Monday, August 24, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 58 নমঃশূদ্র আন্দোলন ও চন্ডাল গালি মোচন

অতঃপর আর দিনে মীড আসি কয়।


যাহা বলি কর তাই কর্ত্তা মহাশয়।।


দেশে দেশে আছে যত প্রধান প্রধান।


সবারে ডাকিয়া তুমি কর আজ্ঞা দান।।


সবে যেন নিজ দেশে করে আন্দোলন।


যাহাতে চন্ডাল গালি হয় বিমোচন।।


মীডের বচনে প্রভু সুখী অতিশয়।


দেশে দেশে জনে জনে সংবাদ পাঠায়।।


এই ভাবে দেশে দেশে হল আন্দোলন।


কিভাবে কোথায় হল করিব বর্ণন।।


আদি জেলা যশোহর করে আন্দোলন।


পিয়ারী চরণ ঢালী নামে একজন।।


নড়াইল আদালতে ছিল চাপড়াশী।


কালী শঙ্কর সুকুল তার প্রতিবেশী।।


নমঃশূদ্র জাতি তত্ত্ব জানিবার তরে।


জিজ্ঞাসা করিল ঢালী তাঁহার গোচরে।।


তিনি বলিলেন তাহা মের জানা নাই।


জিজ্ঞাসা করিতে পার তারকের ঠাঁই।।


তাঁর কাছে গেলে হতে পারি নিরূপণ।


পিয়ারীচরণ এল তারকের ঠাঁই।


বলে এক কথা মোরে বলহে গোঁসাই।।


নমঃশূদ্র জাতিতত্ত্ব কোন শা্স্ত্রে আছে।


অবশ্য বলুন তাহা আমাদের কাছে।।


শ্রীতারক বলে শুন ঢালী মহাশয়।


সেই কথা গুরুচাঁদ বলেছে আমায়।।


‘শক্তি সঙ্গম তন্ত্রের বিধানে বিধান।


নমঃশূদ্র জাতিতত্ত্ব তাহাতে প্রমাণ।।


গোপীনাথপুরবাসী দ্বারিক মোক্তার।


পিয়ারীর কাছে জানে এই সমাচার।।


তন্ত্র বই আনিবারে বহু চেষ্টা হল।


কিন্তু সেই গ্রন্থ পরে কোথা না মিলিলি।।


নিরাশ হইয়া পড়ে দ্বারিক সুজন।


প্রভু ঠাঁই ওড়াকান্দী করে আগমণ।।


প্রভু বলে “মহাশয়, এক কার্য্য কর।


আলোচনা সবে মিলে কর পরস্পর।।


নানা জেলা হতে সব কর দরখস্ত।


যাহাতে চন্ডালগালি হয় বরখাস্ত।।


এ কার্য্যে সাহায্য পাব মীডের নিকটে।


বলেছি সকল কথা তারে অকপটে।।”


প্রভুর বচনে তবে দ্বারিক মোক্তার।


দেশে দেশে পাঠাইল এই সমাচার।।


আসামে মোক্তার ছিল নামে কুসীরাম।


এই কার্য্যে চেষ্টা তেঁহ করে অবিরাম।।


খুলনা জিলায় বাবু শ্রীরাইচরণ।


পরেশ হালদার বলি ছিল অন্য জন।।


ঢাকা ত্রিপুরাতে ছিল প্রধান যাহারা।


সকলে মিলিয়া কার্য্য করিল তাহারা।।


যশোর ফরিদপুরে নমঃশূদ্রগণ।


গ্রামে গ্রামে করে সবে এই আন্দোলন।।


বোমভাগ গ্রামে ঘর ঈশ্বর পন্ডিত।


বহু কার্য্যে স্বজাতির যিনি করে হিত।।


ভবানীপুরেতে ঘর রামনারায়ন।


আটেরহাটেতে বাস শ্রীগুরুচরণ।।


ধুসাহাটী বাসী হয় হরি নারায়ণ।


খামার গ্রামেতে ঘর শ্রীউমাচরণ।।

 

 

 

সবে মিলি এক ঠাঁই করে আলেচনা।


“ওড়াকান্দী বড়কর্তা করেছে কামনা।।


দরখাস্ত কর সবে রাজার নিকট।


গ্লানি দুর হবে তাতে জব্দ হবে শঠ।।


যেই আজ্ঞা বড় কর্তা করিয়াছে সবে।


চল মোরা সবে কাজ করি সেই ভাবে।।”


এই ভাবে দেশে দেশে করে আন্দোলন।


পরে দরখাস্ত করে নমঃশূদ্র গণ।।


এদিকে প্রভুর গৃহে ওড়াকান্দী গাঁয়।


দেশবাসী সবে আসি উপনীত হয়।।


শ্রীবিধু চৌধুরী আর ভীষ্মদেব দাস।


শ্রীচন্ডী বৈরাগী ধন্য তালতলা বাস।।


আর বহুজন এল ওড়াকান্দী বাড়ী।


দরখস্ত সহি সবে করে তাড়াতাড়ি।।


সেন্সাসের বড় কর্তা ছিল পাঞ্চাবেতে।


নামেতে মিষ্টার গেট কার্য্য তাঁর হাতে।।


যত যত দরখস্ত গেল বঙ্গ হতে।


গুরুচাঁদে “নেতা” বলি উল্লেখ তাহাতে।।


শ্রীহরি ঠাকুর হল মহান পুরুষ।


তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ উন্নত মানুষ।।


যেই ঘরে হেন লোক জন্ম ধরিয়াছে।


সেই জাতি এ জগতে হীন রবে কিসে?


এমত প্রকারে থাকে বহুতর যুক্তি।


সকলে প্রার্থণা করে নমঃশুদ্র-মুক্তি।।


ওড়াকান্দী হতে যেই দরখাস্ত গেল।


“ইহাতে সম্মত আমি” মীড লিখি দিল।।


দরখাস্ত পঁহুছিল গেটের নিকট।


গেট ভাবে দরখাস্ত নাহবে কপট।।


তত্ত্ব জানিবারে তেঁহ সাব্যস্ত করিল।


ন্যায়রত্ন মহেশের নিকটে লিখিল।।


ন্যায়রত্ন বঙ্গদেশে প্রধান পন্ডিত।


জাতিমালা গ্রন্থ হ’ল তাহার রচিত।।


সরকারী কার্য্যে তার ছিল বহুমান।


তার যুক্তি শ্রেষ্ঠ যুক্তি অকাট্য প্রমাণ।।


এই কার্য্যে ছিল তেঁহ রাজকর্ম্মচারী।


বয়সে প্রচীণ তাহে বেতনাদী ভারী।।


মর্ম্ম জানিবারে গেট তাহারে লিখিল।


পত্র পেয়ে ন্যায়রত্ন অবাধে কহিল।।


“বঙ্গদেশে নমঃশূদ্র বলে জাতি নাই।


“চন্ডাল” সকলে তারা প্রমাণেতে পাই।।


বড়ই অসভ্য জাতি বিদ্যা শিক্ষা নাই।


চন্ডাল বলিয়া ব্যাখ্যা করিলাম তাই।।


জবাব পাইয়া গেট ভাবে মনে মন।


ন্যায়রত্ন এই ব্যাখ্যা করে কি কারণ?


পুনরায় দরখস্ত করিল বাহির।


ডক্টর মীডের সহি দেখিল সুধির।।


মনে ভাবে “মীড যদি তত্ত্ব নাহি জানে।


দরখস্ত পরে সহি করিল কেমনে?


অবশ্য লিখিব আমি মীডের নিকটে।


মূলতত্ত্ব মোরে তিনি লিখিবেন বটে।।


এত বলি অবিলম্বে সেই মহাশয়।


মীডের লিখিল পত্র যাহা যাহা হয়।।


পত্র পড়ি মীড প্রাণে পাইল আঘাত।


অবিলম্বে উপনীত প্রভুর সাক্ষাৎ।।


সবিশেষে সমাচার প্রভুকে কহিল।


প্রভু বলে “শোন মীড উপায় কি বল?”


মীড বলে “ভাবিয়াছি আমি সদুপায়।


আমি স্বাক্ষী দিব দেখি তাতে কিবা হয়।।


বঙ্গদেশে মিশনারী যে যেখানে আছে।


অবশ্য লিখিব আমি সকলের কাছে।।


আমাদের সাক্ষ্যে দেখি কিবা ফলে ফল।


রাজ-পুরোহিত মোরা সেই মাত্র বল।।”


এত বলি মীড লেখে মিশনারী ঠাঁই।


নমঃশূদ্র পক্ষে আমি সাক্ষ্য দিতে চাই।।

 

তোমরা সকলে তাতে সাহায্য করিবে।


নমঃশূদ্র হীন নহে এ কথা লিখিবে।।


সেই ভাবে লিখে তাহা দিবে মম ঠাঁই।


মীডের লিখন পেয়ে যত মিশনারী।


আনন্দে লিখিয়া দিল এক এক করি।।


সকলের লেখা যবে আসিয়া পড়িল।


আপনার পত্র মীড তখনে লিখিল।।


প্রভুর নিকটে জানে যত সমাচার।


একে একে লেখে মীড চিঠির ভিতর।।


সর্ব্বশেষ নিজ সাক্ষ্য পশ্চাতে লিখিল।


রাজ-দ্বারে এ জাতির দলিল হইল।।


প্রথমে লিখিল মীড “আমি মিশনারী।


ধর্ম্ম প্রচারিতে সদা বঙ্গদেশে ঘুরি।।


এ দেশেরে যত জাতি চিনি সকলেরে।


খৃষ্টধর্ম্মী আছে জাতি সবার ভিতরে।।


কোন জাতি কি আচারে জীবন কাটায়।


সকলের তত্ত্ব আমি জানি মহাশয়।।


ব্রাহ্মণের ঘরে যদি কেহ মারা যায়।


একাদশ দিনে বটে তার শ্রাদ্ধ হয়।।


গয়াতীর্থ পর করে পুনঃ পিন্ড দান।


এই অধিকার নহে সবার সমান।।


“অন্ন পিন্ড” দিতে পারে শুধুই ব্রাহ্মণ।


অন্ন পিন্ড শূদ্রে দিতে পারে না কখন।।


ব্রাহ্মণের গলে থাকে যজ্ঞ-উপবীত।


তার বিয়া নাহি হয় অন্যের সহিত।।


ব্রাহ্মণের কন্যা ভিন্ন বিয়া নাহি করে।


পূজা পার্ব্বণাদি হয় ব্রাহ্মণের ঘরে।।


নমঃশূদ্র বলি যারে লিখিয়াছি আমি।


কিসে যে ‘চন্ডাল’ হল জানে অন্তর্য্যামী।।


আচার বিচার সব ব্রাহ্মণের মত।


শুধু মাত্র গলে নাই যজ্ঞ-উপবীত।।


আর এক ব্যবহার আছে বটে ভিন্ন।


কৃষি কর্ম্ম করে তারা সকলের জন্য।।


এই কার্য়্যে জানি আমি অতীব পবিত্র।


কৃষক সবার বন্ধু নহে কর ভৃত্য।।


আমি বলি এই জাতি নিশ্চয় ব্রাহ্মণ।


হীন হয়ে আছে শুধু হিংসার কারণ।।


এ জাতির ঘরে আছে এই মত লোক।


ধনে মানে ধন্য তারা জীবের পালক।।


বিশেষতঃ গুরুচাঁদ ওড়াকান্দী গ্রামে।


বহু শিষ্য আছে তাঁর সারা বঙ্গভূমে।।


কায়স্থ ব্রাহ্মণ বৈদ্য আর নবশাখ।


তেলী মালী নমঃশূদ্র আছে লাখে লাখ।।


তাঁর পিতা হরিচাঁদে বলে অবতার।


এই দেশে এক ধর্ম্ম করেছে প্রচার।।


রাজকর্ম্মে অধিকার পেয়েছে এ জাতি।


বলিলাম সব আমি তোমাকে সংপ্রতি।।


আর এক কথা মোর হইয়াছে মনে।


এই জাতি পিছে নহে নারীর সম্মানে।।


বিধবা বিবাহ প্রথা এরা মান্য করে।


ব্যাভিচারী নহে তারা এ জাতির ঘরে।।


এসব কারণে আমি বলিনু নিশ্চয়।


নমঃশূদ্র কোন কালে চন্ডাল না হয়।।


আদিকালে এরা সবে ছিল যে ব্রাহ্মণ।


ক্ষুদ্র কিংবা শুদ্র এরা না হবে কখন।।


এই আমি লিখিলাম যাহা সত্য কথা।


‘চন্ডাল’ কাটিয়া দিতে করো না অন্যথা।।


শুধু আমি নাহি আর যত মিশনারী।


তাঁহাদের লেখা দিনু একসঙ্গে করি।।


সকল পড়িয়া তুমি করিবে বিচার।


‘চন্ডাল’ কোটিতে আমি বলি আরবার।।


এইভাবে পত্র গেল গেটের অফিসে।


পত্র পেয়ে আসে সব গেটের বিশ্বাসে।।

 

নমঃশূদ্র নহে ক্ষুদ্র নহকে চন্ডাল।


এরা সবে এক-জাতি ব্রাহ্মণের দল।।


‘চন্ডাল’ কাটিতে তাই করিল মনন।


মীডে লিখি জানাইল সেই বিবরণ।।


সঙ্গে সঙ্গে লিখিবেন প্রভুজীর ঠাঁই।


“আপনার দরখস্তে যাহা যাহা পাই।।


আরো যাহা সাক্ষ্য মোরে দিয়াছেন মীড।


তাতে দেখি ‘নমঃশূদ্র’ লেখাই উচিত।।


পুনরায় হবে যবে লোকের গানা।


“নমঃশূদ্র লেখা হবে নিশ্চয় ঘটনা।।


এইভাবে চন্ডালত্ব গালি মুছে গেল।


পুনঃ লোক গণনায় নমঃশূদ্র হল।।


এসব ঘটিল শুধু প্রভু-কৃপাগুণে।


নমঃশুদ্রে বন্ধুরূপে গুরুচাঁদে পাই।


গোপালের দয়া বলে তার গুণে গাই।।

 

No comments: