Friday, September 18, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 80 গোপাল সাধু “মুকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘায়তে গিরিম” ……স্তবমালা

“মুকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘায়তে গিরিম” ……স্তবমালা


“And lo! the spirit of the Lord descend


on him as a dove”- The Holy Bible


জিলার দক্ষিণ প্রান্তে ক্ষুদ্র এক গামে।


জন্মিল পুরুষ এক শ্রীগোপাল নামে।।


লহ্মীখালী নামে গ্রামে খুলনা জিলায়।


বার শত আশী সালে আসি জন্ম লয়।।


হিন্দুবংশে অবতৎস নমঃশূদ্র জাতি।


মাতা’ল জগৎজীবে হরি নামে মাতি।।


পিতা তাঁর স্তব্ধ, শান্ত শ্রীরাম চরণ।


উপাধি হাওলাদার-ধনী একজন।।


মাতা তাঁর কালী দেবী সাব্ধী সতী অতি।


মহাসুখে পতি সহ করেন বসতি।।


রাম চাঁদ, জয়ধর সহোদর ভাই।


ভ্রাতৃ-প্রেমে বাস করে ভিন্ন ভাব নাই।।


আদিবাস করে দোঁহে বেতকাটা গ্রাম।


সেই গ্রামে বিভা কৈল রাম গুণ ধাম।।


রামধন হালদার অতি মহাশয়।


তাঁর ঘরে দুই কন্যা আসি জন্ম লয়।।


দুই পুত্র নিলমণি আর সোণারাম।


মহাসুখে বাস করে সেই গুণধাম।।


শ্রীরামচরণে দেখি অতি গুণবান।


পরম আদরে কন্যা করিলেন দান।।


বিভা-পূর্ব্বে বামচাঁদ লহ্মীখালী যায়।


জমিদার হ’তে বহু ভূ-সম্পত্তি পায়।।


বড়ই তেজস্বী ছিল সে রাম চরণ।


মিথ্যাকথা জুয়াচুরী জানেনা কখন।।


পবিত্র চরিত্র তাতে সদা সত্য বাদী।


সেই হেতু শ্রীগোপালে দান কৈল বিধি।।


অবলা সরলা মাতা কালী নাম ধরে।


শ্রীগোপালে কোলে পে’ল পতি-পূজা করে।।


পতি সতী এক সেঙ্গ কৃষ্ণ গুণ গায়।


‘কৃষ্ণ’ ‘কৃষ্ণ’ বলে চক্ষে ধারা বয়ে যায়।।


এমন জনক যেথা জননী এমন।


সেথা কেন আসিবে না সাধু মহাজন?


বার শত আশী সালে শুভ প্রাতঃ কালে।


নামিল গোপালচন্দ্র ধরণীর কোলে।।


বিস্তৃত জীবন কথা আজি নাহি বলি।


গ্রন্থের ভাবের ভাবে ভাব ধরে চলি।।


গুরুর দয়ায় যদি কাল ভবিষ্যতে।


পারি যদি কথা তাঁর কর ভালমতে।।


এবে শুন সংক্ষেপেতে যাহা বিবরণ।


করিলেন শ্রীগোপাল জনম গ্রহণ।।


বাল্যকালে বিদ্যা শিক্ষা হ’ল বাংলা মতে।


মন ব্যস্ত থাকে সদা গোধন চরাতে।।


গোধন চরাবে কিবা বনমধ্যে বসি।


ক্ষণে চিন্তা করি কান্দে ক্ষণে উঠে হাসি।।


আপনার মনে গাভী চরিয়া বেড়ায়।


কার কোন দ্রব্য ক্ষতি করেনা কোথায়।।


জন্মিল কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীমাধব নাম।


কৈশোর বয়সে ত্যাগ করে ধরাধাম।।


বয়সে ষোড়শ বর্ষ পরিপূর্ণ হ’ল।


শ্রীরাম আপন পুত্রে বিভা করাইল।।


আড়ংঘাটা গ্রামে বাস শ্রীগোবিন্দ নাম।


তাঁর কন্যাসহ বিভা বিদল গুণধাম।।


ভগবতী তূল্য রূপ করুণ চাহনি।


মাতৃ-মূর্ত্তি মহাসতী কাঞ্চন জননী।।


কণক-বরণী মাতা শ্রীকাঞ্চনময়ী।


কোটি কোটি দন্ডবৎ সেই পদে হই।।


গোপালের শ্যালিকা এক নামেতে কামিনী।


ওড়াকান্দী হরিভক্ত একজন তিনি।।


বিবাহের রাত্রি গতে প্রফুল্ল ঊষায়।


“ঝারি” হাতে সে গোপাল পায়খানা য়ায়।।


নির্ম্মল তরুণ ঊষা বহিছে মলয়।


আপনা আপনি যেন মন খুলে যায়।।


হেনকালে সে কামিনী সুললিত স্বরে।


পরাণ খুলিয়া ঘরে বসে গান করে।।


কে-যেন টানিছে তারে ধরে মনপ্রাণ।


তাঁরে বিনে বৃথা যেন জাতি কুল মান।।


পরাণে-পরাণে টানে চোখে নাহি দেখা।


চোখে মুখে ওঠে জেগে বিরহের রেখা।।


কামিনী গাহিল গান ব্যথা-ভরা মনে।


পদ-মাত্র উল্লিখিত করিনু এখানে।।


“করেব যা’ব ওড়াকান্দী,


ও ঘরে রয়না আমার মন।।”


মানব-প্রতৃতি কি যে বুঝিয়া না পাই।


সে-যেন কাহারে চেয়ে সদা ছাড়ে হাই।।


সারা-জন্ম কারে যেন করিছে তালাস।


যত-কিছু পাক তাতে সেটে না’ক আশ।।


সত্য বটে জগতের যত সমারোহ।


মানব চিত্তকে ঢেলে রাখে অহরহ।।


কিন্তু সমারোহ যবে অবসান হয়।


মন কেন্দে বলে ওঠে “সে তোর কোথায়?”


বিরহ তারাতে তাই বেজে ওঠে সুর।


ব্যথা দিয়ে মাথা তাহা কত যে মধুর।।


সেই সুরে কত জনে ঘর ছেড়ে যায়।


“দরদী” তালাস করে সারা বিশ্বময়।।


বিবাহের করলোলে মন ডুবে ছিল।


কলরোল শেষ হলে বিরহ বাজিল।।


পরাণ কান্দিয়া ওঠে “প্রাণবন্ধু!” বলে।


ওড়াকান্দী ভিন্ন তাঁরে কোথা গেলে মেলে??


এ যেন বিরহী যক্ষ রামগিরি শিরে।


বিরহিণী গোপী যেন যমুনার তীরে।।


পরাণ-বান্ধব হরি! আজি তুমি কই?


তুমি বিনে রাতি দিনে কিবা ল’য়ে রই?


হৃদয়ে আঁধার রাত্রি নাহি আলো-রেখা।


হৃদয় উজল করি এসে দাও দেখা।।


যে-বিরহে গেয়েছিল কবি বিদ্যাপতি।


সে-বিরহ কন্ঠে পেল কামিনী সতী।।

 

 

“আথির যামিনী, তিমির দিগভরি’


বিজুরিক পাতিয়া।


বিদ্যাপতি কহে-হরি বিনে কৈসে,


গোঙ্গায়িবি দিন-রাতিয়া।।”


কামিনীর গানে মুগ্ধ নর নারী সব।


মনে হয় পশু পাখী নাহি করে রব।।


গান শুনি আত্ম-ভোলা কাঞ্চন জননী।


কামিনীর সঙ্গে গান গাহিলা আপনি।।


ভরিল সুরের রেশ আকাশে বাতাসে।


গোপাল শুনিল গান পায়খানা বসে।।


কিবা সে পরাণ-হারী সুরের লহরী।


পলকেতে মন প্রাণ সব নিল হরি।।


সে-যে কি দারুণ ব্যথা উঠিল হৃদয়।


মনে হয় বুক ভেঙ্গে প্রাণ বাহিরায়।।


অকারণে ঝর ঝর চক্ষে ঝরে বারি।


কান্দিল গোপাল সেথা মন প্রাণ ভরি।।


‘ওড়াকান্দী’ ‘ওড়াকান্দী’ কিবা শুনিলাম।


ওড়াকান্দী কিবা আছে নাহি বুঝিলাম।।


কিছু পরে সে-কামিনী গান বন্ধ কৈল।


মোহন মুরলী যেন নীরব হইল।।


পায়খানা হতে ফিরে আসিল গোপাল।


সবে দেখে গোপালের দুই চক্ষে জল।।


কামিনীর কাছে বলে গোপাল সুজন।


“দয়া করে” বল দিদি সব বিবরণ।।


ওড়াকান্দী কিবা আছে গাও কার গান?


গান শুনে কেন্দে কেন্দে ওঠে কেন প্রাণ?


কে শিখা’ল এই গান কোথা তাঁর ঘর?


কোথা গেলে বল দেখা পা’ব আমি তাঁর।।


আকুল করেছে মোরে প্রাণ নি’ছে কাড়ি।


পাগল হয়েছে হিয়া মন গেছে উড়ি।।”


বল বল বল মোরে সে মানুষ কোথা?


যাঁর নামে আঁখি ভরে বুজে বাজ্যে ব্যথা।।”


গোপালের ভাব দেখি সে কামিনী কয়।


“শুন ভাই যাহা বলি সত্য পরিচয়।।


ওড়াকান্দী এসেছিল মানুষ রতন।


হরিচাঁদ নাম তাঁর রেশম বরণ।।


তাঁর ভাবে মত্ত যারা তারা এই গাহে।


তাঁর নাম তাঁর গান সকলেরে কহে।।


আমার দেশেতে আছে মতুয়া গণ।


এই গান তারা সবে করে সর্ব্ব ক্ষণ।।


আমি গান শিখিয়াছি তাহাদের কাছে।


এই মত কত শত আর গান আছে।।”


গোপাল বিনয়ে তবে বলে কামিনীরে।


“দয়া করে চল দিদি আমাদের ঘরে।।”


তোমার নিকটে গান চাহি শুনবারে।


ওড়াকান্দী কথা কিছু বলিবে আমাবে।।”


দৈবক্রমে কামিনীর যাওয়া নাহি হ’ল।


বিবাহান্তে সে গোপাল গৃহেতে ফিরিল।।


কামিনীর গান তেঁহ না ভোলে কখন।


মনে ভাবে ওড়াকান্দী করিবে গমন।।


নরে ভাবে ইহা, তাহা, সকলি করিবে।


হবে কিনা হবে তাহা কেমনে বলিবে?


ইচ্ছা ময় ইচ্ছা যদি করে নিজ মনে।


মানবের বাঞ্ছা পূর্ণ হয় সেই ক্ষণে।।


গোপালের বাঞ্ছা তাই পূর্ণ নাহি হ’ল।


সংসার আসিয়া ক্রমে তাঁহাকে ঘিরিল।।


ক্রমে ক্রমে দুই পুত্র জন্মে তাঁর ঘরে।


এক কন্যা নিল জন্ম গৃহ আলো করে।।


জ্যেষ্ঠ পুত্র হরশীত যবে জন্ম লয়।


দৈবের বিধান যাতা কে তারে খন্ডায়


মহাত্মা রামচরণ দেহ রক্ষা করে।


একপুত্র শ্রীগোপালে রাখিয়া সংসারে।।


অপুত্রক জয়ধন থাকে এক সঙ্গে।


পড়িলা গোপাল প্রভু সংসার-তরঙ্গে।।


মেঘ-আবরণে সূর্য্য পড়িলেন ঢাকা।


নীড়ে যেন কান্দে পাখী বন্ধ দুই পাখা।।


হয়ে বন্ধূ ওড়াকান্দী হল বিস্মরণ।


অষ্টাদশ বর্ষ ক্রমে রহে অচেতন।।


হেনকালে ওড়াকান্দী প্রভু গুরুচন্দ্র।


দেশে দেশে দিল ভীর-বাণী বজ্র-মন্দ্রা।।


“কাল ঘুম ছেড়ে জাগ জগতের জীব।


নর কুলে নিয়ে জন্ম কেন হলে ক্লীব?


স্বরগ ছানিয়া সুধা আনিলাম সাথে।


কে কে নিবি ছুটে আয় সময় থাকিতে।।”


ভীর শুনি দলে দলে নর নারী ধায়।


দুরন্ত বাদার লোক কেহ নাহি যায়।।


প্রভু দেখে সবাকারে হবে তরাইতে।


এইবারে কেহ নাহি থাকিবে তফাতে।।


যখনে গেলনা কেহ প্রভু ঠেকে দায়।


আপনার লোকে তাই বাদাতে পাঠায়।।


বানেরী নিবাসী সাধু শ্রীদেবী চরণ।


প্রভুর আজ্ঞাতে এল সেই মহাজন।।


অগ্রদূত হয়ে এল শ্রীগণেশ নাম।


অদি পর্ব্বে সেই গেল লহ্মীখালী ধাম।।।


সে সব বৃত্তান্ত পূর্ব্বে করেছি বর্ণনা।


পুনঃ নাহি সে-সকল করিব যোজনা।।


দেবীচাঁদ গোস্বামীজী বহু শক্তিশালী।


তাহার আদর্শে মাতে ভকত সকলি।।


গোপাল মাতিল আর মাতিল শ্রীনাথ।


মাতিল মাধবচন্দ্র গোপালের সাথ।।


এই তিন জনে হ’ল আদিতে ‘মতুয়া।’


পরে বহু মত্ত হৈল গোপালে ধরিয়া।।


গোপাল মাতিল আর ভকত শ্রীনাথ।


এক সঙ্গে বাণীয়ারী করে যাতায়াত।।


দেবীচাঁদ নিল সবে ওড়াকান্দী ধামে।


দেখিয়া শ্রীগুরুচাঁদে মত্ত হল নামে।।


তৃষিতে-চাতক-হিয়া চাহে চন্দ্র পানে।


আহা কি দেখিল রূপ ভরিয়া নয়নে।।


পাষাণ-প্রাচীরে ঘেরা বারি যেন ছিল।


ব্রজধারী গুরুচাঁদ পাষাণ ভাঙ্গিল।।


কারা মুক্ত ছুটে বারি গর্জ্জন করিয়া।


গেলরে বাদার ‘দেশ’ প্লাবনে ডুবিয়া।।


গোপালে দেখিয়া তাঁর পরম আহলাদ।


আনন্দে নাচিছে তাহে স্বামী দেবীচাঁদ।


গুরু-কৃপা মহাতেজে আসর পুড়িল।


আনন্দে গোপাল বলে “বল হরি বল।।”


হরি বল, হরি বল, হরি হরি বল।


দিবানিশি সমভাবে আঁখি ছল ছল।।


যখনে গোপাল করে নাম সংকীর্ত্তন।


মনে ভাবে ‘হরি বলে ত্যজিবে জীবন।।


যথা মাতে ভীমসেন কুরুক্ষেত্রে রণে।


গোপাল তথা মাতে নাম সংকীর্ত্তনে।।


তেজে তাঁর দূরে রয় বদ্ধ-জীব যারা।


হরি বলে সে গোপাল হয়ে জ্ঞান-হারা।।


সিংহ নাদে সে গোপাল হরি হরি কয়।


মনে হয় সেই ধ্বনি ওড়াকান্দী যায়।।


প্রাণের মমতা ছাড়ি করে হরিনাম।


প্রাণ জুড়ে বসিলেন হরি গুণ ধাম।।


ভকত রঞ্জন হরি ভক্ত দেহে এল।


জড় দেহে গোপালের পূর্নজন্ম হল।।


জগত কহিল তাঁরে ‘শ্রী গোপাল সাধু।


ঘরে ঘরে বিলাইল হরি নাম মধু।।


এবে শুন কোন ভাবে পুর্ণজন্ম হল।


কোন ভাবে সে গোপাল কৃপা-সিদ্ধি পেল।।


ইহার প্রমাণ আছে সে মহাভারতে।


সশরীরে যুধিষ্ঠির যায় স্বর্গ পথে।।


বহুত পরীক্ষা দিল সেই ধর্ম্ম রায়।


সকলি উত্তীর্ণ হল প্রভুর কৃপায়।।

পরিশেষে পুন্যতীর্থে করে স্নান দান।


নরদেহ শুদ্ধ হল শাস্ত্রের প্রমাণ।।


গুরু-কৃপা-তীর্থ জলে গোপাল ডুবিল।


নরদেহে তাই তাঁর পুর্ণজন্ম হল।।


অপূর্ব্ব বারতা সবে শুন দিয়া মন।


অগোচরে লীলা করে মতুয়ার গন।।


গোপালের ভাব দেখি পাষন্ডের রোষ।


দুরে দুরে তারা সবে খোঁজে তার দোষ।।


“দাপাদাপি হুড়াহুড়ি করে রাত্রিদিন।


মতো সেজে বসে আছে যত অর্বাচীন।।


আমরাও জপে থাকি হরিনাম মন্ত্র।


কই তাতে লাগে নাতো ঢাকা ঢোল যন্ত্র।।


হরিনাম নিলে নাকি মরা বেঁচে ওঠে।


যত বেটা মতুয়ারা সেই কথা রটে।।


দেব দেবী মানামানি কোন কিছু নাই।


বাবা হরিচাঁদ বলে সদা ছাড়ে হাই।।


জাতি ধর্ম্ম সব নাশ হবে কালে কালে।


সময় থাকিতে ঠান্ডা কর এই দলে।।


এত বলি পাষন্ডেরা সবে জোট করে।


গোপালকে শাসিবারে নায়েবেরে ধরে।।


সুবর্ণ সুযোগ তাতে আর জুটে গেল।


সেই দিনে দেবচাঁদ লহ্মীখালী এল।।


পাষন্ডেরা বলে গিয়ে নায়েবের ঠাঁই।


“গোপালের গৃহে আজ এসেছে গোঁসাই।।


উভয়েরে ডেকে আন এ কাছারী বাড়ী।


অপমান জরিমানা করে দেও ছাড়ি।।


পেয়াদা পাঠাও তুমি তাদের গোচরে।


ইচ্ছাতে না আসে যদি আন তবে ধরে।।


দশ টাকা নজরানা রাখিলাম মোরা।


আর দশ টাকা দেব কাজ হলে সারা।।


অর্থ লোভে সে নায়েব তাতে রাজি হয়।


গোপালে ধরিতে তবে পেয়াদা পাঠায়।।


পেয়াদা আসিয়া বলে গোপালের ঠাঁই।


“তোমাকে কাছারী আমি দরে নিতে চাই।।


তুমি চল আর সাথে তোমার গোঁসাই।


নায়েবের আজ্ঞা যাহা বলিলাম তাই।।


শুনিয়া গোপাল বলে এ কেমন বার্তা?


যেতে হয় আমি যাব কেন যাবে কর্তা?


যতক্ষণ দেহে মোর আছে মাত্র প্রাণ।


কর্তারে করিতে নাহি দিব অপমান।।


যাহা কিছু কর মোরে তাতে দুঃখ নাই।


আমি একা যাব সঙ্গে যাবেনা গোঁসাই।।


হেন কালে দেবীচাঁদ সেই ঠাঁই এসে।


বলিছে গোপালে ডেকে মৃদু মৃদু ভাসে।।


“কিবা দোষ ও গোপাল আমি সাথে গেলে?


রাজাত প্রজার বাপ-প্রজা তাঁর ছেলে।।


পিতার নিকটে যেতে পুত্রে নাহি ভয়।


চল মোরা এক সাথে যাব সে জাগায়।।”


গোপাল কান্দিয়া বলে “প্রভুহে আমার।


এ-আজ্ঞা পালিতে বাবা পারিনা তোমার।।


তুমি যদি চল সাথে অনর্থ ঘটিবে।


কিজানি কি শেষ কালে লোক খুন হবে।।


যদ্যপি পাষন্ড কেহ নিজ ভাগ্য দোষে।


অপমান করিবারে তব পারে রোষে।।


প্রাণ যায় যাবে তাতে নাহি করি ভয়।


পাষন্ডের প্রাণ নিয়ে ফেলাব ধূলায়।।


তাই বলি দয়াময় শুধু আমি যাই।


তোমার করুণা গুণে কোন ভয় নাই।।


তোমার অভয় নাম থাকিলে স্মরণে।


ভয় নাই জলে স্থলে কিংবা রণে বনে।।


শ্রীমুখে করুন আজ্ঞা আমি ঘুরে আসি।


আমার জামীন তুমি আছ দিবানিশি।।


গোপালের বাক্যে তব গোস্বামী ফিরিল।


নায়েবের কাছে একা গোপাল চলিল।।

 

এদিকে পাষন্ড সবে করিতেছে সায়।


“নায়েবের শাস্তি ছাড়া কিবা করা যায়?


বড় জোর “জুতা-পেটা’ নায়েব করিবে।


কিংবা দুই শত টাকা জরিমাণা চাবে।।


দু’শো টাকা দিতে বটে কষ্ট কিছু হয়।


দশ বিশ ‘জুতা বাড়ী’ সে’ত কিছু নয়।।


বিশ কেন শত ‘জুতা-বাড়ি’ মোরে দাও।


হাসি মুখে মাথা পেতে নিতে পারি তাও।।


এতে বিষ নাহি যাবে লেজে বিষ রয়।


লেজ ছেড়ে বিষ পরে আসিবে মাথায়।।


তাতে বলি বিষধরে কিসের মমতা?


একেবারে দেহ হতে ছিড়ে নেও মাথা।।


এই ভাবে পাষন্ডেরা করিল একতা।


ঠিক হল ভেঙ্গে দেবে গোপালের মাথা।।


খালের নিকট সবে ঝোঁপের আড়ালে।


অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে তারা বসে দুই দলে।।


খালের দক্ষিণ পারে অর্দ্ধ সংখ্যা রয়।


উত্তর পারেতে থাকে আর সমুদয়।।


খালের উপরে রহে বংশ-দন্ড চার।


তাই দিয়ে লোক জনে হয় পারাপার।।


বাড়ী ফিরিবারে জানি সেই মাত্র পথ।


তাই দুই ধারে বসে যতেক অসৎ।।


গোপাল কাছারী গেল ‘অপর’ বেলায়।


ফিরিতে লাগিবে সন্ধ্যাভাবে বোঝা যায়।।


সন্ধ্যার আগেতে জোটে পাষন্ডেরা সব।


ঝোপের আড়ালে থাকে নাহি করে রব।।


অল্প কিছু বেলা আছে এহেন সময়।


গোপাল কাছারি আসি হইল উদয়।।


একক গোপালে দেখি নায়েবের ক্রোধ।


ক্রোধেতে আরক্ত চক্ষু বাক্য হ’ল রোধ।।


গোপাল ভূমিতে পড়ি করিল প্রণাম।


ক্রোধে পূর্ণ নায়েবের দেহে ঝরে ঘাম।।


মৃত্তিকা আসন করি বসিল গোপাল।


নায়েব দাঁড়াল ফিরে মিটাইতে ঝাল।।


ক্রোধ ভরে বলে তাঁকে আরে পাষন্ড।


হুকুম অমান্য করি একা এলি ভন্ড?


বল তোর গুরু কোথা? কোথা রেখে এলি?


ঠিক না বলিলে তোর ভেঙ্গ দেব খুলি।।


বিনয়ে গোপাল বলে “নায়েব মশায়।


আমার গোঁসাই কেন আসিবে হেথায়?


যাহা কিছু আছে দোষ সকলি আমার।


কোন কার্য্যে কোন দোষ নাহিক তাঁহার।।


মোরে নিয়ে যাহা ইচ্ছা কর তুমি তাই।


আমার দোষের শাস্তি নেবে কি গোঁসাই?


গোপালের কথা শুনি নায়েব তখন।


ক্রোধেতে জ্বলিল যেন দীপ্ত হুতাশন।।


একে ত মনসা দেবী তাতে ধূপ-জ্বালা।


অঙ্গ-জ্বলে নায়েবের সেই সন্ধ্যা বেলা।।


আদেশ অমান্য করে আদি অপরাধ।


সম্মুখে আসিয়া করে বাদ-অনুবাদ।।


মহাক্রোধে নায়েবের বুদ্ধি লোপ হল।


“তিন শত জরিমানা নায়েব হাঁকিল।।


কটুত্তর বহুতর করে পরে পরে।


বলে জুতা না মারিনু শুধু দয়া করে।।


শ্রেষ্ঠ প্রজা তোর পিতা ছিল এই দেশে।


তার লাগি ছেড়ে তোরে দিনু ভালবেসে।।


সপ্তাহ কালের মধ্যে জরিমানা চাই।


তারিখ ‘খেলাপ’ হলে আর রক্ষা নাই।।


নায়েবের কথা শুনি হাসিল গোপাল।


মনে মনে হেসে বলে “আহা কি দয়াল।।”


যে ভাবে বাসিলে ভাল নায়েব মশায়।


কি জানি কি পরিণামে কি যেন কি হয়।।”


প্রকাশ্যে তাহারে বলে করজোড় করি।


এখন নায়েব বাবু যেতে আমি পারি?

সামান্য মানুষ আমি তাতে ধন হীন।


মালেকের বাধ্য প্রজা আছি চিরদিন।।


জরিমানা ডাকিয়াছে শুনিলাম তাই।


একবার মালেকের কাছে আমি যাই।।


তাঁর পায়ে নিবেদন আমি করে দেখি।


কিছু জরিমানা মাপ বাবু করে নাকি?


কোন দোষে জরিমানা হয়েছে আমার।


দয়া করে তুমি তাই বল একবার।।”


নায়েব বলিল “দোষ আছে বহুতর।


হরিনাম কর কেন দেশের ভিতর।।


দেব দেবী নাহি মান মান না আচার।


এসব কারণে দন্ড হয়েছে তোমার।।”


গোপাল হাসিয়া বলে “শুনিলাম ভাল।


তাহলে ত হরিনাম দেশ হতে গেল।।


যাহা হয় তাহা হোক আমি তবে আসি।


নাম-করা ছাড়ি কিসে নাম ভালবাসি।।


দেখি জমিদার মোর কোন কথা কয়।


দন্ডবৎ শ্রীচরণে নায়েব মশায়।।”


এত বলি পথ ধরি গোপাল ফিরিল।


সন্ধ্যার আঁধার আসি পৃথিবী ঘিরিল।।


এ দিকেতে দেবী চাঁদ গোস্বামী সুজন।


ইতি উতি ঘুরে সাধু স্থির নহে মন।।


গোপালের সতী নারী কাঞ্চন জননী।


হরশীত, কাশী নামে দুই পুত্র জানি।।


সবে ডাকি বলিতেছে গোস্বামী রতন।


“এসো মোরা সবে মিলি করিব কীর্ত্তন।।


গোপাল গিয়াছে একা রাজার কাছারী।


তাহার মঙ্গল লাগি বল হরি হরি।।


বিপদে বান্ধব কেন নাহি হরি বিনে।


আয় মোরা সে বান্ধবে ডাকি এক মনে।।”


অমৃত-মাথানো সুরে দেবী কথা কয়।


হরশীত কাশী কান্দে কান্দে তার মায়।।


“মাঙ্গালের বন্ধু কোথা রয়েছে বসিয়ে?


করুণ নয়নে প্রভু দেখহে চাহিয়ে।।


আপন বলিতে বাবা, আর কেহ নাই।


অকুল তরঙ্গে পড়ে বুঝি মারা যাই।।


তুমি না করিলে দয়া আর কে করিবে?


তুমি না দেখিলে বাবা আর কে দেখিবে?”


কান্দে সতী কা্ন্দে তাঁর কোল-ভরা শিশু।


সাথে সাথে কান্দিতেছে পাখী আর পশু।।


উঠিল কান্নার ঢেউ আকাশ ভেদিয়া।


গোস্বামীর পদে পড়ে আকুল হইয়া।।


কাঙ্গালের সে-কান্নায় আসন টলিল।


ভকতে রক্ষিতে হরি আপনি আসিল।।


চক্রীর চক্রান্ত বল কে বুঝিতে পারে?


নরাকারে এল হরি পাষন্ডের ধারে।।


খালের উত্তর পারে আগে প্রভু গেল।


পাষন্ডের কাছে গিয়া কহিতে লাগিল।।


“আমি দেখি তোমাদের বুদ্ধি শুদ্ধি নাই।


কোন ভাবে কর কাজ ভাবিয়া না পাই।।”


পাষন্ডের দেখে যেন সাথী একজন।


তাহাদের কাছে আসি কহিছে বচন।।


তারা বলে “কোন কথা এসেছ বলিতে?


প্রভু কয় “কোন কিছু পার না শুনিতে।


অন্ধকারে চোখ কাণ সব বন্ধ হল।


খালের দক্ষিণ পারে শীঘ্র গতি চল।।


দুই পারে দুই দল থাকা ভাল নয়।


এক যোগে কাজ হলে কাজ ভাল হয়।।


বিশেষতঃ দক্ষিণ পারেতে মোরা যারা।


আমরা না করিব কাজ তোমাদের ছাড়া।।


আমাদের কাছ দিয়া আসিবে গোপাল।


দুই দল দুই খালে মাঝখানে খাল।।


যত কিছু কাজ বুঝি করিব আমরা?


বিনা কাজে শেষে বুঝি নাম নিবে তোরা।।

এ সব চালাকী নয় চল এক ঠাঁই।


এক সাথে কাজ হবে তাই মোরা চাই।।


পাষন্ডেরা বলে “তবে চল এক ঠাঁই।


সেই ভাবে কাজ হলে কোন বাধা নাই।।”


উত্তর পারের দল দক্ষিণেতে গেল।


আপনি দয়াল প্রভু অদৃশ্য হইল।।


দক্ষিণপারের দলে বলে “একি কান্ড?


স্থান ছেড়ে এল কেন যত অপগন্ড?”


উত্তর পারের দলে বলে “একি কথা?


ডেকে এনে অপমান? ভেঙ্গে দেব মাথা।।


দক্ষিণ পারের দল বলিছে রাগিয়া।


‘কে এনেছে তোমাদের এখানে ডাকিয়া।


যারা এল তারা বলে “তোমরা ডাকিলে।


তোমাদের একজন ওপারেতে গেলে।।”


তারা বলে “স্থান ছেড়ে কেহ যাই নাই।


যারা এল তারা বলে “মিথ্যুক সবাই।।”


অন্য দলে রেগে বলে “তোরা মিথ্যাবাদী।


মাথা ভেঙ্গে দেব সব কথা বল যদি।।


কথা কাটাকাটি করে দুই দলে মিশে।


একাকী গোপাল তবে সেই পথে আসে।।


হরি যারে রক্ষা করে কেবা তারে মারে?


পাষন্ডেরা একসাথে গোলমাল করে।।


কেবা গেল কেবা এল কোন লক্ষ্য নাই।


গোলমালে মত্ত রল পাষন্ড সবাই।।


গোপাল ফিরিল গৃহে অতি নিরাপদে।


সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করে গোস্বামীর পদে।।


গোপালের দেখিয়া সবে প্রেমে পূর্ণ হল।


হরি বলে তবে সবে কান্দিতে লাগিল।।


সেই ভাবে নিশি ভোর করিল সকলে।


প্রভাতে গোস্বামী তবে গোপালেরে বলে।।


বানীয়ারী এবে আমি চলিব গোপাল।


হরি বলে সবে মিলে থাকিও সামাল।।”


এই ভাবে গোপালের প্রাণ রক্ষা হল।


শ্রীগুরুর কৃপা ধন্য হরি হরি বল।।

 




No comments: