Monday, September 21, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 87 ভক্তালয় ভ্রমণ(প্রথম পর্ব)

বিধবার বিয়া দিল স্বামী দেবীচন্দ্র।
আনন্দিত তাহে অতি প্রভু গুরুচন্দ্র।।
অতঃপর দেবীচাঁদ ভাবিলেন মনে।
বানিয়ারী নিবে তেঁহ প্রভু গুরুচানে।।
আপন মনের কথা প্রভুরে জানায়।
তাহাতে সম্মতি দিল প্রভু দয়াময়।।
প্রভু বলে “শোন দেবী আমার বচন।
মম সঙ্গে প্রাদ্রী মীড করিবে গমন।।
যথাযোগ্য আয়োজন অবশ্য করিবে।
তোমার গৃহের ‘পরে মহাসভা হবে।।”
শুনি দেবীচাঁদ হ’ল বড় আনন্দিত।
পদে দন্ডেবৎ করে প্রেমে পুলকিত।।
দিন স্থির করি পরে নিজবাসে গেল।
ষ্টিমারে আসিবে প্রভু কথা ঠিক হল।।
নামিবেন নাগকাঠি বন্দরের পারে।
তথা হতে বানিয়ারী যাবে নৌকা করে।।
দেশে আসি দেবীচাঁদ সকলে জানায়।
আসিবেন দয়াময় আমার আলয়।।
ভক্তগণে সব্বনে সমাচার দিল।
দুইদিন পূর্ব্বে যত ভক্ত সেথা এল।।
এদিকে দয়াল প্রভু সাঙ্গপাঙ্গ সঙ্গে।
যাত্রা করে বানিয়ারী নিজে মনোরঙ্গে।।
পাদ্রী মীড সঙ্গী তাঁর আপনি হইল।
শ্রীবিধু চৌধুরী আদি কত সঙ্গে গেল।।
দূর্গাপুর হতে আসে কবি হরিবর।
ষ্টিমারে উঠিলেন তারাইল পর।।
এদিকে শ্রীদেবী করে বহু আয়োজন।
নাগকাঠী উপস্থিত লয়ে ভক্তগন।।
ডঙ্কা, শিঙ্গা কংস কাসী খোল করতাল।
লোহিত পতাকা হাতে বলে “হরিবল।।”
বিরাট সঙ্ঘট হল লোক সংঘটন।
নাগকাঠী উপস্থি শ্রীদেবীচরণ।।
আশ্চর্য্য মানিয়া লোকে বলাবলি করে।
এত আয়োজন সাধু করে কার তরে?
কেহ কেহ জিজ্ঞাসিল দেবীচাঁদ ঠাঁই।
কারে নিতে আয়োজন করেছ গোঁসাই?
আনন্দেতে দেবীচাঁদ ডেকে বলে ভাই।
সফল জনম মোর সুখে সীমা নাই।।
ওড়াকান্দীবাসী প্রভু ধন্য গুরুচাঁদ।
দয়া করি করিলেন পতিত আবাদ।।
রূপে গুণে কোনখানে যাঁর তুল্য নাই।
দয়া করে আসিছেন সেই যে গোসাই।।
পতিত পাবন প্রভু পতিতের বন্ধু।
পার করে দীনজনে এই ভব-সিন্ধ।।
মম সম পাতকীরে বড় দয়া তাঁর।

দয়া গুণে আসে প্রভু গৃহেতে আমার।।


মম পিতা হরিচাঁদ মানবের তরে।


এসেছিল এ জগতে নরদেহ ধরে।।


বিশ্ববাসী মানবের যাতে শুভ হয়।


সেই ধর্ম্ম নীতি কথা বলেছে সদায়।।


মানব গোষ্ঠীর তাতে সুমঙ্গল হবে।


নরজাতি দিনে দিনে সে-ধর্ম্ম জানিবে।।


সেই নীতি শিরে করি আমি কাজ করি।


আমার ভরসা মাত্র দয়াল শ্রীহরি।।


জগত-বান্ধব ছিল হরি দয়াময়।


এ-বিশ্ব তারণ-কথা তাঁরে শোভা পায়।।


মোর মধ্যে সেই শক্তি কিছু মাত্র নাই।


পিতার আদেশ মাত্র বহিয়া বেড়াই।।


তিরোধন পূর্ব্বে তিনি ডাকিয়া নিকটে।


আমাকে বলিল কথা অতি অকপটে।।


দলিত পীড়িত যত বিদ্যাহীন নর।


মতাদুঃখে কাটে কাল পৃথিবী-ভিতর।।


তাদের দুঃখের বোঝা বিদ্যা বুদ্ধি দানে।


দূর করে দিতে আজ্ঞা করে ততক্ষণে।।


অগ্রভাগে বঙ্গবাসী নমঃশূদ্র গণে।


উদ্ধার করিতে বলে আনন্দিত মনে।।


নিপীড়িত জাতি মধ্যে এজাতি প্রধান।


অগ্রভাগে করি তাই তাদের কল্যাণ।।


নমঃশূদ্র সে আদর্শ করিলে গ্রহণ।


তাঁদের ধরিয়া ধন্য হবে অন্য জন।।


তাহার প্রমাণ আজি দেখ হে সবাই।


অবশ্য ঘটিছে সব মিথ্যা বলি নাই।।


আমার পিতার ভক্ত মতুয়া যাহারা।


দেশে দেশে কোন কর্ম্ম করিয়াছে তাহারা?


আর বলি শোন কথা কথার চূড়ান্ত।


নমঃশূদ্র দেখ আজি কত ভাগ্যবন্ত।।


অস্পৃশ্য চন্ডাল বলি গালি দিত যারা।


শিষ্যরূপে আজি দেখ পদানত তারা।।


মতুয়ার গণ চলে আজি দেশে দেশে।


এক বস্ত্র ধারী বটে বেহালেল বেশে।।


নির্ব্বাণ-আগ্নেয়গিরি যথা ঘুমে রয়।


সেই মত মতুয়ারা ঘুরিয়া বেড়ায়।।


কার্য্যকালে মহোল্লাসে অগ্নি সম জ্বলে।।


পাপী তাপী তর্কবাদী ডুবায় সকলে।।


শক্তি দেখি ভক্তি দেখি যত জীব কুল।


মতুয়ারে “গুরু” করে হইয়া আকুল।।


চন্ডালত্ব ঘুচাইয়ে দিল ব্রহ্ম-পদ।


তাই বুঝি মতুয়ারে ভেবেছে আপদ।।


চিরকাল পরপদ-ধূলি মাখ অঙ্গে।


তোমরা কিসের তুল্য মতুয়ার সঙ্গে?


তোমাদের মান দিতে তাঁরা হল দোষী।


গোবরের পোকা যেন গোবরেতে খুশী।।


আরো বলি শোন কথা নমঃশূদ্রগণ।


অনর্থক ক্রোধ সবে কর কি কারণ?


নমঃ জাতি নাম ভাল নমস্য সবার।


নমস্কার পেতে লাগে কোন ব্যবহার?


ধর্ম্ম আর বিদ্যাবলে চিত্ত শুদ্ধ হয়।


চিত্ত-শুদ্ধ জনে সবে ভকতি জানায়।।


তোমার জাতির মধ্যে সেই গুণ কই?


গুণ যদি নাহি থাকে কিসে বড় হই?


মতুয়ার দ্বেষ কত কর মনে মনে।


ভেবে দেখ সব কর শুধু অকারণে।।


এক সঙ্গে তারা সবে করিছে আহার।


তার মধ্যে দোষ বাপু বল কি তাহার?


শ্রীক্ষেত্র পুরুষোত্তমে ব্রাহ্মণ যবন।


এক সঙ্গে করে থাকে প্রসাদ গ্রহণ।।


সীমাবদ্ধ স্থানে যদি এত গুণ রয়।


মতুয়ার গুণে তাহা হ’ল সর্ব্বময়।।


শাস্ত্রের দোহাই সবে দেও সর্ব্বদায়।


তত্ত্ব তার কোন জনে মান না কোথায়।।

পুরাণের বাক্য বলি শান সবে বসি।


নারদের ঠাঁই প্রভু যাহা বলে আসি।।


“নাহং তিষ্ঠামি বৈকুন্ঠে নচে যোগিণাং হৃদয়ে।


মদ্ভক্তাঃ যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ।।”


যেই খানে হরি নাম গুনগান হয়।


আপনি বৈকুন্ঠনাথ উদয় তথায়।।


যেখানে উদয় হয় কমল লোচন।


ক্ষেত্র হতে হীন তারে বলে কোন জন।।


প্রেমানন্দে মতুয়ারা নাম গান গায়।


অন্ন কোথা শ্রীনাথের প্রসাদান্ন খায়।।


প্রসাধের মধ্যে যেবা আনে ভিন্ন ভেদ।


তার পক্ষে প্রসাদ তো নরকের ক্লেদ।।


শ্রীক্ষেত্রের ভাব আজি প্রতি ঘরে ঘরে।


আমার পিতার ভক্ত মতুয়ারা করে।।


এসব দেখিয়া তবু আছ দৃষ্টি হীন।


কয়লা ছাড়িতে কভু পারেনা মলিন।।


ছেড়ে দাও গন্ডগোল আঁখি মেলে চাও।


সাধুর তরঙ্গে ডুবে প্রাণ ভরে খাও।।


অভিমান বশে সবে হয়ে আছ অন্ধ।


অন্ধকারে বসে পায় পেচকে আনন্দ।।


হিংসা হিংসি দ্বেষা দ্বেষী ভুলে যাও তাই।


একতা বিহনে দেখ উদ্ধার ত নাই।।


আর কথা বলি যাহা শোন মন দিয়া।


নরনারী বিদ্যাশিক্ষা কর এক হইয়া।।


মাতা ভাল নাহি হলে পুত্র ভাল নয়।


মার গুনে ছ ভাল লোকে তাই কয়।।


এই যে ডক্টর মীড বসিয়া এখানে।


তোমাদের জন্যে চিন্তা করে সর্ব্বক্ষণে।।


নারীর শিক্ষার তরে এই মহামতি।


ওড়াকান্দি বিদ্যালয় করেছে সম্প্রতি।।


ইহার সঙ্গিনী যিনি মিস টাক নাম।


নারীর উন্নতি লাগি চেস্টা অবিরাম।।


কত ঋণী নমঃশূদ্র ইহাদের ঠাঁই।


সে সব বলিব কিবা গুণে সীমা নাই।।


বহু কথা একা আমি বলিয়াছি হেথা।


এবে সবে শোন তবে সাহসের কথা।।


বসিবার পূর্বে পুনঃ বলি আরবার।


ধর্ম্ম আর বিদ্যা বিনে নাহিক উদ্ধার।।


পবিত্র চরিত্র জানি সর্ব্ব নীতি সার।


ধর্ম্মে কর্ম্মে সর্বখানে মান সদাচার।।


এত বলি দয়াময় বসিল আসনে।


আকাশ ভরিয়া গেল জয় জয় গানে।।


অতঃপর উঠিলেন মীড মহামতি।


অনেক বলিল কথা করিয়া যুকতি।।


সার মর্ম্ম তার কিছু ত্রিপদীর ছন্দে।


বলিব সবার ঠাঁই মনের আনন্দে।।

কহে মীড বাস্তবিক


আজিকার দিনে।


কেন হেন মনে হল


ভার মোর মনে।।


বৈদেশিক আমি ঠিক


ভিন্ন জাতি ভাষা।


দীনজনে কৃপা দানে


মনে মোর আশা।।


আমি বঙ্গে মনোরঙ্গে


ভ্রমিয়া বেড়াই।


যাঁরে চাহি তাঁরে নাহি


খুঁজিয়া ত পাই।।


মনে মনে সর্ব্ব ক্ষণে


করি অন্বেষণ।


তবু দেখা প্রাণ সখা


না দেয় কখন।।

 

 

দিনে দিনে মনে প্রাণ


হতেছি হতাশ।


এ সময় দয়াময়


দিলেন আশ্বাস।।


কিবা নাম শুনিলাম


গ্রাম ওড়াকান্দী।


শুনি কানে সেই ক্ষণে


মন হল বন্ধী।।


আসিলাম দেখিলাম


বুঝিলাম মনে।


খুঁজি যারে হেথাকারে


রয়েছে গোপনে।।


দীন গৃহে ঢেকে রহে


আপন সৌরভ।


অন্ধ জাতি ছন্ন মতি


জানেনা গৌরব।।


দেখা মাত্রে প্রেম সূত্রে


বাঁধিয়াছে মোরে।


শক্তি নাই কোথা যাই


ছাড়িয়া তাহারে।।


তাতে বলি মহাবলী


নমঃশূদ্রগণ।


জান মনে এই জনে


পরম রতন।।


হেন রত্ন বিনা যত্ন


আসেনা কোথায়।


ভুল করে যেন তারে


ছেড় না হেলায়।।


কি জঞ্জাল হে চন্ডাল


বলিত যাহারে।


কৃপা করে নিজ করে


উদ্ধারে তাহারে।


মোরে বাধ্য করে সাধ্য


হেন নাহি কার।


মোরে বান্ধে গুরুচাঁন্দে


মহিমা তাহার।।


ওঠ জাড়ি কিবা লাগি


রয়েছে আঁধারে।


দীপ্ত রবি সম ছবি


তোমাদের ঘরে।।


বলে যাহা কর তাহা


মন ঠিক কর।


ডেকে যায় এ সময়


তাঁর পথ ধর।।


মতিমান দেবীচান


গুণেতে বাখানি।


কুল শ্রেষ্ঠ ইষ্ট নিষ্ঠ


তারে আমি জানি।।


একত্রতা বান্ধবতা


তার সাথে মোর।


হেথা আসি মিশামিশি


প্রেমেতে বিভোর।।


দলে দলে সর্ব্ব স্থলে


জাগ নমঃশূদ্র।


কেন হায় এ ধরায়


রবে সবে ক্ষুদ্র।।


নমঃ জাতি প্রতি প্রীতি


মোর সদা আছে।


চিরদিন মোর ঋণ


আছে নমঃকাছে।।


বলি তাই শোন ভাই


ওঠ সবে জেগে।


সিংহ প্রায় যেতে হয়


বীর অনুরাগে।।

কর হুষ কি মানুষ


আসিয়াছে ঘরে।


ধর তারে নিষ্ঠা ভরে


অন্তরে বাহিরে।।


এ সুযোগ যোগাযোগ


বড়ই আশ্চর্য্য।


মনোমত অবিরত


কর সবে কার্য।।


যে কান্ডারী দয়া করি


ধরিয়াছে হাল।


অন্যজনে কোন গুণে


পায়না নাগাল।।


এ সৌভাগ্য পেতে যোগ্য


নহে অন্য কেহ।


কেন জানি গুণমনি


করেছে এ স্নেহ।।


উপদেশ করি শেষ


মহতী সভায়।


কর সবে উচ্চ রবে


গুরুচাঁদ জয়।।


ভাবেবে করিল মীড বাক্য সমাপন।


জয় গুরুচাঁদ ধ্বনি করে সভাজন।।


প্রভু কহে জয় মীড দীনের বান্ধব।


সঙ্গে সঙ্গে সভা জনে করে সেই রব।।


সভা সাঙ্গ করি প্রভু বানিয়ারী রয়।


পরদিন উপনীত বড় বাড়ী গাঁয়।।


শ্রীরাম চরণ নামে অতি ধনবান।


তার গৃহে মহাপ্রভু করিল প্রয়াণ।।


বহু কথা আলোচনা হইল তথায়।


তদন্তে পুলিশ সাহেব সেইখানে যায়।।


বৈদক্রমে প্রভু সঙ্গে হল দেখাদেখি।


প্রভুর সঙ্গেতে তেহ করে মাখমাখি।।


বিনয়ে প্রভুর তেঁহ করিল সম্মান।


ভাব দেখি ভক্ত গণে নেচে ওঠে প্রাণ।।


যেইখানে যায় প্রভু ন ভাব আনে।


আনন্দের ঢেউ সদা নাচে সেই খানে।।


প্রত্যহের রীতি নীতি জীবে ভুলে যায়।


আনন্দে পাথরে পড়ি হাবুডুবু খায়।।


মানবের আচরণে দেখি ব্যবহার।


রাজ্য মধ্যে রাজা যবে করেন বিহার।।


ছুটি পায় কয়েদীরা কাটে কর্ম্ম বন্ধ।


জয় মহারাজ বলি করে যে আনন্দ।।


সামান্য কারার দ্বারমুক্ত হয়ে যায়।


সংসার করার বুকে আসি বন্ধু হয়।।


গুরুচাঁদ আগমনে ভব কারা খোলে।


পাপী তাপী, দুঃখী সদা নাচে কুতুহলে।।


ইহা দেখি মনে হয় তারকের গান।


মানুষের আগমনে বহে প্রেম বান।।


যে যে খানে দয়াময় করিল গমন।


জাতির উন্নতি কথা কহে সর্ব্বক্ষণ।।


সেই বাণী কানে শুনি জাতি জেগে ওঠে।


গুরুচাঁদ কৃপা গুণে এত সব ঘটে।।


ভ্রমণ করিয়া শেষ প্রভু আসে ঘরে।


জয় ধ্বনি করে সবে আনন্দ অন্তরে।।


ঘরে ঘরে ঘুরে প্রভু প্রেম-বাতি জ্বলে।


সেজে অন্ধ মহানন্দ চক্ষু নাহি মেলে।।

 



 

No comments: