Monday, August 31, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 63 বীর সাধক মহাত্মা দেবীচাঁদ গোস্বামীর জীবন কথা প্রণতি

প্রণাম চরণে দেব দেবীচাঁদ স্বামী।


জ্ঞানে কর্ম্মে ধর্ম্মে সদা ভক্ত-শ্রেষ্ঠ তুমি।।


মম গুরু শ্রীগোপাল তুমি তস্য গুরু।


মম পক্ষে তাই তুমি বাঞ্ছা-কল্পতরু।।


বালক বয়সে তোমা হেরেছি নয়নে।


আজি কিন্তু দাদু তাহা নাহি মোর মনে।।


পুত্র হতে পৌত্র নাকি হয় প্রিয়তর।


তাই নিবেদন পদে রহিল আমার।।


গুণ নাই জ্ঞান নাই নাহি ভক্তি লেশ।


তবোপরে তবু মোর দাবী নহে শেষ।।


এসোহে দয়াল দাদু! হৃদয় কন্দরে।


গাহ হরি-গুণ-গীতি মধুময় স্বরে।।


সেই ধ্বনি বিশ্বজনে করিব বন্টন।


তব পরিচয় মোর সফল জীবন।।


সুপুত্রের গুণে পিতা হয় পরিচিত।


সকলে সুপুত্র তব ভুবন-বিদিত।।


গোপাল বিপিন আর শ্রীতপস্বী রাম।


নেপাল মাধব এরা সবে গুণধাম।।


রত্নের আকর ছিল তোমার হৃদয়।


তাই বিশ্বে দিয়ে গেলে রতন নিশ্চয়।।


জহুরী সাজিয়া তুমি আনিলে জহর।


শুদ্ধ শান্ত শক্তিমন্ত সাধুর বহর।।


গুরুচাঁদ-রূপালোকে পতঙ্গের প্রায়।


ঝাঁপ দিয়ে গুণনিধি ত্যজি সমুদয়।।


আলোকের কণা তুমি তথা হতে নিলে।


দাবানল সম তাহা সর্ব্বত্র ছড়ালে।।


পাপ তাপ মায়া মোহ পুড়ে হল ছাই।


গলিত-কাঞ্চন সম বহু ভক্ত পাই।।


পতিত তরাতে ইচ্ছা গুরুচাঁদ করে।


তাঁর ইচ্ছা পূরাইলে অন্তরে বাহিরে।।


সবার বিরুদ্ধে-কর্ম্ম নিজ তেজোগুণে


হে বীর! করিলে তুমি শঙ্ক-হীন মনে।।


জ্ঞা কর্ম্ম সম্মিলনে তোমাতে হইল।


যতেক পতিত জাতি তাহাতে তরিল।।

 

বিধির বিধান বুঝি বুঝেছিলে মনে।


তাই গেলে নিজ-লোকে কর্ম্ম অবসানে।।


পুত্রগণে দিয়া গেলে নিজ কর্ম্ম ভার।


তাহাদের মধ্যে হেরি প্রকাশ তোমার।।


তোমার অসীম লীলা চাই লিখিবারে।


আপনা আপনি লীলা লেখ দয়া করে।।


মহাশান্ত বীর্য্যবন্ত সহজ সরল।


প্রেম-গঙ্গা হৃদি-মধ্যে করে টলমল।।


পবিত্র চরিত্র রক্ষা যাহে সবে করে।


বারে বারে শতবারে দন্তিতে সবারে।।


অগ্নি-মন্ত্রী হে তপস্বী! এসো পুনরায়।


দলিত পতিত নয় তোমাকেই চায়।।


প্রিয়তম দাদু মোর আজিকে কোথায়?


তোমার স্নেহের ছোঁয়া মহানন্দ চায়।।


পরম দয়অল তুমি এই জানি মনে।


দয়া করে এসো দাদু! মম হৃদাসনে।।


কল্পলোকে গল্প গুলি ভাসিয়া বেড়ায়।


প্রেম ডোরে বন্ধে এসে শুনাবে আমায়।।


তোমার রচিত গাঁথা তোমারে শুনাই।


তোমারে চিনুক সবে এই মাত্র চাই।।


তোমার চরণ তলে রাখিলাম শির।


হাসাও কান্দাও দাদু! ভক্ত-শ্রেষ্ঠ বীর।।”


পরিচয়

শ্রীদেবী চরণ নামে মন্ডল উপাধী।


ধর্ম্মবীর কর্ম্মবীর বহু গুণ নিধি।।


আদি বাস ছিল ফরিদপুর জেলায়।


গোপালগঞ্জ থানা মচন্দপুর গাঁয়।।


পরে বাস করিলেন বাণীয়ারী গ্রাম।


বরিশাল জিলা মধ্যে নয়নাভিরাম।।


পাটগাতী গ্রামে ধনী সম্মানিত অতি।


মন্ডল উপাধিধারী করেন বসতি।।


গাতিদার সেই বংশ বড়ই সম্মান।


নমঃশূদ্র কুলে জন্ম বংশেতে প্রধান।।


সেই ঘরে দেবী চাঁদ করিত চাকুরী।।


কাজ কর্ম্মে ছিল তেঁই বিচক্ষণ ভারী।।


অষ্ট-ধাতু-দিয়ে-গড়া সুন্দর পুরুষ।


সাবধানী সর্ব্বকর্ম্মে ছিল তাঁর হুষ।।


দুষ্ট প্রজা যদি কেহ কর নাহি দেয়।


দেবীকে দেখিলে কর তখনি জোগায়।।


কি মোহিনী ছিল তার দুইটি নয়নে।


ভয়ে ভয়ে কেন নাহি চাহে তার পানে।।


এমন তেজস্বী ছিল সে দেবীচরণ।


অন্তরে কোমল যেন ফুলের মতন।।


দুঃখী যদি ভাগ্য ক্রমে পড়ে তাঁর আগে।


তাঁর দুঃখ দূর করে যত কিছু লাগে।।


দেখিতে কঠিন বটে অন্তরে দয়াল।


ঠিক যেন বৃক্ষোপরে নারিকেল ফল।।


এই ভাবে কাজ করে সেই মহামতি।


এবে শুন কোন পথে গেল তাঁর গতি।।


প্রতিবর্ষে শারদীয়া উৎসব-কালে।


শ্রীতারক গান করে সেই গৃহ-স্থলে।।


গান করে রসরাজ রসের সাগর।


প্রেমানন্দে শোনে সবে নিস্তব্ধ আসর।।


দেবীচরণের ‘পরে সকলি নির্ভর।


দেখা শুনা করে তেঁহ প্রত্যেক বছর।।


তারকে দেখিয়া দেবী ভাবে মনে মন।


কবি গান কর্তা বটে আছে বহু জন।


কিন্তু এই ব্যক্তি যেন সেই দলে নয়।


এ ব্যক্তির মধ্যে যেন অন্য কিছু রয়।।


হরিনাম শুনা মাত্র চক্ষে বহে জল।


এই কোন ভাব আমি বুঝিনা সকল।।

 

 

সন্দেহ জাগিল মনে স্থির নহে মন।


তারকেরে জিজ্ঞাসিল যেই মহাজন।।


অভয় যদ্যপি আমি পাই তব ঠাঁই।


“এক কথা তব পাশে জিজ্ঞাসিতে চাই।।”


তারক হাসিয়া বলে “গোমস্তা মশায়।


করহ জিজ্ঞাসা মোরে যাহা মনে লয়।।”


সাহসে করিয়া ভর সে দেবীচরণ।


তারকের ঠাঁই তবে করে নিবেদন।।


“কোন গুণ বল তব চোখে ভরে জল।


দিবানিশি বল কেন বল হরি বল?”


হরিচাঁদ! গুরুচাঁদ! বল অবিরত।


আমাকে সকল কহ করিয়া নিশ্চিত।।”


দেবীর বচনে সাধু হইল আকুল।


শ্রীহরি স্মরণে প্রাণ হইল ব্যকুল।।


অবিরল ঝরে জল নয়নের কোণে।


ক্ষণ কাল পরে বলে চাহি দেবী-পানে।।


“শুন শুন মহাশয়! সত্য বিবরণ।


হরি বলে কভু মোর ভরেনা নয়ন।।


শ্লেষ্মা বৃদ্ধি ধামু মোর তাই ঝরে জল।


ভাণ করে মাঝে মাঝে বলি হরি বল।।


কান্না কাটি যত দেখা তাহা কিছু নয়।


তবে এক কথা আজি বলিব তোমায়।।


হরি চাঁদ, গুরুচাঁদ শুনিয়াছ মুখে।


যাহা করে তাঁরা করে আমি করার কে?


কলি শেষে ওড়াকাকান্দী হল অবতার।


নমঃশূদ্র কুলে আসি করিল উদ্ধার।।


পিতাপুত্র অভিন্নাত্মা পূর্ণ অবতার।


যাহা কিছু দেখ বাপু সব গুণ তাঁর।।”


এতেক বলিয়া সাধু বহুত কান্দিল।


মনে মনে দেবী তাঁর চরণ বন্দিল।।


প্রকাশ্যে কহিল তঁরে করিয়া বিনয়।


ওড়াকান্দী যেতে কিন্তু মোর ইচ্ছা হয়।।”


শুনিয়া তারক বলে “শুভ সমাচার।


বারুণীর কালে দেখা পাইবে আমার।।


মম সঙ্গে যদি তুমি ওড়াকাদন্দী যাও।


ব্রহ্মার-বঞ্চিত ধন অনায়াসে পাও।।


এত বলি শ্রীতারক গেল নিজ দেশে।


এ দিকে দেবীচরণ শুধু ভাবে বসে।।


দেহ মধ্যে প্রাণ যেন আর বান্ধা নাই।


উদাস হয়েছে মন সদা ছাড়ে হাই।।


মনে ভাবে কবে যাবো ধাম ওড়াকান্দী।


মিছামিছি মায়াজালে রহিয়াছি বন্ধী।।


ক্রমে দিন গত হল বসন্ত আসিল।


তারকের কথা ভাবি ব্যাকুল হইল।।


হেন কালে একদিন প্রভাত বেলায়।


কবি রসরাজ সেই পথ ধরি যায়।।


দুই জনে নৌকা বাহে গোস্বামী আসীন।


দেবীচাঁদ এল ঘাটে অন্তরে মলিন।।


তাকে দেখিয়া চিত্ত হইল নির্ম্মল।


আপনা ভুলিয়া বলে “বল হরি বল।।”


সহজ প্রাণের ঢেউ তাহে প্রেম-বারি।


তারকের চিত্তে হ’ল প্রেমানন্দ ভারী।।


‘হরি বোল’ বলি সাধু তরণী ভিড়ায়।


শ্রীদেবী প্রণাম করে গোস্বামীর পায়।।


আনন্দে তারক তাঁরে ধরে দিল কোল।


প্রেমানন্দে দেবী বলে “বল হরি বোল।।”


কোলাকুলি করে দোঁহে প্রেমে মত্ত হয়ে।


দুই সাধু পড়ে পরে ভুমিতে লোটায়ে।।


উভয়ের চক্ষে বহে প্রেম-বারি-ধারা।


উভে কান্দে ধরি যেন জ্ঞান-হারা।।


এই ভাবে কিছু কাল কাটিল সময়।


শ্রীতারক দেবীচাঁদ ডাক দিয়া কয়।।


“এখন কি ওড়াকান্দী মন যেতে চায়।


দেবী বলে “আর মোর নাহিক সংশয়।।

 

ঠিক হল বারুনীতে দেবীচাঁদ যাবে।


তারক তাঁহাকে গুরু-চাঁদকে দেখাবে।।


এই ভাবে দুই সাধু বিদায় হইল।


তারকের তরী তবে বাহিয়া চলিল।।


বারুণী আসিতে দেরী দশ বার দিন।


চিন্তাতে শ্রীদেবী চাঁদ হতেছে মলিন।।


দেহ আছে পাটগাতী মন ওড়াকান্দী।


ক্ষণে ক্ষণে সাধু উঠে ফুকারিয়া কান্দি।।


ভাব দেখে মন্ডলেরা কানাকানি করে।


এত কাল পরে বুঝি দেবী যাবে ছেড়ে।।


কাজ কর্ম্মে মন নাই সদা উদাসীন।


এর দ্বারা কাজ করা বড়ই কঠিন।।


বহু উপকারী লোক কিবা বলি তাঁরে।


কিছু কাল দেখা যাক কি ভাবে কি করে।।


দেখিতে দেখিতে দিন আসিল নিকট।


দেবী যেন শর-বিদ্ধ করে ছটফট।।


আসিল বারুণী তিথি আকাশ নির্ম্মল।


হরি বলে ‘মতুয়া’ চলে দলে দল।।


এক সঙ্গ ধরে দেবী বেহালের বেশে।


উদয় হইল গিয়া ওড়াকান্দী বাসে।।


হরিবল, হরিবল, মুখে মাত্র ধ্বনি।


অবিরল চোখে জল পড়িছে অমনি।।


মতুয়ার সঙ্গে ধামে উপস্থিত হল।


কীর্ত্তনে মাতিয়া বলে বল হরিবল।।


হেনকালে শ্রীতারকে দেখিবারে পায়।


প্রেমে মত্ত মহাসাধু চরণে লোটায়।।


তারক টানিয়া তাঁরে লইলেন কোলে।


কোলে পড়ি কান্দে আর হরি হরি বলে।।


তারক কহিল তারে “শুন মহাশয়।।


চল এবে গুরুচাঁদে দেখাব তোমায়।।”


গুরুচাঁদ নাম শুনি সাধু কেন্দে কয়।


“আমার কি হবে বল সে ভাগ্য উদয়?


নয়নে দেখে না কিছু মন সব দেখে।


মনে যাঁরে লাগে ভাল মন তাঁরে রাখে।।


আমার অবোধ মন কাদা-মাটী-ভরা।


আমার কি হবে দেখা প্রভু মনোহরা?”


বিলাপ করিয়া সাধু কান্দে উভয়রায়।


শ্রীতারক বলে “সাধু নাহি কোন ভয়।।”


পরম দয়াল মোর এল এই কুলে।


তাঁর কৃপা দৃষ্টি আছে বেড়িয়া সকলে।।


সুবোধের জন্যে দয়া কিবা প্রয়োজন?


অবোধ অজ্ঞানে লাগে দয়ার কিরণ।।


অতএব চল এবে যাই তাঁর ঠাঁই।


দেখি সেই রাঙ্গা পদে স্থান যদি পাই।।


এত বলি দুই সাধু উঠিয়া চলিল।


গুরুচাঁদ সন্নিকটে উপস্থিত হল।।


আসনে বসিয়া প্রভু পরম দয়াল।


ভক্ত সঙ্গে কথা কহি হাসে খল খল।।


এমত সময় দেবী তারক সহিতে।


উপনীত হল গুরুচাঁদের সাক্ষাতে।।


চাহিয়া দেখিল যেন গলিত-কাঞ্চন।


নরমূর্তি ধরি করে প্রেম-আলাপন।।


কিবা সে চরণ-যুগ রক্তরাগ-মাখা।


উভপদে দেখা যায় দীর্ঘ উর্দ্ধরেখা।।


অঙ্গের গঠন নাহি বর্নিবারে পারি।


অঙ্গহতে জ্যোতিঃ যেন উড়ে সারি সারি।।


দীর্ঘ ভূজ করপদ্মে ঊদ্ধ-রেখা-আঁকা।


প্রশস্ত বুকের ছাতি স্বল্প লোমে ঢাকা।।


আলতা গুলিয়া যেন গুগ্ধের সহিত।


প্রভুর অঙ্গেতে বিধি করেছে মিশ্রত।।


সুকোমল ঢল ঢল চারুচন্দ্রানন।


চৌরাশ কপাল তাঁর অতি সুশোভন।।


নয়ন যুগল যেন সন্ধ্যাতারা প্রায়।


ব্যথিত জীবের প্রতি চাহে করুণায়।।

 

শির যেন সুমেরুর উচ্চ-শ্বেত-চুড়া।


সুঘন কেশের দলে চারিদিকে বেড়া।।


নিরিবিলি নিরজনে সে কোন ভাস্কর।


গঠিল এমন অঙ্গ যেন সুধাকর।।


পিক-কন্ঠ যিনি স্বর মধুর মধুর।


যেই শোনে সেই হয় প্রেমেতে আতুর।।


রূপ দেখে সুর শুনে দেবীচাঁদ নাই।


আপনা ভুলিয়া শুধু ছাড়ে ঘন হাই।।


কিছুকাল এইভাবে দাঁড়াইয়া ছিল।


অকস্মাৎ ভূমিতলে লুটায়ে পড়িল।।


তাহা দেখি গুরুচাঁদ ডাক দিয়া কয়।


“এ কারে আনিলে সাথে গোস্বামী মশায়?


চেহারায় মনে হয় জন্ম উচ্চ বংশে।


জ্ঞানে গুণে কম নাহি হবে কোন অংশে।।


বড়লোক বড়-মন বড় সমুদয়।


ওড়াকান্দী আসে এরা ঠেকে কোম দায়?


এ বাড়ী কাঙ্গালে চেনে কাঙ্গালী-নিবাস।


কাঙ্গালের বাড়ী এই তাদের বিশ্বাস।।


ধূলা বালি মেখে তারা হেথা সুখে রয়।


মিলেনা আহার তবু কথা নাহি কয়।।


দুঃখী যারা দুঃখ ছাড়া সুখ নাহি চিনে।


মিলাতে দুঃখীর মেলা আসে সে এখানে।।


বড় যারা সুখী তারা বল কোন গুণে।


দুঃখীর আলয়ে তারা আসিবে কেমনে?


যারা যারা আসে হেথা তারা ভাল জানে।


দুঃখ-ছাড়া সুখ কভু পাবে না এখানে।।


দুঃখলে পশরা তারা করে নিজ শিরে।


দুঃখের-বান্ধব-হরি সাথে সাথে ফিরে।।


সুখের পিয়াসী যারা তারা কেন আসে?


দুঃখী সুখী বল কবে এক সাথে বসে?


কাজ নাই সুখী নিয়ে দুঃখী মোর ভাল।


দুঃখী জনে বন্ধু জেনে করেছি সম্বল।।”


এতেক কহিলা যদি পতিত-পাবন।


করজোড়ে দাঁড়াইল সে দেবীচরণ।।


জলধারা বহে চক্ষে কম্পিত শরীর।


ঘন ঘন বহে শ্বাস চিত্ত নহে স্থির।।


কেন্দে কয় “দয়াময় কিবা কব আর?


পড়েছি অকুল নীরে কর মোরে পার।।


এ অকুলে ভূমন্ডলে বন্ধু কেহ নাই।


দয়া করে তোল মোরে ক্ষীরোদের সাঁই।।


করুণ নয়নে চাহ অগতির গতি।


গৌরবে ডুবেছি করে সুখর বসতি।।


সুখ বলি যারে বলি সে’ত সুখ নয়।


বাতুলতা মাত্র তাহা বুঝেছি নিশ্চয়।।


ধন জন মান যশ জীবে সদা চায়।


নশ্বর সকলি তাহা দু’দিনে ফুরায়।।


ধন-হারা হতে প্রভু না লাগে সময়।


স্বার্থ গেলে জনপ্রাণী সবাই দূরে যায়।।


মান যশ প্রতিষ্ঠাদি সকলি নশ্বর।


ধনে জনে বাধ্য কভু নহেন ঈশ্বর।।


এ-তত্ত্ব বুঝিল ভাল রূপ সনাতন।


তুচ্ছ ধন ফেলে নিল পরমার্থ ধন।।


সে কথা আমার বলা বাতুলতা মাত্র।


আমি পাপী তারা ছিল পরম পবিত্র।।


সুখেরে চাহিয়া প্রভু জীবন কাটিল।


যত চাই সুখ মোরে দেখা নাহি দিল।।


আলোয়ার পাশে যথা পথ-হারা ধায়।


অন্ধকারে মরে ঘুরে পথ নাহি পায়।।


এ ভব আন্ধার ঘোর আমি পথ-হারা।


সুখের আলোয় মোরে করিয়াছে সারা।।


ওহো রে! দুঃখের বন্ধু! যদি দিলে দেখা।


সুখের বসতি ভেঙ্গে কর মোরে একা।।


দুঃখের আকাশ তলে আমি বান্ধি ঘর।


দুঃখ হোক সখা, সাথী দুঃখ সহচর।।

দুঃখের আগুণ পুড়ে হবে আমি ছাই।


দুঃখের বান্ধব হরি তাকে যদি পাই।।


দুঃখের ভূষণে ঢাকা মহাশান্তি আছে।


দুঃখেরে ধরিল দুঃখ নেবে তার কাছে।।


দুঃখের মন্দিরে রাণী দেবী শান্তি মাতা।


দুয়ারে প্রহরী সুখ উঁচু করে মাথা।।


শান্তির মন্দিরে জীব যেতে যবে চায়।


সুখ আসি হাসি হাসি তাতে বাধা দেয়।।


মোহিনী মায়ায় সুখ নিয়ে যায় দূরে।


আলোয়ার পাছে যথা পথ-হারা ঘুরে।।


যে জন সুখেরে চেনে জানে সে-মোহিনী।


সে কি কভু শোনে প্রভু সে সব কাহিনী?


বীরের স্বভাব ধরি মন্দিরেতে যায়।


সুখ তারে কত মতে কত ভয় দেয়।।


সে সব করিয়া তুচ্ছ সোজা যেবা চলে।


দুঃখের মন্দিরে তার শান্তিময়ী মেলে।।


অতল সাগর তলে গাঢ় অন্ধকার।


মুক্ত-বুকে শুক্তি শুয়ে থাকে নিরন্তর।।


শুক্তি ত খোলস মাত্র মুক্ত কিন্তু সার।


মুক্ত লোভে শুক্তিবহে বিশ্ববাসী নর।।


দুঃখের বুকেতে তুমি দুঃখহারা-ধন।


দুঃখে বিনা তোমা নাহি মিলে কদাচন।।


দুঃখ বহে সে’ত শুক্তি কেবা তাহা চায়?


দুঃখ বহে মুক্তা রূপে তোমা ধনে পায়।।


ক্ষণিক সুখের বাসা ভেঙ্গ গেছে মোর।


চিরস্থায়ী দুঃখ দাও ওহে মনোচোর।।”


এত বলি পুনঃ সাধু ধরণী লোটায়।


তাহারে ধরিয়া পুনঃ তারক বসায়।।


মহাপ্রভু ততঃপর কহে তার প্রতি।


“শোন দেবী, শোন সবে আমার ভারতী।।


কোন কাজে নাহি দেখ আমাদের হাত।


সকল কর্ম্মের কর্তা প্রভু জগন্নাথ।।


ক্ষুদ্র দৃষ্টি ক্ষুদ্র চোখে কতটুকু দেখি।


যা দেখি সামান্য তাহা বেশী থাকে বাকী।।


আমি যে কি তাহা আমি নিজে নাহি জানি।


সব জানে সর্ব্বজ্ঞাতা সৃষ্টিকর্তা যিনি।।


আমি ভাবি এই পথে আমি যাব চলে।


পারি কিনা পারি নাহি জানি কোন কালে।।


আমার ইচ্ছায় কিংবা যত্ন পরিশ্রমে।


হত যদি কোন কিছু এই ধরাধামে।।


আমার মনের মত গড়ায়ে সংসারে।


আমি সেজে রহিতাম কর্তা চিরতরে।।


কিন্তু দেখ সেইখানে মোরা কেহ নই।


খেড়ুয়ার হাতে মোরা পুতুল যে হই।।


খেড়ু খেলে তার খেলা থাকিয়া আড়ালে।


লোকে বলে ‘কি সুন্দর! পুতুল নাচালে।।”


দেবী বলিয়াছে কথা কিছু মিথ্যা নয়।


রূপ সনাতন ছিল রাজার আশ্রয়।।


মহাধনী মহাসুখী অভাব না ছিল।


তারা বল কি অভাবে সন্ন্যাসী সাজিল?


তারা কি জানিত কভু সে-সুখের-ঘর।


ভেঙ্গে হবে ধুলিস্মাৎ এতই সত্বর।।


রাজ-মন্ত্রী দুই ভাই সুখের দুলাল।


তারা কেন সে-সুখের ভাবিল জঞ্জাল।।


তারা কভু তারে নাই তাদের ভাবাল।


ভাবের অভাবে তাই ফকির সাজিল।।


সার্ব্বভৌম পন্ডিতের জান বিবরণ।


এ সব ঘটায় প্রভু কমললোচন।।


রাজা হয়ে রাজ্য করে বহু মহাশয়।


কি রাজত্ব করে গেল শ্রীঅশোক রায়।।


নাম যায় ‘চন্ডাশোক’ পাষন্ড-হৃদয়।


কোন গুণে বল পরে ‘ধর্ম্মাশোক কয়?


অপ্রিয় কার্য্যেতে যার রত ছিল মন।


তাঁরে কেন পরে বলে ‘শ্রীপ্রিয়-দর্শণ।।”

তাই বলি কে যে কেটা কেবা তাহা জানে।


পর ত দুরের কথা নিজেই জানিনে।।


যারে দিয়ে যেই কার্য প্রভু ইচ্ছা করে।


সে কার্য করাবে তারে রাখিয়া সংসারে।।


তাঁর ইচ্ছা হলে তাতে বাধা কিছু নাই।


অবাধ তাঁহার ইচ্ছা জানিবে সদাই।।


এই যে দেবীচরণ মন্ডল মশায়।


ওড়াকান্দি এল বল ঠেকে কোন দায়?


বাড়ী আছে ঘর আছে আছে ধন জন।


এ কেন ধূলায় পড়ে করিছে রোদন।।


অবশ্য প্রভুর মনে কোন ইচ্ছা আছে।


সে-ইচ্ছা পুরাতে তাই উহারে এনেছে।।


সে ইচ্ছায় দেবী যদি দিতে পারে তাল।


ধন্য হবে নাম ওর রবে চিরকাল।।


তাই বলি দেবীচাঁদ শোন বাছাধন।


এসেছিস ত আয় তুই জম্মের মতন।।


আর কোথা কিবা পাবি সব খানে ছাই।


ওড়াকান্দী এলে তার জন্ম-মৃত্যু নাই।।


এলে শুধু হবে না রে খাঁটি আসা চাই।


সব ছেড়ে এসেছ যে তার শঙ্কা নাই।।


তোরে বলি দেবী তুই আয় একবারে।


বিশ্ব বাসী নাম তোর ল’বে ঘরে ঘরে।।


এতেক বহিলা যদি পতিত পাবন।


দেবীর চক্ষেতে যেন নামিল শ্রাবণ।।


কেন্দে কয় “দয়াময়, ধন্য তব দয়া।


হীন জনে কৃপা দানে দিলে পদ ছায়া।।


তুমি ত বলেছ প্রভু’ প্রভুর ইচ্ছায়।


সকলি হতেছে বিশ্বে কহিনু নিশ্চয়।।


মো’ সব পতিত দিয়ে যদি কিছু হয়।


ইচ্ছা হলে কর তাহা ওগো দয়াময়।।”


প্রভু কহে “দেবী তোর চিন্তা নাহি আর।


ঘরে ঘরে হরিনাম করগে প্রচার।।


শুধু এক দেশে নয় দেশ দেশান্তরে।


হরি নামে ডঙ্কা মেরে বেড়া’ তুই ঘুরে।।


তোর সাথী আমি আছি কোন ভয় নাই।


ডঙ্কা মেরে বেড়া ঘুরে আমি তাই চাই।।”


হস্ত নাচইয়া প্রভু বলে এ্ই বাণী।


শক্তি পে’ল দেবীচাঁদ পরাণে তখনি।।


মুহুর্ত্তে প্রাণেতে তাঁর এল মহাবল।


মহানন্দে নৃত্য করে বলে “হরি বল।।”


এই ভাবে দেবী চাঁদ মতুয়া হইল।


দেখা মাত্র গুরুচাঁদ তাঁর শক্তি দিল।।


সেই-বলে দেবী ঘুরে দেশে কি বিদেশে।


অতঃপর কি করিল বলিব বিশেষে।।


শ্রীগুরুচাঁদের গুণে অন্ত কিছু নাই।


গেল দিন কহে হীন হরি বল ভাই।।



 

No comments: