Friday, September 25, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 92 পদ্মাবতীর বৃত্তান্ত


কংশের জননী নাম সতী পদ্মাবতী।


সত্যকেতু নাম তার পিতা মহামতি।।


বিদর্ভ রাজ্যের রাজা সেই মহাশয়।


ধর্ম্মপথে থাকি রাজ্য পালে সর্ব্বদায়।।


মথুর রাজ্যের রাজা উগ্রসের নাম।


মহাসুখে রাজ্য যেথা করে গুণধাম।।


পরম রূপসী সেই সতী পদ্মাবতী।


তাঁরে বিয়া কৈল উগ্রসেন নরপতি।।


পত্মীসহ মহাতেজা করয় বিহার।


পত্নীর চিন্তায় সদা চিত্ত মুগ্ধ তার।।


এই ভাবে কিছু কাল যবে গত হয়।


মনে মনে ভাবিলেন সত্যকেতু রায়।।


বহুদিন কন্যা মুখ দেখি নাই চোখে।


নাহি জানি কন্যা মোর কোন ভাবে থাকে।।


পদ্মাবতী কন্যা আনি জুড়াব পরাণ।


এতদিন তারে মনে করি নাই কেন।।


পিতার নিকটে কন্যা বহু আদরিণী।


মাতার নিকটে পুত্র সেই রূপ জানি।।


পুত্র নিয়ে আছে সুখে পদ্মার জননী।


কন্যার বিরহে পোড়ে এ পোড়া পরাণী।।


পদ্মার জননী বলে ‘‘কন্যা বিয়া দিলে।


পিতৃগৃহে রাখা মন্দ শাস্ত্রে ইহা বলে।।


তবু মনে বলে কন্যা কিছু দিন তরে।


অবশ্য রাখিব তারে এনে নিজ ঘরে।।


কিছু কাল পরে কন্যা স্বামী গৃহে যাবে।


আমার তাপিত প্রাণে পূর্ণ শান্তি হবে।।


এত ভাবি সেই রাজা দূত পাঠাইল।


দূত দিয়া উগ্রসেনে কহিতে লাগিল।।


‘‘নিবেদন নরপতি করি তব পায়।


কন্যাকে লইতে রাজা আমারে পাঠায়।।


কন্যার বিরহে রাজা দুঃখী অতিশয়।


তাই ইচ্ছা করে কন্যা নিতে পিত্রালয়।।’’


ধীরভাবে শুন কথা উগ্রসেন রায়।


মনেতে বিচার করে- কি কর্ত্তব্য হয়।।


পরম ধার্ম্মিক বটে সত্যকেতু রাজা।


দীপ্তমান সূর্য্য প্রায় অতি মহাতেজা।।


স্নেহের বাঁধনে বান্ধে করি কন্যাদান।


আমার মঙ্গল ইচ্ছা করে মতিমান।।


অপত্য স্নেহের দায়ে কন্যা নিতে চায়।


তাঁর আজ্ঞা অবহেলা উচিত না হয়।।


প্রাণের অধিক মোর পদ্মাবতী সতী।


তার প্রেমে মগ্ন আমি আছি দিবারাতি।।


তথাপিত কর্ত্তব্য মোর জাগিয়াছে মনে।


পাঠাইতে পদ্মাবতী পিতার ভবনে।।

 

 

যেই প্রেম কর্ত্তব্যেরে অবহেলা করে।


‘মোহ’ নাম ধরে তাহা পৃথিবী ভিতরে।।


পদ্মাবতী প্রতি মোর বহু প্রেম আছে।


কিন্তু ক্ষুদ্র মানি তাহা কর্ত্তব্যের কাছে।।


এত ভাবি নররায় পাঠাইল সতী।


সুখে পিতৃ-গৃহে গেল সেই পদ্মাবতী।।


মানব আচারে যাহা ঘটে সর্ব্বদায়।


পদ্মাবতী পক্ষে তার না হল ব্যতায়।।


পিতৃ গৃহে আসি পদ্ম প্রমত্তা হইল।


পতি-চিন্তা পতি-ধ্যান সব ভুলে গেল।।


আত্মীয় স্বজন বন্ধু দেখে চারিদিকে।


আদরে ‘কদর’ বাড়ে সুখে মত্ত থাকে।।


বসন ভূষণে সদা ঢাকে নিজ দেহ।


আপনার গুণগানে মত্ত অহরহ।।


নিঃশঙ্ক চিত্তেতে সদা করিত ভ্রমণ।


যথা ইচ্ছা তথা যায় পেলে নিমন্ত্রণ।।


বাল্যের সঙ্গিনী যত তাহাদের সাথে।


বন উপবনে যায় মাতি আনন্দেতে।।


অপত্য স্নেহের দায়ে পিতামাতা হার।


দেখিয়াও নাহি দেখে এ সব আচার।।


বিন্দুমাত্র রূঢ় কথা যদি কেহ কয়।


ক্রোধে জ্বলে ওঠে পদ্ম প্রাণে নাহি সয়।।


এই ভাবে নারী-ধর্ম্মে পড়ে গেল ভুল।


ফল-ভরা বৃক্ষ দেখ হারাইল মূল।।


একদিন সেই পদ্মা সঙ্গিনীর সঙ্গে।


রম্য উপবনে খেলা করে মনোরঙ্গে।।


কর্ম্মফল আসি তবে দিল দরশন।


এবে শুন কিসে তার হইল পতন।।


গেভিল নামেতে দৈত্য কুবেরের দাস।


দৈবক্রমে যেতে ছিল ভেদিয়া আকাশ।।


নিম্নদৃষ্টি করি দেখে রমণীর মেলা।


তরুণী রূপসী সবে করিতেছে খেলা।।


মায়াবী দৈত্যের মনে কাম উপজিল।


আকাশ ভেদিয়া তবে ভূতলে নামিল।।


মায়াশক্তি বলে দেখে করিয়া গণনা।


মথুরারাজের পত্মী সেই যে ললনা।।


সতী-ধর্ম্মে ঘেরা বটে ছিল এতদিন।


পিতৃ-গৃহে আসি তাহা হয়েছে মলিন।।


গেভিল ভাবিছে মনে তবে আছে আশা।


সতী-ধর্ম্ম হীনা নারী-সেই মোর বাসা।।


পাপ-পথে এ বালারে পারিব মজাতে।


নাহি ভয়-ধর্ম্মশক্তি নাই তার হাতে।।


নারী-ধর্ম্ম ছাড়ি এবে মোহ চক্ষু অন্ধ।


কিছুই দেখে না চোখে ভাল কিংবা মন্দ।।


এত ভাবি সে গেভিল মায়া-মূর্ত্তি ধরে।


উগ্রসেন রূপে দেখা দিল কিছু দূরে।।


মোহন বাঁশিতে ধ্বনি করিতে লাগিল।


বাঁশী শুনি পদ্মাবতী চঞ্চলা হইল।।


স্বর প্রতি শীঘ্র গতি হল অগ্রসর।


দেখে কিছু দূরে উগ্রসনে নরবর।।


সতীধর্ম্ম-হারা পদ্মা জ্ঞান-চক্ষু নাই।


দৈত্য যে পতির বেশে দেখিল না তাই।।


মোহাচ্ছন্ন সেই নারী লজ্জ্বিতা হইল।


লজ্জ্বা-ছিদ্র পথে পাপ তাহারে ঘিরিল।।


মায়াবী গেভিল দৈত্য পাইল সুযোগ।


পদ্মাবতী কন্যা সেথা করিল সম্ভোগ।।


পাপের এমনি লীলা নরে বোঝা দায়।


বক্ষে টেনে নিয়ে পাপ পরে চেনা দেয়।।


এ ক্ষেত্রে ঘটিল তাহা সম্ভোগের পরে।


পদ্মা বোঝে ধর্ম্ম নাশ করে অন্য নরে।।


অতি ক্রুদ্ধা সেই পদ্মা শাপ দিতে গেল।


মায়া-রূপ ছেড়ে দৈত্য নিজ রূপ নিল।।


পদ্মা বলে ‘‘ওরে দুষ্ট দানব অধম।


নিশ্চয় স্মরণ তোরে করিয়াছে যম।।

 

ছেলে বলে ধর্ম্মনাশ করিলি আমার।


আমার শাপেতে তোর নাহিরে নিস্তার।।’’


বিষহীনা বিষধরে কেবা করে ভয়?


হাসিয়া গেভিল দৈত্য তাই তারে কয়।।


‘‘অযথা গঞ্জনা নারী করো না আমায়।


ধর্ম্মহীনা তুমি তাই নাহি মোর ভয়।।


আমার আচার যাহা বলি তব ঠাঁই।


দৈত্যাচারে দেখ মোরা ঘুরিয়া বেড়াই।।


পরনারী পরধন হরণ করিয়া।


দিবানিশি যথা তথা বেড়াই ঘুরিয়া।।


যজ্ঞ-ধর্ম্মে নরনারী আছে যত জন।


তাঁহাদের ছিদ্র মোরা করি অন্বেষণ।।


কখনে মিলিলে ছিদ্র আর রক্ষা নাই।


অনায়াসে ধর্ম্মনাশ করি সর্ব্ব ঠাঁই।।


দৈত্য-ধর্ম্মে এই নীতি শুনহে ললনা।


কিন্তু তিন স্থানে মোরা করিনা ছলনা।।


সে-তিনের তেজে দৈত্য ভস্মীভূত হয়।


শোন বলি সে-তিনের যাহা পরিচয়।।


রক্ষাকর্ত্তা ভগবান বিষ্ণু নাম যাঁর।


অগ্নিদোত্রী সুব্রাহ্মণ পবিত্র আচার।।


পতিব্রতা নারী জানি সকলের সেরা।


এতিনের কাছে কভু নাহি যাই মোরা।।


পতিব্রত্য ধর্ম্ম কথা শুন দিয়া মন।


পতিব্রতা নারী বল আছে কয় জন?


‘‘বাক্যে, মনে, কর্ম্মে নারী পতিকে তুষিবে।


দেখিলে পতির ক্রোধ, ক্রুদ্ধ নাহি হবে।।


তাড়িতা হইয়া নারী পতি নাহি ছাড়ে।


তাঁর শান্তি দিতে প্রাণ ছাড়িতে যে পারে।।


পতি-মধ্যে যেই নারী নাহি দেখে দোষ।


স্নেহাদি শুশ্রূষা দানে জন্মায় সন্তোষ।।


পতিব্রতা বলি তাঁরে কহে নারায়ণ।


দেবে তাঁরে পূজা করে ছাড় দৈত্যগণ।।

ব্রাহ্মণের পক্ষে যথা যজ্ঞাগ্নি তাঁহার।


সন্তানের পক্ষে পিতা জানি যে প্রকার।।


নারী পক্ষে পতি বটে তেমন প্রকার।


পতিত্যাগ সতী পক্ষে নহে সদাচার।।


অধিক বলিব কিবা সতীধর্ম্ম কথা।


পতি ভিন্ন সতীনাহি হয় পতিব্রতা।।


পতিত, ব্যাধিত, কিংবা কুন্ঠিত বিকল।


বিত্তহীন, কর্ম্মহীন, বিহীন সম্বল।।


এহেন যদ্যপি পতি হয় কোন কালে।


যেই সতী নাহি যায় কভু তারে ফেলে।।


বরঞ্চ আদরে তার শুশ্রূষা করয়।


ধন্য সতী পতিব্রতা জানিবে তাহায়।।


অর্থ, বিত্ত, রূপ যশ আছে অধিকারে।


এহেন পতিরে নারী সদা বাঞ্ছা করে।।


সতীত্ব ধর্ম্মের তাতে না হয় পরীক্ষা।


পতিব্রতা ধর্ম্মে লাগে দুঃখাগ্নিতে দীক্ষা।।


আমাকে শাপিবে বৃথা মোর দোষ নাই।


আমার কর্ত্তব্য পথে ঘুরিয়া বেড়াই।।


অগ্নির কি দোষ বল ‘জ্বলা’ ধর্ম্ম তার।


উড়িয়া পতঙ্গ কনে পড়ে তার পর?


আমাদের ধর্ম্ম কিছু বলি পুনরায়।


সে-ধর্ম্ম পালনে কিছু দোষ নাহি হয়।।


ধর্ম্ম পথে নরনারী মোরা বটে রাখি।


ধর্ম্ম-ছাড়া হলে গুরুদন্ড দিয়া থাকি।।


পতি অগোচরে বেশ করে যেই নারী।


পুংশ্চলী বলিয়া তারে আমি ব্যাখ্যা করি।।


এবে বল কোন ধর্ম্মে তুমি আজ হেথা?


সেজেছ মোহিনী বেশে পতি তব কোথা?


পিতৃগৃহে আনন্দেতে প্রমত্তা হয়েছ।


সতীর পবিত্র ধর্ম জলাঞ্জলি দেছ।।


পতি অগোপরে রবে সাজিয়া যোগিনী।


শাস্ত্রে এই মত কয় আমি তাহা জানি।।

এবে বল দেখি তুমি কোন ধর্ম্মে আছ?


পতিকে রাখিয়া দুরে ধর্ম্মকে ছেড়েছ।।


এই পাপে গুরুদন্ড দিতেছি তোমায়।


আমার কার্য্যের ফল ব্যর্থ নাহি হয়।।


ধর্ম্মের বিরোধী কর্ম্মে জান এই ফল।


তব গর্ভে পুত্র হবে দৈত্য মহাবল।।


বিষ্ণু-দ্রোহী, দেব-দ্রোহী হবে এ জগতে।


কুযশ রটনা হবে সেই পুত্র হতে।।


কু-কর্ম্মে কু-ফল ফলে সুফল সুকর্ম্মে।


এখনো সামাল হয়ে পাল নিজধর্ম্মে।।


এত বলি সেই দৈত্য গেল নিজালয়।


দুঃখে কান্দে পত্মাবতী বসে নিরালায়।।


সখিগণ আসি পরে সকলি জানিল।


বিমর্ষ চিত্তেতে পদ্ম পিতৃগৃহে গেল।।


পিতামাতা জানিলেন সব বিবরণ।


পতি গৃহে গেল পদ্মা বিষাদিত মন।।


সেই গর্ভে মহাদৈত্য কংস জন্ম নিল।


গেভিলের বাক্য দেখ আপনি ফলিল।।


এ সব কারণে সখি বলিয়াছি কথা।


পতি ছাড়া হয়ে নাহি রহে পতিব্রতা।।


পতি যদি কাছে নাহি রহিবারে পারে।


কার্য্যব্যপদেশে যায় কাছে কিংবা দূরে।।


পতিব্রতা নারী তবে সাজিবে যোগিনী।


সুখ, ভোগ, বেশ ভূষা ত্যজিবে তখনি।।


সেই হেতু দীনা বেশ আমি সাজিয়াছি।


ফিরে যদি আসে পতি তবে প্রাণে বাঁচি।।’’


এই মত কথা যদি সুকলা কহিল।


সখি গণে সবে তাঁরে ধন্য ধন্য কৈল।।


পতিব্রতা সতী-থাকে কত বড়দায়।


পদে পদে বিপদের ছাড়া দেখা দেয়।।


এইভাবে সে সুকলা কাটাইছে কাল।


স্বর্গপতি ইন্দ্র আসি পাতে মায়া-জাল।।


ইন্দ্র ভাবে এই নারী সাধ্বী অতিশয়।


পরীক্ষা করিয়া দেখি কি ফল দাঁড়ায়।।


পতি তার দূরে গেছে একানিনী ঘরে।


কোন শক্তি বলে দেখি ধর্ম্মরক্ষা করে।।


এত ভাবি ইন্দ্রেদের কামকে স্মরিল।


চিন্তামাত্রে কাম আসি সম্মুখে দাঁড়াল?


ইন্দ্র বলে ‘‘শুন কাম আমার বচন।


নারীকুলে ধন্যা দেখ নারী এই জন।।


পরম পবিত্রা সতী নামেতে সুকলা।


নাহি জানে পাপে চিন্তা নহেক চঞ্চলা।।


তীর্থবাসে পতি তার করিয়াছে গতি।


একাকিনী ঘরে আছে সেই মহাসতী।।


অবশ্য পরীক্ষা আমি করিব তাঁহারে।


দেখি সতী কোন বলে ধর্ম্মরক্ষা করে?


এই কার্য্যে তুমি মোর হইবে সহায়।


বুঝিয়া করহে কার্য্য উচিত যা হয়।।


ইন্দ্রের বচন শুনি কহিলেন কাম।


তব আজ্ঞা শিরোধার্য্য আমি করিলাম।।


এই কার্য্য মোর পক্ষে না হবে কঠিন।


আমার শক্তির তত্ত্ব জান চিরদিন।।


মুনি, ঋষি, দেব, নর, আর যক্ষ, রক্ষ।


সকলি আমার বশ্য আছে বহু সাক্ষ্য।।


কি বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র সবে আমি জানি।


আমার বিক্রম জানে নিজে শূলপাণি।।


সামান্যা মানবী এই তাহে একাকিনী।


মুহুর্ত্তে আমার শরে মরিবে রমণী।।


ইন্দ্র বলে ‘‘শুন কাম মম অভিপ্রায়।


লোভে, ক্ষোভে, কামে, ত্রাসে এই কার্য্য নয়।।


কেমন পবিত্রা সতী করিব পরীক্ষা।


দেখি কোনগুণে সতী করে ধর্ম্মরক্ষা।।


এত বলি দেবরাজ ধরে নরাকার।


পরম সুন্দর যুবা অতি মনোহর।।

 

সুকলার গৃহে আসি দিল দরশন।


লালসায় অঙ্গভঙ্গী করে ক্ষণে ক্ষণ।।


তার প্রতি মহাসতী চাহিয়া না দেখে।


পতি চিন্তা মাঝে সতী মগ্ন হয়ে থাকে।।


যেথা যায় সেই সতী ইন্দ্র ঘুরে সাথে।


ভুলিয়া ও সতী নাহি চাহে তার ভিতে।।


মায়ার পুতলি ইন্দ্র স্মরণ করিল।


দূতীরূপে রতি আসি উপনীত হল।।


ধরিয়া সতীর বেশ সুকলারে কয়।


‘‘সত্য, ধৈর্য্য, ক্ষমা তব দেখি অতিশয়।।


কাহার কামিনী তুমি কোন পুণ্যবান?


ভার্য্যারূপে পেয়ে তোমার মহা ভাগ্যবান।।


সুকলা কহিল তারে ‘‘শুন তুমি সতী।


কৃকল নামেতে সাধু হয় মোর পতি।।


তীর্থবাসে গেল পতি এ তিন বছর।


তাঁহার বিরহে মোর চিত্ত জর জর।।


এবে তব পরিচয় কহ মোর ঠাঁই।


কিবা লাগি এইখানে আসিয়াছ ভাই?


দূতী বলে ‘‘শুন সতী আমার মনন।


এক কার্য্য লাগি হেথা করি আগমন।।


পরম নিষ্ঠুর তব পতি মহাশয়।


বিনা দোষে সতী ছেড়ে তীর্থবাসে যায়।।


বিনা দোষে যেই পতি গিয়াছে ছাড়িয়া।


তার পথ চেয়ে কেন রয়েছ বসিয়া?


মানব জীবন দেখ নহে দীর্ঘতর।


বয়সের ভেদে তাহে আছে কত স্তুর।।


বাল্যকালে মানবের যায় ক্রীড়াচ্ছলে।


বার্দ্ধকো দুঃখের রশি যায় বান্ধে হাতে গলে।।


একমাত্র যৌবনেতে সুখের বিহার।


সুখভোগ তব ভাগ্যে হলনা এবার।।


যৌবনে তোমার পতি হয়েছে প্রবাসী।


কোন লোভে আশা পথ চেয়ে আছ বসি?


বিফলে যৌবন যদি আজি চলে যায়।


তবে কেন বল সতী এলে এ ধরায়?


আমি বলি যৌবনেরে কর উপভোগ।


তাতে তব ভাগ্যে দেখ পরম সুযোগ।।


এই যে পুরুষ রত্ন অতি রূপবান।


ধন্যাঢ্য, সর্ব্বজ্ঞ রাখে সকল সন্ধান।।


ইহ সঙ্গে সুখ ভোগ তুমি মত্ত হও।


যৌবন-মদিরা পানে মহাসুখে রও।।


এই মতে সেই দুতী করিল কীর্ত্তন।


সুকলা কহিল তারে পবিত্র বচন।।


‘‘শুন দূতি হেন বাক্য নাহি কহ আর।


বুঝিলাম তুমি নাহি জান সমাচার।।


ক্ষণিকের সুখলোভ দেখাইলে মোরে।


নূতনত্ব কিছু নাহি ইহার ভিতরে।।


যেই মতে কর নরে গৃহের নির্ম্মান।


সেই তত্ত্ব নরদেহে দেখি বিদ্যমান।।


আদিকান্ডে হয় শুধু গৃহের নির্ম্মাণ।


মানবের বাল্যকাল ইহার সমান।।


নির্ম্মাণের পরে গৃহ চিত্রিত করয়।


চাকচিক্যশালী-গৃহ কিবা শোভা পায়।।


মানব যৌবন জানি এইরূপ প্রায়।


যৌবনের আগমনে রূপের উদয়।।


পরে সেই গৃহ যবে ধ্বংস হতে যায়।


গৃহ ছাড়ি গৃহস্বামী নবগৃহে ধায়।।


বার্দ্ধক্য মানব দেহে এমনি প্রকার।


বার্দ্ধক্যের আগমেন অস্থি চর্ম্ম সার।।


মানব জীবনে দেখ সকলি চঞ্চল।


যুবত্ব, বৃদ্ধত্ব কিছু নহেক প্রচল।।


বালক যুবক হয় যুবক প্রাচীন।


এক ঠাঁই কেহ বসে নহে চির দিন।।


ঘটে ঘরে যথা ভরা রহে এক জল।


আত্মা থাকে সর্ব্ব দেহে ব্যাপিয়া সকল।।

 

 

কামনা লালসা যাহা ভোগের বাহন।


কোনরূপে তারা তুষ্ঠ নহে কদাচন।।


দেহী মাত্রে আছে দেখ বার্দ্ধক্য যৌবন।


সৃষ্টি স্থিতি লয় তার আছে নিরূপণ।।


মোহ বশে জীব ছোটে কামনার পথে।


অতৃপ্ত বাসনা তৃপ্ত নহে কোন মতে।।


এই যদি পরিণাম কামনার পথে।


কিবা ফল বল দূতি মজিয়া তাহাতে?


আর বলি শোন তুমি নিগুঢ় কাহিনী।


বিষ্ঠা-মূত্র-কৃমি-পূর্ণ এই দেহ জানি।।


যেই রূপবান মোরে করিছে কামনা।


তার বটে সেই দেহ একই ঘটনা।।


তাতে বলি নূতনত্ব এই পথে নাই।


জেনে শুনে বল কিসে সেই বিষ খাই?


কু-আশা আমার কাচে পূর্ণ নাহি হবে।


তোমার প্রভুর কাছে এ-বাক্য কহিবে।।’’


এই বাক্য শুনি দূতী করিল গমন।


ইন্দ্রের নিকটে সব করে নিবেদন।।


ইন্দ্র বলে ‘‘ধন্য সতী দেখিলাম চোখে।


আর না করিব আমি পরীক্ষা তাহাকে।।’’


কাম বলে মহারাজ কি বাক্য কহিলে।


সামান্যা নারীর ঠাঁই পরাভব নিলে?


ইন্দ্র বলে ‘‘কাম তুমি করহে স্মরণ।


গৌতমের অভিশাপ বহি যে কারণ।।


সতী নারী প্রতি মোর নাহিক দুরাশা।


মনে কর শিব-হস্তে তোমার দুর্দ্দশা।।’’


মদন ডাকিয়া বলে শুন সুরপতি।


আমি বটে জানি সত্য নরনারী-গতি।।


কামনার পথে নারী অধিক বিহবলা।


মনে মনে মন তার সতত উতলা।।


মুখে বটে নাহি বলে অন্তরেতে চায়।


বড় বড় কথা বলে সতীত্ব জানায়।।


কিন্তু যদি অবকাশ পায় কোন ছলে।


পত্যাখ্যান নারী নাহি করে কোনকালে।।


বিশেষ আমার শাস্ত্রে অব্যর্থ সন্ধান।


নিশ্চয় সুকলা দিবে নিজ কুলমান।।’’


এত বলি কাম তবে রতিকে কহিল।


‘‘সঙ্গী সাথী সবে নিয়ে মোর সাথে চল।।’’


অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া তখন।


ইন্দ্র ও রতির সঙ্গে চলিল মদন।।


কামের কুটিল ইচ্ছা বুঝি নিজ মনে।


সত্য কহে খেদভরে চাহি ধর্ম্মপানে।।


‘‘দেখ ধর্ম্ম মহাদুষ্ট কামের দুরাশা।


আমার আশ্রয় ধ্বংসে তার বড় আশা্।।


তুমি, আমি, আর পূণ্য তিনের লাগিয়া।


সুপবিত্রা সতী-গৃহে রেখেছি গড়িয়া।।


তুমি জান কোথা কোথা আমার আবাস।


একে একে আমি তাহা করিব প্রকাশ।।


তপোধন বিপ্র আর পতিব্রতা সতী।


সত্যবাদী জিতেন্দ্রীয় যেই নরপতি।।


‘‘পতি তপোধনো বিপ্রঃ সুসতী যা পতিব্রতা।


সুসত্যো ভূপতিধর্ম্মো মম গেহং ন সংশয়।।’’


—-ভূমিখন্ড—–


এই খানে গুরুচাঁদ সকলেরে বলে।


‘‘কোন তত্ত্ব হ’ল হেথা কেহ কি বুঝিলে?


অলঙ্কার দিয়া শাস্ত্রে বলেছে বচন।


সহজ সরল ভাবে বলিব এখন।।


ধর্ম্মকে রাখিলে ধর্ম্ম রাখে ধার্ম্মিকেরে।


সেই কথা শাস্ত্রাবিদ বলেছে প্রকারে।।


বিপ্র যদি মনে প্রাণে তপঃশীলা হয়।


রাজা যদি সত্যপথে রাজত্ব চালায়।।


নারী যদি পতিব্রতা হয় মনে প্রাণে।


ধর্ম্ম সদা রক্ষা করে এই সব জানে।।

 

 

অধিক সকল অর্থ শুন সবে বলি।


পবিত্র জনেরে কভু নাহি ছোঁয় কলি।।


পতিব্রতা সতী কিবা করে ব্যবহার?


পতি-চিন্তা পতি-ধ্যান পতি সর্ব্বসার।।


আপন বলিয়া ভবে তার কিছু নাই।


সর্ব্বস্ব পতির পদে বিক্রীত সদাই।।


মনে প্রাণে ভরা তার আছে পতিরূপ।


তার চোখে আর নাহি দেখে অন্যরূপ।।


সত্যকথা সত্যভাব সত্য ব্যবহার।


আপনা হইতে জাগে হৃদয়ে তাঁহার।।


এই নিষ্ঠা ধরি রাখে যেই পতিব্রতা।


সত্য, ধর্ম্ম, পুণ্য আসি বাস করে সেথা।।


নিস্কাম সতীর ব্রতে তার দীক্ষা হয়।


কামের তাড়না কভু জাগেনা হৃদয়।।


প্রকৃতির ভাবে যদি কোভু কোন ক্ষণে।


কাম-বাঞ্ছা ওঠে জেগে পতিব্রতা প্রাণে।।


পতি-নিষ্ঠা ব্রতে প্রাণে সত্য ব্যবহার।


সত্যভাব দেয় বাধা কুকর্ম্মে তাহার।।


শাস্ত্রে তাই বলিয়াছে করি অলঙ্কার।


পতিব্রতা সতীনারী সত্যধর্ম্ম-ঘর।।’’


এবে শুন সত্য কিবা বলে ধর্ম্ম ঠাঁই।


কামের দুরাশা দেখে বলে ছেড়ে হাই।।


সত্য বলে ‘‘শোন ধর্ম্ম এইসতী নারী।


এর দেহে দেখ আমি সদা বাস করি।।


সুসতীর দেহে মোর বড়ই আনন্দ।


কামের কুটিল আশা তারে করে মন্দ।।


ইতিপূর্ব্বে বহুবার এই দুষ্ঠ জন।


বহুতর গৃহে মোর করেছে পতন।।


এমনত পবিত্রা সতী অহল্যা কল্যাণী।


কাম সঙ্গে ইন্দ্র ধর্ম্ম নাশিল আপনি।।


মহাতাপ বিশ্বামিত্র আশ্রয় আমার।


কাম এনে মেনকারে দিল ছারেখার।।


কামের সঙ্গেতে যোগে আছে সুরপতি।


সঙ্গিনী রঙ্গিণী রতি দুষ্ঠা সরস্বতী।।


প্রবাসী কৃকল সাধু একেলা সুকলা।


কি জানি কি দুষ্ঠ গণে করে ছলা কলা।।


সসৈন্যে আসিছে কাম যুদ্ধের কারণে।


সদুপায় কর ধর্ম্ম থাকিয়া এখানে।।’’


সত্যের বচন শুনি ধর্ম্ম মহামতি।


বলে ‘‘সত্য মোর বাক্য শুনহে সম্প্রতি।।


প্রবাসী পতির লাগি সুকলা কাতরা।


চিন্তা রোগে দেহমন আছে জরা জরা।।


পতির কুশল যদি শুনিবারে পায়।


দেহমন তেজোময় হইবে নিশ্চয়।।


মোদের বান্ধব এই ‘প্রজ্ঞা’ মহামতি।


সুকলারে শুভবার্ত্তা দিক শীঘ্র গতি।।


ধর্ম্মের আজ্ঞায় তবে প্রজ্ঞা মহামতি।


শকুনের রূপ ধরি চলে শীঘ্র গতি।।’’


গৃহের উপরে বসি সুমঙ্গল কয়।


‘‘শুনহে সুকলা সতি নাহি কোন ভয়।।


তব পতি শীঘ্র গতি আসিছেন ঘরে।


তৃতীয় দিবসে দেখা পাইবে তাঁহারে।।


সুমঙ্গল বাণী শুনি সেই মহাসতী।


করিল ‘‘মঙ্গল-যাগ’’ অতি শীঘ্র গতি।।


হেনকালে ‘ক্রীড়া রূপী’ মদনের দূতী।


সুকলার আগে গিয়ে জানায় প্রণতি।।


সুকলা কহিল তারে ‘‘তুমি কোন জন?’’


ক্রীড়া বলে ‘‘শোন দেবী মোর বিবরণ।।


গুণবান, বলবান, পতি ছিল মোর।


তাঁর লাগি দিবা নিশি বহে অশ্রুলোর।।


অভাগিনী নারী আমি তাহাতে পাপিনী।


সেই দোষে মোরে ছেড়ে গেছে গুণমণি।।


সর্ব্ব ঠাঁই ঘুরি তাই তাঁহার তালাসে?


তোমার ব্যথার কথা শুনি হেথা এসে।।

 

সমান দুঃখিনী দোঁহে দেখিলাম তাই।


দুঃখিনী এসেছে ছুটে দুঃখিনীর ঠাঁই।।’’


এতেক বলিয়া ধনি করিল ক্রন্দন।


তার দুঃখে সুকলার দুঃখী হল মন।।


আহারে পাপের খেলা বলিহারি যাই।


কোন ভাবে ধরে কারে কিছু ঠিক নাই।।


দন্ডে দন্ডে পলে পলে রূপ বদলায়।


যার ভাব তাই ধরে শেষে করে ক্ষয়।।


কখনে দরদী সাজে কখনে বান্ধব।


কভু সাজে দীন দুঃখী কখনে বৈভব।।


বিশ্বাস জাগায়ে প্রাণে গৃহমধ্যে যায়।


সর্ব্বস্ব লুটিয়া শেষে কাঙ্গাল সাজায়।।


এ যেন রাবণ রাজা মহাযোগী বেশে।


ভিক্ষাচ্ছলে জানকীরে হলে লয় শেষে।।


এমন নিপুণা সতী সুকলা জননী।


‘ক্রীড়াকে’ আশ্রয় দিল ভাবিয়া দুঃখিনী।।


এদিকে মদন রাজা সাঙ্গাপাঙ্গো লয়ে।


মায়াজাল ফেলি সেথা রহিল বসিয়ে।।


কুসুম কানন করে অতি মনোলোভা।


কিবা সে নন্দন বন কিবা তার শোভা।।


ততোধিক উপবন সৃজন করিল।


সৌরভে আকাশ বায়ু সকলি ভরিল।।


মায়াবৃক্ষে দুলিতেছে মায়াময় ফুল।


কনক কুসুম বলে চোখে লাগে ভুল।।


ফুল হাসে পাখী গায় মায়া উপবনে।


দেবতার মন হরে ছার নর গণে।।


কাননের শুন এবে শুন দিয়া মন।


মায়া-বণে মায়া-ভরা সকলি স্বপন।।


লোভী জনে উপবনে ভোগ লাগি যায়।


কুসুম ধরিতে গেলে বাতাসে মিশিয়া।।


হস্ত পদ বাঁধা পড়ে মায়ার শৃঙ্খলে।


পিপাসায় প্রাণ যায় ক্রমে তিলে তিলে।।


এই উপবনে তবে মদনের দূতী।


সুকলারে নিয়ে যাবে করে হেন মতি।।


সুকলারে ডাক দিয়া কহে মায়া নারী।


‘‘চল সখি পাপ-হর বলে মোরা ঘুরি।।


এই বনে আছে জান পুণ্যময় স্মৃতি।


এইবনে গেলে সতী ফিরে পায় পতি।।’’


সঙ্গিনীর বাক্যে দেবী সন্দেহ না করে।


তার সাথে চলিলেন বনের ভিতরে।।


বনে বনে দুই সখী করিছে ভ্রমণ।


কোন দৃশ্যে নাহি ভুলে সুকলার মন।।


ধর্ম্ম-আবরণে ঢাকা দেহমন যাঁর।


কেমনে স্পর্শিবে মায়া বরাঙ্গ তাহার।।


সৌরভ আসিল কত বাতাস ভরিয়া।


মকরন্দ রূপে মায়া পড়িল ঝরিয়া।।


কার পানে সেই সতী চাহিয়া না দেখে।


পতিরূপ সর্ব্বদায় মনেমধ্যে রাখে।।


হেনকালে ইন্দ্র ডাকি কহে মদনেরে।


‘‘এসেছে সুকলা তুমি বেঁধ তারে শরে।।’’


মদন কহিছে ‘‘তুমি শোন সুরপতি।


এমন করিতে মোর না হবে শকতি।।


অনঙ্গ হয়েছে আমি ত্রিলোচন-শাপে।


আজো স্মৃতি হলে মনে প্রাণ মোর কাঁপে।।


আধারে করিয়া ভর তাই কাজ করি।


নিজ হতে কোন কাজ করিতে না পারি।।


শোন ইন্দ্র কহি আমি কার্য্য পরিচয়।


কোন ভাবে নরনারী ভুলাই মায়ায়?


মোর যত সৈন্য দেখ আছে মোর সঙ্গে।


সকলে আমার আজ্ঞা মানে মনোরঙ্গে।।


নরদেহে করি ভর নারীকে ভুলাই।


পুনরায় নর ছেড়ে নারী দেহে যাই।।


এই ভাবে খেলা মোর চলে এ জগতে।


এই ভাবে সকলেরে টানি নিজ পথে।।

 

 

তাই বলি এবে তুমি মোরে বাক্য লও।


সুন্দর সুন্দর বেশে নিজেরে সাজাও।।


তোমারে করিয়া ভর আমি করি রণ।


অবলা নারীর আজি নিশ্চয় মরণ।।


মদনের কথা শুনি তবে সুরপতি।


সুন্দর পুরুষ বেশে চলে শীঘ্র গতি।।


সুকলার কাছে গিয়া দিল দরশন।


তার দিকে সুকলার ফিরেনা নয়ন।।


হেন কালে মায়া দূতী স্বরূপ প্রকাশে।


সুকলার প্রতি কথা বলে হেসে হেসে।।


‘‘শোন সখি এই ব্যক্তি অতি গুণবান।


স্বর্গরাজ্যে রাজা ইনি দেবেন প্রধান।।


তোমাকে কামনা ইনি করিছে সদায়।


ইহাকে বরণ করি যাহ সুরালয়।।


হেনকালে ইন্দ্র তবে কহিল বচন।


শোন সতী আমি বলি আমার মনন।।


তোমারে দেখিয়া মন পাগল হইল।


তোমার রূপেতে মোর নয়ন ভুলিল।।


পূর্ব্বে তাই দূহী গেল নিকটে তোমার।


তাই ঠাঁই নাহি পাই আশার সঞ্চার।।


তাই নিজে তব পাশে আমি আসিয়াছি।


কামনা পূরণ হলে তবে প্রাণে বাঁচি।।


আমার কামনা যদি পূর্ণ কর তুমি।


তোমাকে করিব রানী স্বর্গরাজ্যে আমি।।


দেব যক্ষ রক্ষ সবে তোমারে বন্দিবে।


মর-দেহে তুমি নারী অমর হইবে।।


মানব-জীবন দেখ বহু দুঃখে ভরা।


জন্ম, মৃত্যু, আধি, ব্যাধি, পাপ, তাপ, জরা।।


অমরত্ব পেতে দেখ কত মুনি ঋষি।


অনাহারে অনিদ্রায় কষ্ট সহে বসি।।


তবু সকলের ভাগ্যে অমরত্ব নয়।


অমরত্ব পেতে কত জন্ম কেটে যায়।।


এহেন অমূল্য ধন দিব যে তোমারে।


আমারে বরণ কর আনন্দে অন্তরে।।


সবারে ডাকিয়া প্রভু বলে এইখানে।


বল দেখি দুষ্ঠা নারী কি করে তখনে?


পতি, পুত্র, ঘর বাড়ী সব ছেড়ে যায়।


কুল মান বিসর্জ্জন করে ইন্দ্র-পায়।।


ইন্দ্র ত দূরের কথা কি দেখি জগতে?


শত শত দুষ্টা নারী চলে কোন পথে?


স্বর্গরাজা অমরত্ব কিছুই লাগেনা।


কামবৃত্তি চরিতার্থে পুরায় বাসনা।।


সর্ব্ব দেশে দেখি আমি সবার ভিতরে।


সামান্য কারণে নারী পাপে মজে মরে।।


ধনবান রূপবান যত ব্যাভিচারী।


শয্যা পার্শ্বে রেখে থাকে কত শত নারী।।


সধবা বিধবা কিংবা অনূঢ়া কুমারী।


একদরে দেয় দাস মিশ্রী আর মুড়ি।।


ইহার মূলেতে দেখ রয়েছে কারণ।


কামনার কাল-বিষে ঘনায় মরণ।।


গৃহস্থ ঘরের বধু বল কোন দোষে?


পতি ছাড়ে ঘর ছাড়ে কোন মোহ বশে?


কামনার ধর্ম্ম এই নাহি মিটে আশা।


দিনে দিনে জীবদেহে বাড়ায় পিপাসা।।


জ্বলন্ত আগুনে যথা রাখিয়া কটাহ।


নারী গণে ভাজে ধান রাখি অহরহ।।


এই স্থানে সেই ধান থাকিতে না পারে।


এখানে সেখানে ছুটে পড়ে চারিধারে।।


আগুণের মধ্যে তার নাহি মিলে শান্তি।


হেথা সেথা ঘোরে নিয়ে আপনার ভ্রান্তি।।


সেই রূপ নর নারী দেখি সমূদয়।


জীবন-কটাহে তারা ঘুরিয়া বেড়ায়।।


কামনা-আগুন তলে জ্বলে ঘোরতর।


তার তাপে নর নারী ঘুরে নিরন্তর।।

 

 

হায়! হায়! যেথা যায় সেইখানে তাপ।
জীবের জীবন-পটে ঘোর অভিশাপ।।
কামনার অগ্নি জ্বলে নিজে তাপ সহে।
যাহা পায় তাহা কয় ‘‘নহে ইহা নহে।।’’
কামনার তাপে জীব কভু নহে স্থির।
তীর ছেড়ে নীরে পড়ে নীর ফেলে তীর।।
জীবনের অভিশাপ-কামনার খেলা।
বিক্ষুব্ধ সাগর-বুকে দাঁড়ি-হীন ভেলা।।
কামনার রজ্জু দিয়ে যদি নারী নর।
এক সূত্রে বাঁধা দোঁহে পড়ে পরস্পর।।
কামের তাড়নে যদি দিলে এক সাথে।
সে-বন্ধন হবে ছিন্ন জীবনের পথে।।
প্রকাশ্যে নিরালে কত ঘটে ব্যাভিচার।
অতৃপ্ত কামনা রাজ্যে এই ব্যবহার।।
কিন্তু যদি পতি-পত্নী পবিত্র বাঁধনে।
সত্য-রজ্জু দিয়ে বাঁধা পড়ে মনে প্রাণে।।
ধর্ম্ম রাজ্যে চলে দোহে নিষ্ঠা সহকারে।
ব্রহ্মান্ড সৃজিতে শক্তি ধরিবারে পারে।।
ইন্দ্রত্ব, ব্রহ্মত্ব তাঁরা অতি তুচ্ছ গণে।
করজোড়ে সে বিধাতা নমে সে-চরণে।।
তাহার প্রমাণ দেখ রাজার নন্দিনী।
সাবিত্রী নামেতে যিনি শাস্ত্রের কাহিনী।।
পবিত্রতা গুণে দেখ সেই মহাসতী।
বিধির লিখন মুছে আনে নিজ পতি।।
পতি ভিন্ন অন্য সবে সতী তুচ্ছ করে।
নারায়নে শাপ দেয় যদি ধর্ম্ম হরে।।
তাহার প্রমাণ দেখ তুলসী সুন্দরী।
ছলে যাঁর ধর্ম্ম নাশ করিলেন হরি।।
নারায়নে দিল শাপ সেই অপরাধে।
বহিল সতীর শাপ নিজে কালাচাঁদে।।
সতী পক্ষে পতি ভিন্ন নাহি অন্য জন।
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব কিংবা নিজে নারায়ণ।।
পতিই সতীর পক্ষে স্বয়ং ঈশ্বর।
পতি সেবা ভিন্ন অন্য ধর্ম্ম নহি তার।।
সতীগুণে পতি ধন্য বলে লোকাচারে।
মিথ্যা নহে-সত্য ইহা বলি বারে বারে।।
স্ত্রীভাগ্যে ধনের আশা করে সব লোকে।
সেই জন্যে লোকাচারে কথা বলে থাকে।।
‘সতীর সোয়ামী যেন পর্ব্বতের চূড়া।
অসতীর পতি যেন ভাঙ্গা নায়ের গুড়া।।
তাই বলি মা-সকল হও পতিব্রতা।
এবে শোন সে সুকলা বলে কোন কথা।।
ইন্দ্র যদি লোভ দিল অমরত্ব-ধনে।
বিষ-সম বাজে কথা সুকলার কাণে।।
ক্রুদ্ধা অতি সহাসতী ডাক দিয়া কয়।
‘‘আ রে রে দুরাত্মা তুই ঘোর পাপাশয়।।
একা নারী ভাবি মোর কর দুষ্ট বুদ্ধি।
কালের আহবানে তোর হল এত বৃদ্ধি।।
শোন দুষ্ট একা আমি নাহি কদাচন।
নিজে ধর্ম্ম করে মোরে সতত রক্ষণ।।
পতি-চিন্তা পতি-ধ্যান প্রহরী আমর।
সতীত্ব ধনুকে জ্ঞানরূপে তীক্ষ্ণ শর।।
সত্যের বর্ম্মেতে ঢাকা আমার শরীর।
ইহাদিগে ধ্বংস করে নাহি হেন বীর।।
‘সতী-কোপ’ নামে অগ্নি আছে দুই চোখে।
এ-বিশ্ব নাশিতে পারে চক্ষের পলকে।।
ইন্দ্র পরিচয় দিলি ওরে মূঢ় ভ্রান্ত।
দেবরাজ ইন্দ্র দেখি অতি গুণবন্ত।।
তাঁর মুখে এই কথা শোভা নাহি পায়।
ছলাকারী মহাদুষ্ট তুই রে নিশ্চয়।।
অথবা সত্যই যদি ইন্দ্র তুই হস?

কি সাহসে হেন কথা নিজ মুখে  কস?

তোর রীতি নীতি আমি সব জানি ভাল।


তোর দোষে সে অহল্যা পাষাণী সাজিল।।

ধর্ম্ম-হারা সতী তাই শাপ নাহি দিল।


গৌতমের অভিশাপে কিছু দুঃখ হল।।


বুড়া ঋষি নড়া-বুদ্ধি তাই পেলি রক্ষে।


তোর বাবা তোর প্রাণ চেয়ে নিল ভিক্ষা।।


রক্ষা তোর সেই দিনে আমি জন্মি নাই।


আজো সবে ইন্দ্র-মূর্ত্তি চোখে দেখে তাই।।


কিন্তু স্বভাবের দোষ কিসে বল যায়?


নিজে কাল টেনে তোর এনেছে হেথায়।।


ইন্দ্র চন্দ্র ব্রহ্মা কিষ্ণু যেই তুমি হও।


বাঁচিয়া থাকিতে যোগ্য তুমি আর নও।।


কালাগ্নি সতীর কোপে আর রক্ষা নাই।


দুষ্ট ব্যভিচারি তোরে দন্ড দিতে চাই।।


যদি কেহ থাকে তোর শেষের আশ্রয়।


প্রাণ ভরে তোরে ডেকে নে রে এ সময়।।


এত বলি মহা সতী ডাকে আয় আয়।


আয়রে সতীত্ব তেজ অগ্নি হয়ে আয়।।


বলিতে বলিতে অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল।


স্বর্গ মর্ত্ত্য ত্রিভুবন পলকে ঘিরিল।।


হতজ্ঞান ইন্দ্র দেখে আকাশে চাহিয়া।


উঠিছে অগ্নির শিখা অসীম ব্যাপিয়া।।


তার মধ্যে দেখে নাচে নিজে মহাকালী।


অসুর নাশিনী বেশে গলে নর-খুলী।।


লক লক নড়ে জিহবা রক্ত ধারা ঝরে।


দক্ষিণে খর্পর তাঁর খান্ডা বাম করে।।


মহাভীত সুরপতি জ্ঞান নাহি আর।


কোথা রতি? কোথা কাম? সব অন্ধকার।।


নিশ্চয় মরণ বুঝি দেব সুরপতি।


পড়িল সতীর পদে করিয়া প্রণতি।।


মা মা বলি ডাকে ইন্দ্র পড়িয়া ধরায়।


নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।।


জানু পাতি করজোড় সে ইন্দ্র তখন।


স্তুব করে সতী-পদ করি নিরীক্ষণ।।

 

স্তব

‘‘জয়তু! জয়তু! তৃপ্যতু! তৃপ্যতু!


সতীরূপা কাল-ধাত্রি!


সম্বর! সম্বর! তেজঃ ভয়ঙ্কর


আমি যে মরণ-যাত্রী।।


ভীমা ভয়ঙ্করা ভব-ভয়-হরা,


ভীষণা ভাবিনী বেশে।


পলকে প্রলয় য়টিবে নিশ্চয়


কালের কেতন কেশে।।


অবোধ অজ্ঞান তাই অপমান


দিতে চাই জননীরে।


ভাঙ্গিয়াছে ভুল ভাবিয়া আকুল


পাপ কেন নিছি শিরে।।


যে কর্ম্ম করেছি মরি কিংবা বাঁচি


কোন দুঃখ তাতে নাই।


একের কারণে মরে সর্ব্বজনে


মিনতি চরণে তাই।।


কাল-অগ্নি ঢেকে এ অপরাধীকে


শুধুই কথায় বাণে।


তারে শুধু লও জগত বাঁচাও


অপরে মারিবে কেনে?


সতীর মহিমা দিতে নারে সীমা


আপনি জগত-স্বামী।


সাজিয়া অজ্ঞান কামে হতজ্ঞান


গরণ খেয়েছি আমি।।


শুন গো জননি ব্রহ্মান্ড ধারিণি।


পাতকী সন্তানে ক্ষম।


ক্রোধ-অগ্নি জ্বেলে আঁখি খুলে দিলে


রাতুল চরণে নমঃ।।

 

 

জননী আমার আপনি সংহার


চরণে পড়িয়া রয়।


নারী-রূপধারী তুমি সতী নারী


আজিকে বুঝিছে হায়।।


সতীর দোহেতে সতীত্ব রূপেতে


তেজময়ী তুমি মাতা।


ক্ষম অপরাধ দেহ নিত্য পদ


চরণে রাখিনু মাথা।।


করুণা রূপিণী কৃকল-গৃহিণী


সেজেছ নারীর সাজে।


চরণে শরণ করেছে গ্রহণ


ক্ষমা কর দেবরাজে।।’’


এ ভাবে করিল স্তব দেব সুরপতি।


শূণ্য হতে বলে তবে দেবী ভগবতী।।


অতি ধন্যা প্রিয়া কন্যা কৃকল গৃহিণী।


ক্ষমা কর দেবরাজে ওগো সীমন্তিনী।


আর না করিবে ইন্দ্র এ হেন আচার।


তোমাকে পরীক্ষা করে মনে ভাব তাঁর।


অবোধ অজ্ঞান ইন্দ্র বৃদ্ধি নাহি ধরে।।


পবিত্র গঙ্গার জল কিসে শুদ্ধ করে।।


বহু শিক্ষা দেবরাজ পেল তব ঠাঁই।


শরণাগতরে মেরে কোন ফল নাই।।’’


দৈববাণী শুনি কোণে কৃকল-গৃহিনী।


চাহিয়া ইন্দ্রের পানে কহিলা তখনি।।


‘‘মাতার আজ্ঞায় ইন্দ্র! করিলাম ক্ষমা।


কিন্তু এক সর্ত বটে দিব আমি তোমা।।


যে যেখানে যেই নারী সতীধর্ম্মে আছে।


ত্রাণকর্ত্তা রূপে রবে তাহাদের কাছে।।


কোন দুষ্টু যদি চাহে ধর্ম্ম নাশিবারে।


অবশ্য হানিবে ব্রজ সে দুষ্টের শিরে।।’’


করজোড়ে বলে ইন্দ্র ‘‘ওগো কৃপাময়ি।


তোমার পবিত্র সর্তে আমি বাধ্য হই।।


আমি রব দেব তোমা আনন্দ অন্তরে।


অবিলম্বে তব পতি আসিবেন ঘরে।।


তোমার কীর্ত্তির কথা শুনিবে যে নারী।


পতিসহ হবে সেই স্বর্গ অধিকারী।।’’


এতেক বলিয়া ইন্দ্র বিদায় হইল।


স্বর্গে যেতে পথে পথে অন্তরে ভাবিল।।


‘‘এই যে কৃকল সাধু পুণ্যধর্ম্ম-আশে।


সতী ফেলে একা চলে দুর তীর্থবাসে।।


পুণ্যময় ধর্ম্মতত্ত্ব তার জানা নাই।


পবিত্র ধর্ম্মের তত্ত্ব তাহারে শিখাই।।


সুকলার সম সতী যার ঘরে রয়।


শত শত তীর্থফল ঘরে বসে পায়।।


অবোধ কৃকল তাহা বুঝিতে না পারে।


সতী ফেলে মিছামিছি তীর্থে তীর্থে ঘুরে।।


তাহারে শিখাব আজ পূণ্যধর্ম্ম কথা।


যেভাবে শিখাল মোরে তাঁর পতিব্রতা।।


এত ভাবি ইন্দ্র তবে চলিল দক্ষিণে।


যে দিকে কৃকল সাধু ফিরে গৃহ পানে।।


গৃহের নিকটে আসি নামি পঙ্গাজলে।


করিল তর্পণ সাধু অতি কুতুহলে।।


তর্পণ করিয়া বৈশ্য জুড়ি কর পানি।


‘তৃপ্ত হও তৃপ্ত হও’ করে এইধ্বনি।।


পিতৃ পুরুষের প্রতি করিল তর্পণ।


বলে ‘‘তীর্থ-যাত্রা ফল করিনু অপূর্ণ।।’’


হেনকালে দেখ তথা কিবা কান্ড হল।


প্রত্যক্ষে কৃকল সাধু দেখিতে লাগিল।।


জ্যোতির্ম্ময় রূপধারী কোন মহাজন।


কৃকলের পিতৃগণে করিছে পীড়ন।


পিতৃপুরুষেরা কান্দি কহিছে বচণ।


‘‘কোনপাপে আমাদিগে’’ করিছে শাসন।।’’


জ্যোতির্ম্ময় মহাজন ক্রোধভরে কয়।


‘‘চৌর্য্য অপরাধে দোষী তোমরা নিশ্চয়।।

 

 

এই যে কৃকল বৈশ্য তোমাদের সূত।


নিজ হস্তে শ্রাদ্ধ পিন্ড করেছে প্রস্তুত।।


শাস্ত্রে বলে ধর্ম্মপত্নী সঙ্গে করি লবে।


সতী নারী শ্রাদ্ধ পিন্ড প্রস্তুত করিবে।।


এই দুষ্ট সেই ধর্ম্ম করিয়াছে ভঙ্গ।


ধর্ম্ম পত্নী ঘরে ফেলে এসেছে নিঃসঙ্গ।।


যেই মূঢ় ধর্ম্মযুতা সতী নারী ফেলে।


ফললোভে তীর্থে যায় নিজ বাহুবলে।।


তার কৃতযত ধর্ম্ম সব বৃথা যায়।


তার দত্ত পিন্ড নিলে চুরি করা হয়।।


আর শুন সতীগুণে কত ফল হয়।


সতী যেথা সর্ব্বতীর্থ তথা আসি রয়।।


যার গৃহে সত্যবতী সতী নারী রয়।


দেব, ঋষি, বেদ শ্রুতি অধিষ্ঠান হয়।।


পুণ্যা নদী, পুণ্যতীর্থ যে আছে যেখানে।


সতী নারী যেথা রয় রহে সেইখানে।।


এ কারণে গৃহাশ্রমে সর্ব্বোত্তম কয়।


গার্হস্থ্য ধর্ম্মের তুল্য অন্য কিছু নয়।।


‘‘গার্হস্থ্যৎ পরমোধর্ম্মো দ্বিতীয়োনাস্তি ভূতলে।।’’


—পদ্মপুরাণম—


আর বলি শুন বৈশ্য ধর্ম্মনীতি যত।


ত্রিভূবনে ধর্ম্ম নাই গৃহধর্ম্ম মত।।


‘যত্র ভার্য্যা তত্র গৃহ সাধু জনে কয়।


ভার্য্যা ছাড়া গৃহ ধর্ম্ম কিসে বল হয়?


পুণ্যবতী সতী নারী পুণ্যতীর্থ ময়।


সতীর গুণেতে গৃহ স্বর্গ তুল্য হয়।।


তোমার পবিত্রা সতী সুকলা নামিনী।


তোমার বিরহে গৃহে কাদে একাকিনী।।


তাঁহারে ফেলিয়া তুমি যে ধর্ম্ম করিলে।


সেই সব ধর্ম্মফল গিয়াছে বিফলে।।


যদি নিজ শুভ চাও নিজ গৃহে যাও।


পত্নীর সন্তুষ্ট করি শ্রাদ্ধপিন্ড দাও।।


পিতৃপুরুষেরা তবে পাইবে নিস্তর।


অন্যথায় দন্ড আমি দিব ঘোরতর।।


এমত শুনিয়া বাণী কৃকল তখন।


মহাদুঃখে গৃহপানে করিল গমন।।


কৃকলে আসিতে দেখি সুকলা কল্যাণী।


উচ্চরবে করিলেন সুমঙ্গল ধ্বনি।।


পাদ্য অর্ঘ্য শীঘ্রগতি করে আনয়ন।


স্বহস্তে পতির পদ করে প্রক্ষালন।।


অঞ্চলে মুছায় পদ যতন করিয়া।


দন্ডবৎ করে পদে গলে বস্ত্র দিয়া।।


কুশল জিজ্ঞাসা করে সুমধুর ভাষে।


সুখাদ্য আনিল দেবী চক্ষের নিমেষে।।


মনে মনে কৃকলের জাগে অনুতাপ।


বলে ‘‘দেবী! আজ মোরে কর তুমি মাপ।।


বড়ই কুকর্ম্ম আমি করেছি জীবনে।


কোন ফল হয় নাই তীর্থাদি ভ্রমণে।।


তব সম সতী সদা গৃহে আছে যার।


সর্ব্বতীর্থ করে বাস গৃহেতে তাহার।।


মূঢ় আমি সেই তত্ত্ব পূর্ব্বে বুঝি নাই।


অনর্থক তীর্থবাসে কত কষ্ট পাই।।


মমতা রূপিনী তুমি কত গুণময়ী।


তোমার স্নেহের আমি সদা বাধ্য রই।।


তোমার গুণের কতা কি বলিব আর।


দোষ পেয়ে কোন দোষ লহনা আমার।।


নিষ্ঠুর সাজিয়া আমি ফেলে একাকিনী।


গোপনে করিনু ত্যাগ সতী শিরোমণী।।


এত বড় অপরাধ কিছু নাহি মনে।


ফিরে পেয়ে পূজ মোরে পরম যতনে।।


হায়, হায় মন্দমতি আমি অভাজন।


দেখি নাই নিজ ঘরে পরম রতন।।’’


এতেক বলিয়া বৈশ্য অনুতাপ করে।


শশব্যস্ত সে সুকলা কহে পদ ধরে।।

‘‘প্রাণনাথ হেন বাক্য আর না কহিও।


পদানতা সুকলার পরাণে রহিও।।


তোমার মঙ্গল ইচ্ছা রক্ষিয়াছে মোরে।


আমি বেঁচে আছি শুধু তব কৃপা জোরে।।


কত অপরাধ নাথ এই অভাগিনী।


পারে নাই পূজিবারে চরণ দুখানি।।


নারীর জীবনে যাহা পরম সম্বল।


কর্ম্ম দোষে হারা হয়ে ছিনু এতকাল।।


কত যে করুণা তব তুল্য দিতে নাই।


দয়া করে অভাগীরে দেখা দিলে তাই।।


এই কথা বলে দেবী কান্দিয়া কান্দিয়া।


দুই হস্তে পতিপদ বক্ষেতে বান্ধিয়া।।


কৃকল কান্দিছে আর কান্দিছে সুকলা।


শূণ্যে জয়ধ্বনি করে যত দেববালা।।


দেব ঋষি মুনিগণে করিছে স্তবন।


ধন্য সতি ধন্য পতি ধন্য দুই জন।।


অপঃপর সে কৃকল পত্নীর সহিতে।


পিতৃগণে পিন্ডদান করে বিধিমতে।।


তবে পিতৃগণ তার দিব্যদহে ধরি।


স্বর্গ পথে গেল চলি আশীর্ব্বাদ করি।।


কিছুকাল পরে দেখ পতী পত্নী দোঁহে।


তাজিয়া মরত ধাম উর্দ্ধে যেতে চাহে।।


ইচ্ছা মাত্রে বিষ্ণু লোক হতে অকষ্মাৎ।


আসিল ধবল মূর্ত্তি জ্যোতির্ম্ময় রথ।।


সেই রথে এক সাথে পতি পত্নী গেল।


দোঁহা আগমনে স্বর্গে দুন্দুভি বাজিল।।


বিষ্ণুলোকে যেই মাত্রে করিল প্রবেশ।


নর দেহ ছাড়ি নিল ‘‘বিষ্ণুলহ্মী’’ বেশ।।


সতীর গুণেতে তাই নমস্কার করি।


সতীলহ্মী প্রীতে সবে বল হরি হরি।।

 

 

No comments: