Saturday, August 22, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 51 ১৩০৯ সালে শ্রীধাম ওড়াকান্দীর অবস্থা

হরিচাঁদ নর-লীলা সাঙ্গ করি গেল।


গুরুচাঁদ ওড়াকান্দী ধামেশ্বর হল।।


আদি পর্ব্বে ভক্ত সনে ছলনা করয়।


তারক চিনিয়া বলে “চিনেছি তোমায়।।”


উদাসীন সাজিবারে মনে কৈল আশা।


সত্যভামা দেবী তাহে করিল নিরাশা।।


সংসারীর সাজে প্রভু আপনা লুকায়।


‘অর্থ চাই’ ‘অর্থ চাই’ এ-ভাব দেখায়।।


কিসে অর্থ কোথা অর্থ খোঁজে সেই পথ।


ব্যবসায় করে প্রভু বৃহৎ বৃহৎ।।


রাজসিক ভাবে প্রভু চলিবারে চায়।


রাজ-তুল্য তৈজসাদি আনিল আলয়।।


পুত্রগণে শিক্ষা দেয় বিবিধ বিধানে।


বড় বড় ঘর হতে পুত্র-বধু আনে।।


সুবৃহৎ জলাশয় করিল খনন।


ইস্টক নির্ম্মিত হর্ম্ম্য হইল গঠন।।


হরিচাঁদ নাহি করে রাজসিক ক্রিয়া।


সহজ জীবন চলে উদাসী সাজিয়া।।


প্রভু বলে গৃহী পক্ষে নহে এ জীবন।


রাজসিক নীতি গৃহী করিবে পালন।।


গৃহী পক্ষে অর্থ হয় পরম আশ্রয়।


অর্থ রূপে লহ্মী সাথে নারায়ণ রয়।।


খাট আনে গদি করে আনিল চেয়ার।


ঝাড় বাতি আনে সাথে ঢাকনি তাহার।।


রাজগৃহে যেই যেই দ্রব্য শোভা পায়।


গুরুচাঁদ আনিলেন আপন আলয়।।


অতঃপর তের শত নয় সাল এলে।


দশভূজা দুর্গা-পূজা করে কুতুহলে।।


বহিরঙ্গে সবে ভাবে এই কোন ভাব?


এ ভাব নহে ত কোন সাধুর স্বভাব।।


বড়কর্তা বটে পুত্র শ্রীহরিচান্দের।


কিন্তু তিনি নাহি রাখে পিতৃ-কর্ম্ম-জোর।।


বড় লোক হতে দেখ বড় কর্তা চায়।


নৈলে কি সাধুর পুত্র রাজ ভাবে রয়?


প্রমাণ তাহার দেখ কাটিয়াছে চুল।


এই কার্য্য বড় কর্তা করিয়াছে ভুল।।”


এই মত জনে জনে কত কথা কয়।


দূরে দূরে বলে বটে কাছে চুপ রয়।।


বহিরঙ্গ ভক্ত যারা ভাব নাহি বুঝে।


তারা বলে ‘দেখে যাই সব চোখ বুজে।।”


সেই রাম সেই ধাম নাহি কিছু আজ।


নিজ মনে বড়কর্তা করে সব কাজ।।


প্রভুর মুখের বাক্য কোন ভাবে ঠেলি।


তাই থাকি চুপ করে কথা নাহি বলি।।


অন্তরঙ্গ ভক্ত গণে এই সব শুনি।


প্রভুকে জানায় যত বিরুদ্ধ-কাহিনী।।


প্রভু বলে “কিবা ছাই বল মোর কাছে।


দেখা যাক কত ভক্ত থাকে মোর পাছে।।


আমি ত বিষয়ী বটে তাতে নাই সন্দ।


কেহ মোরে ভাল বলে কেহ বলে মন্দ।।


তাতে কিবা আসে যায় মূল রাখ ঠিক।


এক দৃষ্টে ধর পাড়ি ছেড়োনা নিরিখ।।


আর মোন বলি যাহা কথা মিথ্যা নয়।


কোন ভাবে এ জাতির মান বৃদ্ধি হয়।।


চিরকাল যেই ভাবে কাটিয়াছে দিন।


বসন-ভূষণে সবে দীন হতে দীন।।

 

সব কাজ সব ভাবে বড় যদি হয়।


জাতির উন্নতি তাতে আসিবে নিশ্চয়।।


সে-আদর্শ আমি যদি নিজে না দেখাই।


এজাতি কোথায় পাবে বল শুনি তাই?


আর শোন ভক্তগণ নিগূঢ় বারতা।


তত্ত্বজ্ঞানী জানে মর্ম্ম অন্যে পাবে কোথা?


যে-জন যে-ভাবে থাকে-সেইভাবে পায়।


ভিক্ষুকের ঘরে বল লহ্মী কবে যায়?


ভিক্ষুকের মুষ্টি ভিক্ষা সবে দিয়া থাকে।


রাজা যদি চায় ভিক্ষা পায় লাখে লাখে।।


বিধির বিধানে তাই দেখি তারতম্য।


জ্ঞানী জন পক্ষে যাহা সদা বোধগম্য।।


মূল কথা ভাব-ছাড়া কিছু নাহি হয়।


যে ভাবে যে ভাব ধরে সেই ভাবে পায়।।


রাজা যদি হতে চাও ধর রাজ-ভাব।


ভাব অনুযায়ী আসে ভাবের স্বভাব।।


ধর্ম্ম ক্ষেত্রে কর্ম্ম ক্ষেত্রে ভাব হয় মূল।


ভাব ছাড়া ধর্ম্ম কর্ম্ম সকলি নির্ম্মূল।।


কর্ম্মহীন সাত্বিকতা আনে অনাচার।


রাজসিক ধর্ম্মে আছে শক্তির আধার।।


গৃহী পক্ষে রাজধর্ম্ম শাস্ত্রের বিধান।


মূলভিত্তি হতে তার সাত্বিক-প্রধান।।


সত্তঃ রজঃ মিলনেতে গার্হস্থ্য-জীবন।


মোর পিতা হরিচাঁদ করিল গঠন।।


এই দুই তত্ব মিলে যাঁহার জীবনে।


“সেই মোর শ্রেষ্ঠ ভক্ত” হরিচাঁদ ভণে।।


কর্ম্মেতে প্রধান হবে ধর্ম্মেতে প্রবল।


বাহুতে রাখিবে শক্তি চক্ষে প্রেম-জল।।


দুষ্ট ধ্বংসে প্রাণপণ, পতিতে করুণা।


ভীষ্ম সম চরিত্রেতে প্রেমে ব্রজাঙ্গণা।।


কোমলে কঠিন হবে অপূর্ব্ব মিলন।


কুসুমের মৃদু কন্ঠে বজ্রের গর্জ্জন।।


এ-আদর্শ রক্ষা করি পিতার আজ্ঞায়।


ইচ্ছা মোর নমঃশূদ্র ঘরে ঘরে পায়।।


আর বলি খাঁটি মতো হবে কোন জন?


যার কার্য্যে হবে দুই ভাবে মিলন।।


কত জন রবে শুধু সত্তঃ ভাব নিয়ে।


কত যাবে রজঃ পথে ধনে মত্ত হয়ে।।


উভয়ের পরিণামে হা-হুতাশ সার।


এরা নহে খাঁটি ভক্ত আমার পিতার।।


আমি গেলে এই ঘরে যে হবে ঠাকুর।


তাঁর লীলা হবে আরো কঠিন-মধুর।।


‘রাজর্ষি উপাধি তাঁর ঘোষিবে জগত।


তাঁর কার্য্য হবে ক্রমে মহৎ মহৎ।।


অন্তরের ভাব জানি কর্ম্ম যেবা করে।


‘অন্তরঙ্গ’ বলি ব্যাখ্যা সবে করে তাঁরে।।


অন্তরের ভাব আজি বলিনু খুলিয়া।


কোন পথে যাবে দেখ আপনি বুঝিয়া।।


প্রভুর বচনে ভক্ত শা্ন্তি পায় মনে।


কেন্দে কয় “দয়াময়! রাখিও চরণে।।”


সংসার জীবনে প্রভু রাজ-ধর্ম্ম রাখে।


রাজ-বুদ্ধি রাজাচার রাজ-ভাব থাকে।।


জল মধ্যে রাজহংস করে জল কেলি।


জল নিয়ে ছড়াছড়ি জল ফেলা ফেলি।।


নিজে ডুবে নানাভাবে জলের ভিতর।


কিন্তু জণে নাহি ছোঁয় তার কলেবর।।


সেই মত প্রভু মেশে সকলের সঙ্গে।


আপনার ভাবে নাচে আপন তরঙ্গে।।


পরশি সকলে প্রভু সবে ধন্য কর।


স্পর্শিতে প্রভুর অঙ্গ নাহি দেয় কারে।।


পদধূলি নিতে যদি কেহ আগু হয়।


দূর-দূর করি প্রভু তাহারে তাড়ায়।।


অনন্ত আকাশে সূর্য্য আপনার তেজে।


রক্ষা করে জীবগণে আপন গরজে।।

 

রশ্মি-রূপে স্পর্শ করে যত জীব কুলে।


সূর্য্যকে স্পর্শিতে জীব পারে কোন কালে?


সূর্য্য সম গুরুচাঁদ সবে দয়া করে।


কিন্তু নাহি দেয় প্রভু স্পর্শিতে তাঁহারে।।


রাজ-ব্যবহারে চলে রাজ-ভাব নিয়া।


সেই ভাব নিতে জাতি পড়ে পিছাইয়া।।


নাগাল না পেয়ে তাঁরে মনে হয় রোষ।


পরশ্রীকাতর হয়ে কহে নানা দোষ।।


অন্তরঙ্গ ভক্ত তাহে কোণ নাহি দেয়।


বহিরঙ্গ ভক্ত মনে জাগিল সংশয়।।


অভ্যাসের বশে বটে আসে ওড়াকান্দী।


মন থাকে নিজ দেশে দেহ আনে বান্ধি।।


এই ভাবে করে তারা লুকোচুরী খেলা।


তের শত চৌদ্দ সালে পরীক্ষা পহেলা।।


বহিরঙ্গ ভক্ত যত ছিল পরিচয়।


বিধবা-বিবাহ চাপে দূরে চলি যায়।।


সে সব বৃত্তান্ত পরে হইবে লিখন।


এবে শুন যত আছে অন্য বিবরণ।।


তের শত নয় সালে শ্রীশশীভূষণ।


পুত্র রূপে পেল কোলে প্রমথরঞ্জন।।


পুত্র পেয়ে মহাশয় আনন্দিত মন।


এক দিন পিতৃ-পদে করে নিবেদন।।


“নিবেদন করিবারে মনে শঙ্কা পাই।


দয়া করে আজ্ঞা দিলে প্রার্থণা জানাই।।”


প্রভু বলে ‘বল কথা শশী বাপধন।


অকপটে বল মোরে তোমার মনন।।”


বাবু বলে কৃপা বলে পেয়েছি নন্দন।


ইচ্ছা করে দশভূজা করিব পূজন।।”


প্রভু বলে ‘ওরে বাবা! রাজসূয় যজ্ঞ।


ও সব করিতে বাপু! আমি নহি যোগ্য।।


‘দশ-হাতা’ বেটি আসি দশ হাতে খায়।


ওর পূজা দিতে গেলে রাজা হতে হয়।।


আমরা সামান্য লোক নহি অর্থ কড়ি।


বিশেষতঃ অল্প স্থান বিল মধ্যে বাড়ী।।


দশভূজা পূজা যেথা হয় আয়োজন।


লোক সংঘটন সেথা হয় আগণন।।


এ সব আমার পক্ষে সম্ভব না হবে।


দোষ পেলে লোকে সবে কলঙ্ক গাহিবে।।


এমত বলিয়া প্রভু মৌন হয়ে রয়।


ব্যথা পেয়ে শশীবাবু গৃহ মধ্যে যায়।।


সারাদিন অনাহারে ফেলে অশ্রুজল।


মনে ভাবে হ’ল মোর জীবন বিফল।।


চক্রীর চক্রান্ত-চক্র নরে বোঝা ভার।


পরদিন প্রাতেঃ বলে দয়াল আমার।।


‘শোন শশী! অদ্য নিশি দেখিছি স্বপন।


দশভূজা পূজা লাগি কর আয়োজন।।


আমারে স্বপনে দেবী বলিলা বচন।


মনোসাধে পূজা নিবে আমার ভবন।।


যশোহরবাসী এক ব্রাহ্মণ সুজন।


চন্ডী-স্তব-মন্ত্র নাকি করেছে লিখন।।


সেই স্তব মন্ত্রে পূজা এই বাড়ী হবে।


ব্রাহ্মণ আসিয়া নিজে পুঁথি দিয়া যাবে।।


পিতৃ-মুখে এই বাক্য যখন শুনিল।


মহানন্দে শশীবাবু আহারাদি কৈল।।


ক্রমে বারিধারা শান্ত আসিল শরৎ।


সোনালী কিরণে শুদ্ধ সুন্দর জগৎ।।


দোয়েল পাপিয়া দলে করে কলতান।


শারদ বাতাসে বাজে আগমনী গান।।


ওড়াকান্দী দশভূজা পূজা আয়োজন।


শুনি নর-নারী সবে আনন্দিত মন।।


ভাস্কর আসিয়া সুখে মাতৃ মূর্ত্তি খানি।


গড়িল চিত্রের মত তুলি রেখা টানি।।


মৃন্ময়ী মূরতি যেন লাগিল হাসিতে।


নামিল জননী যেন আঁধার নাশিতে।।

 

ষষ্টি-কল্প দিবসেতে বোধনের কালে।


উপনীত দ্বিজ এক ‘দুর্গা’ ‘দূর্গা’ বলে।।


প্রভুর নিকটে গিয়া দিল দরশন।


কর জোড় করি কহে বিনয় বচন।।


‘যশোহর বাস মোর গুন মহাশয়।


আসিয়াছি তব গৃহে মাতার আজ্ঞায়।।


চন্ডী স্তুতি গান আমি করেছি রচনা।


প্রতিদিন করি আমি দেবীর বন্দনা।।


তিন দিন পূর্ব্বে দেবী স্বপনেতে কয়।


স্বপ্ন-ঘোরে শুনি যেন দৈববাণী প্রায়।


“শুন দ্বিজ চন্ডী-গীতি করেছ রচন।


তব প্রতি প্রীতি আমি তাহার কারণ।।


ওড়াকান্দী হরিচাঁদ অবতীর্ণ হল।


লীলা সাঙ্গ করি প্রভু নিজ লোকে গেল।।


তস্য পুত্র রূপে যিনি তিনি মোর গুরু।


মহাকাল মহেশ্বর বাঞ্ছা-কল্প-তরু।।


তাঁর পুত্র রূপে যিনি শ্রীশশীভূষণ।


দশভূজা রূপে মোরে করিবে পূজন।।


সেই পূজা মনোসাধে করিব গ্রহণ।


চন্ডী-স্তুতি লয়ে তুমি করহ গমন।।


তোমার রচিত গীতি সেথা পাঠ হবে।


গুরুচাঁদ কাছে তুমি এই স্তব দিবে।।


আর বলি গুরুচাঁদে বলিও বচন।


পূজা ঘরে নমস্কার না করে কখন।।


গুরুর প্রণাম আমি নিতে নাহি পারি।


বিনয়ে বলিও কথা কর জোড় করি।।”


এই মত কথা বলে ব্রাহ্মণ তনয়।


নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।


বার বার নমস্কার প্রভু পদে করে।


প্রভু বলে স্থির হতে সেই দ্বিজবরে।।


ব্রাহ্মণের ভাব দেখি ভক্ত চোখে জল।


ভাবাবেগে বলে কেহ হরি হরি বল।।


আশ্চর্য্য কাহিনী শুনি হ’ল ভাবোদয়।


বসে বলে ‘জয় হরি-গুরু চাঁদের হায়”।।


এই ভাবে দেবী পূজা অরম্ভ করিল।


প্রেমানন্দে পূজা সাঙ্গ দশমীতে হ’ল।


“বিজয়া-দশমী” করে বিসর্জ্জন পরে।


লোকে লোকে লোকারণ্য হ’ল চারিধারে।।


প্রভু বলে শান্তি সভা” করহে এখন।


নারীগণে করে ধ্বনি মঙ্গলাচরণ।।


প্রভুকে বসা’ল সবে পবিত্র আসনে।


ধূপ, দীপ, চন্দনাদি নারীগণ আনে।।


অগ্রে বিপ্র প্রভু পদে বরণ করিল।


নারীগণে এক সঙ্গে হুলুধ্বনি দিল।।


নর গণে জয় ধ্বনি হরি ধ্বনি করে।


প্রভুকে বরণ করে আনন্দ অন্তরে।।


বরণের কালে বহে দুই চক্ষে জল।


মনে ভাবে ধন্য মোর জনম সফল।।


ভক্ত গণে পরস্পরে হিংসা দ্বেষ ভুলি।


ভাই ভাই বলে সবে করে কোলাকুলি।।


এই ভাবে দশভূজা পূজা সমাপন।


সারা রাত্রি হরি কথা হ’ল আলাপন।।


ওড়াকান্দী পূজা নিতে দশভূজা এল।


হরিগুরুচাঁদ প্রীতে হরি হরি বল।।

 

No comments: