Wednesday, September 23, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 91 পতিব্রতা সুকলাদেবীর উপখ্যান

কৃকল নামেতে বৈশ্য বারাণসী পুরে।


সুকলা নামেতে সাধ্বী ছিল তাঁর ঘরে।।


ধর্ম্মজ্ঞ, দেবজ্ঞ, বটে সেই মহাশয়।


পুণ্যকর্ম্মে তেঁহ বাধ্য ছিল সর্ব্বদায়।।


পরম পবিত্রা সতী সুকলা রমণী।


পতিপদ পূজে সতী দিবস রজনী।।


পতিই পরম ধন জানিয়া অন্তরে।


দিবানিশি সে সুকলা পতি পূজা করে।।


এইভাবে পতিপত্নী গৃহবাসে রয়।


তীর্থে যেতে ইচ্ছা করে সেই মহাশয়।।


সঙ্গী সহ যাইবারে করিলেন মন।


পত্নীর নিকটে কহে আপন মনন।।


“শুন সতী তীর্থবাসে যেতে আমি চাই।


তোমার আদেশ বিনা যেতে সাধ্য নাই।।


ধর্ম্মপত্নী তুমি মোর আছ এই ঘরে।


তোমার সম্মতি চাই ধর্ম্ম কর্ম্ম তরে।।


তীর্থ ধর্ম্ম শুনিয়াছি মহাপূণ্যময়।


তীর্থ ভ্রমণেতে যেতে মন মোর চায়।।


ধর্ম্মকর্ম্মে মত নিবে ধর্ম্মপত্নী ঠাঁই।


তাই এই পূণ্য কর্ম্মে তব আজ্ঞা চাই।।”


এতেক কহিলা যদি কৃকল সুজন।


করজোড়ে সে সুকলা কহিছে বচন।।


“পরম পবিত্র তুমি ওহে মহামতি।


সে প্রস্তাব করিলে তাহা পুণ্যময় অতি।।


সরল অন্তরে আমি করি নিবেদন।


পুণ্যময় কর্ম্ম তুমি কর অনুক্ষণ।।


ধর্ম্মপত্নী কোন ধর্ম্ম করিবে পালন?


তার কিছু কথা আমি করি নিবেদন।।


জাগাবে পতির প্রাণে ধর্ম্মের পিপাসা।


ধর্ম্মপথে থাকে পতি সদা সেই আশা।।


ধর্ম্মকর্ম্মে পতি সনে রহিবে সঙ্গিনী।


আখ্যা পাবে পতিব্রতা সে সহধর্ম্মিণী।।


মহাপুণ্যময় বটে তীর্থাদি ভ্রমণ।


পূর্ণকর্ম্মে তব সঙ্গে করিব গমন।।


‘সস্ত্রীক পালিবে ধর্ম্ম’ শাস্ত্রের বচন।


সে কারণে মোরে সঙ্গে করহ গ্রহণ।।”


পত্নীর বচন শুনি কৃকল ভাবিল।


তীর্থযাত্রাকালে এ কি বিপদ আসিল।।


‘পথি নারী বিবর্জিতা” শাস্ত্রে ইহা কয়।


নারী সঙ্গে নিতে মোর ইচ্ছা নাহি হয়।।


বিশেষতঃ মোর নারী অতীব কোমলা।


পথশ্রমে অঙ্গ তার হইবে বিকলা।।


দুর্গম তীর্থের পথে যাতায়াত কালে।


সুবর্ণ লতিকা সম পড়িবে সে ঢলে।।


ক্রমে ক্রমে হতে পারে প্রাণনাশ তার।


তারে ছাড়া পরে গতি কি হবে আমার?


ধর্ম্মের আশ্রয় মোর এই বর-নারী।


তারে হারা হয়ে বল কিসে প্রাণ ধরি?


কুসুমের সম এই প্রাণ-প্রিয়া মোর।


পতির চিন্তাতে সদা রয়েছে বিভোর।।


সঙ্গে নিলে মহাদুঃখে কুসুম শুকাবে।


তীর্থ-ধর্ম্ম পুণ্যকর্ম্ম সব বৃথা হবে।।


অধিক কি এই নারী যদি মৃতা হয়।


আমার কঠিন প্রাণ যাইবে নিশ্চয়।।


সতী নারী ছেড়ে গেলে পতি কি আর রয়?


পতি পক্ষে সতী নারী পরম আশ্রয়।।”


অতএব তীর্থ-পথে চলিব একেলা।


গৃহেতে রহিবে সতী পবিত্রা সুকলা।।


মনে মনে এই চিন্তা করে মহাশয়।


সুকলা জানিল প্রাণে তত্ত্ব সমুদয়।।


দেহমন সমপূন পতিরে যে করে।


পতির মনের কথা জানিতে সে পারে।।


বুঝিয়া পতির মন সুকলা কহিল।


‘হেন চিন্তা প্রভু তব মনে কেন এল?


পুরুষের পক্ষে বহু ধর্ম্ম নিরূপণ।


নারীপক্ষে ধর্ম্ম শুধু পতির সেবন।।


পতিই আশ্রয় তার সর্ব্বতীর্থ সার।


পতি বিনে রমণীর গতি নাহি আর।।


পতি স্বর্গ পতি মোক্ষ পতি তীর্থ ময়।


পতির চরণে নারী সর্ব্ব তীর্থ পায়।।

পতির দক্ষিণ পদে তীর্থ যে প্রয়াগ।


পুস্কর নামেতে তীর্থ রহে বাম ভাগ।।


“যুবতীর্ণা পৃথক তীর্থং বিনা ভর্ত্তুর্নশোভতে।


সুখদং নাস্তি বৈ লোকে স্বর্গমোক্ষপ্রদায়কম।।


সব্যং পাদং স্বর্ভর্ত্তুশ্চ প্রয়াগং বিদ্ধি সত্তম।


বামংচ পুস্করং সত্য যা নারী পরিকল্পয়েৎ।।”


….পদ্মপুরানম


ছায়া সম তব সাথে মোরে প্রভু লও।


অধিনীর পানে চাহি কৃপাবন্ত হও।।


আমারে ছাড়িয়া নাথ যেয়ো না কখনে।


এ প্রাণ রবে না দেহে কভু তোমা বিনে।।


এতেক কহিছে তাঁরে বহু স্নেহ করি।


কৃকল কহিছে তাঁরে বহু স্নেহ করি।।


“শোন প্রিয়ে মম কথা না হবে খন্ডন।


তোমাকে ব্যাজিতে আমি পারিকি কখন?


সতী নারী যেই জন করিয়াছে তাজ্য।


সাধু সমাজেতে তেহ বড়ই অ-পূজ্য।।


ধর্ম্ম তারে কভু নাহি করিবে কল্যাণ।


ধর্ম্মহীন মূঢ় সেই পশুর সমান।।


তোমা নাহি ছেড়ে যাব এই জান মনে।


আমি সদা আছি বাধ্য তোমার সুগুণে।।”


এইরূপে যদি কথা কৃকল কহিল।


শান্ত হয়ে সতী তবে গৃহেতে পশিল।।


মনুষ্য চরিত্র দেখ বড়ই অদ্ভুত।


মনে মনে সে কৃকল নহে শান্তিযুত।।


তীর্থে যেতে মন তার হইল চঞ্চল।


ধর্ম্মলোভে নারী সঙ্গে করিল মন্ত্রণা।।


একা তীর্থে যাবে সঙ্গে নারীকে লবে না।


মন্ত্রণা করিয়া সাধু গেল নিজ ঘরে।


কোন কথা না কহিল সতীর গোচরে।।


শেষ রাত্রে শয্যাত্যাগ করে মহাশয়।


সঙ্গীর সঙ্গেতে তবে তীর্থ প্রতি ধায়।।


কিছু না জানিল সতী এহেন ঘটনা।


পতি প্রতি কোনরূপে সন্দেহ আসে না।।


ক্রমে ক্রমে বেলা হল সতী ভাবে মনে।


বেলা হল তবু পতি নাহি ফিরে কেনে?


দেবতা মন্দিরে নিত্য পূজার্চ্চনা হয়।


দেবপূজা কাল আজি বুঝি সরে যায়।।


ব্যাকুলা হইয়া সতী পল্লীমধ্যে যায়।


স্বজন বান্ধব জনে ডাকিয়া শুধায়।।


“শুন হে বান্ধব সবে আমার বচন।


কেহ কি পতিরে মোর করেছ দর্শণ?”


সুকলার বাণী শুনি প্রতিবেশী কয়।


“তোমার বচন শুনি লাগিল বিস্ময়।।


মোরা জানি তর পতি তীর্থে চলে গেল।


তুমি যে জান না তাহা কিসে বুঝি বল?


অদ্য প্রাতেঃ সঙ্গী সহ করিল প্রস্থান।


এতক্ষণে বহু পথ হল আগুয়ান।।”


এমত বচন যদি কহে প্রতিবেশী।


সুকলা ফিরিল গৃহে আঁখি জলে ভাসি।।


গৃহে ফিরি সেই সতী করিছে বিলাপ।


“কোন জনে দিল মোরে হেন অভিশাপ?


জন্মান্তরে ছিল বুঝি মোর বহু পাপ।


নিষ্ঠুর সাজিয়া পতি দিল এই তাপ।।


পূর্ব্বজন্ম কর্ম্মফলে সেজেছি পাপিনী।


পতি তাই ছেড়ে গেল আপন গৃহিণী।।


এ ছার জীবনে বল কিবা কাজ আর?


বৃথা জন্ম থেকে পতি দূরে গেল যার।।


তীর্থবাসে পতি মোর কত কষ্ট পাবে।


আধিতে ব্যাধিতে বল কে তারে সেবিবে?


কোথায় মিলিবে শয্যা কোথায় আহার?


ভূমি শয্যা পরে রহে তীর্থে বাস যার।।


বিলাস ব্যসন কিছু না ঘটে কপালে।


সুখাদ্য কোথায় মেলে তীর্থবাসী হলে?

পতি যার তীর্থবাসে সহিতেছে দুঃখ।


কোন মুখে নারী ঘরে করে ভোগ সুখ।।


অদ্য হতে আমি তাই ছাড়িনু সুখেরে।


যোগিনী সাজিয়া রব পতির সংসারে।।


সেই হতে সেই সতী রহে ভূমি পরে।


কভু অনাহারে রহে কভু একাহারে।।


কখন করে না সতী করবী বন্ধন।


হাস্য-পরিহাস-শূণ্য মলিন বদন।।


তৈল, মৎস্য, ঘৃহ, দধি না খায় লবণ।


আতপ তন্ডুল সিদ্ধ করেন গ্রহণ।।


মিষ্টদ্রব্য করে ত্যাগ নাহি খায় ক্ষীর।


হা পতি হা পতি বলি চক্ষে বহে নীর।।


নিদ্রাহীন চোখে দেবী দিবারাত্রি রয়।


পুরুষের সঙ্গে কভু কথা নাহি কয়।।


এভাবে সুকলা তবে সাজিলা যোগিণী।


পতি চিন্তা নিয়ে ঘরে থাকে একাকিনী।।


তাহার সঙ্গিনী যত আসি তাঁর ঠাঁই।


বলে সখি হেন ভাব মোরা দেখি নাই।।


কি কারণে বল তব মলিন বদন?


দিবানিশি কেন সদা করিছ রোদন?”


সুকলা কহিছে ‘সখি মম কর্ম্ম দোষে।


ভার্ষ্যা ছাড়ি পতি মোর গিয়াছে প্রবাসে।।


তাঁহার বিরহে মোর জীবন চঞ্চল।


সেই হেতু চক্ষে দেখ সদা ঝরে জল।।


‘পতিই নারীর সুখ” শাস্ত্রের প্রমাণ।


পতি ছেড়ে নারী বল কিসে রাখে প্রাণ?


সেই দুঃখে দেহ মোর হয়েছে অঙ্গার।


পতি ছাড়া তুমি প্রাণ নাহি বাঁচে আর।।


এতেক কহিলা যদি সুকলা জননী।


প্রবোধে কহিল তাঁরে যতেক সঙ্গিনী।।


“শুন দেবী বৃথা তুমি করিতেছ খেদ।


কিছু কাল পরে তবে রবে না বিচ্ছেদ।।


তীর্থযাত্রা সারি তব পতি মহোদয়।


অবশ্য আসিবে গৃহে নাহিক সংশয়।।


তার লাগি আত্মকষ্ট কেন তুমি সহ।


কি শিখাল এই ধর্ম্ম সেই কথা কহ।।


অসার সংসার মাঝে কেহ কার নয়।


কার লাগি কান্দ তবে কাহার আশায়?


বিশেষতঃ পতি তব ফিরিবেন ঘরে।


কোন লাগি বল কষ্ট সহ তার তরে?


পান ভোজনাদি জান সংসারের ফল।


তাহা ছেড়ে বল দেহে কোথা পাবে বল?


তাই বলি শোন সখী দুঃখ কর মিছে।


আত্মা কষ্ট পেলে তাতে জীব নাহি বাঁচে।।


আর এক কথা মনে উঠিয়াছে সখি।


তব সম আচরণ কার নাহি দেখি।।


তীর্থবাসে গিয়ে থাকে সকলের পতি।


কেহ সঙ্গে যায় কেহ নাহি হয় সাথী।।


যারা গৃহে থাকে তারা না হয় মলিন।


পান ভোজনাদি ছেড়ে নাহি হয় ক্ষীণ।।


দেখিয়া তোমার কান্ড হয়েছি বিস্মিত।


এই ধর্ম্ম কোন শাস্ত্রে লিখেছে বিহিত?”


সঙ্গিনীর কথা শুনি সতী ডেকে কয়।


“সতীধর্ম্ম নীতি কেহ জানে না নিশ্চয়।।”


বেদে বলে “নারী সদা রবে পতি সনে।


সতত তুষিবে তাঁরে বিবিধ বিধানে।।


পতি ছেড়ে যেই নারী রহে একাকিনী।


সাধু শাস্ত্রে বলে তারে ‘পুংশ্চলী পাপিনী।।”


পতি বর্ত্তমানে নারী পালে অন্য ধর্ম্ম।


বিষ্ঠা মূত্র সম তার হয় সব কর্ম্ম।।


“বিদ্যামানে যদা কান্তে অদ্য ধর্ম্মং করোতি যা।


নিষ্ফলং জায়তে সত্যঃ পুঃশ্চলী পরিকথ্যতে।।


…..পদ্মপুরাণম

 

স্বামী তুষ্ঠে দেব তুষ্ট, তুষ্ট মুনি ঋষি।
স্বামী-পদে নারী পায় গয়া গঙ্গা কাশী।।
স্বামী গুরু, স্বামী নাথ, দেবের দেবতা।
স্বামীই নারীর প্রভু বিধির বিধাতা।।
“তুষ্টে ভর্ত্তরি তস্যাস্ত তুষ্টাঃ স্যুঃ সর্ব্বদেবতাঃ
তুষ্টে ভর্ত্তরি তুষ্যন্তি ঋষয়ো দেবমানাবঃ।।
ভর্ত্তা নাথো গুরুভর্ত্তা দেবতা বৈ তৈঃ সহ।

ভর্ত্তা তীর্থশ্চ পুণ্যশ্চ নারীনাং নৃপনন্দন।।”


-ভূমিখন্ডম।


রমনীর বেশভূষা পতির কারণে।


পতি দূরে গেলে বেশাভূষা করে কেনে?


পতি অগোচরে নারী বেশভূষা করে।


পাপিনী বলিয়া তারে কহে সাধু নরে।।


তাহা ভিন্ন আর কথা আছে গুরুতর।


পতি অগোচরে সজ্জা আছে পাপভার।।


প্রমাণ তাহার শুন বলি একমনে।


সতীত্ব হারা’ল পদ্য কেমন বিধানে?”


No comments: