Wednesday, September 23, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 90 প্রভুর আগমনে লহ্মীমাতার আবির্ভাব

প্রভুর আগমন জন্য কাঞ্চন জননী।


‘মাঠে ভরি’ যত্নে চাল রাখিলেন তিনি।।


আট মণ রাখে চাল যতন করিয়া।


মুখেতে ঢাকনি ঢাকা এক পাত্র দিয়া।।


ভক্ত সঙ্গে মহাপ্রভু করে আগমন।


পাত্রির ঢাকনি মাতা খুলিল তখন।।


রন্ধন কারণে চাল দিতেছে মাপিয়া।


ভক্তগণে মহানন্দে নিতেছে বহিয়া।।


মাপ শেষে দেখা গেল চাল দশমণ।


সবে কয় নাহি বুঝি ইহার কারণ।।


মাপা-চাল কোন ভাবে এত বৃদ্ধি পায়?


গণনাতে ভুল বুঝি হয়েছে নিশ্চয়।।


দারুণ সংশয় চিত্তে সবে বাক্য-হত।


কোন যুক্তি কার নাহি হয় মনোমত।।


সংশয় নাশিতে কেহ করিল প্রস্তাব।


“নিশ্চয় বুঝিতে হবে এই কোন ভাব।।


সব চাল আন হেথা মেপে দেখি ফিরে।


রাখ-চাল বেশী আজ হ’ল কি প্রকারে?


সবে তাতে দিল সায় চাল আনা হল।


আপন হস্তেতে চাল ভক্তে মেপে দিল।।


সেই চাল সেই মাঠ সেই সমুদয়।


ঠিক ঠিক দশমণ মাপে দেখা যায়।।


সেই চাল পুনরায় মাঠেতে রাখিল।


মাঠ ভরি দুই মন চাল বৃদ্ধি হল।।


ঘটনা দেখিয়া সবে কথা নাহি কয়।


অবিরল নেত্র জল পড়িছে ধরায়।।


প্রেমে গদ গদ তনু সবে ডাকি কয়।


“লহ্মী আভির্ভূতা হেথা বুঝিনু নিশ্চয়।।”


কাঞ্চন জননী সব দেখিয়া নয়নে।


আত্ম-হারা হয়ে পড়ে প্রভুর চরণে।।


প্রভু কয় “ওগো মাতা থাক চুপ করি।


সকল কর্ম্মের কর্ত্তা একমাত্র হরি।।


হরি যেথা আসে লহ্মী আসে তার সাথে।


সর্ব্বঘট হয় পূর্ণ লহ্মীর দয়াতে।।


কান্নাকাটি ছেড়ে মাতা পাকশালে যাও।


অন্নপূর্ণা সেজে অন্ন আমারে খাওয়াও।।


প্রভুর আজ্ঞাতে দেবী ত্রস্তগতি ধায়।


অবিলম্বে উপনীত সে পাক শালায়।।


ভক্তের কারণে পাক বাহিরেতে হয়।


প্রভুর কারণে পাক রন্ধন শালায়।।


এস্তে ব্যস্ত মাতা গেল রন্ধন শালায়।


সুগন্ধে পূরিত গৃহ বুঝিবারে পায়।।


আশ্চর্য্য মানিয়া মাতা যায় অগ্রসরি।


দেখে পাকশালা মধ্যে আছে এক নারী।।


জননীর বাঞ্ছা মনে স্বহস্তে রাঁধিয়া।


করিবে প্রভুর সেবা মন প্রাণ দিয়া।।


অচেনা রমণী তাহে বিনা আদেশেতে।


কোন কার্য্যে পাক করে কার আজ্ঞামতে?


অন্তরে ক্রোধিতা মাতা নারী পানে চায়।


ইচ্ছা করে রূঢ় কথা বলিবে তাঁহায়।।


হেন কালে সেই নারী চাহে মাতা পানে।


ফুটিল মধুর হাসি তাঁহার আননে।।


ক্ষণিক চাহিয়া নারী করুণ নয়নে।


পার্শ্ব-দ্বারা দিয়া দ্রুত পড়িল উঠানে।।


মাতা কয় “ওগো বাছা কোথা ছুটে যাও।


ঘরে কেন এলে তুমি তাই মোরে কও।।


বলিতে বলিতে মাতা আসিল বাহিরে।


চারিদিকে চাহে কিন্তু দেখেনা কাহারে।।


ডাকাডাকি করে মাতা ভক্ত নারী গণে।


বলে “তোরা বল দেখি কে এল এখানে?


শূণ্য ছিল রান্না ঘর কেহ ঘরে নাই।


অচেনা রমনী সেথা আমি দেখা পাই।।

আমারে দেখিয়া নারী গেল পালাইয়া।


এই পথে সবে তো দেখ না খুঁজিয়া।।”


হেনকালে ডেকে বলে এক ভক্ত নারী।


“কি যে কথা বল মাগো বুঝিতে না পারী।।


তুমি বলো তুমি নাহি ছিলে রান্না ঘরে।


এই মাত্র তবে আমি দেখিনু কাহারে?


এই মাত্র তুমি নিজে পাকশালে ছিলে।


আমাকে ডাকিয়া তুমি কাছে টেনে নিলে।।


নিজহস্তে পাক কর অন্নাদি ব্যঞ্জন।


সে সব কেমনে মাতা হলে বিস্মরণ?


অন্নাদি ব্যঞ্জন সব রন্ধন করিয়া।


আপনার হাতে তাহা রেখেছ ঢাকিয়া।।


এবে কিবা বল মাগো কিছু নাহি বুঝি।


মন-ভোলা দশা মাগো হল কে আজি?”


কথা শুনি মা-জননী দ্রুত গতি ধায়।


নারীগণে বলে “তোরা মোর সাথে আয়”।।


তরাসে চলিল পুনঃ রন্ধন শালায়।


দেখে অন্ন ব্যঞ্জনাদি সারি সারি রয়।।


সারি সারি আছে সব পাত্র দিয়ে ঢাকা।


নিখুঁত প্রকারে আছে সব দ্রব্য রাখা।।


সৌরভে গৃহের বায়ু আছে ভরপুর।


সঙ্গে যারা সবে বলে “মধুর’ মধুর।।


স্বচক্ষেতে সব দ্রব্য দেখিল জননী।


পরে কেন্দে বলে হায় আগে নাহি জানি।।


দয়া করে দয়াময়ী এসেছিল ঘরে।


স্বচক্ষে দেখিু তবু নাহি চিনি তাঁরে।।


গুরুচাঁদ বাবা মোর স্বয়ং নারায়ন।


তাঁর সেবা লাগি মাতা করে আগমন।।


ভকতি বিহীনা আমি নয়নে না দেখি।


অবোধ দেখিয়া মাতা মোরে দিল ফাঁকি।।


আপনার হাতে মাতা করিল রন্ধন।


দয়াময় গুরুচাঁদ করিবে ভোজন।।


বামনের আশা যথা চাঁদে ধরিবারে।


পঙ্গুর যেমতি আশা লঙ্ঘিতে গিরিরে।।


সেই মত আশা আমি করেছিনু হায়।


মোর রান্না খাবে আজি প্রভু দয়াময়।।


যাঁর সেবা করে লহ্মী নামিয়া ধরায়।


সামান্য মানবী আমি করি সে আশায়।।


আহারে কতই ভুল এসেছে হৃদয়।


মানুষ ভেবেছি যাঁরে লহ্মী সদা চায়।।”


এভাবে বিলাপ করে কাঞ্চন জননী।


সঙ্গে সঙ্গে কান্দে তাঁর যতেক সঙ্গিনী।।


এ হেন সময়ে সেথা আসিল গোপাল।


দেখিল কাঞ্চন দেবী ভাবেতে বিহবল।।


পতিরে দেখিয়া সতী পড়ে তার পায়।


ক্রমে ক্রমে সব কথা তাঁহারে জানায়।।


শুনিয়া গোপাল বলে ধন্য এ জীবন।


ধন্য সতী ভাগ্যবতী তুমি একজন।।


সতী নারী ঘরে যায় ধন্য সে সংসারে।


সতীরে তুষিতে দেখ দেবে বাঞ্চা করে।।


নিজ চোখে দেখিয়াছ জগত জননী।


তব স্বামী পরিচয়ে আমি ধন্য মানি।।


পতির মুখেতে শুনি এ হেন বচন।


কাঞ্চন জননী বলে কান্দিয়া তখন।।


“প্রাণনাথ এ প্রশংসা নহে যোগ্য মোর।


দয়া করে বান্ধ পদে দিয়ে কৃপা ডোর।।


আমি দাসী দিবানিশি বিক্রীত ও পদে।


আমারে প্রশংসা করে ফেলনা বিপদে।।


আমি নাথ যাহা জানি করি নিবেদন।


প্রশংসার ভাগী ভবে হয় কোন জন?


গৃহস্থের ঘরে দেখ থাকে দাস দাসী।


প্রভুর আজ্ঞায় কাজ করে দিবা নিশি।।


আজ্ঞাবাহী ভৃত্য তারা আজ্ঞা নিয়ে ফেরে।


প্রভু যাহা ইচ্ছা করে সেই কর্ম্ম করে।।

কর্ম্মফল যাহা কিছু প্রভু সব পায়।


ভূত্যের কর্ত্তত্ব কর্ম্মফলে কবে হয়?


আমি দাসী তব ঘরে প্রভু তুমি মোর।


তোমার কৃপার বলে মোর সব জোর।।


তব আজ্ঞা শিরে নিয়ে আমি কাজ করি।


তাতেও কতই ভুল-ভেবে দুঃখে মরি।।


পরম দয়াল তুমি তাই কর ক্ষমা।


দয়া করে কোন দোষ নাহি রাখ জমা।।


দেহ মন আত্মা প্রভু সকলি তোমার।


ফলাফল কোন কিছু নাহিত আমার।।


আমার সম্বল শুধু ও রাঙ্গা চরণ।


সম্বলে বঞ্চিত প্রভু করোনা কখন।।


তোমার সাধন বলে এসেছে ঠাকুর।


তারিল জগতে যত অনাথ আতুর।।


কাঙ্গালিনী তার মধ্যে আমি একজন।


তোমার দয়ায় ধন্য হল এ জীবন।।


তোমার সাধন-বৃক্ষে ফলিয়াছে ফল।


মোরা সবে তাই পেয়ে জনম সফল।।


আমার প্রশংসা প্রভু করিওনা আর।


যা কিছু হয়েছে হবে সকলি তোমার।।


কর্ত্তা তুমি ফলে তব পূর্ণ অধিকার।


তোমার কৃপায় ধন্য জীবন আমার।।


এই নিবেদন করি রাতুল চরণে।


অন্য কিছু নাহি চাহি তব পদ বিনে।।”


এত বলি কান্দি সতী ধরণী লোটায়।


আঁখি জলে ভেসে তবে শ্রীগোপাল কয়।।


“সতী নারী মানবের পরম সম্পদ।


সতীর গুণেতে পতি পায় মুক্তিপদ।।


সতীশূল্য গৃহ দেখ স্মশানের প্রায়।


সতীর গুণেতে লহ্মী গৃহে বান্ধা রয়।।


যেই ঘরে নাহি সতী তাহাত অরণ্য।


সেই জন্যে বলিয়াছি সতী তুমি ধন্য।।


এইভাবে ভাবালাপ করিতেছে দোঁহে।


হেনকালে এক ভক্ত সেথা আসি কহে।।


“মহাপ্রভু গুরুচাঁদ করেছে স্মরণ।


শুনিয়া গোপাল করে ত্বরিতে গমন।।


কাঞ্চন জননী তাহে পিছে পিছে ধায়।


গুরুচাঁদ সম্মুখেতে হইল উদয়।।


উভয়ের চক্ষে বহে দ্রুত বারিধারা।


গুরুচাঁদ দরশনে প্রেমে মাতোয়ারা।।


অন্তর্য্যামী প্রভু সব বুঝিলেন মনে।


গোপালে চাহিয়া প্রভু বলিছে তখনে।।


“শুনহে গোপাল আমি বলি তব ঠাঁই।


সতী রমনীর গুণের সীমা কভু নাই।।


ধর্ম্মর আবাস-গৃহ সতীর হৃদয়।


যেথা সতী সেথা ধর্ম্ম জানিও নিশ্চয়।।


সাবিত্রী পরমা সতী শুনিয়াছ কথা।


মৃতপতি বাঁচাইল অপূর্ব্ব বারতা।।


মহাভারতের মধ্যে এসব কাহিনী।


অন্য এক সতী নারী আছে আমি জানি।।


পুরানে বর্ণিত তাহা অতীব মধুর।


শোন সবে সেই কথা বলিব প্রচুর।।”


এত বলি গুরুচাঁদ কহিল প্রবন্ধ।


শ্রীগুরু-চরণ ভাবি ভণে মহানন্দ।।

No comments: