Sunday, September 20, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 85 মহাত্মা শশীভূষণ ঠাকুর

বারশ’ পঁচাত্তর সাল ভাদ্র মাসেতে।


শ্রীশশীভূষণ জন্মি নিলেন ধরাতে।।


জন্মকালে হরিচাঁদ গৃহেতে আছিল।


সুপুত্র জন্মিবে বলি আশীষ করিল।।


পরম সুন্দর রূপ চারু কলেবর।


রূপ দেখি আনন্দিত যত নারী নর।।


চন্দ্র জ্যোতিঃ মুখে দেখি হরি বলে হাসি।


“শশি সম রূপে পুত্র নাম থাক শশী।।


দিনে দিনে বাড়ে শশী স্বর্গ শশী প্রায়।


সুধীর মধুর ভাষী আধ কথা কয়।।


পঞ্চম বয়ষ কালে বিদ্যারম্ভ হয়।


গঙ্গাচরণ পন্ডিত ঘৃতকান্দী গায়।।


তেঁহ ঠছাই কিছুকাল লেখাপড়া করি।


বর্ণশিক্ষা ব্যাঞ্জনাদি এল সব সারি।।


নমঃকুলে জন্ম রঘুনাথ সরকার।


শিক্ষক সাজিয়া এল ওড়াকান্দী পর।।


ওড়াকান্দীবাসি যত স্বজাতির গণ।


শিক্ষাকর্য্যে রঘুনাথে করিল বরণ।।


গ্রাম মধ্যে গৃহ এক নির্ম্মাণ করিল।


সেই ঘরে পাঠশালা স্থাপতি হইল।।


নমঃ করে বিদ্যাদান অদ্ভুত ঘটনা।


বর্ণহিন্দু সবে করে জল্পনা কল্পনা।।


নমঃ করে বিদ্যাদান নমঃ শিক্ষা পায়।


নমঃ যদি শিক্ষা পায় কি হবে উপায়।।


তাই ভেবে বর্ণহিন্দু আলোচনা করে।


প্রকাশ্যে বলিতে নারে নমঃশূদ্র ডরে।।


নমঃ মধ্যে আদি স্কুল ওড়াকান্দি হল।


নমঃশূদ্র ছাত্রবর্গ সকলি জুটিল।।


এই পাঠশালে পড়ে শ্রীশশীভূষণ।


নিম্ন ছাত্রবৃত্তি শিক্ষা করে সমাপন।।


ছাত্রবৃত্তি কেন্দ্র রয় মহকুমা পরে।


মাদারীপুর বলিয়া জানে সর্ব্ব জনে।।


ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষাতে শ্রীশশীভূষণ।


কৃতিত্বে করিল পাশ জানে সর্ব্বজন।।


উচ্চছাত্রবৃত্তি শিক্ষা করে অতঃপর।


পরীক্ষা করিল দান মহাকৃমা পরে।।


বারশ নব্বই সালে মধ্যছাত্রবৃত্তি।


পাশ করি বড় বাবু লভিবেন বৃত্তি।।


বড়ই মেধাবীছাত্র শ্রীশশীভূষণ।


শিক্ষকে বাসিত ভাল পুত্রের মতন।।


দেশ মধ্রে শিক্ষা শেষ অতঃপর হল।


ইংরেজী শিখিতে প্রাণে কামনা জাগিল।।


পিতৃপদে মনোখেদে করে নিবেদন।


“ইংরেজী শিখিতে কিবা উপায় এখন।।


এই দেশে নাহি তাতঃ সেই বিদ্যালয়।


প্রাণের বাসনা বুঝি প্রাণে হ’ল ক্ষয়।।


দয়া করি মোরে পিতাঃ পাঠান বিদেশে।


রাজবিদ্যা ল’ব শিখি বিদেশেতে বসে।।

 

পুত্র মুখে শুনি বাণী প্রভু বড় সুখী।


বলে “শশি থাক বসি ভয় আছে কি?


প্রাণে যদি ইচ্ছা থাকে অবশ্য পুরিবে।


রাজবিদ্যা শিক্ষা তুমি নিশ্চয় করিবে।।”


মনে চিন্তা করে প্রভু কি করি উপায়?


পুত্রধনে শিক্ষা লাগি রাখিব কোথায়।।”


হেনকালে উপনীত তারক গোঁসাই।


গানে জ্ঞানে প্রেমে ধ্যানে যাঁর তুল্য নাই।।


হরিচাঁদে সমর্পিত আত্মা মন তনু।


জ্ঞানে বৃহস্পতি তথা রূপে যেন ভানু।।


অভেদাত্মা “হরিগুরুচাঁদ” বলি জানে।


হরিচাঁদ গুরুচাঁদ এক জানি মানে।।


শ্রীহরির লীলাকালে যেমন আসিত।


সেই মত ওড়াকান্দী করে যাতায়াত।।


সেই যে তাকরচন্দ্র দিল দরশন।


ভক্তিভাবে পূজিলেন শ্রীগুরু-চরণ।।


আনন্দে হাসিয়া প্রভু কুশল জিজ্ঞাসে।


তারক উত্তর করে আঁখিজলে ভেসে।।


“তব কৃপা দৃষ্টি প্রভু যার “পরে রয়।


অকুশল তার সঙ্গ ছাড়ি দূরে যায়।।


তব কৃপা বারিধারা পড়ে যেই শিরে।


দুরন্ত সংসার তাপে কি করিতে পারে?


বারি মধ্যে শীতলতা গুণ আছে জানি।


শীতলতা গুণে স্নিগ্ধ হয় সব প্রাণী।।


যেই পাত্রে থাকে বারি তাতে ভেদ নাই।


শীতলতা রহে সদা বলিহারি যাই।।


তব কৃপা-বারি প্রভু তাপ-জ্বালা-নাশী।


যেই পায় সেই স্নিগ্ধ তাপমধ্যে বসি।।


বড়ই কুপাত্র আমি পাপ-তাপে জারা।


আমা হতে প্রভু-কার্য্য কিছু নহে সারা।।


বিফল জীবন বটে বিফল জনম।


নাহি মোর ভক্তি শক্তি নাহি পরাক্রম।।


তোমার কৃপার গুণে বলিহারি যাই।


কৃপাগুণে সর্ব্বস্থানে মহাশান্তি পাই।।


তাই বলি কৃপাগুণে আছি যে কুশলে।


তব কৃপা রাখে মোরে জলে কিংবা স্থলে।।


বিনয় বচনে যদি বলিল তারক।।”


ব্যাখ্যা তারে করে প্রভু হইয়া পুলক।।


আহারাদি শেষে ডাকি বলে তারকেরে।


“শোন শোন হে তারক বলি যে তোমারে।।


তব বাসস্থল হয় জয়পুর গ্রামে।


নবগঙ্গা তীরে দেশ সুন্দর সুঠাম।


নানা বর্ণ বাস করে সে গ্রাম মাঝারে।


বিশেষতঃ সুশিক্ষিত সবে বাস করে।।


ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য আর নবশাখ।


কুম্ভকার কর্ম্মকার নহেত একক।।


নমঃশূদ্র তেলী মালী আছে বহুতর।


সর্ব্ববর্ণ সম্মিলনে গ্রামটি সুন্দর।।


শিক্ষা দীক্ষা সভ্যতাদি সকলি রয়েছে।


ধনী জ্ঞাণী সুবিদ্বান কতই জন্মেছে।।


আমাদের দেশে দেখ তার কিছু নাই।


আলোহীন অন্ধ দেশে বাস করি তাই।।


স্কুল পাঠশালা দেখ আছে মাত্র কটা।


বাংলা শিক্ষা দেয় শুধু কিছু পরিপাটি।।


ইংরেজী শিক্ষার কেন্দ্রে এই দেশে নাই।


পুত্রগণে বল দেখি কোথায় পাঠাই।।”


এতেক বচন প্রভু কহে মনোদুঃখে।


তারক শুনিয়া বাণী রহে অধোমুখে।।


ক্ষণকাল পরে বলে “দয়াল ঠাকুর।


মনোকথা বলি খুলে দুঃখ কর দূর।।


যদি মম সাধ্য মধ্যে কোন কিছু রয়।


তব কৃপা বলে আমি করিব নিশ্চয়।।”


প্রভু কর “ হে তারক ছাত্রবৃত্তি পড়ি।


শশী রহে বাড়ী বসে উপায় কি করি?


তাহার বড়ই ইচ্ছা উচ্চ বিদ্যা শিখে।


উপায় জিজ্ঞাসি তাই এই দায় ঠেকে।।”


শ্রীতারক বলে তবে করিয়া মিনতি।


“আমা হতে হতে পারে কোনরূপে গতি?”


প্রভু বলে “মম ইচ্ছা তব গৃহে থাকি।


শশী ধন্য হবে কত উচ্চ বিদ্যা শিখি।।


তব গৃহে রহে যদি শ্রীশশী ভূষণ।


মম গৃহে আছে পুত্র এই ভাবি মন।।”


প্রভুর বচন শুনি তারক কান্দিল।


গললগ্নীকৃতবাসে অনেক কহিল।।


“পরম সৌভাগ্য মোর তুল্য দিতে নাই।


নিজগুণে কৃপা করে ক্ষীরোদের সাই।।


নিজ মুখে কৃপা করে কহিয়াছে বাণী।


জয়পুর গৃহ তবে এ ভাগ্য রাখানি।।


বড় বাবু নিজ গৃহে যাইবে আপনি।


তব ইচ্ছা পূর্ণ হোক ওগো গুণমণি।।”


শ্রীশশীভূষণ পরে পিতৃ-আজ্ঞা ক্রমে।


উপনীত শিক্ষা লাগি জয়পুর গ্রামে।।


লহ্মীপাশা হাই স্কুল নিকটে আছিল।


শুভদিনে সেই স্কুলে প্রবেশ করিল।।


বড়ই আগ্রহ তার বিদ্যার কারণে।


সুশিক্ষা লভিল কত নিজ চেষ্টাগুণে।।


উচ্চবর্ণ হিন্দু যত স্কুলেতে আছিল।


শ্রীশশীভূষণ সবে পরাস্ত করিল।।


কিবা শিক্ষা, কি ভদ্রতা, অথবা চরিত্রে।


সর্ব্বগুণ সমন্বয় যেন এক পাত্রে।।


শিক্ষকেরা কানাকানি করি কথা কয়।


নমঃকুলে হেন ছেলে কিসে জন্ম লয়?


রূপে গুণে মানামানে বর্ণহিন্দু হতে।


এই ছেলে হীন নহে কভু কোন মতে।।


যে জাতির ঘরে জন্মে এ হেন তনয়।


সে জাতি জাগিবে ধ্রুব নাহিক সংশয়।।

 

কেহ বলে “ওরে ভাই কথা সত্য বটে।


দৈবশক্তি বিনা কভু জাতি নাহি ওঠে।।


এই নমঃশূদ্র দেখ জঘন্য আছিল।


দৈব শক্তিধারী হরি এই কুলে এল।।


শ্রীহরি ঠাকুর বলে হয়েছে উপাধি।


তাঁর নামে কতজনে মুক্ত হয় ব্যাধি।।


সেই বংশে তার পুত্র গুরুচাঁদ নাম।


তেঁহ বটে গুণীশ্রেষ্ঠ সুন্দর সুঠাম।।


তাঁহার নন্দন এই শ্রীশশীভূষণ।


“আত্মাবৈ জায়তে পুত্রঃ এই সে লহ্মণ।।


কানাকানি করে “বটে প্রশংসাদি করে।


প্রকাশ্যতঃ হিংসা দ্বেষ করে ব্যবহারে।।


সে কালে যতেক হিন্দু পরিচয় দিত।


অশিক্ষিত জাতিগণে ঘৃণাই করিত।।


ধনে মানে রাজদ্বারে বর্ণ হিন্দুগণ।


উচ্চপদ লাভ করি করিত শাসন।।


দলিত পীড়িত যত অশিক্ষিত জন।


সমাজের নিম্নস্তরে আছিল তখন।।


অস্পৃশ্য করিয়া কত রাখিত সমাজে।


সেই জন্য কত জন হিন্দুধর্ম ত্যাজে।।


সেদিন যে ভুল হিন্দু করেছে জীবনে।


আজি ফলভোগ করে কালের পেষণে।।


হিংসা ভাব দেখি শশী মনে দুঃখ পায়।


মনে -ভাবে এই দুঃখ কোথা গেলে যায়।।


রাজধানী কলিকাতা প্রধান শহর।


সভ্যতার শ্রেষ্ঠ-কেন্দ্র ভারত ভিতর।।


“সংবাদ পত্রিকাদি কত প্রচার হইত।


শিক্ষালয়ে শিক্ষকেরা গ্রহণ করিত।।


সে সংবাদপত্র যোগে শ্রীশশি ভূষণ।


দেশ বিদেশের কথা করিত পঠন।।


ব্রাহ্ম সমাজের নীতি পড়ে মন দিয়া।


সেই নীতি পড়ি তার মুগ্ধ হল হিয়া।।

মনে ভাবে হেন দিন কবে মোর হবে।


কলিকাতা শহরেতে গিয়ে-দুঃখ যাবে।।


মহাজন বাক্য আছে শাস্ত্র গ্রন্থাদিতে।


“ভাবিলে ভাবনা সিদ্ধি পারিলে ভাবিতে।।


যাদশী ভাবনার্যস্য সিদ্ধিযাতি তাদৃশী।।”


শ্রীশশীভূষণ যবে জয়পুর যান।


তাহার কিঞ্চিত পূর্ব্বে আছয় প্রমাণ।।


চাঁদসী নিবাসী ধন্য নমঃকুল জাত।


ডাক্তার উপাধিধারী বহুত বিখ্যাত।।


বিষ্ণুহরি নাম আদি উপাধিতে দাস।


মনসা দেবীর বরে লভে মান যশ।।


বিনা অস্ত্রাঘাতে করে ক্ষত চিকিৎসা।


ভুভারতে ধন্য আজি তাহার ব্যবসা।।


তাঁর যত বংশধর শিষ্য সংখ্যা যত।


চাঁদসী ডাক্তার বলি সবে পরিচিত।।


সেই বংশে জগবন্ধু নামেতে প্রধান।


শ্রীহরির জীবকালে ওড়াকান্দী যান।।


হরিকে দেখিয়ে তার আঁখি খুলি যায়।


বহুৎ বিনয়ে তেহ হরিকে পূজায়।।


তাহে প্রীতি হরিচাঁদ করে আশীর্ব্বাদ।


“পূর্ণ হোক তব মনে যাহা কিছু সাধ।।”


ওড়াকান্দী ধাম দেখি চিত্ত বিমোহিত।


শ্রীশশীভূষণে দেখি হল বড় প্রীত।।


অষ্টম বরষ মাত্র বয়স তাঁহার।


অপরূপ রূপ যেন পূর্ণ শশধর।।


বড়ই বিনয়ী তাতে অমি মিষ্ট ভাষা।


মনে মনে জগবন্ধু করে কত আশা।।


এমন সোনার চাঁদ যদি হাতে পাই।


ইচ্ছা হয় কন্যা দানে ধন্য হয়ে যাই।।


হরির অপূর্ব্ব লীলা আদি অন্ত নাই।


মন জানি আশীর্ব্বাদ দিলেন তাহাই।।


জগবন্ধু যেইকালে প্রস্থান করিল।


শ্রীগুরুচরণে ডাকি শ্রীহরি কহিল।।


“শুন গুরুচাঁদ আজি মোর কথা লও।


কুলে শীলে ধন্য যদি হইবারে চাও।।


শ্রেষ্ঠ বংশ হতে কন্যা গৃহেতে আনিবে।


তোমার গৃহেতে তবে রাজা জন্ম লবে।।


এই যে ডাক্তার দেখ চাঁদসী নিবাসী।


মহাশ্রেষ্ঠবংশ জান পরম বিশ্বাসী।।


এই শ্রেষ্ঠ বংশ হতে এক কন্যা এনে।


অবশ্য বিবাহ দিবে তব পুত্র সনে।।


‘যথা আজ্ঞা’ বলি প্রভু স্বীকার করিল।


বারশ’ নব্বই সালে সেই দিন এল।।


জগবন্ধু কৃষ্ণদাস প্রসন্ন বিপিন।


বংশমধ্যে শ্রেষ্ঠ সবে জ্ঞানেতে প্রবীণ।।


চারিজন একতরে এল ওড়াকান্দী।


সবে করে গুরুচাঁদ সখ্য-গুণে বন্ধী।।


এ সময়ে জয়পুরে শ্রীশশীভূষণ।


লহ্মীপাশা হাই স্কুলে করে অধ্যয়ন।।


দুইদিন ডাক্তারেরা ওড়াকান্দী রহে।


মনোগত কথা কিন্তু কিছু নাই কহে।।


তৃতীয় দিবস বেলা প্রহর সময়।


সে জগবন্ধু ডাক্তার হাসি হাসি কয়।।


“বড়কর্ত্তা তব ঠাঁই এক নিবেদন।


দয়া করি সেই কথা করুন শ্রবণ।।


এই যে প্রসন্ন মম ভ্রাতুপুত্র হয়।


বড়ই অভিজ্ঞ ইনি চিকিৎসা বিদ্যায়।।


বংশ মধ্যে ইহ সম নাহি অন্য কেহ।


কলিকাতা বাস করে করি নিজ গৃহ।।


আমাদের বংশে ছিল শ্রীহরমোহন।


প্রসন্নের খুল্লতাত অমি মহাজন।।


ভারত ব্যাপিয়া যশ ছিল চিকিৎসায়।


নিজ আয়ে গৃহে করে সে কলিকাতায়।।

 

অপুস্কক বলি তার অর্থ বিত্ত যত।


লভিয়াছে এ প্রসন্ন আইনানুগত।।


অনঙ্গমোহিনী নাম্নী বড় গুণবতী।


এক কন্যা আছে ঘরে চির আয়ুষ্মতী।।


তব জ্যেষ্ঠ-পুত্র নাম শ্রীশশীভূষণ।


দেবকান্তি সমরূপ করি দরশন।।


দয়া করি এই কন্যা সেই পুত্র লাগি।


গ্রহণ করুন মোরা এই ভিক্ষা মাগি।।”


এতেক বচন যদি বলিল ডাক্তার।


ক্ষণ কাল স্তুব্ধ রহে প্রভু অতঃপর।।


চন্দ্রজ্যোতিঃ সম হাসি অধরে আনিয়া।


সারগর্ভ বাক্য কহে হস্ত দোলাইয়া।।


“শুনহে ডাক্তার বাবু! আমার বচন।


পবিত্র প্রস্তাব সবে করেছ কথন।।


সপ্তবর্ষ পূর্ব্ব মম পিতা বিদ্যামানে।


এই গৃহে একবার আসিলা আপনে।।


আপনি প্রস্থান যবে কর মহাশয়।


মমপিতা মোর প্রতি এক বাণীকয়।।


তব বংশ হতে এক কন্যা আনিবারে।


আজ্ঞাকরি মোর পিতা গিয়াছে আমারে।।


মম মনোমধ্যে বটে আছে সেই সাধ।


বর্তমানে সেই কার্য্য আছে কিছু বাদ।।


আমার মনের কথা আপনার ঠাঁই।


অকপটে ধীরে ধীরে বলিবারে চাই।।


এই নমঃশূদ্র জাতি দেখুন বিচারি।


কি কারণে হীন ভাবে আছে দেশে পড়ি?


মোর মনে এই বলে শিক্ষার অভাবে।


আর্য্য হয়ে ত্যজ্য মত রহিয়াছে সবে।।


প্রাণের বাসনা মোর প্রাণপণ যত্নে।


এ জাতিকে উচ্চ করি দিয়া বিদ্যা রত্নে।।


এজীবনে তিন কর্ম্ম জানিবে নিশ্চয়।


বিধাতার ইচ্ছা ক্রমে ঘটিছে সদায়।।


জন্ম, মৃত্যু পরিণয় এই কর্ম্ম তিন।


বিধাতার ইচ্ছাধীন জানিবে প্রবীণ।।


মম জ্যেষ্ঠ পুত্র শশী জয়পুর গাঁয়।


উচ্ছ বিদ্যা শিক্ষা করে উচ্চ বিদ্যালয়।।


মম মনে এই ইচ্ছা শিক্ষা শেষ হলে।


পুত্রের বিবাহ দিব উপযুক্ত কালে।।


এই ত বলিনু আমি মম অভিপ্রায়।


আপনি বলুন তবে যাহা মনে লয়।।”


শ্রীগুরুর বাক্য শুনি জ্ঞানী জগবন্ধু।


কহিতে লাগিল কথা যেন নাচে সিন্ধু।।


“ধন্য ধন্য বড়কর্তা অপূর্ব্ব ভারতী।


হেন বাক্য শুনি নাই কাহার সংহতি।।


এ জাতির মর্ম্ম কথা আজি তব ঠাঁই।


শুনিয়া তাপিত প্রাণে বড় শান্তি পাই।।


মহাশিক্ষা তব ঠাঁই লভিনু সম্প্রতি।


শিক্ষা ভিন্ন কভু নাহি উঠিবে এ জাতি।।


তব আজ্ঞা শিরোধার্য্য করিনু নিশ্চয়।


তথাপি প্রার্থণা এক মনোমধ্যে রয়।।


ইংরাজী বিদ্যার লাগি তব পুত্রবর।


প্রাণপণে চেষ্টা করে থাকি পরঘর।।


বিশেষতঃ কলিকাতা বঙ্গ রাজধানী।


সর্ব্ব শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কেন্দ্র সব ইহা জানি।।


এই ভাবে কর্ম্ম যদি হয় সমাপন।


নির্ব্বিঘ্নে করিবে শশী বিদ্যা অধ্যায়ন।।


আমাদের গৃহে থাকি নিজ-পুত্র প্রায়।


বিদ্যা শিক্ষা করিবেক যত মনে লয়।।”


এই কথা প্রভু প্রতি বলে জগবন্ধু।


মনে মনে চিন্তা করে করুনার সিন্ধু।।


শশীর প্রাণের ইচ্ছা রাজবিদ্যা শিখে।


ইহা হতে শুভযোগ আরেো কোথা থাকে?


করুণা রুপিণী দেবী হরিপ্রিয়া সতী।


শান্তি মাতা পদে বার্ত্তা করে অবগতি।।

 

সানন্দ অন্তরে মাতা আজ্ঞা করি দিল।


বিবাহের দিন ধার্য্য তবেত হইল।।


মহাসমারোহে হয় পরিণয় কার্য্য।


উভে উভ সসমভাব নহে কিছু ত্যজ্য।।


জয়পুর ছাড়ি তবে শ্রীশশীভূষণ।


কলিকাতা থাকি করে বিদ্যার সাধন।।


কটন স্কুলে প্রথমে প্রবেশ।


ইংরেজী বিদ্যার জ্ঞান লভিল বিশেষ।।


প্রবেশিকা পরীক্ষঅতে কৃতিত্ব সহিত।


উত্তীর্ণ হইল তেঁহ সবে হ’ল প্রীত।।


ঢাকা শহরেতে ছিল জগন্নাথ নাম।


উন্নত কলেজ এক সুন্দর সুঠাম।।


প্রভুর তৃতীয় পুত্র শ্রীউপেন্দ্র নাথ।


পড়িবারে গেল ঢাকা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সাথ।।


কলেজে পড়েন শশী ইস্কুলে উপেন্দ্র।


এক ঠাঁই দুই ভাই অভেদ অভিন্ন।।


দৈবের লিখন দেখ খন্ডন না যায়।


দৈবশক্তি বলশালী মহাজনে কয়।।


অচিন্ত্য দুঃখের ভরা তথা সুখ-ভার।


জীব ভাগ্যে আসে নিত্য জান পরস্পর।।


এ কারণে দৈবশক্তি জানিবে প্রবল।


অসাধ্য সাধন করে দৈব মহাবল।।


“অচিন্তিতানি দুঃখানি যথৈবায়ান্তি দেহিনাম।


সুখান্নাপি তথামন্যে দৈবমাত্রাতিরিচ্যাতে।।”


দৈবযোগে সে উপেন্দ্র পড়ে মহারোগে।


তাহার শুশ্রূষা শশী করে রাত্রি জেগে।।


ওড়াকান্দী ডাকঘর ছিল না তখন।


দেশবাসী জানিত না পত্রাদি লিখন।।


বহু দূরে ডাকঘর ছিল সে সময়।


চিঠি দিলে দশ দিন পরে সবে পায়।।


ঢাকা হতে চিঠি লিখে শ্রীশশীভূষণ।


এদিকে সঙ্কটাপন্ন ভ্রাতার জীবন।।


চারিদিন পরে তবে সে উপেন্দ্র নাথ।


ত্যজিল জীবন যেন হ’ল ইন্দ্র পাত।।


এই ভাবে সে-উপেন্দ্র ত্যাজিল জীবন।


সংক্ষেপে জীবনী তাঁর করিব লিখন।।


বারশ’ পঁচাশী সালে তেঁহ জন্ম লয়।


তের শত এক সালে দেহ ছাড়ি যায়।।


শাস্ত্রে পাই কার্ত্তিকেয় বড়ই সুন্দর।


“মরা” হতে রূপে শ্রস্ঠ নামটি কুমার।।


তাহার অধিক রূপ সে উপেন্দ্র ধরে।


রূপের ঝলক সদা নাচে দেহ ঘিরে।।


শুধু রূপ নয় হায়! বহু শক্তিধারী।


তাঁর শক্তি দেখে সবে বলে “বলিহারী।।”


পঞ্চবর্ষ মাত্র যবে তাঁর বয়ঃক্রম।


শক্তি ক্ষেত্রে দেখাইল অপূর্ব্ব বিক্রম।।


অর্দ্ধ মণ ‘বাটখারা’ লৌহের নির্ম্মিত।


অনায়াসে সে উপেন্দ্র দূরে নিয়ে যেতে।।


পিতামাতা স্নেহ তাঁরে করে অতিশয়।


পিতামাতা বন্ধু ভ্রাতা সবে ভাল কয়।।


আত্ম-সম্ভ্রমেতে ছিল অতি সচেতন।


সে সম্বন্ধে শুন এক আশ্চর্য্য ঘটন।।


একদা প্রভুর সঙ্গে উপেন্দ্র সুজন।


প্রতিবেশী গৃহে গেল করিতে ভোজন।।


বয়সে বালক মাত্র খেলাধূলা করে।


খেয়ালের বেশ গেল পিতৃসঙ্গ ধরে।।


আহারের কালে হল মহা গন্ডগোল।


বাড়ী শুদ্ধ পড়ে গেল মহা কলরোল।।


অপরের পক্ষে তাহা বেশী কিছু নয়।


উপেন্দ্রর পক্ষ হল মন্দ অতিশয়।।


একখানি বড় পীড়ি প্রভুকে দিয়াছে।


বড় থাল এনে তার সম্মৃখে রেখেছে।।


তার পাশে ঠাঁই করে উপেন্দ্রের জন্য।


ভিন্ন পীড়ি দিল তারে থাল দিল ভিন্ন।।

কিন্তু পীড়ি থালা গ্লাস সবগুলি ক্ষুদ্র।


দেখিয়া উপেন্দ্র ক্ষেপে যেন মহারুদ্র।।


“আমাকে দেখিয়া ছোট উপেক্ষা করিল।


কিছুতে রবনা হেথা বাবা তুমি চল।।”


গৃহকর্ত্তা পড়িলেন ঘোর সমস্যায়।


কোনরূপে সে-উপেন্দ্র শান্ত নাহি হয়।।


বড় থাল বড় পীড়ি সব-কিছু দিল।


তবু বলে “মোরে কেন উপেক্ষা করিল।।”


পরিশেষে গৃহকর্ত্তা ক্ষমা চাহি লয়।


তবে সে উপেন্দ্রনাথ শান্ত হয়ে খায়।।


পিতৃ-বুকে এই স্মৃতি ছিল চিরদিন।


বলিতে বলিতে প্রভু হতেন মলিন।।


শ্রীশশীভূষণে তেঁহ ভালবাসে বেশী।


তাঁর কাছে কাছে তেঁহ থাকে দিবানিশি।।


পাঠ লাগি শশী যবে ঢাকা চলি যায়।


উপেন্দ্র চলিল সাথে পাঠের আশায়।।


নমঃশূদ্র ছাত্র যত এক সঙ্গে রয়।


নিজ হাতে পাক করে অনেক সময়।।


এতদিন সে উপেন্দ্র করিলেন পাক।


ডা’ল তরকারী রাঁধে আর রাঁধে শাক।।


দৈবের লিখন তাহা কে খন্ডা’বে বল?


পাকরূপে মহাকালে উপস্থিত হ’ল।।


শাক মধ্যে ‘লঙ্কা বাঁটা’ বেশী দেয় হয়।


ঝাল দেখে তারা সবে শাক ফেলে দিল।।


সকলে শশীকে বলে “দেখুন মশায়।


আপনার ভাই কার্য্য করেছে অন্যায়।।”


সকল জানিয়া শশী বলিল তখনে।


“কি উপেন্দ্র শাকে এত ঝাল দিলে কেনে।।”


আত্মসম্ভ্রমেতে তাঁর আঘাত পড়িল।


বলে “দাদা মাপ চাই, বেশি নাহি বল।।


কিছু ফেলে নাহি দিব খাইব সকলি।


নিশ্চিত হইয়া যাও কলেজেতে চলি।।”


কলেজ চলিল শশী উপেন্দ্র তখন।


সব শাক একা একা করিল ভক্ষণ।।


অল্প পরে কাল রোগে তাঁরে আক্রমিল।


রাহুগ্রস্ত চন্দ্রসম ঢলিয়া পড়িল।।


“আত্মকর্ষণ” যন্ত্রে তেঁহ কিছু দিন পরে।


বলিলেন কথা তবে শশীর গোচরে।।


“তব পুত্ররূপে দাদা আমি জন্ম লব।


তোমার স্নেহের দান গ্রহণ করিব।।”


সে সব কাহিনী যত পরে জানা যাবে।


এবে শোন শশীবাবু কি করে কি ভাবে?


মহাশোকে মুহ্যমান শ্রীশশীভূষণ।


ক্ষণে ক্ষণে ভ্রাতৃ-জন্যে করিছে রোদন।।


এদিকে যেদিন চিঠি পৌঁছে ওড়াকান্দী।


ক্ষণে ক্ষণে লহ্মীমাতা উঠে কান্দি কান্দি।।


চিঠির বৃত্তান্ত শুনি প্রভু গুরুচন্দ্র।


সবাকে ডাকিয়া বলে “সংবাদ যে মন্দ।।


কি জানি কি আছে ভাগ্যে বলা নাহি যায়।


শশীকে আসিতে বাড়ী লিখহ ত্বরায়।।”


সবে বলে “ওহে প্রভু মানিনু বিস্ময়।


শশীকে আসিতে বল উপেন্দ্র কোথায়?”


হাসিয়া বলেন ‘প্রভু তাতে কাজ কিবা।


বাড়ীতে আসিলে শশী সকলি শুনিবা।।


মাতা কেন্দে বলে নাথ একি সমাচার।


তাহলে কি গেছে চলে উপেন্দ্র আমার?


প্রভু বলে “শান্ত হও, ব্যস্ত কেন আগে?


ডাকিরে ঘুমন্ত শত্রু নিজে শত্রু জাগে।।


আসুন না শশী বাড়ী শুনি সমাচার।


পারে যদি উপেন্দ্রও সাথী হোক তার।।


প্রভুর গভীর লীলা নরে বোঝা যায়।


বাক্য-ছলে মৃত্যু-বার্ত্তা প্রভু বলে যায়।।


নিরাশার মাঝে আশা সকলে করিল।


শীঘ্র করি চিঠি লিখি শশীকে আনিল।।

একক শশীকে দেখি কাঁদিছে জননী।


‘উপেন্দ্র কোথায় বাপ বল তাই শুনি?


একসাথে দুই ভাই বিদেশেতে গেলে।


ভাই ফেলে একা কেন আজ বাড়ী এলে?


কুলের গৌরব তুই জ্যেষ্ঠ-পুত্র মোর।


বহু মূল্য মণি এক সাথে দিনু তোর।।


মণি হারা ফণী মত তোরে দেখা যায়।


আমার প্রাণের মণি রাখিলি কোথায়?”


এমত বিলাপ মাতা করে লোকাচারে।


গর্জ্জন করিছে প্রভু আসি অন্তঃপুরে।।


“মরা শব লাগি কান্দ’ ওরে জ্ঞানহীনা।


দেহ ছেড়ে গেলে প্রাণ কখনো ফিরে না।।


মরণ জানিবে ধ্রুব দেহধারী পক্ষে।


শোক দুঃখ যত দেখ প্রভু পরীক্ষে।।


“জীবানাম মরণঃ ধ্রুবঃ


অসাধ্যোয়ং নিবারণেন সদা।।”


কেবা কার পুত্র কন্যা কেবা কার পতি?


সম্বন্ধ-বিহীন সবে ভ্রমিতেছে ক্ষিতি।।


মায়া-ঠুলী চোখে দিয়ে যত জীব গণ।


যারে দেখে তারে বলে “আমার আপন।।”


যখনে মরণ আসি ভাঙ্গে মায়া-ঠুলী।


আপন স্বরূপে দেখে দৃষ্টি যায় খুলি।।


আর না পাছের ডাকে সেই ফিরে চায়।


কর্ম্মফল অনুসারে যথা তথা যায়।।


শোক নহে সত্য শুধু মায়ার বাহন।


স্নেহ-কৃপা-শৃঙ্গে জীবে করিছে শাসন।।


এতই অজ্ঞান জীব এ ভবে আসিয়ে।


আঘাতের ব্যথা থাকে নীরবে সহিয়ে।।


দেখ ত শোকের কান্ড কত ভয়ঙ্কর।


অবিরাম বক্ষে কত করিছে প্রহার।।


ছাড়হ শোকের ছলা চিত্ত কর স্থির।


এসব জানিবে লীলা শুধু শ্রীহরির।

 

আর শুন গূঢ় কথা কহি তব ঠাঁই।


শোকে করে দেখ কিন্তু বিরুদ্ধেতে যাই।।


যদ্যপি প্রভুর মনে হয়ে থাকে ভাব।


পুত্র নিয়ে শোক দিয়ে দিবে পরভাব।।


তাঁহাদের ইচ্ছায় সুখ যদি নাহি পাই।


দুঃখ পেয়ে কেন্দে কেন বিরুদ্ধেতে যাই?


তাঁর ইচ্ছা যাহা হ’ল তাই ধন্য মানি।


তাঁহার ইচ্ছায় শুভ এই মাত্র জানি।।


মোরা যে তাঁহার প্রিয় যত জীব গণ।


অপার করুণা গুণে পালে সর্ব্বক্ষণ।।


যা কিছু মোদের দেয় সকলি সুন্দর।


সকলি আনন্দময় প্রেমের আকর।।


শোক দুঃখ তূল্য সব জান তাঁর ঠাই।


আনন্দ-মূরতি তিনি নিরানন্দ নাই।।


শীঘ্র করি শোক ফেল করগো আনন্দ।


তুচ্ছ লাগি উচ্চ জনে নহে নিরানন্দ।।


এতেক বচন শুনি প্রভুর শ্রীমুখে।


শোক সম্বরিয়া দেবী চুপ করি থাকে।।


পড়িবারে পুনঃ শশী যেতে চায় ঢাকা।


জননী জাকিয়া বলে “কোথা যাবি একা?


ঢাকা জিলা গিয়ে বাছা কার্য্য কিছু নাই।


ইচ্ছা হলে পড় গিয়ে অন্য কোন ঠাঁই।।


পুনঃ কলিকাতা তাই আসিলেন শশী।


মেট্রোপলিটন কলেজ ভর্ত্তি হল আসি।।


অল্পদিন পরে সেই কলেজ ছাড়িল।


“জেনারেল এসেম্বলী” কলেজে পশিল।।


প্রিন্সিপ্যাল মরিসন সাহেব সুন্দর।


শ্রীশশীভূষণে করে অতি সমাদর।।


স্বভাবের গুণে শশী করে তাঁরে বাধ্য।


সাহেবে করায় কাজ অন্যে যা অসাধ্য।।


কতদিন এই ভাবে পড়াশুনা করে।


গুরুচাঁদ ডাকে তারে কিছুদিন পরে।।

বলে “শোন বাছা শশী বলি তব ঠাঁই।


ইহার অধিক পাঠ কার্য্য আর নাই।।


তব পরে দেখ আছে ভাই দুই জন।


তুমি বিনা ইহাদিগে কে করে শাসন?


একাকী উন্নত হ’লে কিবা ফল তায়?


সেই ধন্য যেই সাথে সকলে উঠায়।।


তাই বলি বাছাধন কলিকাতা ছাড়ি।


এবে তুমি ঘরে এস, ওড়াকান্দী বাড়ী।।


পিতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য্য করে সেই গুণী।


পড়া ছাড়ি ওড়াকান্দী আসিল তখনি।।


মধ্যম ইংরাজী স্কুল গ্রামেতে স্থপিল।


প্রধান শিক্ষক পদে আপনি বসিল।।


সযতনে প্রাণপণে ছাত্র দিতে শিক্ষা।


শিক্ষামহাপূণ্যব্রতে লইলেন দীক্ষা।।


নমঃকূলে আদি কালে যত মহাজন।


শশী ঠাঁই শিক্ষা পেল প্রায় সর্ব্বজন।।


ধন্য ওড়াকান্দীবাসী ভীষ্মদেব দাস।


“ব্যবস্থাপক সভায়’ সভ্য অর্জ্জিল সুযশ।।


শ্রীশশীভূষণ বটে তস্য গুরু হন।


এই রূপে আছে আর কত মহাজন।।


গ্রামের শিক্ষার কেন্দ্রে যবে স্থির হল।


শ্রীশশীভূষণ তবে স্বদেশ ছাড়িল।।


পুনরায় আসিলেন কলিকাতা পরে।


কটন ইস্কুলে থাকি শিক্ষকতা করে।।


সেই কালে কলিকাতা বাসী শ্রেষ্ঠ জন।


শশীভূষণের সঙ্গে হইল মিলন।।


মহামান্য হাইকোর্ট শ্রেষ্ঠ আদালতে।


সারদা চরণ মিত্র জজিয়তী পদে।।


পরম পন্ডিত ছিল সেই মহাশয়।


“হাইকোর্টজজ” বলি সদা মান্য পায়।।


তেঁহ সঙ্গে শশীবাবু করে আলাপন।


কালক্রমে হল প্রেমে ষনিষ্ঠ বন্ধন।।


শশীবাবু সঙ্গে তাঁর ছিল বড় ভাব।


শশীর চরিত্রে সেথা বাধ্য ছিল সব।।


ব্রহ্মধর্ম্ম কুলাচার্য শাস্ত্রী শিবনাথ।


যাঁর নাম নিলে হয় সদা সুপ্রভাত।।


নগেন্দ্র চ্যাটার্জ্জি ন্য ব্রাহ্ম মহাজন।


ইহসঙ্গে শশী সদা করেন মিলন।।


আদি পরিচয় পরে হয় ভাবালাপ।


প্রগাড় বন্ধুত্ব পরে প্রেমময় ভাব।।


ইহা প্রেমে পড়ি তেঁহ করে যাতায়াত।


ব্রাহ্ম সমাজেতে মিশে যত ব্রাহ্মসাথ।।


ব্রাহ্মের উদার নীতি শুনি দিনে দিনে।


ব্রাহ্মধর্ম্মে দীক্ষা নিতে ইচ্ছিলেন মনে।।


‘থিওজফি’ সমাজেতে যাতায়াত করে।


পুরাতত্ত্ব জানিবারে কামনা অন্তরে।।


পরলোক, পরতত্ত্ব প্রাচীন সাধনা।


জানিবারে প্রাণে তার বড়ই বাসনা।।


বিশেষতঃ গাঢ় শ্রদ্ধা ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রতি।


সেই ধর্ম্মে দীক্ষা নিতে ইচ্ছিল সংপ্রতি।।


পিতৃ-আজ্ঞা প্রয়োজন ভাবে মনে মনে।


ওড়াকান্দী উপনীত হয় কতদিনে।।


সরল প্রাণের কথা করে নিবেদন।


“আমি পিতাঃ ব্রাহ্মধর্ম্ম করিব গ্রহণ।।


বড়ই উদার ধর্ম্ম এই ব্রাহ্ম-নীতি।


সর্ব্ব সমন্বয় তাতে সব এক জাতি।।


হিংসা দ্বেষ নাহি কিছু সব সমতুল।


পরম উদার ধর্ম্ম জনিয়াছি স্থুল।।


তব আজ্ঞা ব্যাতিরেকে কিছু সাধ্য নাই।


শ্রীচরণে নিবেদন সেহেতু জানাই।।


প্রীতমনে আজ্ঞাদান করুণ আমারে।


‘ব্রহ্ম’ পেতে চাই আমি ব্রাহ্মের ভিতরে।।”


পুত্রের বচন শুনি প্রভু কন হাসি।


“এহেন অবোধ চিন্তা কোথা পেলে শশী।।

ব্রাহ্ম হলে ব্রহ্মপাবে এই কোন কথা?


ব্রহ্মকি এতই সোজা পাবে যথা তথা?


ব্রহ্ম যারে বল সেত সেই নারায়ন।


কোথায় বসতি তার জান কি কখন?


ব্রহ্ম নহে অন্যকোথা ব্রহ্ম নিজ দেহে।


বীর্য্যরূপে ব্রহ্ম আছে সর্ব্বজীব গেহে।।


সে’ত আছে ঘরে তব নহে’ত বাহিরে।


তুমি যে করিছ চেষ্টা দূরে দিতে তারে।।


ঘরে যেঁই আছে বসে তাঁরে দিয়ে দূরে।


চোখ বুঁজে কিবা পাবে গভীর আন্ধারে?


শোন শশি কিছু তত্ত্ব কহি তব ঠাঁই।


‘শক্তিরূপ’ ব্রহ্ম তুমি জানিবে সদাই।।


এই শক্তি দেখ রহে জীবের শরীরে।


পরম অমূল্য নিধি বীর্য্যরূপ ধরে।।


এই শক্তি যদি কা’র ব্যয় নাহি হয়।


নিশ্চয় জানিবে ব্রহ্ম তাঁরে ঘিরে রয়।।


সে কেন চাহিবে ব্রহ্ম, ব্রহ্ম তারে চায়।


তার-ছোকে ব্রহ্ম দেখে তার মুখে খায়।


“যস্মিন চরিত্র ব্রহ্ম” ব্রহ্মচর্য্য কয়।


ব্রহ্মের আশ্রয় স্থল জানিবে নিশ্চয়।।


ব্রহ্মচর্য্য পালে যেই কায়মনোবাক্যে।


ব্রহ্ম তারে রহে ফিরে সবার অলক্ষ্যে।।


এই ব্রহ্ম পেতে বাপু! ব্রহ্ম হতে চাও।


ব্রহ্ম যদি পেতে চাও ব্রহ্মচারী হও।।


আপনার ঘরে রহে অমূল্য রতন।


অন্ধ তুমি তাই ভ্রমে করনা যতন।।


আপনার ঘরে রহে মধুর ভান্ডার।


পর্ব্বতে ছুটিতে চাহ মধু আনিবার?


যমোবন্ত দেব যিনি মম পিতামহ।


গৃহী ব্রহ্মচারী সাধু আছিলেন তেহ।।


ব্রহ্মচার্য্য পালিলেক সেই ধর্ম্মবীর।


তাঁর দেহে ব্রহ্ম তাই ছিল সদা স্থির।।


সেই ব্রহ্ম রূপ নিল শ্রীহরি ঠাকুর।


ব্রহ্ম পেতে গেলে চাই সাধনা প্রচুর।।


শোন কথা শশী আমি বলি তব ঠাঁই।


পবিত্র চরিত্র হলে কোন চিন্তা নাই।।


আমিত গৃহস্থ লোক সাধনাদি নাই।


বল দেখি কেন আমি যাহা চাই পাই।।


মম পিতা মহাপ্রভু শ্রীহরি ঠাকুর।


তিনবাক্য দিয়ে মোরে তোলে এতদূর।।


পবিত্র চরিত্র আদি বলিল আমারে।


চিরকাল ব্রহ্মচর্য্য বলে রক্ষিবারে।।


প্রাণপণে সেই বাক্য আমি পালিতেছি।


তাঁর কৃপাগুণে আমি সকলি পেতেছি।।


বন্ধ-চোখে যে ব্রহ্মকে দেখিবারে চাও।


সে ব্রহ্ম পারে না কিছু এই কথা লও।।


আর কথা শোন শশী গীতার বচন।


নিজধর্ম্ম শ্রেষ্ঠ জানে যত মহাজন।।


পরধর্ম্ম ভয়াবহ জানিবে ধার্ম্মিক।


নিজধর্ম্মে মৃত্যুভাল এই জানি ঠিক।



No comments: