Friday, August 14, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 33 কর্ম তরঙ্গে শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ

প্রস্তাবনা

 

হরিতে ধর্মের গ্লানি রক্ষিতে সাধক প্রানী


নিজ গুণে গুণমণি আসে।


নাশিতে দুষ্টের শক্তি নিয়ে বিভু-প্রেম-ভক্তি


নরাকারে ধরাধামে আসে।।


আদরিণী কন্যা ধরা যুগে যুগে আছে ধরা


প্রেমময় পিতা তারে রাখে।


অঙ্গে যবে মাখি ধূলা শোকে দুঃখে শোকাকুলা


‘আয়! কোলে আয়’ বলি ডাকে।।


আপন কোমল করে ধূলা মাটি দূর করে


অমল-ধবল করে অঙ্গ।


ধরা হাসে খল খল মুছে ফেলে আঁখিজল


দেখি খুশী হয় কি সে-ত্রিভঙ্গ।।


কিছু কাল পরে হায় ধরা সব ভূলে যায়


পুনরায় ধূলি পড়ে লুটে।


সারা গায় মাখি ধূলা কাঁদে বসি সারা বেলা


ক্ষমা ভিক্ষা করে করপুটে।।


আহা কিবা দয়াময় গলে’ যায় সে কান্নায়


পুনঃ বুকে টানি লয় তারে।


বলে ‘শুন ধরা রাণী! করনা এমন খানি


তোরে ধু’বে কেবা বারে বারে?


বারে বারে ধূলা মাখে ধূলা মেখে তারে ডাকে


বারে বারে সে ধুলা ধোয়ায়।


যুগে যুগে অভিনব কত হল এই ভাব


ভাবে ভাব অভাবনা হয়।।


চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা সবগুলি শিশু তারা


সব তার হাতের পুতুল।


সে যেন বসি একেলা আনমনে করে খেলা


খেলা তার আজানা অতুল।।


শিশু-সম সে বিরাট মেলিয়া সৃষ্টির নাট


দণ্ডে দণ্ডে কত গড়ে ভাঙ্গে।


কোথা উঠে হাসি রোল দুঃখ কোথা উতরোল


বাঁধা নাহি কিছু তার সঙ্গে।।


আপনি সে ইচ্ছা ময় সৃষ্টি করে স্ব-ইচ্ছায়


ইচ্ছা ভিন্ন নাহিক বিকার।


ভাঙ্গা-গড়া কাজ তার নাহি ধারে কারো ধার


অচিন্ত অমোঘ শক্তি তার।।


ইচ্ছা বহে’ শক্তি তাঁর তাই নামে ‘অবতার’


বাহ্য-দৃশ্যে আকারেতে ভিন্ন।


এ যেন সমুদ্র সাথে যোগ রাখি কোন মতে


ক্ষুদ্র কায় কূপ থাকে পূর্ণ।।

 

আকারে দেখিতে কূপ, অন্তহীন সিন্ধু-রূপ


প্রতি জল বিন্দু মাঝে আছে।


আকারে বিকার দেখি, মোরা কূপ বলে ডাকি


পরিপূর্ণ সিন্ধু তারি পাছে।


যিনি পূর্ণ তাঁর খণ্ড, খণ্ড আদি-মান-দণ্ড


খণ্ড খণ্ড জুড়ি’পূর্ণ হয়।


খণ্ডে-পূর্ণে নাহি ভেদ, আমরা করি বিভেদ


গণ্ডী রেখা ছায়া-বাজী প্রায়।।


সীমা দিয়ে দৃষ্টি ঘেরা, তাই নাহি দেখি মোরা


এক হয়ে আছে ‘পূর্ণ জুড়ি।


সীমানা ভাঙ্গিয়া যায়, তাহাতে প্রকাশ হয়


খণ্ড পূর্ণ দোহে জড়াজড়ি।।


ধরার বেদনা দেখি, আপনি কমলা আখি


খণ্ডে শক্তি দিয়া ব্যথা নাশে।


স্থুল-দৃষ্টি ধরা কয়, “এই মোর দয়াময়


অন্তরালে বসি প্রভু হাসে।।


শক্তি রূপে বার-বার, প্রভু হয় অবতার


শ্রেষ্ঠাকার নরাকার ধরে।


ধরার জনম খণ্ডে, ইতিহাস এ ব্রহ্মাণ্ডে


মীন কুৰ্মরূপে লীলা করে।।


সৃষ্টি অগ্রসর হয়, নর রূপ শ্রেষ্ঠ কয়


জীব-মধ্যে তারে শ্রেষ্ঠ কৈল।


চেতনাচেতন-তত্ত্ব, কিবা সত্য পরমার্থ


নর-মধ্যে জ্ঞান-শক্তি হৈল।


ঈশ শক্তি সুবিকাশ, মানবে হল প্রকাশ


অন্য জীবে হল না প্রকাশ।


নরে তাই ধরা পরে, দণ্ড শক্তি হাতে ধরে


নৃপ সাজি করিতেছে বাস।


নর মনে করে যুক্তি, অজানা অচেনা শক্তি


চরাচর শাসে রাজ দণ্ডে।


কিছু অংশ মোরা পাই, তাতে মনে করি ভাই


ঈশ শক্তি আছে এই ভাণ্ডে।।


ইচ্ছাময় ইচ্ছা করে, তাই প্রকৃতি উপরে


সহজাত অধিকার আছে।


নরাকারে পূর্ণ তিনি, সৰ্ব্বব্যাপী ব্যপ্ত যিনি


নর-মধ্যে শক্তি প্রকাশিছে।।


প্রত্যক্ষ তাঁহার রূপ নর-রূপ বিশ্বভূপ


তার মাঝে রহি দেয় সাড়া।


নর আর ভগবানে,ভেদ নাহি কোন খানে


নিজ রূপ নিজ-হাতে-গড়া।।


সেই শক্তি ইচ্ছাময়, করে যাহা ইচ্ছা হয়


আধারের না করে অপেক্ষা।


নশ্বরে সৃজিত দেহ, কোন দিনে কভু কেহ


শক্তি ছাড়ি নাহি করে ভিক্ষা।।


ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, শেষাবধি আদি হতে


নরাকারে এল হরিচাঁদ।


দেহ যবে হ’ল লয়, আপনি সে ইচ্ছাময়


পূর্ণ শক্তি রূপে গুরুচাঁদ।।


হরি চাঁদ-রূপ দেখে, দলিত পতিত বা কে ?


কিবা হেতু পতিত সংসারে?


দেখে ব্যভিচারে ভ্রষ্ট, যারা নাহি চিনে ইষ্ট


তেহ সবে অন্ধকারে মরে।।


মূল ভিত্তি সদাচার, পবিত্র চরিত্রটার


মুক্তি-মন্ত্র তেঁহ সবে দিল।


‘সং’সাজি সংসারে বদ্ধ, ধৰ্ম পথ সদা রুদ্ধ


সংসারের মায়া দূরে কৈল।।


সংসারে নাহিরে কিছু, সবে আয় মোর পিছু


কাঙ্গালের বেশে হরি কয়।


চিত্তভূমি সিক্ত কৈল, বপনের কাল হৈল


প্রেম-নীরে সবে ডুবে যায়।


এক দৃষ্টি এক ধ্যান, ভক্তি, পবিত্রতা, জ্ঞান


মলিনতা নাশে স্থিতি হৈল।


ক্ষেত্ৰ দেখি সুপ্রস্তুত, প্রভু যশোবন্ত সুত


রূপ ছাড়িবারে ইচ্ছা কৈল।।

 

আদিতে আবাদ করি, কর্ষণ করিল হরি


মুক্তি-বীজ আনে তার পরে।


কর্ষকের রূপ ছাড়ি, সাজিলা বপন-কারী


এক রূপে দুই নাহি করে।।


তাই রূপ অন্ত করি, গুরুচাঁদ রূপ-ধারী


হরি-গুরু পূৰ্ণচন্দ্র হৈল।


হরি যে-সংসার ছাড়ে, গুরুচাঁদ তাই ধরে


জগজীবে মহামুক্তি দিল।।


স্বভাব প্রবল বড়, কহি তাহা অতঃপর


হরিচাঁদ রূপ যবে ঢাকে।


গুরুচাঁদ মধ্যে পশি, ভাবে বসে দিবানিশি


আন মনে চুপ করি থাকে।।


মহাদেবী সত্যভামা, গুণে যাঁর নাই সীমা


তেহ ঠাই প্রভু বলে খেদে।


‘শুন প্রিয়া মোর কথা, মনে পাই বড় ব্যথা


সংসার রাখিল মোরে বেঁধে।।


আমি ইচ্ছা নাহি করি, করিতে ‘সংসার-গিরি,


মোর মনে সদা এই ভয়।


ছাড়িয়া বিষয়-কাণ্ড, রাত্রি কিংবা দিন দণ্ড


প্রেমানন্দে দিন কেটে যায়।।


অনিত্য যাহার নাম, এই যে সংসার ধাম


তার লাগি কেন ঘুরি মিছে।


আমি ভোলা ভোলনাথ, নাহি করি দৃষ্টিপাত


সংসারে পড়িয়া থাকি পিছে।।


কি কাণ্ড করিলা হরি, বিষম লজ্জায় মরি


ভোলানাথ ভুলইয়া আনি।


সংসার-পাষাণ গলে, বাঁধিয়া ফেলিল জলে


তীরে নিতে হবে তারে টানি।।


উপায় নাহিক দেখি, কি জানি কমল আঁখি


কারে দিয়া কোন কার্য করে।


আমার বলিতে যাহা, সকলি হরেছে তাহা


মোর বলে নাহি কিছুঘরে।।


আমার এমন-যেই, তারে কেন দূরে দেই


মিছে মিছে সাজিয়া সংসারী।


সদা বলি হরি হরি, হরি পারের- কাণ্ডারী


হরি বলে বাহি নিজ-তরি।।


অন্য কোন ভাব নিয়া, না থাকিব শুন প্রিয়া


তার ভাবে মত্ত সদা রব।


যে-ইচ্ছা তাহার হয়, তাই হোক নাহি ভয়


ডুবি যদি তাহাতে ডুবিব।।


সংসারের যে-বাসনা শুন বলি শবাসনা


হীরা, মণি, সোনা, দানা, ছাই।


পাগলা ভোলার পক্ষে, এ কোন ছার পরীক্ষে


ভুল-ছাড়া ভোলানাথে নাই।।


করিনু সংসার ত্যাগ, হরি নাম-মহাযাগ


অনুরাগে রাগ দিয়ে বলি।


যাহা ইচ্ছা কর তুমি, ভোলানাথ যার স্বামী


তারে আমি বলি তুই ম’লি।।”


শুনিয়া স্বামীর কথা, সত্যভামা জগন্মাতা


কিছুমাত্র কথা না কহিল।


মৌন রহে হরজায়া, ভোলা আনন্দিত হৈয়া


নিজ ভাবে ডুবিয়া রহিল।।


কিছুদিন গত হয়, গভীর নিশীতে তায়


গৃহ ছাড়ি প্রভু যবে চলে।


বৃহৎ রসাল বৃক্ষ, পত্র যাহে লক্ষ লক্ষ


নিত্য রাত্রি বসে তার তলে।।


প্রভুরে চাহিয়া দেবী, নিখুঁত পবিত্র-ছবি


মুরজ-মুরলী স্ববে কহে।


‘শুন প্রভু দয়াময়, কোথা যাও এ সময়


গৃহ-ছাড়ি চলা ঠিক নহে।।


কিছুদিন পূৰ্ব্বে তুমি, পরাণ বান্ধব স্বামী


যে বাৰ্ত্তা বলে’ছ মোর কাছে।


তার কিছু সদুত্তর, করি নাই তথা’পর


সব কথা মোর মনে আছে।।

 

 

তোমার স্বভাব জানি, গুণাতীত গুণমণি


নিগুণ বিষয়ে মত্ত নহ।


তবে কেন ভোলানাথ, আসিলে প্রভুর সাথ


সেই কথা মোর কাছে কহ।।


তুমি জান আমি জানি, কেন হরি-রত্ব-খনি


দোঁহাকারে আনিল ধরায়।


জীব দুঃখী দেখে ভারী, পরম দয়াল হরি


জগজ্জীবে উদ্ধারিতে চায়।।


পূৰ্ব্বে পূৰ্ব্বে যে যে এল, জীবে মন্ত্র যাহা দিল


অপূর্ণ কারণে তাহ ব্যর্থ।


জীব সাজি জীব-দায়, হরিচাঁদ এ ধরায়


জগজীবে দিল পরমার্থ।।


সংসারে জড়িত রহে, তাহা হতে দূরে নহে


জগতের যত নরকুল।


যা’ ধরি বাঁচিয়া রয়, ‘ধৰ্ম বলি তারে কয়


এই ব্যাখ্যা কভু নহে ভুল।।


সংসার ধরিয়া রয়, নরনারী জীবচয়


ধৰ্ম ভিত্তি পরে যদি তাহা।


কখনে সাজা’তে পার, বিনয়েতে বলি হর


সৃষ্টি কত শুদ্ধ হবে আহা!


আদর্শ সংসারী সাজি, এস মোরা দোহে আজি


হরি স্মরি করি তার কাজ।


পিতার বচন ফেলে, পুত্র যদি অবহেলে


কত দুঃখ পাবে হরি-রাজ।।


আপনা সারিবে যারা, সন্ন্যাসী সাজুক তারা


সেই পাঠ তুমি কর দূর।


সংসারী সাজিয়া থাক, প্রভুর বচন রাখ


কর তুমি যে-আজ্ঞা প্রভুর।।


এই দেখ তব ঘরে, পুত্র রূপে জন্ম ধরে


আসিয়াছে তনয় তনয়া।


আদর্শ নাহি দেখা’লে, এই সব মেয়ে ছেলে


কিসে পাবে ধৰ্ম-বৃক্ষ-ছায়া।।


আমার বচন ধর, নাশ চিত্ত অন্ধকার


সংসারী সাজিয়া কর কর্ম্ম।


শুন প্রভু নিবেদন, নাহি কর অন্য মন


রাখ প্রভু রাখ পিতৃধর্ম্ম।।


দেবী যদি এই কয়, প্রভু দাঁড়াইয়া রয়


ক্ষণকাল স্তব্ধ হয়ে রৈল।


উজ্জ্বল আলোক রাশি, গুরুচাঁদ মধ্যে পশি’


গৃহ খানি আলময় কৈল।।


প্রভু কহে হাসি হাসি, নাশিয়া আঁধার রাশি


শরতের চন্দ্র যেন হাসে।


“ শুন দেবী যাহা কই, তব উপদেশ লই


ফিরিলাম পুনঃ গৃহবাসে।।


তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হোক, তাঁর বাক্য সত্য রো’ক


তাঁরে ভাবি হইনু স্বীকার।


সংসারী সাজিয়া তবে, রহিলাম এই ভবে


আর মনে নাহিক বিকার।।


শুনি পতির ভারতী, জগন্মাতা মহাসতী


প্রভু প্রতি বিনয় করিল।


ঘর ছাড়া ভোলানাথ, আসিয়া হরির সাথ


হরি আজ্ঞা মতে গৃহী হৈল।।


আসিল শ্ৰীগুরুচন্দ্ৰ, জীবে দিতে মুক্তি মন্ত্র


পদ স্পর্শে ধরা ধন্যা হল।


মহানন্দ দীন হীন, কাটেনা জন্মের ঋণ


কাঁদে ভেবে দিন চলে গেল।।

No comments: