Friday, August 7, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 26 শিক্ষা বিস্তারে শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ

“হে মোর দুর্ভাগা দেশ!


যা ‘দেরে করেছ অপমান। “


—- রবীন্দ্রনাথ

দত্তডাঙ্গা সভা – মধ্যে গুরুচাঁদ কয়।


শিক্ষা বিনা এ জাতির নাহিক উপায়।।


সেই বাণী সবে মানি নিল দেশে দেশে।


পাঠশালা করে সবে পরম উল্লাসে।।


ওড়াকান্দী পাঠশালা করে রঘুনাথ।


ক্রমে ক্রমে শিক্ষাদান ক’রে সুত্রপাত।।


নিম্ন প্রাথমিক হতে ক্রমে কালে কালে।


ছাত্র বৃত্তি বিদ্যালয় করে কুতূহলে।।


ওড়াকান্দী, ঘৃতকান্দী, ঘোনাপাড়া আদি।


গ্রামে গ্রামে স্কুল হল কেহ নহে বাদী।।


প্রভু-জ্যেষ্ঠ-পুত্র জানি শ্রী শশী ভূষণ।


তেহ ওড়াকান্দী স্কুলে করে অধ্যয়ন।।


প্রভুর মধ্যম পুত্র সুধন্য কুমার।


ওড়াকান্দী পাঠশালে পাঠে তৎপর।।


এই ভাবে দিন যায় বহুৎ ঘটনা।


অন্য স্থানে সেই সব করিব বর্ণনা।।


কিভাবে শশীভূষণ কোথা শিক্ষা পায়।


কোন ভাবে কলিকাতা পাঠ শেষ হয়।।


তাহার জীবনী যবে করিব লিখন।


সেই স্থানে সেই সব করিব বর্ণন।।


এবে শুন কিবা হ’ল প্রভুর দেশেতে।


নমঃশূদ্র গণ সবে চলে কোন পথে।।


জাতিতে কায়স্থ নাম শ্রী গিরিশ চন্দ্র।


কুলীনের শ্রেষ্ঠ বসু উপাধির ছন্দ।।


ঘৃতকান্দী গ্রামে বাস ওড়াকান্দী কাছে।


দেশে কি বিদেশে কীর্ত্তি বহু করিয়াছে।।


কাঠের ব্যবসা করি বহু লভ্য হয়।


অধিকাংশ সময়েতে কলিকাতা রয়।।


ধনবান বলি তারে সবে মান্য করে।


দেশের মঙ্গল চিন্তা ছিল যে অন্তরে।।


মনে ভাবে মহাশয় কোন কার্য করি।


দেশ-মধ্যে কাজ কিছু করি যদি পারি।।


কারে কহি মনোগত কথা মোর যত।


স্বজাতি বান্ধব দেশে অল্প পরিমিত।।


হরিপুত্র গুরুচাঁদ অতি বিচক্ষণ।


তার কাছে উপদেশ করিব গ্রহণ।।


মহতের পুত্র তিনি স্বভাবে উদার।


তাঁর তুল্য দেশ মধ্যে কেহ নাহি আর।।


কিবা উপদেশ দেয় সেই মহামতি।


দেশে গিয়ে সেই বার্ত্তা জানিব সম্প্রতি।।


শাস্ত্রে বলে স্বর্গাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দুই জন।


দেশ-মাতা নিজ-মাতা করি নির্ব্বাচন।।


নর কুলে জন্ম লয়ে এই দুই জনে।


সেবিবে দোহার পদ বিবিধ বিধানে।।


সত্য বটে বহু অর্থ পাইয়াছি আমি।


এই অর্থে সেবা করি নিজ মাতৃভূমি।।


নিজ ঘরে মান যার নাহি কদাচন।


মানী বলে অন্যে তারে করেনা গ্রহণ।।


দেশ-সেবা কাজ করে যদি মান পাই।


মান পাব কবে যশ সর্ব্বত্র সবাই।।


কোন ভাবে এই কার্য সমাধা করিব।


বড় কর্ত্তা গুরুচাঁদে তাহা জিজ্ঞাসিব।।


এত ভাবি দেশে এসে সেই মহাশয়।


শ্রী গুরুচাঁদের গৃহে হইল উদয়।।


প্রণাম করিয়া বলে প্রভু গুরুচাঁদে।


‘বড় কর্ত্তা বলি কথা যাহা জাগে হৃদে ‘।।


সমাদরে প্রভু তারে বসা’ল আসনে।


কুশল জিজ্ঞাসা করে বসুজীর স্থানে।।

কুশলাদি জানাজানি হয় পরস্পরে।


বসু মহাশয় বলে পূর্ব্ব কথা ধরে।।


‘মনের বাসনা আমি কহি তব স্থানে।


অর্থ দ্বারা কিছু কার্য করিব এখানে।।


কি – কি -কার্য করা ভাল সেই উপদেশ।


আমাকে বলিয়া দিন করিয়া বিশেষ।।


মহোল্লাসে প্রভু বলে ‘ ধন্য মহাশয়।


তব তুল্য ব্যক্তি অল্প আছে এ ধরায়।।


মহৎ উদ্দেশ্য তব নিজেও মহৎ।


ধনী মানী গুণী জ্ঞানী আর তাতে সৎ।।


দেশের মঙ্গল তরে কেন্দেছে পরাণ।


পরম উদার তুমি অতি ভাগ্যবান।।


তব প্রতি ঈশ্বরের করুণা থাকিবে।


দেশে কি বিদেশে সবে তব নাম লবে।।


দেশ-মধ্যে কাজ যদি করিবারে চাও।


যাহা কহি তাহা কর মোর বাক্য লও’।।


এমত সময় বলে বসু মহাশয়।


একটি বাসনা আমি জানা’ব তোমায়।।


‘ এই দেশে চিকিৎসার বন্দোবস্ত নাই।


দাতব্য-চিকিৎসালয় করে দিতে চাই’।।


প্রভু বলে ‘মহাশয় বড় ভাল কথা।


ব্যাধি-দূর-করা বটে অতি উদারতা।।


অজ্ঞান-ব্যাধিতে ভরা আছে এই দেশ।


জ্ঞানের আলোকে ব্যাধি তুমি কর শেষ।।


উচ্চ বিদ্যালয় এই দেশে কোথা নাই।


উচ্চ বিদ্যালয় কর এই ভিক্ষা চাই।।


প্রভুর মনেতে উঠে পূর্ব্ব-দুঃখ যত।


পাঠশালা করি করে শিক্ষা সূত্র-পাত।।


পাঠশালা পাঠ পড়ি শ্রী শশিভূষণ।


ইচ্ছা করে উচ্চ শিক্ষা করিতে গ্রহণ।।


দেশ মধ্যে উচ্চ বিদ্যালয় কোথা নাই।


প্রভু বলে ‘এ বালকে কোথা বা পাঠাই।।


জয় পুর বাসী কবি শ্রী তারকচন্দ্র।


তারে ডাকি বলিলেন প্রভু গুরুচন্দ্র।।


“উচ্চ শিক্ষা নিতে চায় আমার নন্দন।


তোমার গৃহেতে তারে করহে গ্রহণ”।।


লক্ষ্মীপাশা বিদ্যালয়ে শ্রী শশীভূষণ।


তারকের গৃহে থাকি করে অধ্যয়ন।।


বিদেশে সন্তানে রাখা শিক্ষার কারণে।


দীন দুঃখী জনে তাহা পারিবে কেমনে।।


দীনের – বান্ধব প্রভু দীনে বড় দয়া।


দীনেরে পালিল প্রভু দিয়ে পদছায়া।।


সেই দুঃখ মনে পড়ে প্রভু বলে বাণী।


‘যাহা বলি তাহা কর বসুজী আপনি ‘।।


প্রভুর মুখেতে শুনি এ বাক্য মধুর।


ধন্য ধন্য করে তাঁরে বসুজী প্রচুর।।


‘তব আজ্ঞা শিরোধার্য আমি করিলাম।


করিব ইংরাজি স্কুল কথা যে দিলাম।।


প্রভু বলে ‘শুন শুন বসু মহাশয়।


তোমার গুণের কথা কহনে না যায়।।


অশিক্ষিত নমঃশূদ্র তব কৃপাগুণে।


পাইবে পরম রত্ন বিদ্যা – মহাধনে।।


বিদ্যাদান তুল্য দান আর কিছু নাই।


দেশ – গুরু হলে তুমি বসুজী মশাই।।


বিনয়ে বসুজী কহে ‘ কর্ত্তা মহাশয়।


মম প্রতি আশির্বাদ সদা যেন রয়’।।


প্রভু বলে ‘ এই বার্ত্তা দিব ঘরে ঘরে।


তব নাম লেখা রবে সোনার অক্ষরে’।।


বহু আলোচনা করে সে গিরিশচন্দ্র।


গৃহে গেল প্রাণে পেল বড়ই আনন্দ।।


তবে প্রভু ডেকে বলে নমঃশূদ্র গণে।


“শোন নমঃশূদ্র সবে বাঁচিলে জীবনে।।


পরম উদার চিত্ত ধনী ভাগ্যবান।


ঘৃতকান্দী গ্রামে বাস কায়স্থ প্রধান।।

 


গিরিশ নামেতে খ্যাত সবে জান তাঁরে।


উচ্চ বিদ্যালয় করে তোমাদের তরে।।


তাড়িতের মত বাণী দেশে দেশে যায়।


সবে বলে ধন্য! ধন্য! বসু মহাশয়।।


যে আনন্দ নমঃশূদ্র সবে পেল প্রাণে।


বর্ণিতে অসাধ্য তাহা বর্ণিব কেমনে।।


বসু – বাড়ী দিবা রাতি সবে আসে যায়।


এ সব দেখিয়া প্রফুল্ল বসু মহাশয়।।


বসু মহাশয় পুনঃ এল প্রভু কাছে।


বিদ্যালয় স্থান লাগি প্রভু কাছে যাচে।।


ওড়াকান্দী ঘৃতকান্দী হতে সমদূর।


উচ্চ ভিটা ছিল এক দিখিতে বন্ধুর।।


ভিটার কাহিনী কিছু বলিবারে চাই।


প্রাচীন লোকের মুখে যা শুনিতে পাই।।


বাবাজী কোমল দাস নামে মহাশয়।


কিছুকাল বাস করে ওড়াকান্দী গাঁয়।।


অবতীর্ণ হরিচাঁদ সফলানগরী।


ওড়াকান্দী এল পরে দেশ পরিহরি।।


হরির ভাবের অন্ত কেবা কোথা জানে।


ভ্রমন করিত প্রভু নানাবিধ স্থানে।।


কখনও একাকী চলে প্রভু কেহ সঙ্গে।


ভাসিয়া চলিত প্রভু লীলার তরঙ্গে।।


ওড়াকান্দী এল পরে সে কোমল দাস।


প্রভুকে দেখিয়া হল চরণের – দাস।।


বাহ্যভাবে সেই ভাব বোঝা নাহি যেত।


মাঝে মাঝে সে কোমল প্রভুকে ডাকিত।।


একদা ঊষার কালে সূর্য উঠে নাই।


‘হরি ‘ বলে মহাপ্রভু ছাড়িলেন হাই।।


বিরাট হইল শব্দ যেন বজ্রঘোষে।


কম্পমান হল সবে শব্দের তরাসে।।


সে কমল দাস ছিল শ্রীগুরুর ধ্যানে।


মহাবেগে শব্দ পশে তার দুই কানে।।


ধ্যান ভঙ্গে সে বাবাজী দ্রুত বেগে চলে।


হরিচাঁদে দেখা পেল গ্রাম মধ্যস্থলে।।


হস্তে ধরি তারে বলে ‘বাবাজী গোঁসাই।


চল মোরা দুইজনে ঘুড়িয়া বেড়াই।।


তিন স্থানে অদ্য মোরা বসিব দু’জনে।


তিন কার্য হবে তথা রাখিও স্মরণে।।


এত বলি দুই প্রভু দ্রুত গতি চলে।


উপনীত হল দোহে এহ ভিটা-স্থলে।।


গ্রামের পশ্চিম দিকে ভিটে এক ছিল।


দুই প্রভু পদ্মাসনে সেখানে বসিল।।


ওড়াকান্দী হাইস্কুল এবে যথা রয়।


সেই ভিটা এই ভিটা কহি পরিচয়।।


ক্ষণকাল বসি তথা দুই প্রভু উঠে।


দক্ষিন দিকেতে দোহে দ্রুতগতি ছোটে।।


সফলানগরী ছাড়ি রামদিয়া গ্রাম।


খাল কূলে বটবৃক্ষ শোভে অনুপম।।


এবে সেই বৃক্ষ নাই তার শিশু আছে।


দুই প্রভু বসিলেন সেই বৃক্ষ নীচে।।


কলেজ হয়েছে সেথা অতি মনোহর।


হরি – পদরজে ফল ফলেছে এবার।।


কিছুকাল বসি পরে দুইজনে ধায়।


পূর্ব্ব দিক ধরি চলে ঘৃতকান্দী গাঁয়।।


ঘৃতকান্দী ছাড়ি পুনঃ উত্তরাভিমুখে।


এক ভিটা পরে বসি কথা বলে সুখে।।


স্থান যদি চাহিলেন বসু মহাশয়।


সেই ভিটা দেখাইলা প্রভু দয়াময়।।


দুই গ্রাম হতে ভিটা সমদূর বটে।


স্কুল হলে হবে তাহা দোঁহার নিকটে।।


বিল দেশে উচ্চ ভিটা এমত প্রকার।


মোদের উদ্দেশ্য পক্ষে নাহি দেখি আর।।


স্থান দেখি বসুজীর আনন্দিত মন।


স্থান করিবারে সেথা করিল মনন।।

 

 

আসবাব পত্র লাগি যাবে কলিকাতা।


সবে মিলি যুক্তি করি ঠিক করে সেথা।।


স্থির হল কিছুদিন পরে দেশ হ’তে।


কলিকাতা যাবে সব জিনিষ আনিতে।।


হেন কালে শুন সবে অপূর্ব্ব ঘটনা।


আজো মনে হলে তাহা জাগে প্রাণে ঘৃণা।।


ব্রাহ্মণ কায়স্থ আদি বর্ণ হিন্দু যত।


নমঃশূদ্র প্রতি হিংসা করে যে সতত।।


পদতলে পিষ্ট করি রাখিবারে চায়।


নমঃর উন্নতি হলে বিষে দহে কায়।।


ওড়াকান্দী হতে দূর ফুক্ রা গ্রামেতে।


ব্রাহ্মণ কায়স্থ বাস করে একসাথে।।


বিশেষ ব্রাহ্মণ তথা মান্যবান অতি।


পণ্ডিত আচার্য সব করিছে বসতি।।


নমঃশূদ্র শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র রহে চারিধারে।


সবে জানে কত শক্তি তারা সেথা ধরে।।


হিংসুক ব্রাহ্মণ যত ভাবে মনে মন।


উচ্চ শিক্ষা পায় যদি নমঃশূদ্র গণ।।


কিছুতে নিস্তার মোরা নাহি পাব আর!


নমঃশূদ্র করিবেক সব অধিকার।।


গ্রামবাসী সবে মিশি করে পরামিশে!


‘শীঘ্র করি বলে ক’য়ে থামাও গিরিশে।।


সে কেন করিবে স্কুল নমঃর ভিতরে।


শিক্ষা পেলে নমঃ আর নাহি মানে কারে।।


একান্ত গিরিশ যদি স্কুল দিতে চায়।


আসিয়া করুক স্কুল হেথা এই গাঁয়।।


স্বজাতি কায়স্থ তার আছে এই দেশে।


ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মোরা হীন – হেয় কিসে?


জন কত চলি যাও গিরিশের বাড়ী।


কিছুতে তাহাকে মোরা নাহি দিব ছাড়ি।।


সঙ্গে করে আন তাকে আমাদের গাঁয়।


আমাদের কথা শুনি দেখি সে কি কয়।।


সলা-পরামর্শ করি যতেক ব্রাহ্মণ।


লোক পাঠাইয়া দিল তথা দুই জন।।


বহুৎ বিনয়ে তারা অনেক কহিল।


‘বিশেষ কারনে তোমা’ ব্রাহ্মণে ডাকিল।।


ফুকরা নিবাসী যত ভট্টাচার্য আছে।


তব দরশন তারা একবার যাচে।।


সরল বিশ্বাসী ধনী গিরিশ সুজন।


তাহাদের সাথে করে ফুকরা গমন।।


যেই মাত্র সেই গ্রামে উপস্থিত হল।


বহুৎ সন্মান করি তারে বসাইল।।


ঘিরিয়া বসিল তারে পণ্ডিত মণ্ডলী।


বলে ‘ বসু মহাশয়! শুন কথা বলি।।


সত্য মিথ্যা নাহি জানি শুনিয়াছি কথা।


জন্মভূমি ‘ পরে তব বিশেষ মমতা।।


সেই খানে তুমি নাকি করিবে স্কুল।


যবে উঠিয়াছে কথা নাহি হবে ভুল।।


আর নাকি দিতে চাও চিকিৎসালয়।


এই কার্যে হবে নাকি বহু অর্থ ব্যয়।।


লক্ষ্মীর কৃপায় তব অর্থা ভাব নাই।


গুটি কত কথা তবে বলিবারে চাই।।


চিকিৎসালয় দিবে দাও নাহি করি মানা।


স্কুল দিবে কোন মর্ম্মে কিছু তো বুঝিনা।।


ব্রাহ্মণ কায়স্থ কোথা যেথা তব ঘর।


তুমি বাস কর বাপু! নমঃর ভিতর।।


নমঃ জাতি চিন তুমি বিদ্যা শিক্ষা নাই।


বিদ্যাহীন বলে মোরা তাদেরে চরাই।।


স্কুল যদি পায় তারা বিদ্বান হইবে।


আমাদের মান বাপু কভু না রহিবে।।


বিশেষতঃ এই দেশে উচ্চ বিদ্যালয়।


ওলপুর ভিন্ন আর কোথা নাহি হয়।।


বিদ্যা দান – পুণ্য যদি লভিবারে চাও।


এই গ্রামে উচ্চ বিদ্যালয় করে দাও।।

 

 

পুণ্য হবে মান রবে বাঁচিবে ব্রাহ্মণ।


কর্ত্তব্য কি অকর্ত্তব্য বুঝ বাছাধন’।।


এতেক যদ্যপি বলে ব্রাহ্মণ সকল।


গিরিশ কাতরে বলে আঁখি ছল ছল।।


‘যে বার্ত্তা কহিল মোরে ব্রাহ্মণ সকলি।


হতজ্ঞান তাহে আমি বল কিবা বলি ?


কথা দিয়া আসিয়াছি সবাকার ঠাঁই।


কেমনে প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গি বল দেখি ভাই।।


“বাক্যে-নষ্টে ধর্ম্ম-নষ্ট “শাস্ত্রে তাই বলে।


বাক্য দিয়া বাক্য নষ্ট করি করি কি কৌশলে।।


সর্ব্ব কার্য বিধিদাতা তোমরা ব্রাহ্মণ।


হেন – বাক্য পুনঃ নাহি কর উচ্চারণ।।


বিশেষতঃ বড়কর্ত্তা গুরুচাঁদ যিনি।


এই কার্য করিবারে বলিয়াছে তিনি।।


তাহার সন্মান যদি আমি নাহি রাখি।


তিনি ভাবিবেন আমি দি’ছি তাঁরে ফাঁকি”।।


সে মতে বিনয়ে কহি ‘ শুন সর্ব্বজন।


হেন অনুরোধ নাহি করো কদাচন।।


গিরিশের মুখে শুনি এমত কাহিনী।


জ্বলিয়া উঠিল সব ব্রাহ্মণ বাহিনী।।


ক্ষুব্ধ স্বরে ব্যঙ্গ করে বলে ক্রোধ ভরে।


‘থাক থাক মোরা সবে চিনেছি তোমারে।।


একে কলিকাল তাহে ব্রাহ্মণ নির্বীর্য।


তাই শূদ্র হেন মতে করে কত কার্য।।


জানি জানি কেন হল হিন্দুর দুর্গতি।


অবহেলা করে সবে ব্রাহ্মণের জাতি।।


দেব-দেবী সবে আজি রয়েছে নিদ্রিত।


কাল নাই মোরা তাই সেজেছি পতিত।।


হায় রে ব্রাহ্মণ জাতি! অভাগা সাজিলি।


ব্রহ্ম কুলে জন্ম লয়ে কলঙ্কে মজিলি।।


কালেতে সকল করে দেখিলাম তাই।


নৈলে ব্রহ্ম-কোপে পড়ে হত সব ছাই।।


মনে পড়ে পিতামহ দুর্ব্বাসার কথা।


যার কোপে পুড়ে যেত ঘাস-লতাপাতা।।


সেদিন নাইরে আর কলির প্রভাবে।


ব্রাহ্মণের অপমান করিতেছে সবে।।


হায়! পিতা ভৃগু মুনি কোথায় রহিলে।


সন্ততির কি দুর্দ্দশা দেখ আঁখি মেলে।।


রাজা ছিল রামচন্দ্র গুণে সীমা নাই।


ব্রাহ্মণের আজ্ঞাবহ রহিত সদাই।।


তার রাজ্যে শুদ্র এক তপস্যা করিল।


ব্রাহ্মণ করিলে আজ্ঞা মাথা কেটে নিল।।


সে রাম অযোধ্যা নাই নাহি সেই কাল।


বোঁড়া হয়ে ঢোঁড়া সেজে আছি নাগ-কাল।।


ম্লেচ্ছে রাজ্যে বাস করি ম্লেচ্ছের আচার।


ধর্ম্মাধর্ম্ম পাপ-পুণ্য কিছু নাহি আর।।


নীচে জনে উচ্চ কথা উচ্চ কণ্ঠে কয়।


ধর্ম্ম-কথা অপগণ্ডে ধার্ম্মিকে শিখায়।।


ধন্য! বসু মহাশয়! মান্যবান অতি।


তব ঠাঁই শিখিলাম কিছু ধর্ম্ম-নীতি।।


ধর্ম্ম সব গেছে আজি যুক্তির ভিতর।


শাস্ত্র-বাক্য ভাবে সবে সকলি অসার।।


তুমি বল বাক্য দিয়ে বাক্য নষ্ট করা।


ধার্ম্মিকের পক্ষে নাকি নহে এই ধারা।।


কিন্তু মহাশয় বল কোন নীতি বলে।


কুরুক্ষেত্রে যুধিষ্ঠির মিথ্যা কথা বলে।।


কোন নীতি বলে বল জয়দ্রথ ম’ল ?


সে সব কি ধর্ম্মনীতি অনুসারে হল ?


আর জান পঞ্চ বাণ ভীষ্ম রাখে সেরে।


অর্জ্জুন আনিল বান বল কি প্রকারে ?


ছলে বলে কি কৌশলে শত্রু-নাশ হ’লে।


তা’তে পাপ নাহি স্পর্শে শাস্ত্রে এই বলে।।


আর দেখ অধিকারী – ভেদে কর্ম্ম আছে।


আদি শাস্ত্র রামায়নে সে কথা লিখেছে।।


শুদ্র পক্ষে তপ জপ ত্রেতা যুগে নাই।


শুদ্রকের মাথা কাটে রামচন্দ্র তাই।।


নমঃশূদ্র অতি ক্ষুদ্র ক্ষীণ হয়ে রবে।


বিদ্যা শিক্ষা তার পক্ষে কভু না সম্ভবে।।


কৃষি কর্ম্ম করে যারা সেই ভাবে র’বে।


বিদ্যা পেলে কৃষি কর্ম্ম বল কে করিবে ?


আর শুন গূঢ় কথা বলি তব ঠাঁই।


জমা – যোত প্রায় কিছু আমাদের নাই।।


যজন – যাজন আর রাজ কার্য করি।


লেখাপড়া নিয়ে আছি হাল নাহি ধরি।।


তোমার স্বজাতি যত কায়স্থ সুজন।


এই ভাবে সবে তারা কাটায় জীবন।।


যাহা কিছু খাস জমি রাখে কোন জনে।


বর্গা করে তাহা প্রায় নমঃশূদ্র গণে।।


যত জমি বঙ্গ দেশে চাষাবাদ হয়।


যারা কৃষি করে তারা ফসল জন্মায়।।


ব্রাহ্মণাদি নবশাখ আর যত জা’ত।


ইহাদের স্কন্ধে মোরা করি কালপাত।।


নিজ হাতে চাষ-বাস কেহ নাহি করি।


প্রয়োজন মত নমঃ মুসলমানে ধরি।।


পোদ আর পাল বটে চষে কিছু হাল।


কাপালি নামেতে আছে জাতি একদল।।


কৃষি কার্য একরূপ এরা সবে করে।


ধান্য – লক্ষ্মী থাকে বান্ধা ইহাদের ঘরে।।


লেখাপড়া নাহি জানে বোকা অতিশয়।


শিক্ষিত হলে এরা মোদের হবে দায়।।


জমি – যোত নাহি হাতে হাল নাহি ধরি।


এরা যদি হয়ে বসে রাজ কর্ম্মচারী।।


হাতে – ভাতে মারা যাবো নাহিক সন্দেহ!


ব্রহ্ম হত্যা হ’বে শেষে তাই তুমি কহ ?


নিতান্ত ভাবনা যদি আসে তব মনে।


এক কাজ কর তুমি যা ‘ বলি এখনে।।


দাতব্য- চিকিৎসা -গৃহ দেহ সেই ঠাঁই।


তার চেয়ে পুণ্যকর্ম্ম আর কিছু নাই।।


রোগে শোকে মরে জীব কত কষ্ট পেয়ে।


তারা-সব বেঁচে থাক ঔষধাধি খেয়ে।।


বিদ্যাদান তুচ্ছ কথা প্রাণ দান হবে।


পুণ্য ফলে অন্তঃকালে স্বর্গে চলে যাবে “।।


এই মত কথা কত কহিতে লাগিল।


নত – শির বসুজীর অন্তর দহিল।।


উভয়-সঙ্কটে পড়ে মনে হল কষ্ট।


মনে মনে ভেবে বলে হারে দুরদৃষ্ট।।


কোন পথে যাই আমি পথ নাহি পাই।


দেশে থেকে কার্য নাই কলিকাতা যাই।।


ভাবিয়া চিন্তিয়া পরে যা’ হয় করিব।


আপাততঃ অসন্তুষ্ট কেন করে যাব ?


মৌনভঙ্গে মৌন রঙ্গে সে গিরিশ কয়।


‘যাহা বলি শুন সবে ব্রাহ্মণ তনয়।।


বড়ই সঙ্কটে মোরে ফেলিয়াছ সবে।


জবাব ইহার কিছু আজি নাহি পাবে।।


আপাততঃ কলিকাতা আমি যাই চলে।


পশ্চাতে জানাবো কিছু জানাবার হ’লে’।।


এত বলি চলি গেল বসু মহাশয়।


ব্রাহ্মণেরা যুক্তি করে কি হবে উপায়।।


সবে জুটি একদলে পরামর্শ করে।


হানা দিল পুনরায় সপ্তাহের পরে।।


দশ-বার-জন জুটি গেল কলিকাতা।


পুনরায় গিরিশেরে বলে বহু কথা।।


‘জ্ঞান বান ব্যক্তি তুমি বসু মহাশয়।


আমাদের কথা ফেলা উচিত না হয়।।


বিদ্যাদান মহাধর্ম্ম মানিলাম কথা।


দাতা দান করে তা’তে নাহি হেথা সেথা।।


শিক্ষা নিবে ব্রাহ্মণাদি উচ্চ বর্ণ যত।


তারা যাতে শিক্ষা পায়, কর সেই মত।।

 

যেই কর্ম্ম যেবা জানে তারে তাই দাও।


কৃষক লাঙ্গল পাবে মাঝি পাবে নাও।।


নমঃশূদ্র ভরা দেখি ঘৃতকান্দী গাঁও।


উলুবনে কেন বাপু মুক্তা ছড়াও ?


উচ্চ বর্ণ ব্রাহ্মণাদি ফুকরাতে বাস।


স্কুল দিলে সেই গ্রামে তা’তে পাবে যশ।।


এই ভাবে নানা ছলে ব্রাহ্মণ কায়স্থ।


ফুকরাতে স্কুল হবে করে বন্দোবস্ত।।


নিরুপায় হয়ে তায় সে গিরিশ বসু।


ব্রাহ্মণের কবলেতে সেজে র’ল শিশু।।


নিতান্ত লজ্জার দায় করে আনাগোনা।


চিকিৎসালয় করিবারে করে প্রস্তাবনা।।


কিছুকাল পরে কথা প্রচার হইল।


নমঃশূদ্র গণ তাতে বড় দুঃখ পেল।।


নিরুপায় সবে যায় গুরুচাঁদ কাছে।


বলে কর্ত্তা! শুন বার্ত্তা,শিকার ভেগেছে’।।


স্কুল নাহি হবে হেথা হবে ফুকরায়।


চিকিৎসালয় হবে মাত্র তাই শোনা যায়।।


কুটিল ব্রাহ্মণ জাতি কায়স্থের মন্ত্রী।


কায়স্থ যন্ত্রেতে দ্বিজ সাজিয়াছে যন্ত্রী।।


উপায় কি বল প্রভু কিবা করা যাবে।


চিরকাল নাজেহাল হব এই ভাবে ?”


কথা শুনি গুণমনি গুরুচাঁদ কয়।


“ঘরে যাও ভাইসব নাহি কোন ভয়।।


ঈশ্বরের ইচ্ছা যাহা কে খণ্ডিবে বল।


এই কর্ম্ম দ্বারা কিন্তু শিক্ষা এক হল।।


যদ্যপি গিরিশ বসু স্কুল করে দিত।


তার ঠাঁই চিরকাল হত মাথা নত।।


ভাল হল সে জঞ্জাল নাহি হল আর।


সকলে দাঁড়াও দিয়ে নিজ পায়ে-ভর।।


যার কাজ সেই করে পরে করে কিবা ?


তারা সবে নমঃশূদ্রে পেয়েছে কি হাবা ?


প্রাণপণ কর সবে আর কথা নাই।


যেভাবে সে ভাবে হোক স্কুল করা চাই।।


উচ্চ বিদ্যালয় যদি করিতে না পার।


যাহা পার তাহা কর কাজে কেন হার ?


আমি বলি মধ্য বাংলা কি মধ্য ইংরাজী।


স্কুল কর,স্কুল কর কথা সোজাসুজি।।


ছাত্র বৃত্তি স্কুল আছে ওড়াকান্দী গ্রামে।


সেই স্কুল কর সবে মধ্য ইংরাজী নামে।।


বাড়ীতে রয়েছে শশী তার কাছে যাও।


তার সাথে যুক্তি করি স্কুল খুলে দাও”।।


প্রভুর বচন শুনি সবারই আনন্দ।


বর্ণহিন্দু করে হিংসা কহে মহানন্দ।।



No comments: