Monday, August 24, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 57 ভক্তগণের সহিত প্রভুর আলাপন ও বিধবা–বিবাহ প্রস্তাব

“গার্হস্থঞ্চ সমাশ্রিত্য সর্ব্ব জীবনন্তি জন্তুবঃ


তাদৃশং নৈব পশ্যামি হান্যমাশ্রমমুত্তমম-


……..দদ্মপুরাণম।


“শুন সব ভক্তগণ করিয়াছ আগমন


হরি-লীলাভূমি ওড়াকান্দি।


শ্রীমহা বারুণী দিনে তাঁহারে স্মরণে এনে


প্রেম ডোরে রাখ তারে বান্ধি।।


হরিচাঁদ রসময় আসিলেন এ ধরায়


উদ্ধারিতে পতিত মানব।


তাঁর ভাব-ধারা নিয়ে তাঁর ভাবে ভাব দিয়ে


চলিতেছে ভক্তগণ সব।।

 

 

শ্রীহরির যেই ধর্ম্ম শুন সবে তার মর্ম্ম


মূল ভিত্তি গার্হস্থ্য জীবন।


সন্ন্যাসীর ধর্ম্ম যাহা এই ধর্ম্ম নহে তাহা


শুন বলি তাহার কারণ।।


গৃহী থাকে গৃহ বাসে গৃহীর নিকটে আসে


সাধু সন্ত সন্ন্যাসী সুজন।


গৃহী উপার্জ্জয় ধন সেই ধনে সর্ব্বজন


করিতেছে জীবন ধারণ।।


অধিকাংশ জীব দলে গৃহ ধর্ম্ম-মতে চলে


তাই চলে সৃজনের খেলা।


গৃহী যদি রক্ষা পায় তাতে জীব রক্ষা হয়


গৃহী জনে নাহি কর হেলা।।


আর বলি গূঢ় কথা মনু ইলা পিতামাতা


আদি কালে সৃষ্টির প্রভাতে।


সৃষ্টির প্রসার কল্পে আসে তাঁরা কল্পে কল্পে


তাই সৃষ্টি-রক্ষা-এ-জগতে।।


আদি গৃহী ছিল তারা গৃহ ধর্ম্মে সৃষ্টি-ধারা


চলিতেছে আদি যুগ হতে।


তাই সৃষ্টি মূল-ভিত্তি গৃহ ধর্ম্ম শ্রেষ্ঠ-নীতি


অন্য নীতি ছিল না জগতে।।


ক্রমে বংশ বৃদ্ধি হয় গৃহ কলুষিত তায়


দুঃখ এল মানব জীবনে।


সেই দুঃখ নাশিবারে বারে বারে অবতারে


হরি-নামে জীবের কারণে।।


এত বার যতবার হরি হল অবতার


পূর্ণ শিক্ষা গৃহী নাহি পেল।


হরিচাঁদ রূপে তাই নামিল ক্ষীরোদশায়ী


গৃহীরূপে গৃহস্থ সাজিল।।


কিছুদিন খেলা করি চলিয়া গিয়াছে হরি


আজ্ঞা করি দিয়াছেন মোরে।


“গৃহী যাতে বড় হয় কর তুমি সে উপায়


সদুপায় দেখাবে সবারে।”


সেই আজ্ঞা শিরে ধরে তোমাদের ঘরে ঘরে


কহিতেছে তাঁর যত নীতি।


যে জন পিছনে আছে অগ্রে বলি তার কাছে


তাই ধরি নমঃশূদ্র জাতি।।


নমঃশূদ্র মধ্যস্থলে তার দুই ধারে চলে


দুই ভাবে দুইটা সমাজ।


ব্রাহ্মণ কায়স্থ করি উচ্চবর্ণ যারে ধরি


উচ্চে থাকি করে উচ্চকাজ।।


উন্নত বলিয়া তারা মহা অহঙ্কারে-ভরা


ধরা নাহি দেয় কোন কালে।


অবনত বলি কহে অপর যাহারা রহে


দুঃখে সদা ভাসে অশ্রুজলে।।


দুয়ের মিলন লাগি নমঃশূদ্র উঠে জাগি


তাই তারে ধরি অগ্রভাগে।


নমঃশূদ্র শক্তি পেলে নিশ্চয় এ ভূমন্ডলে


সবে ধন্য হয়ে হবে স্বার্থ-ত্যাগে।।


এবে শুনি বলি কথা মনে পাই বড় ব্যথা


মাথা হেঁট হল অপমান।


উচ্চ জাতি হিংসা করে জানিয়াছে রাজ-দ্বারে


রীতি নীতি নমঃ নাহি মানে।।


বহুত কলঙ্ক কথা ভরিয়া লিখেছে পাতা


‘সেন্সাস রিপোর্ট’ বলে যারে।


ব্রাহ্মণের রীতি নীতি পালে নমঃশূদ্র জাতি


লেখা নাই তাহার ভিতরে।।


অধম চন্ডাল বলি সে গ্রন্থে দিয়াছে তুলি


মিথ্যা করি আরো লিখে কত।


আছেন ডক্টর মীড যিনি রাজ পুরোহিত


পর উপকারে সদা রত।।


এই দুঃখ বলি তাঁরে মীড তাই বলে মোরে


সেন্সাসের কাগজ আনিতে।


কাগজ আনিয়া দেখি মিথ্যা সব রাখে লিখি


অপমান করে হেন মতে।।

 

এই কার্য্যে যাহা পাই ইংরাজের দোষ নাই


কর্ম্মচারী কায়স্থ ব্রাহ্মণ।


যে রিপোর্ট দিল তারা ইংরাজ আসিল যারা


অবিকল করিল লিখন।।


বিমর্ষ তাহাতে মীড ক্রোধান্বিত থোচিত


পরামর্শ দিয়াছে তিনি।


“কলঙ্ক ঘুচাতে হলে তোমাদের নমঃকুলে


আন্দোলন কর গুণমণি।।


যদি নিজ ইষ্ট চাও বিধবার বিয়ে দাও


সেই বার্ত্তা কহ রাজ-দ্বারে।


দরখাস্ত করি কও তোমরা চন্ডাল নও


ইহা শুধু বলে হিংসা করে।।


রাজা নহে পক্ষপাতি সমভাব প্রজা-পতি


সুবিচার করিবে অবশ্য।


আমি সাক্ষ্য দিব জোরে নমঃভাল কাজ করে


কভু তারা নহেক অস্পৃশ্য।।”


মীড কথা বলে যাহা আমি দেখি সব তাহা


এ জাতির মঙ্গল-কারণ।


বিধবার বিভা দিব নমঃকূল তরাইব


এই আমি করেছি মনন।।


এই কার্য করিবারে বলিতেছি সবাকারে


কে কে আছে হতে অগ্রসর?


এই কার্য যে করিবে নিশ্চয় জানিও সবে


নাম যাবে রাজার গোচর।।”


এই কথা করি শেষ গুরুচাঁদ পরমেশ


ভক্তে চাহি করিছে অপেক্ষা।


চক্র ধরি চক্রধর মনে ইচ্ছা হল তাঁর


ভক্তগণে করিতে পরীক্ষা।।


অন্তরঙ্গ বহিরঙ্গ ভক্ত মধ্যে যে প্রসঙ্গ


বিপদ তরঙ্গে যায় চেনা।


সুখে সুখে ভক্ত-থারা ভক্ত কিসে? ভাব-রাখা


লাভ খাবে নাহি লবে দেনা।।


পড়ি ঘোর সমস্যায় ঠাকুরের পরীক্ষায়


ভক্ত সবে রহে বসে চুপ।


মনে মনে আলোচনা করিতেছে জনা জনা


এই খেলা কোন লীলা-রূপ?


ভক্তি যাঁর বল তাঁর ভক্তি তাঁরে করে পার


দেহে বল মনে বল থাকে।


করি-কি-না-করি ভাব সুখের পায়রা সব


সুখে হলে কথা বটে রাখে।।


মুক্তিকামী ভক্ত যারা মুক্তি পেতে ভাব-ধরা


নিজে মুক্তি পেলে সব হল।


যারা কিছু নাহি চায় প্রভু কিসে শান্তি পায়


এই ভাব ধরে তাঁরা মল।।


ভক্ত এই দুই ভাবে স্বার্থে আর অনুরাগে


যার যার ভাবে সেই রয়।


এই ভাব কেন হয় জানে শুধু ইচ্ছাময়


সব ঘটে তাঁহারি ইচ্ছায়।।


ভক্তি বলে শক্তিমান মহাসাধু দেবীচান


গলবস্ত্রে উঠিয়া দাঁড়ায়।


বলে প্রভু আমি দীন আমা হতে কোন দিন


তব কার্য হবে কি সাধন?


যদি মোরে দয়া হয় তব ইচ্ছা সাথে রয়


কার্য করি করে প্রাণপণ।


বিধবা বিবাহ তুচ্ছ যদি ধূমকেতু-পুচ্ছ


আনিবারে আজ্ঞা কর মোরে।


দয়া যদি শিরে পাই শুভ ইচ্ছা সাথে চাই


অবশ্য আনিতে পারি ধরে।।


নাহি মোর বলাবল নাহি চাহি ফলাফল


বলাবল সব মোর তুমি।


এই ভিক্ষা রাঙ্গা পায় যাতে তব শান্তি হয়


সদা যেন তাই করি আমি।।

 

এই ভাবে নিবেদন করিলেন মহাজন


নয়নের জলে বক্ষঃ ভাসে।


আনন্দে শ্রী গুরুচাঁদ বলে ধন্য দেবীচাঁদ।


বিপদে করিলে রক্ষা এসে।।


তুমি ধন্য কার্য ধন্য নাম হবে জগন্মন্য


ধর্ম্ম পূণ্য লাভ হবে সব।


দধীচির মত তুমি মান্য হবে বঙ্গভূমি


আনন্দে করহে উৎসব।।


প্রভুর এ ভাব দেখি পরস্পর দেখাদেখি


করিতেছে ভক্ত গণ সবে।


জনে জনে অতঃপর বলে সবে জুড়ি কর


আজ্ঞামত কার্য প্রভু হবে।।


প্রভু সবে বলে ডাকি আরা কথা আছে বাকী


এই কার্য্য বহু না করিবে।


উদ্দেশ্য পূরণ হলে এই কার্য্য কোন কালে


করা নাহি যুক্তি-যুক্ত হবে।।


অনাচারী ব্যাভিচারী আছে যত নরনারী


এই কর্ম্মে পাইবে সুযোগ।


স্বামী-ভক্তি হবে ক্ষুন্ন লালসা-পূরণ-জন্য


অনাচারে হবে মহাভোগ।।


মতুয়ার নীতি এই বিধবার বিয়ে নেই


বাল্য বিবাহের কর বন্ধ।


বিধবা পবিত্র ভাবে জীবনে বাঁচিয়া রবে


পর জন্মে দূর হবে মন্দ।।


বাল্য বিবাহের ফলে বিষময় ফল ফলে


অকালে হারায় কত প্রাণ।


কালে যদি বিয়া হয় জেন তাতে সুনিশ্চয়


বংশে হবে অশেষ কল্যাণ।।


চলে যদি এই ভাবে পতি-হারা কম হবে


সতীধর্ম্ম থাকিবে সুদৃঢ়।


এক নারী ব্রাহ্মচারী বলেছে দয়াল হরি


দুই নারী বিয়া করে মুঢ়।।


‘এক সতী এক পতী’ এই শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম-নীতি


প্রাণে প্রাণে পূর্ণ বিনিময়।


এক বারে দিলে যাহা কোন ভাবে বল তাহা


ফিরাইয়া আনে পুনরায়।।


তবে যে বিবাহ দিতে বলিলাম কোন মতে


সেই কথা বলিয়াছি আগে।


জাতির মঙ্গল তরে মীড যে বলিল মোরে


বিধবার বিয়ে দেয়া লাগে।।


কিছু কিছু বিয়া দাও নরনারী যদি পাও


জোর করে না করিও কার্য্য।


ইচ্ছা করে যারা যারা এই কার্য্যে দিবে সাড়া


বর কন্যা কর তাই ধার্য্য।।


প্রভু-আজ্ঞা করে শেষ ভক্তগণ নিজ দেশ


বিদায় মাগিয়ে সবে গেল।


ভক্তগণে সঙ্গে করি, মুখে বলে হরি হরি


দেবীচাঁদ গৃহেতে ফিরিল।।


আসিয়া বানেরী গাঁয় স্বামী দেবীচাঁদ কয়


“শোন কথা গোপাল’ বিপিন।


নেপাল তপস্বীরাম আর যত গুণধাম


সবে আসিয়াছ বহু দিন।।


যার যার দেশে যাও বিধবার বিয়ে দাও


এই কার্য্যে সবে দেও মন।


প্রভু বলিয়াছে যাহা নিশ্চয় আমরা তাহা


প্রাণপণে করিব পালন।।”


গোস্বামীর বাণী শুনি জোর করি নিজ পাণি


শ্রীগোপাল বলিলেন তাঁরে।


“বাবা আমি চাই ভিক্ষা আপনার বাক্য রক্ষা


হয় যেন এ অভাগা হতে।


পথ যদি ভুলে যাই শ্রীচরণে এ দোহাই


দয়া করে টেনে রেখ পথে।।”

 

 

 

এই কথা বলি তাঁয় ভুমে গড়াগড়ি যায়


ভাব দেখি দেবীর আনন্দ।


বলে “শোন হে গোপাল ছেড়ে দেও ফলাফল


তাঁর কাজে নাহি কোন সন্দ।।”


বিদায় হইল সবে প্রেমানন্দ-উৎসবে


দেশে দেশে আসি করে আয়োজন।


গোপালের মত নিয়া শ্রীনাথ করিল বিয়া


আর বিয়া করে কতজন।।


ফরিদপুর, খুলনা বরিশাল এক খানা


ত্রিশ জনে বিবাহ করিল।


সামাজিক ব্যক্তি যত সবে যেন ব্রজাহত


বলাবলি করিতে লাগিল।।


“মতুয়ার এ কি কান্ড ক্রিয়া কর্ম্ম লন্ড ভন্ড


জাতি ধর্ম্ম আর নাহি থাকে।


বিধবার দিল বিয়ে কার কাছে বুদ্ধি নিয়ে


হেন কর্ম্ম করে ঝাঁকে ঝাঁকে।।


মতুয়ারে বাদ দাও সমাজেতে নাহি নাও


খৃষ্টানের মত ব্যবহার।


কর তারে হুকা বন্ধ নাপিত ব্রাহ্মণ বন্ধ


এক সঙ্গে করো না আহার।।


বিবাহের কিছু পরে গোপালের সঙ্গে করে


দেবীচাঁদ গেল ওড়াকান্দী।


প্রণমি প্রভুর পায় সকলি খুলিয়া কয়


করজোড়ে দুই হস্ত বান্ধি।।


দেবী কয় “এ গোপাল ওড়াকান্দী অল্পকাল


যাতায়াত করে অনুরাগে।


আপনার আজ্ঞা পেয়ে শীঘ্র নিজ দেশে গিয়ে


বিয়া দিল সকলে আগে।।”


এই কথা দেবী কয় গোপালের পানে চায়


মহাপ্রভু গুরুচাঁদ যিনি।


কোমল-করুণ-দৃষ্টি করে যেন মধু বৃষ্টি


আত্মহারা গোপাল অমনি।।


ক্ষণমাত্র দৃষ্টি করে গোপাল লুটায়ে পড়ে


চক্ষে তাঁর বহে প্রেম-বান।


প্রভু কয় দেবীচান্দে এ দেখি পড়িল কেন্দে


এ মানুষ হতে ভাগ্যবান।।


কি নাম বলিলে শুনি শ্রীগোপাল গুণমণি


এ ত মোর নন্দের গোপাল।


এই হয় মোর মনে এই ভাগ্যবান জনে


ওড়াকান্দী এল বহুকাল।।”


ভক্ত আর ভগবানে কিবা কহে কেবা জানে


এই মাত্র বুঝি অনুমানে।


সাধনাতে শ্রীগোপাল মত্ত থাকি এত কাল


‘কৃপাসিদ্ধি’ পেল কৃপাগুণে।।


এই শুভ সমাচার করিবার সুপ্রচার


মীডেরে ডাকিয়া প্রভু বলে।


‘শুন হে ডক্টর মীড আজ্ঞা তব যথোচিত


পালন করেছি সবে মিলে।।


এই যে দেবীচরণ অতিশয় মহাজন


তাঁর শিষ্য নামেতে গোপাল।


আরো আছে বহুজন সবে হয়ে একমন


এক সাথে যারা দিল তাল।।”


আনন্দে সাহেব কয় ‘শুন কর্তা মহাশয়


আমি নিব ইহাদের ছবি।


নাম ছবি এক সাথে আমি পাঠাব বিলাতে


কার্যোদ্ধারে এই হল চাবী।।


আমি বলি সুনিশ্চয় আর কিছু নাহি ভয়


কলঙ্ক করিব আমি দুর।


আমি জানি ভলমতে এ জাতির ভার হতে


নিজে তুমি নিয়েছ ঠাকুর।।


এই ভাবে বিয়া হয় প্রভু দেবীচাঁদে কয়


আর নাহি করে প্রয়োজন।


যাহা বলে এই ভাল এ জাতি উদ্ধার হল


আর বিয়া দিব কি কারণ?

 

নিজ হাতে নিয়ে ভার নমঃশূদ্রকে উদ্ধার


করিলেন দয়ার ঠাকুর।


কবি কহে শুন ভাই এস ছুটে ভয় নাই


যত আছে অনাথ আতুর।।

 

No comments: