আত্মা দুই দেহ ভিন্ন কলেবর।।

তাহার প্রমাণ শুন পরবর্তী কথা।

গিরিধর কির্তুনের অপূর্ব বারতা।।

হরিচাঁদ কায়া প্রভু লুকাইয়া যায়।

গুরুচাঁদে শক্তিরূপে অধিষ্ঠান হয়।।

কিছুকাল পরে দেখ দৈবের ঘটন।

মহাজ্বরে গুরুচাঁদে করে আক্রমণ।।

প্রভুর অসাধ্য লীলা বুঝিবারে নারি।

ক্ষণে ক্ষণে ডেকে বলে আমি বুঝি মরি।।

প্রভুর ব্যাধির কথা শুনি গিরিধর।

উপনীত ওড়াকান্দী প্রভুর গোচর।।

প্রাণসখা গিরিধরে দেখিয়া নয়নে।

ডেকে বলে গিরি দাদা আর এলে কেনে।।

আমার দারুণ ব্যাধি হয়েছেরে ভাই।

সকলে বিদায় দাও দেহ ছেড়ে যাই।।

কথা শুনি গিরিধর চমকিত হল।

কিছুকাল স্তব্ধ রহে কিছু না কহিল।।

পরে ডেকে বলে শুন গুরুচাঁদ সোনা।

পরপারে এবে তোর যাওয়া হবে না।।

 জগতের বোঝা তোরে দিয়াছে গোঁসাই।

তুই গেলে জগতের উপায় যে নাই।।

এতই জ্বরের যদি হয়ে থাকে ক্ষুধা।

তোরে ফেলে মোরে নিক নাই কোন বাধা।।

সামান্য মানব আমি সামান্য জীবন।

বাঁচি মরি তাতে নাই দুখের কারণ।।

আমি গেলে দেখ মাত্র এক প্রাণ যাবে।

তুই গেলে বল কোথা জগত দাঁড়াবে।।

অপার মহিমাশালী সেই গিরিধর।

গৃহে যেতে সেই দিনে দেহে নিল জ্বর।।

ক্রমে বৃদ্ধি হ’ল জ্বর গিরির শরীরে।

কালজ্বর গুরুচাঁদে তা’তে গেল ছেড়ে।।

সপ্তাহ পরেতে প্রভু নীরোগ হইল।

গিরিধর জ্বর রোগে জীবন ত্যজিল।।

এমন মহান ছিল সেই গিরিধর।

তার সাথে গুরুচাঁদ পড়ে একত্তর।।

বয়সে বালক দোহে জ্ঞানেতে প্রবীণ।

ভিন্ন ভাবে দেখা দেখি নাহি কোনদিন।।

মাঝে মাঝে দুই জনে ওড়াকান্দী যায়।

পুনঃ ফিরে আসে দোহে গিরির আলয়।।

তিন বর্ষ এই ভাবে বিদ্যা শিক্ষা করি।

গুরুচাঁদ এল ফিরি ওড়াকান্দী বাড়ী।।

বাসনা প্রবল প্রভুর বিদ্যালাভ তরে।

মনোভাব প্রকাশিল পিতার গোচরে।।

কথা শুনি হরিচাঁদ আনন্দ পাইল।

ওড়াকান্দী মক্তবেতে প্রভুকে পাঠা’ল।।

কিছুকাল তথাকারে শ্রী গুরুচরণ।

আরবী পারসী ভাষা করে অধ্যয়ন।।

সাধু গুরু মতুয়ার চরণে প্রণতি।

সেকালের শিক্ষা রীতি বলিব সম্প্রতি।।

সতেরশ সাতান্ন সালে পলাশীর ক্ষেত্রে।

ইংরাজ লভিল বঙ্গে রাজ দণ্ড ছত্রে।।

শত বর্ষ লাগে প্রায় ভারত বিজয়ে।

কোম্পানী রাজত্ব করে স্বার্থেতে মজিয়ে।।

প্রজার সুখের দিকে কিছু লক্ষ্য নাই।

স্বার্থ পেলে সর্বশান্তি আর কিবা চাই।।

আচার বিচার নীতি শিক্ষা দীক্ষা যত।

যার ধর্মে যাহা যাহা তার তার মত।।

মুসলিম রাজত্ব কালে উর্দ্দু পার্শি ভাষা।

রাজ ভাষা বলি তারা মান্য পেল খাসা।।

রাজার প্রসাদ লোভী যারা যারা ছিল।

রাজ কার্যে রত থাকি সে ভাষা শিখিল।।

রাজধানী হতে দূরে যত জমিদার।

পৌরাণিক মতে চলে তাদের বিচার।।

রাজ কর দিলে আর কোন চিন্তা নাই।

নিজ রাজ্যে স্ব-প্রধান ভূ স্বামী সবাই।।

তাহার প্রমাণ আছে দ্বাদশ ভূস্বামী।

বার ভূঁইয়া নামে খ্যাত এই বঙ্গ ভূমি।।

নিজ দেশে স্ব-প্রধান জমিদার যত।

শিক্ষা দীক্ষা দেয় সবে নিজ মনোমত।।

প্রায়শঃ বঙ্গেতে ছিল হিন্দু জমিদার।

নিজ রাজ্যে তারা সবে শিখা’ত আচার।।

জমিদারী মহাজনী দলিল লিখন।

শিক্ষা বলি ছিল এই দেশে প্রচলন।।

ইহার অধিক যদি শিখিবারে চায়।

টোলে শিখি দেব ভাষা শাস্ত্র বেত্তা হয়।।

কেহ যদি রাজ কার্যে চাহে পশিবারে।

রাজভাষা শিক্ষা করে মুন্সীর গোচরে।।

চতুষ্পাঠী খুলি রহে ব্রাহ্মণ সুজন।

ছাত্রগণে শিক্ষা দেয় লিখন পঠন।।

বেতন বলিয়া কিছু না ছিল তখন।

বিনা মূল্যে শিক্ষা দিত যশের কারণ।।

স্বেচ্ছা কৃত দান প্রায় দ্রব্যাদি সম্ভার।

সেই দানে গুরুজীর চলিত সংসার।।

যেইকালে গুরুচাঁদ আবির্ভূত হল।

পূর্বাপর প্রথা প্রায় বর্তমান ছিল।।

সেই রীতি অনুসারে শিক্ষা লাভ করি।

দ্বাদশ বর্ষের কালে পড়া দিল ছাড়ি।।

গৃহে বসি শাস্ত্র পাঠ করে নিয়মিত।

ক্ষণে ভ্রমে ভক্ত গৃহ পিতার সহিত।।

তরুণ অরুণ কান্তি দিব্য মনোহর।

রূপ দেখি ভক্তগণে লাগে চমৎকার।।

গম্ভীর মূরতি প্রভু চারু কলেবর।

বালবেশে শোভে যেন আপনি ভাস্কর।।

চন্দ্রকলা সম প্রভু বাড়ে দিনে দিন।

এ দিকেতে হরিচাঁদ ক্রমে উদাসীন।।

সংসার ত্যজিয়া প্রভু উদাসী সাজিল।

গৃহস্থ আশ্রমে গুরুচাঁদকে রাখিল।।

No comments: