Saturday, September 19, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 81 মহাসঙ্কীর্ত্তন শ্রীশ্রীহরি আবির্ভাব ও গোপালের “কৃপাসিদ্ধি” লাভ

তবে ত গোপাল একা চলিল দশানী।


মালিকের বাড়ী সেথা সেই কথা জানি।।


বারুজীবি কুলে জন্ম নাম যদুনাথ।


বিশ্বাস উপাধি তাঁর বড়ই বিখ্যাত।।


চন্দ্রনাথ যদুনাথ তৃতীয় শ্রীনাথ।


পরম ধার্ম্মিক তাঁরা জমিদার সৎ।।


চিরদিন গোপালেরে তারা ভালবাসে।


মাঝে মাঝে সে গোপাল রাজ-বাড়ী আসে।।


ক্রমে ক্রমে যদুবাবু শনিলেন কাণে।


গোপাল মেতেছে এবে হরিনাম গানে।।


তাহাতে বড়ই সুখী হ’ল জমিদার।


ধন্য ধন্য সেই ব্যক্তি প্রজা সাধু যারা।।


শ্রীনাথ বাবুর পুত্র শ্রীমহেন্দ্র নাম।


পরম উদার তিনি অতি গুণধাম।।


গোপালেরে দেখে যেন, গোঁসাই ঠাকুর।।”


মহকুমা বাগহাট খুলনা জিলায়।


দশানী নামেতে গ্রামে আছে পরিচয়।।


সেই গ্রামে চলিলেন গোপাল সুধীর।


মুখে নাম অবিরাম চক্ষে বহে নীর।।


সভক্তি প্রণাম করে আসনে বসিল।


জমিদার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিল।।


ক্রমে ক্রমে সব কথা গোপাল জানায়।


জমিদার বলে “কার্য্য বিশেষ অন্যায়।।


আমার নায়েব হয়ে হেন ব্যবহার।


এই দোষে মোর হাতে পাবে না নিস্তার।।

ক্রোধে অগ্নি সম জ্বলে জমিদারগণ।


তখনি নায়েবে দিল করিয়া লিখন।।


“অকারণে গোপালের কর জরিমানা।


তোমার মতন দুষ্ট মোরা রাখিবনা।।


প্রজা তাহা পুত্র তাহা ভেদাভেদ নাই।


দান্ড দাও মোর পুত্রে এতই বড়াই।।


শোনা কথা শোনা নাই-করিনু সাব্যস্ত।


আমাদের কার্য্য হতে তুমি ‘বরখাস্ত।।”


গোপালের সাথে দিল প্যাদা একজন।


সেই পত্র নিয়া দিবে নায়েব-সদন।।


অতঃপর নিজ গৃহে ফিরিল গোপাল।


প্রভুর করুণা ভাবি চক্ষে ঝরে জল।।


প্যাদা আসি উপনীত নায়েবের ঠাঁই।


নায়েব পড়িয়া পত্র ছেড়ে দীর্ঘ হাই।।


চাকুরীটী গেলে তার সংসার বাঁচে না।


রাগ করে আজ তিনি মোটেই নাচে না।।


বাবুর আদেশ মান্য নায়েব করিল।


চাকুরীটা ছেড়ে দিয়ে বাড়ী চলে গেল।।


সংবার জানিয়া তবে পাষন্ডেরা কয়।


“বেশী ঘুষ খাইয়াছে “বাবুরা” নিশ্চয়।।


টাকা খেয়ে গোপালেরে দিয়াছে ছাড়িয়া।


দিনে দিনে গোপাল ত চলিবে বাড়িয়া।।


কি উপায় করা যায় ঠিক কর মনে।


যার যার মনোমত বলে জনে জনে।।


হেনকালে একজনে ডাক দিয়া কয়।


“শোন সবে আমি এক ভেবেছি উপায়।।


শত্রুতা করিয়া তারে মারা নাহি যাবে।


তারে “মার” দিতে হবে ডেকে বন্ধু ভাবে।।


কীর্ত্তন করিতে তারে ডাক’ কোন বাড়ী।


তার সাথে সবে মিলে কর গড়াগড়ি।।


গড়াগড়ি জড়াজড়ি পড়াপড়ি কর।


কীর্ত্তনের ছলে তারে সবে ধরে মার।।”


ধন্য ধন্য করি সবে তাতে দিল সায়।


গোপালের কাছে পরে পাষন্ডেরা যায়।।


প্রসন্ন সুতার নামে লোক একজন।


লহ্মীখালী বাস করে অতি দীনজন।।


তাহার পত্নীর নাম অলকা সুন্দরী।


দৈবেতে কলেরা রোগে প্রাণে গেল মরি।।


পাষন্ডেরা তাতে বলে “এই ত সুযোগ।


কার্য্যসিদ্ধি উপলক্ষ্যে বড় শুভ যোগ।।


বলিয়া কহিয়া সবে গোপালের অন।


রোগী দেখাব ভাব যেন তারে মান।।


রোগী দেখিবারে ছলে আন বাড়ী পরে।


রোগীরে মারিলি কেন? দাবী কর পরে।।


প্রাণ-হীনে প্রাণ ফিরে বল কবে পায়?


গোপালের বাঁধ করেস রোগী-মারা-দায়।।


যথেচ্ছা প্রহার করে করিবে চালান।


খুনী হয়ে জেলে যাবে হবে হতমান।।


সবে সায় এ-মন্ত্রনায় দিলে পরে পরে।


প্রসন্নকে পাঠাইল গোপালেল ধারে।।


যেজন সঁপেছে প্রাণ শ্রীগুরুর পদে।


গুরু তারে রক্ষা কয় গোপালের ঠাঁই।


“দয়া করে মোর গৃহে চলুন গোঁসাই।


আমার পত্নীর আজি কলেরা হয়েছে।


মনে বলে এই যাত্রা বাঁচে কি না বাঁচে।।


তার ইচ্ছা হরিনামে মতুয়া হইবে।


আপনার দেখা পেলে পরাণে বাঁচিবে।।


পরম দয়াল তুমি সবে মোরা জানি।


দয়া করে মোর গৃহে চল গুণমনি।।


এভাবে বিনয় যদি প্রসন্ন করিল।


নির্ম্মল উদার চিত্ত গোপাল ভাবিল।।


পর দুঃখে দুঃখী হতে গুরুর আদেশ।


বিশেষতঃ হরিভক্তহীন এই দেশ।।

 

একে ত দুঃখীর কান্না তাতে হরিনাম।


যাহা করে গুরুচাঁদ স্বীকৃত হলাম।।


প্রকাশ্যে প্রসন্নে বলে “তুমি বাড়ী যাও।


জল ঢেলে সে রোগীরে সিনান করারও।।


এবে অল্প বেলা আছে সন্ধ্যার সময়।


তোমার গৃহেতে আমি হইব উদয়।।


মোর সঙ্গে আর যাবে মতুয়া সুজন।


তব গৃহে সারা রাত্রি করিব কির্ত্তন।।


প্রসন্ন ফিরিয়া গেল আপনার ঘরে।


সব শুনি পাষন্ডেরা এল জোট করে।।


কত কষ্টে মতুয়ারা সে কালে কাটায়।


সংক্ষেপেতে কিছু আমি দিব পরিচয়।।


নদী খাল কেহ তারে পার নাহি করে।


দুর দুর করে গেলে বাড়ীর উপরে।।


ভাই বন্ধু কেহ নাই সকলি বিপক্ষ।


মতুয়ার অভিযোগে নাহি মেল সাক্ষ্য।।


প্রকাশ্যে কীর্ত্তন হলে আর রক্ষা নাই।


রাত্রিকালে কোন গৃহে পাবে নাক ঠাই।।


যথাতথা কটুবাক্য সহে অপমান।


ভিন্ন জাতি সম সবে করে তারে জ্ঞান।।


নিরালে জঙ্গলে তাই মতো বলে হরি।


লোক যদি আসে কাছে থাকে চুপ করি।।


বিপদে অবধি নাই পথে-চলা ভার।


দুষ্টুগণে বলে তারে করিবে সংহার।।


অসহ্য পরীক্ষা তার আসে পদে পদে।


হায় হায় নিরুপায় সদা প্রাণ কাঁদে।।


পলাইয়া যায় সবে বানিয়ারী গ্রামে।


তথা হতে ওড়াকান্দী চলে ক্রমে ক্রমে।।


দুঃখ-অগ্নি দহনেতে চিত্ত সুনির্ম্মল।


তাই পেল ভরা-বুকে প্রমামৃত ফল।।


সে-সব কাহিনী বলে আজ কার্য্য নাই।


অল্পে-অল্পে সে-বৃত্তান্ত ক্ষান্ত করে যাই।।


এবে বলি মূলসূত্র কীর্ত্তনের কথা।


গোপালের গৃহ হতে মতুয়া একতা।।।


যে দিনে প্রসণ্ন আসি বিনয় করিল।


মতুয়ারা প্রায় সবে উপস্থিত ছিল।।


মোট শুদ্ধ জন দশ মতুয়া গণনা।


এর বেশি সংখ্যা মতো তখনে ছিলনা।।


গোপাল সকলে বলে শুন সবে ভাই।


প্রাণ দিয়ে হরিচাঁদে আজ ডাকা চাই।।


কি জানি কি দুষ্ট ছল গ্রাম্য লোকে করে।


বিশেষতঃ যাইতেছি তাহাদের ঘরে।।


বিপদ জান’ত সবে থাকে পায়-পায়।


কি জানি কি ইচ্ছা আজ করে ইচ্ছাময়।।


আর কথা শোন বলি মনে যাহা আসে।


কোন ভাবে হরিনাম করিবে বিশেষে।।


এই দেহে প্রাণ নাহি রবে চিরদিন।


কোন ভাবে কাটা যায় জনমের ঋণ।।


অবশ্য মরিতে হবে ইহা নহে ভুল।


এক চিন্তা তাই সবে মনে কর স্থুল।।


মরণ যখনে ধ্রুব কিবা চিন্তা আর?


হরি বলে মর সবে যেতে ভব পার।।


কিবা জানি কোন ভাবে এই প্রাণ যাবে?


হরি বলে মরি যদি তবে কীর্ত্তি রবে।।


“নিশ্চয় মরিব সবে” নাম সংকীর্ত্তনে।


এই ভাবে থাকে যেন সবাকার মনে।।


গোপালের মুখে শুনি এ-সব বারতা।


মতুয়ারা কেন্দে বলে “এই ঠিক কথা।।


প্রাণ দিয়ে সবে আজ বল হরি হরি।


যদ্যপি মরিতে হয় এই ভাবে মরি।।


ডঙ্কা, শিঙ্গা, করতাল আর এক তারা।


কংস কাসি সঙ্গে করে চলে মতুয়ারা।।


অগ্রে চলে শ্রীগোপাল পরেতে মাধব।


পরে পরে চলিলেন মতুয়ারা সব।।

 

রাম বিষ্ণু, শ্রীনাথাদি বেতকাটা বাস।


ঘন ঘন বলে হরি ঘন ছাড়ে শ্বাস।।


হইল প্রহর রাত্রি সবে হেনকালে।


প্রসন্নের বাড়ী ওঠে হরি, হরি বলে।।


প্রাঙ্গণের পরে যবে উপস্থিত হ’ল।


বস্ত্রে-ঢাকা মরা-শব দেখিতে পাইল।।


আর চারিদিকে দেখে বহু লোকজন।


পসন্নের আত্মীয়েরা করিছে ক্রন্দন।।


দেখামাত্র মতুয়ারা বুঝিলেন সার।


আজিকার এ-বিপদে নাহিক উদ্ধার।।


কূট-চক্র-জালে-বেড়া মতুয়ার গণ।


মনে ভাবে “আজ বুঝি নিশ্চয় মরণ।।


গোপালের গৃহে বসি যেই কথা হ;ল।


সেই কথা মতুয়ারা স্মরণ করিল।।


বিপদ দেখিয়া বুকে এল মহাবল।


এক সঙ্গে ধ্বনি করে বল হরি বল।।”


গোপাল ডাকিয়া বলে প্রসন্নের ঠাই।


‘বসিতে বিছানা কিছু দেহ’ত মশাই।।


অন্য কোন কথা মোবে না কহিব।


বসে বসে সারারাত্রি হরিনাম লব।।


প্রসন্ন বলিল “সব পরে দেখা যাবে।।”


কাছে ছিল পাষন্ডেরা তারা বলে ‘তাই।


আগে তুমি কর যাহা বলিছে গোঁসাই।।


সে দিনে সেখানে ঘটে যে-সব ঘটনা।


সাধ্য নাই লিখি তার ক্ষুদ্র এক কণা।।


একে মোর প্রাণে নাই কোন কবি-শক্তি।


তাতে ভাব-ছাড়া চিত্তে নাহি কিছু ভক্তি।।


আমার সাধ্যেতে নহে সে-সব বর্ণনা।


শুধু মাত্র যাই লিখি ঘটনার কণা।।


বুকে যাহা ওঠে ফুটে মুখে ফোটে কই?


লেখনী আসাড় হ’ল তাই বসে রই।।


বুকে যেই ঢেউ উঠে তার কিছু টুকু।


পারে’ত লেখনী মোর সে-টুকু লিখুক।।


অসীমের ঢেউ যাহা “ভাব” তার নাম।


ভাষায় বাঁধিতে তারে হই ব্যর্থকাম।।


লেখনী আর্ধেক বটে ভাষা হতে লয়।


“ভাব” আর “লেখা” এত দূরে দূরে রয়।।


“লিপি” শুধু “ভাবে” যেতে বর্ণ পরিচয়।


কবিতা-কুসুম-রাজ্য বহু দূরে হায়।।


তবে বটে আদিক্ষেত্রে লিপি প্রয়োজন।


লিপি ধরি রস-লিপ্সু করিবে চয়ন।।


“ভাব-রাজ্যে” যেথা আছে তাম্ররস সুধা।


সেথা গিয়ে রসিকের মিটে যাবে ক্ষুধা।।


রসিকের পদে তাই করি নিবেদন।


শুষ্ক শব্দ গ্রন্থি মোর করুন গ্রহণ।।


আপনার চিত্ত রসে ভিজায়ে তাহারে।


দেখুন আনন্দ তাতে দিলে দিতে পারে।।


কোন কিছু দেখিবারে মোর সাধ্য নাই।


আপন অন্তরে চিত্র দেখুন সবাই।।


এক পাশে বসিয়াছে মতুয়ার গন।


বিপদ রাক্ষসী আসে মেলিয়া বদন।।


সম্মুখে বসনে-ঢাকা মৃতা নারী দেহ।


চারিদিকে পাষন্ডেরা-বন্ধু নহে কেহ।।


ঘোর অমানিশা তাহে ঘন অন্ধকার।


অল্প সংখ্যা মতুয়ারা-বিপক্ষে বিস্তার।।


প্রলয়ের পূর্ব্বে যেন নিস্তব্ধ প্রকৃতি।


স্তব্ধ চলে পাষন্ডেরা ভীষণ মূরতি।।


বারুদের স্তুপ যেন রয়েছে সাজানো।


বাকী শুধু এতটুকু আগুন লাগানো।।


অথবা অকুল সিন্ধু মাঝে যথা তরী।


প্রবল বাত্যায় নাড়ে আছাড়ি পাছাড়ি।।


ভয়াকুল দাঁড়িকুল দাঁড় টানে বসে।


মনে হয় তরী ডুবে চক্ষের নিমেষে।।

 

ততোধিক বিপদেতে পড়িল গোপাল।


মনে মনে কেন্দে বলে “কোথায় দয়াল।।”


এই কি তোমার ইচ্ছা আনিয়া বিজনে।


কেড়ে নেবে মূল্যহীন এই ক্ষুদ্র প্রাণে?


তাতে যদি সুখী হও কোন দুঃখ নাই।


তুমি সুখী হও বাবা তাই আমি চাই।।


তোমার ইচ্ছায় বাবা সৃষ্টি, স্থিতি, লয়।


কর তুমি যাহা ইচ্ছা ওগো ইচ্ছাময়।।


যে-ভাবে রেখেছ তুমি তাতে মনে হয়।


এই প্রাণ নেবে আজি তুমি ইচ্ছাময়।।


তবে কেন আর বৃথা কালক্ষয় করি।


দেহ ছাড়ি দয়াময় বলে হরি হরি।।


যেই নাম সেই তুমি নাম-রূপ হরি।


তোমাকে ডাকিয়া হরি, তোমাতেই মরি।।”’


এত ভাবি সে-গোপাল সঙ্গিগণ কয়।


“প্রাণ ভরি, বল হরি নাহিক সময়।।


এখানের ভাব যাহা বুঝেছ অন্তরে।


এস সবে হরি বলে যাই তবে মরে।।”


সঙ্গী দলে তাতে বলে “কোন চিন্তা নাই।


যদি মরি-হরি বলে সবে মর্ত্তে চাই।।”


এত বলি মতুয়ারা ধরিলেন গান।


গানে যেন সারা-বিশ্বে বহিল উজান।।


মরণ-যাত্রীর সুখে ভাব-মাখা-সুরে।


উঠিল প্রেমের বন্যা লহরে লহরে।।


পদমাত্র শুন সবে গাছে যেই গান।


“আমার প্রাণ বাঁচাওরে দয়াল।


তোমায় না দেখিলে প্রাণ আমার বাঁচেনারে”


দেশ কাল পাত্র তোতে ভকত-হৃদয়।


গান যেন ভেসে ভেসে কোন দেশে যায়।।


যে ডাকে ডাকিল তাঁরে ভকত প্রহলাদ।


যার ডাকে পায় হরি পরম আহলাদ।।


সেই ডাকে বনে বনে ধ্রুব ডাকে তাঁরে।


যে ডাকে রাখিল হরি ভক্ত সুধম্বারে।।


সেই ডাকে মতুয়ারা ডাকে সেই দিনে।


আপনি নাড়িল হরি ক্ষীরোদ শয়নে।।


নাম রূপে ভক্ত দেহে হল আবির্ভূত।


উঠিল কীর্ত্তনে ঢেউ অদ্ভুত-অদ্ভুত।।


কোথা গেল কংস-কাসি কোথা করতাল।


শুধু মাত্র ধ্বনি শুনি ‘বল হরি বল।।”


আসিল নামের ঢেউ জগৎ ডাবায়ে।


পাপী তাপী সবে নাচে আপনা ভুলিয়ে।।


রুদ্র-রসে শ্রীগোপাল দিল এক লম্ফ।


ধরা নড়ে টল টল যেন ভূমিকম্প।।


বীর রসে ভক্ত গণে লম্ফ ঝম্ফ দেয়।


হেন কালে দেখ সেথা কোন ভাব হয়।।


দয়াময় হরিচাঁদ আবির্ভূত হল।


প্রসন্নেরে ভর করি কীর্ত্তনে নামিল।।


মহাভাবে সে প্রসন্ন ডাক দিয়া কয়।


“আয় তোরা বল হরি কে আছিল কোথায়?”


পলকে সকলে দেখ সে-প্রসন্ন নাই।


“মূর্তি োমন্ত বীর্য্যবন্ত” সবে দেখে তাই।।


হরি আগমনে তবে কীর্ত্তন থামিল।


ধরায় পড়িয়া সবে ম’তোরা কান্দিল।।


গোপালে ডাকিয়া বলে “আহারে গোপাল।


তুমি দেখি সখা মোর নন্দের দুলাল।।।


তোমার কীর্ত্তনে আমি বড় শান্তি পাই।


কিন্তু এক কাজ ভুল বলিতেছি তাই।।


মহাশক্তিশালী বটে এই হরি নাম।


যে যাহা কামনা করে পূরে মনস্কাম।।


কোন ভাবে নাম নিলে নামে ফল দেয়।


শুনি বলি সেই কথা বলিব তোমায়।।


আসতের সঙ্গ ছাড়ি কর হরি নাম।


নামে দিবে প্রেমসুধা পূর্ণ মনস্কাম।।

 

এই খানে দেখ কত আসিয়াছে ভক্ত।


ভকতে মরিতে চায় এমনি পাষন্ড।।


এরা যেথা থাকে সেথা নাম নাহি ফলে।


ভবিষ্যতে অসরেতে নিয়োনা আর দলে।।


আবির্ভাবে হরি যদি এই কথা কয়।


ক্রোধে জ্বলে ওঠে যত পাষন্ড নিচয়।।


তারা ভাবে ভাব ধরে প্রসন্ন সুতার।


তাহাদিগে এই ভাবে করে তিরস্কার।।


গোপালে প্রসন্ন সবে মারিবার তরে।


তলে তলে পাষন্ডেরা ষড়যন্ত্র করে।।


এদিকে গোপাল কেন্দে পড়িল ধরায়।


বলে বাবা এ নারীর কি হবে উপায়।।


মরিয়াছে বহুক্ষণ দেহে প্রাণ নাই।


কেমনে বাঁচিবে মরা বলে দেহ তাই।।


কেবা তুমি আসিয়াছ আমি নাহি চিনি।


ভাবে বুঝি তুমি মোর হরি গুণমনি।।


দয়া করি রক্ষা যদি করিলে আমায়।


এ মরা বাঁচায়ে দেও ওগো দয়াময়।।


ভকত-রঞ্জন তবে বলিল হাসিয়া।।


“অচেনা কেমনে থাকি এখানে আসিয়া?


ক্ষীরোদ শয়নে আমি আছি সদাকাল।


এবে ওড়াকান্দী আছি শুন হে গোপাল।।


আর আর কথা যাহা এবে নাহি কব।


অগ্রভাগে মরা নারী বাঁচাইয়া লব।।


এত বলি বস্ত্র ফেলি দয়াময় হরি।


উঠাইল সে নারীকে হস্তে কেশ ধরি।।


প্রচন্ড চপেটাঘাত করে তার পিছে।


অন্য হাতে চুল তার ধরা থাকে মুঠে।।


বজ্রস্বরে কেহ তারে “ওরে রে পাপীনি।


এতক্ষণ শুয়ে রলি কোন ভাবে শুনি?


ওঠ ওঠ জাগ জাগ দ্যাখ চক্ষু মেলে।


এসেছে গোপাল সাধু হরি হরি বলে।।

 

এই ভাবে কথা কয় সেই মহাবল।


অলকা কান্দিয়া বলে “মোরে দেও জল।।”


মরা-নারী প্রাণ পেয়ে উঠিল যখনি।


গোপাল ধূলায় পড়ে কান্দিয়া তখনি।।


যত নর নারী ছিল গড়াগড়ি করে।


পাষন্ডেরা দেখে সব থাকিয়া অন্তরে।।


হরি বলে “রোগে বিধি আমি নাহি দিব।


যা’ বলে গোপাল আমি তাহাতে থাকিব।।


গোপাল চাহিয়া বলে “রোগে দাও বিধি।”


গোপালে কান্দিয়া বলে “বিধাতার বিধি।।


বিধির বিধানে যাহা কভু লেখে নাই।


যাঁর কৃপা ক্রমে আজ চক্ষে দেখি তাই।।


“বিধাতার বিধি” তুমি নাহিক সন্দেহ।


আমি কি বলিব প্রভু সব তুমি কহ।।”


হরি বলে “যা বলিব সকলি বলেছি।


তুমি যাহা কহ আমি তার মধ্যে আছি।।


বল বল কাল ক্ষয়ে আছে কিবা ফল।


চেয়ে দেখ রোগী তব চাহিতেছে জল।।”


এত যেদি বলে হরি গোপালের কাছে।


গোপাল দেখা’য়ে বলে “ডাব আছে গাছে।।


ডাব পেড়ে জল দাও তাতে সুস্থ হবে।


রোগ ব্যাধি দুর্ব্বলতা সব চলে যাবে।।


অভূত অপূর্ব্ব লীলা করে দয়াময়।


স্বচক্ষে দেখিল যারা তারা ইহা কয়।।


বার তের হাত দীর্ঘ নারিকেল গাছ।


উর্দ্ধদেশ ফল তার নহে কাছে-কাছ।।


মহাশক্তিধারী হরি হস্ত বাড়াইল।


অনায়াসে এব ডাক পেড়ে এনে দিল।।


এক হাতে রাখি ডাব অন্য হাত দিয়া।


কাটিলেন ডাব কিছু হাতে না লইয়া।।


অলকা খাইল জল ব্যাধি গেল দূরে।


কান্দিয়া অলকা পড়ে ধূলি শয্যাপরে।।

কেন্দে কয় “দয়াময় অবলা রমণী।


তোমার লীলার তত্ত্ব কিছু নাহি জানি।।


মরণের ঘর হতে আনিলে ফিরায়ে।


তোমারে পূজিব বাবা কি কথা বলিয়ে?”


এই ভাবে সে অলকা কান্দে ফুলে ফুলে।


পুনরায় দয়াময় ধরে তার চুলে।।


ক্রোধ ভরে বলে তারে “ওরেরে পাপিষ্ঠা।


জল খেয়ে বল পেয়ে গেছে বুঝি তেষ্টা।।


“নাকি সুরে” কাঁদাকাট শিখিয়াছ ভাল।


জ্ঞান আছে এ দিকেতে রাত কত হল?


অভূক্ত সাধুরা সবে বসিয়া উঠানে।


শ্রীঘ্র করে ভাত রেঁধে এনেদে এখানে।।”


প্রভুর বচনে তবে অলকা উঠিল।


গোপালের কাছে হরি আপনি বসিল।।


ক্ষণ পরে সে-অলকা আসিল বাহিরে।


কেন্দে কেন্দ বলিতেছে ভেসে অশ্রুনীরে।।


“এক কণা চাল বাবা মোর ঘরে নাই।


কোথা পাব, কি রাঁধিব বল বাবা তাই।।”


প্রভু বরে “হে গোপাল! থাক বসে কেনে?


অলকা চাহিল চা’ল চাল দাও এনে।।”


প্রভুর হুকুমে শুনি গোপাল ভাবিল।


আশ্চর্য্য এ সব কান্ড যেখানে ঘটিল।।


যেখানে এসেছে হরি ক্ষীরোদ বিহারী।


সেইখানে কোন কাজে কিবা শঙ্কা করি।।


অকস্মাৎ চিত্তে তাঁর উঠিল যুকতি।


আমি জানি প্রভু মোর কমলার পতি।।


যেই পদ সযতনে লহ্মী সেবা করে।


সেই পদ রাখে প্রভু এ ধূলির পরে।।


ইহা আজি নহে ধূলা পরম-পদার্থ।


ইথে আছে সর্ব্বধন বুঝিলাম তত্ত্ব।।


যেই খানে পদ রেখে প্রভু বসে ছিল।


তথা হতে শ্রীগোপাল মুষ্টি-ধূলা নিল।।


অলাকরে ডাকি বলে “শুন গো জননী।


ধান-ভানা চাল কোথা আমি নাহি জানি।।


সর্ব্বফল দাতা যাহা সেই পদধূলি।


দিতেছি তোমার হাতে হরি হরি বলি।।


উনানে তাতিয়া জল হাড়ির ভিতরে।


হরি বলে এই দ্রব্য দেও তাতে ছেড়ে।।


যাঁর স্পর্শে মরা দেহে পেয়ে গেলে প্রাণ।


তাঁর পদধূলি আজ দিবে অন্নদান।।”


প্রেম ভরে সে অলকা ধূলি নিয়ে গেল।


গোপালের আজ্ঞামত জল মধ্যে দিল।।


ঢাকিয়া হাঁড়িয়া মুখ করজোড়ে কান্দে।


এদিকেতে কথা হরি বলেছে আনন্দে।।


হেন কালে দেখ কান্ড বড়ই অদ্ভুত।


এক স্থানে পাষন্ডেরা আছিল মজুত।।


হরিকে মারিতে যারা করেছিল মন।


অকস্মাৎ কেন্দে তারা উঠিল তখন।।


হস্ত পদ তাহাদের দেখিতে দেখিতে।


অতিশয় বেদনায় লাগিল ফুলিতে।।


দারুণ ব্যথার দাপে প্রাণ ফেটে যায়।


নিরুপায় হয়ে পড়ে শ্রীহরির পায়।।


হরি বলে “ওরে ওরে পাষন্ড দেমাকী।


কোন দোষে এই হ’ল খুলে বল দেখি।।”


প্রাণ যায়! নিরুপায়! পাষন্ড সকলে।


পূর্ব্বাপর সব কথা বলে প্রভু স্থলে।।


কি ভাবে গোপালে সবে মারিতে চাহিল।


পূর্ব্বাপর সব কথা খুলিয়া বলিল।।


শেষ ভাগে কোন ভাবে ষড়যন্ত্র করে।


সব কথা খুলে বলে প্রভুর গোচরে।।


প্রভু বরে “যাহা বলে গোপাল সুজন।


তাতে মুক্তি পাবি সবে বলিনু কারণ।।”


গোপালের পেদে পড়ে কাঁদা কাঁদি করে।


গোপাল বলিল তবে ডাকিয়া সবারে।।

“হরিভক্ত যেইখানে করয় কীর্ত্তন।


আপনি দয়াল হরি করে আগমন।।


কীর্ত্তনের ধুলি তাতে মহাশক্তিশালী।


সর্ব্ব ব্যাধি দূর তাতে আমি ইহা বলি।।


ভক্তি করে কীর্ত্তনের ধুলি মাখা অঙ্গে।


রোগ পীড়া যত কিছু যাবে সঙ্গে সঙ্গে।।


তবেত পাষন্ড সবে ধূলাতে লুটাল।


পলকের মধ্যে রোগ দূরে চলে গেল।।


হেনকালে এক ব্যক্তি কান্দিতে কান্দিতে।


গড়াগড়ি করে পড়ি ধূলি মধ্যেতে।।


গোপাল ডাকিয়া বলে “তুমি কান্দ কেন?


সে বলে দয়াল তুমি সকলি ত জান।।


সপ্তাহ পূর্ব্বেতে মোর মরেছে নন্দন।।”


দয়া করে প্রাণদান কর মহাজন।।”


শ্রীহরি ডাকিয়া বলে “দেহ কোথা আছে?


যদি থাকে তারে এনে দে রে মোর কাছে।।


শ্মশানের পানে পরে সেই ব্যক্তি ধায়।


দেহ-অংশ কোন খানে কিছু নাহি পায়।।


ফিরিয়া আসিয়া পরে করে নিবেদন।


“দেহাংশ কিছুই প্রভু মিলেনা এখন।।


প্রভু বলে “ভাগ্যহীন চুপ করে থাক।


দেহ যার নাই হেথা সেই চলে যাক।।”


এমত সময় এল অলকা সুন্দরী।


বলিছে প্রভুর অগ্রে করজোড় করি।।


“তোমার দয়ায় বাবা প্রসাদান্ন হল।


কোথায় প্রসাদ দিব তাই মোরে বল।।”


শুনিয়া বিস্মিত যত উপস্থিত জনে।


তারা ভাবে এই কার্য্য হইল কেমনে?


বিনা চালে অন্ন হল মরা-দেহে প্রাণ।


উঠিল ভাবের বন্যা প্রেমের তুফান।।


ভক্তাভক্ত, কি পাষন্ড যতজন ছিল।


ভূমিতলে পড়ে সবে গড়াগড়ি দিল।।


কি যে হল কে যে এল বুঝিতে না পারে।


এসব দেখিছে যেন সবে স্প্ন ঘোরে।।


হেনকালে গোপালের করে ধরি কর।


শ্রীহরি চলিয়া গেল বনের ভিতর।।


ক্ষণ পরে লক্ষ্য করে দেখিল সবাই।


প্রভু আর শ্রীগোপাল সেইখানে নাই।।


বন অন্তরালে বসি কোন কথা হল।


পৃথিবীর নরনারী কিছু না জানিল।।


অল্প পরে দুই প্রভু আসিলেন ফিরে।


হরি-শক্তি ছেড়ে গেল সেই প্রসন্নেরে।।


হত-জ্ঞান সে-প্রসন্ন পড়ে ভূমিতলে।


ক্ষণ পরে জ্ঞান পেয়ে হরি হরি বলে।।


কীর্ত্তনের ধূলি দিয়ে পে প্রসাদ হল।


আনন্দে সকলে সেই প্রসাদান্ন খেল।।


এই ভাবে শ্রীগোপাল হল “কৃপা-সিদ্ধি।।”


দিনে দিনে সেই ভাব ক্রমে হয় বৃদ্ধি।।


শ্রীহরি ডাকিল তাঁর শ্রীগোপাল সাধু।


সে নামে বিখ্যাত হল পিয়ে প্রেম-মধু।।।


এবে বলি শুন আর কোন শক্তি পায়।


কোন শক্তি বলে গুরুচাঁদ ধরা দেয়?

 

No comments: