Wednesday, August 19, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 39 ফরিদপুরে লাট দরবার ও সর্বপ্রথম নমঃশূদ্র অভিনন্দন

দরবারে যেতে প্ৰভু করিলেন মন।


মীডে ডাকি কহে প্রভু এহেন বচন।।


“শুনহে ডক্টর মীড আমি যাহা বলি।


লাট দরবারে যেতে কোন বেশে চলি ?


মীড বলে “বড় কর্তা! ঠিক বলিয়াছ।


ধনে মানে এই দেশে তুমি শ্রেষ্ঠ আছ।।


সেই মতে বেশ ভূষা লাগিবে তোমার।


শীঘ্ৰ গতি কর তুমি জোগাড় তাহার।।


তোমার প্রথম পুত্র শ্ৰীশশিভূষণ।


অবিলম্বে কলিকাতা করুক গমন।।


পোষাকের বার্তা তার জানা আছে ভাল।


শীঘ্ৰ যাক এ দিকেতে দিন কাছে এল।।”

প্রভুজী ডাকিয়া বলে বড় বাবু ঠাঁই।


“আমার ত’ দরবারী সজ্জা কিছু নাই।।


এই ক্ষণে কলিকাতা তুমি চলি যাও।


পোষাক কিনিয়া আন যাহা তুমি পাও”।।


পিতার বচনে বাবু আনন্দিত অতি।


যাত্রা কৈল কলিকাতা অতি শীঘ্ৰ গতি।।


যথা কালে কলিকাতা হল উপনীত।


কিনিল পোষাক তাঁর যথা মনোনীত।।


চোগা চাপকান কেনে সুন্দর পাগড়ী।


কাল বর্ণ দীর্ঘ কোর্তা লাল বর্ণ ছড়ি।।


মূল্যবান জুতা কেনে মোজা এক জোড়া।


রাজ তুল্য পোষাকাদি সুন্দর চেহারা।।


পোষাক কিনিয়া বাবু গৃহ পানে ধায়।


দুই দিনে উপনীত আপন আলয়।।


আপন পোষাক আর পিতার পোষাক।


পোষাক দেখিয়া লোকে লেগে গেল তাক।।


পাঁচ শত টাকা দিয়ে পোষাক কিনিল।


পোষাক দেখিয়া মীড বিষ্মিত হইল।।


মীড বলে “বড় কর্তা’ হ’তেছি আশ্চর্য।


তব সম কেহ নাহি করে হেন কার্য।।


পোষাক সম্পর্কে ছিল এই অনুমান।


শতাবধি হতে পারে ব্যয়ের প্রমাণ।।


এখনে আশ্চর্য হ’য়ে ভাবিতেছি মনে।


রাজোচিত পোষাকাদি আনিলে কেমনে।।


রাজা ভিন্ন কেবা চিনে পোষাক রাজার?


নিশ্চয় আছিলে তুমি রাজার কুমার।।


রাজ ব্যবহার সব তুমি জান ভাল।


রাজ বুদ্ধি বিনা ইহা সম্ভবে কি বল?


মোর মনে এই বলে দেখিলে তোমায়।


লাট বাহাদুর হবে প্রীত অতিশয়।।”


শুনিয়া মীডের কথা প্ৰভু বলে হেসে।


মীডরে গৌরব দিয়া কেহ মিষ্ট ভাষে।।

 

শুন মীড কথা ঠিক রাজ বুদ্ধি বিনা।


রাজ ব্যবহার কেহ জানিতে পারে না।।


রাজ বুদ্ধি কোথা মেলে শোন বলি তাই।


রাজ বংশধর হ’তে রাজ বুদ্ধি পাই।।


রাজবংশ অবতংশ তুমি মহামতি।


তব ঠাঁই পাইয়াছি রাজার পদ্ধতি।।


আমরা দরিদ্র জাতি ধন ধান্য নাই।


কাঙ্গালের ঘরে রাজ বুদ্ধি কোথা পাই।।


শত ধন্যবাদ তাই দিতেছি তোমাকে।


তোমার সাহায্যে আমি উঠা’ব জাতিকে।।


প্রভুর বিনয়ে মীড লজ্জা পায় মনে।


মনে ভাবে ‘কোন বুদ্ধি খাটে না এখানে।।


বুদ্ধি যাঁরে পূজা করে শক্তিপতি জেনে।


মানবের বুদ্ধি তাঁরে হারা’বে কেমনে?


এই রূপে ক্রমে ক্রমে দিন ঘনাইল।


লাট দরবারে যেতে সময় আসিল।।


দুই দিন অগ্রে মীড যাত্রা করি গেল।


সাঙ্গ পাঙ্গ সহ যেতে প্রভুকে কহিল।।


সবাকে সংবাদ দিল প্রভু দয়াময়।


দিন মত ওড়াকান্দী সকলে উদয়।।


চণ্ডী চলে পূর্ণ চলে চলে রাধানাথ।


ভীষ্মদেব আর বিধু চলে সাথে সাথ।।


শ্ৰীশশিভূষণ চলে সহিতে মোহন।


চলিলেন সঙ্গে বালা তারিণীচরণ।।


মহাজ্ঞানী যজ্ঞেশ্বর বিশ্বাস মহাশয়।


প্রিয় ভক্ত বিচরণ সঙ্গে সঙ্গে যায়।।


তারাইল হ’তে যায় খুলনা শহরে।


গোপাল ডাক্তার নামে থাকে তথাকারে।।


তার ঘরে বাস করি রাত্রি কাটাইল।


প্রভাতে গাড়ীতে উঠি কলিকাতা গেল।।


প্রসন্ন কুমার দাস চাঁদসী ডাক্তার।


শ্ৰীশশিভূষণ হ’ল জামাতা তাঁহার।।

সমাদরে নিজ গৃহে প্রভুকে লইল।


চর্ব চোষ্য লেহ্য পেয় আয়োজন কৈল।।


পরম আনন্দে প্ৰভু রহে সেই বাড়ী।


নমঃশূদ্র সবে তবে এল দেখা করি।।


কুমুদ বিহারী বাবু মল্লিক উপাধি।


ভ্রাতৃসহ কলিকাতা বাস নিরবধি।।


মুকুন্দ বিহারী নামে মল্লিক সুজন।


নমঃকুলে আদি মন্ত্ৰী হ’ল সেই জন।।


সে সময় মহাশয় বিদ্যাভ্যাস করে।


প্রভু সঙ্গে দেখা করে তিন সহোদরে।।


জাতির উন্নতি কথা বহুত হইল।


আলাপন সাঙ্গ করি সবে গৃহে গেল।।


অতুল বিহারী বাবু মুকুন্দের ভ্রাতা।


তাঁর গুণে মুগ্ধ হন গুরু জ্ঞানদাতা।।


ইচছা করে প্রভু তাঁরে করিতে বন্ধন।


তার ফলে বিবাহাদি হ’ল সংঘটন।।


প্রভুর দ্বিতীয় পুত্র সুধন্য কুমার।


নলিনী নামেতে এক কন্যা আছে তাঁর।।


তার সঙ্গে অতুলের হ’ল পরিণয়।


ইচ্ছাময় ইচ্ছা করে ইচ্ছা পূর্ণ হয়।।


তথা হ’তে পরদিনে সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে।


ফরিদপুরেতে প্রভু উত্তরিল গিয়ে।।


নামিয়া দেখিল প্রভু মীড দাঁড়াইয়া।


প্রভুকে সম্মান করে হস্ত বাড়াইয়া।।


অতঃপর তাঁর সাথে জেলা মধ্যে যায়।


মীড বলে “বড় কর্তা করেছি উপায়।।


বহু কষ্টে ম্যাজিষ্ট্রেটে করিয়াছি রাজী।


লাটের সহিতে দেখা হইবেক আজি।।


সভামধ্যে মানপত্র তুমি দিবে লাটে।


পরে এক সাথে যাব লাটের নিকটে।।


সেইখানে তোমাদের যত কথা আছে।


লাটেরে বুঝায়ে আমি বলিব তা’ পাছে।।

মীডের মুখেতে শুনি এহেন বচন।


প্রভু কহে “ধন্য ধন্য তুমি মহাজন।।”


মীডের সঙ্গেতে তবে প্রভু দয়াময়।


ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের কামরায় যায়।।


দেখিয়া প্রভুর রূপ ম্যাজিষ্ট্রেট কয়।


“বল মীড এই ব্যক্তি কোন মহাশয়?


রাজবংশে জন্ম বলি অনুমান করি?


সৰ্ব্বাঙ্গ জুড়িয়া এর শুভ চিহ্ন হেরি।।


কহ কহ পরিচয় মীড মহাশয়।


এর তুল্য ব্যক্তি কেহ নাহি এ জেলায়।।


মীড বলে “শুন তুমি জেলা অধিপতি।


নমঃশূদ্র কুলে জন্ম মান্যবান অতি।।


ওড়াকান্দী গ্রামে বাস জেলার দক্ষিণে।


জাতি মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলি সবে এঁরে মানে।।


এঁর পিতা ছিল এক মহৎ পুরুষ।


শিষ্য তাঁর এই দেশে বহুৎ মানুষ।।


রাজভক্ত এই ব্যক্তি অতিশয় সৎ।


মহতের পুত্র ইনি নিজেও মহৎ।।”


সকল শুনিয়া তবে ম্যাজিষ্ট্রেট কয়।


“দয়া করি চেয়ারে বসুন মহাশয়।।”


চেয়ারে বসিল প্রভু কনক বরণ।


তাঁর প্রতি ম্যাজিষ্ট্রেট চাহে ঘন ঘন।।


কিছু পরে জিজ্ঞাসিল মীডের নিকট।


“শুন মীড বল মোরে করিও না হট্।।


নমঃশূদ্র জাতি বলি দিলে পরিচয়।


নমঃশূদ্র কোন জাতি বলত আমায়?”


শুনিয়া ডক্টর মীড ভাবে মনে মন।


হেন কথা ম্যাজিষ্ট্রেট বলে কি কারণ?


নমঃশূদ্র বলে’ নাহি চেনে কোন জাতি।


আমি ত’ শুনিনি কভু এমত ভারতী।।


কি ভাবে চিনাই এঁরে নমঃশূদ্র জাতি।


এ সব ভাবিয়া মীড চিন্তান্বিত অতি।।

হেন কালে প্ৰভু মোর মীডে ডাকি কয়।


“কি চিন্তা করিছ তুমি মীড মহাশয়?”


মীড বলে “বড় কর্তা, পড়েছি চিন্তায়।


সাহেব জানে না নমঃজাতি কারে কয়।।


মনে ভাবি কোন ভাবে চিনাই ইহারে।


সেই চিন্তা উঠিয়াছে তামার অন্তরে।।”


প্রভু বলে শুন মীড কোন চিন্তা নাই।


নমঃশূদ্র জাতি দেখ কেমনে চিনাই।।”


এতেক বলিয়া প্ৰভু ম্যাজিষ্ট্রেটে কয়।


আপনি বলুন দেখি সাহেব মশায়।।


কোন কোন জাতি বাস করে এ জেলায়?


কোন জাতির কি কর্ম বল তা আমায়?


জেলার শাসন কর্তা আপনি যখন।


আপনার জানা আছে সব বিবরণ।।


সাহেব হাসিয়া বলে “শুন মহাশয়।


কোন কোন জাতি আছে আমার জেলায়।।


ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য আর মুসলমান।


তেলী মালী, জেলে আছে নানাবিধ স্থান।।


কুম্ভকার বীরুজীবি কিছু কিছু আছে।


আরেক জাতির কথা বলি আমি পাছে।।


‘চণ্ডাল’ বলিয়া সবে তাহাদিগে’ কয়।


বহুসংখ্যা আছে তারা আমার জেলায়।।


শক্তিশালী বটে তারা জানে লাঠি খেলা।


কৃষিকর্ম করে খায় বিদ্যা করে হেলা।।


শহরে বন্দরে তারা আসে কদাচিৎ।


মোর সাথে নহে তারা বেশী পরিচিত।।


এই ভাবে ম্যাজিষ্ট্রেট যখন বলিল।


মীড বলে “ঠিক ঠিক সব ঠিক হ’ল!”


প্রভু প্রতি চাহি বলে “ধন্য মহাশয়।


আপনার সুকৌশলে হ’ল পরিচয়।।”


পুনরায় ম্যাজিষ্ট্রেটে মীড ডাকি কয়।


“এই জাতি নমঃশূদ্র চণ্ডাল ত নয়।।

কি কারণে ‘চণ্ডাল’ বলিয়া তারে কও?


মূলতত্ত্ব জেলাপতি আমারে জানাও।।”


ম্যাজিষ্ট্রেট হাসি বলে “পাদ্রী মহাশয়।


আমরা কি জানি বল এরা যা’ জানায়।।


তাই শুনি তাই জানি সেই ভাবে কই৷


যা’ বলে দেশের লোকে তাই করি সই।।


আমার অধীন যত আছে কর্মচারী।


তাহারা চণ্ডাল বলে আমি কিবা করি?


যেই ভাবে যেই জন দেয় পরিচয়।


সেই ভাবে চিনি তারে কহিনু নিশ্চয়।।


রিপোর্ট প্রকাশ যাহা তাহা ঠিক মানি।।


তাহা ছাড়া অন্য কথা বল কিসে জানি?”


এই ভাবে ম্যাজিষ্ট্রেট যদি কথা কয়।


প্রভু প্রতি মীড তবে ধীরে ধীরে চায়।।


অর্ন্তযামী বুঝি তবে মীডের অন্তর।


বলে “মীড অন্য কথা বলহ সত্বর।।


সবিশেষ সমূদয় আমি তব কাছে।


ক্রমে ক্রমে সব কথা বলিব যে পাছে।।


সাহেবের কাছে যদি অন্য কথা থাকে।


সেই সব কথা তুমি বলাও আমাকে।।”


মীড বলে ম্যাজিষ্ট্রেট “শুন মহাশয়।


লাটের নিকটে দাও এঁর পরিচয়।।”


ম্যাজিষ্ট্রট বলে “মীড এই মহাজন।


কি কি কার্য করিয়াছে করহ বর্ণন।।”


মীড বলে “রাজ ভক্ত এই মহাশয়।


রাজার বিরুদ্ধে কভু কথা নাহি কয়।।


স্বদেশী আন্দোলনে বড়ই বিরোধী।


রাজার মঙ্গল চিন্তা করে নিরবধি।।


মহাধনবান ইনি দেশের প্রধান।


পুত্র কন্যা যত আছে সকলি বিদ্বান।।


এঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র নাম শ্ৰীশশি ভূষণ।


দরখাস্ত করিয়াছে চাকুরী কারণ।।

সভ্য, শিষ্ট, শান্ত সবে ভদ্র ব্যবহার।


বহু ভাবে উপকার করিছে আমার।।


তোমার অধীন আছে কর্মচারী যত।


ইহাদের প্রতি হিংসা করে আবিরত।।


প্রকৃত বৃত্তান্ত তারা জানিতে না দেয়।


তাই নাহি পাও তুমি সত্য পরিচয়।।


এ জাতির মধ্যে আমি ঘুরি অবিরত।


বিদ্যাবান লোক আমি দেখিয়াছি কত।।


রাজ পরিচিত এরা না ছিল কখন।


পতিত রয়েছে এরা শুধু সে কারণ।।


আমি বলি রাজ কার্য এ জাতিকে দাও।


সমদৃষ্টি রাখে রাজা’ এ নীতি দেখাও।।


এ সব বৃত্তান্ত তুমি বিশেষ করিয়া।


লাট সাহেবেরে দাও নিজে বুঝাইয়া।।


আর শুন এই ব্যক্তি কোন ভাবে চলে।


বহু লোকে মান্য এঁকে করে গুরু বলে।।


তার মধ্যে শূদ্র বৈদ্য ব্রাহ্মণাদি আছে।


গুরু বলে মান্য করে আসে এঁর কাছে।।


অধিক বলিব কিবা কিছু মুসলমান।


গুরু মান্য করি এঁরে দেখায় সম্মান।।


আচার বিচার এঁর ব্রাহ্মণের মত।


ইহাকে করিয়া লহ রাজ পরিচিত।।


রাজ ভক্ত জাতি শুদ্ধ এই নমঃশূদ্র।


এরা কেন পিছে পড়ি হয়ে র’বে ক্ষুদ্র?”


মীড়ের বচন শুনি সেই ম্যাজিষ্ট্রেট।


মনে মনে চিত্তা করে মাথা করি হেঁট।।


মাঝে মাঝে প্রভু পতি নয়ন ঘুরায়।


দেখিয়া প্রভুর রূপ স্তব্ধ হ’য়ে রয়।।


এতকাল যে ধারণা ছিল তার মনে।


প্রভুকে দেখিয়া দূর হইল তখনে।।


রিপোর্ট লিখিয়া পরে কলম রাখিল।


লাটেরে জানা’বে সব মীডকে কহিল।।

No comments: