Friday, September 25, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 93 শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের লহ্মীখালী হইতে প্রত্যাগমন

প্রভুর বচন রাশি যেন মধু-পোরা।


নর নারী কেন্দে কেন্দে যেন জ্ঞান-হারা।।


কাঞ্চন জননী প্রতি প্রভু ডাকি কয়।


‘‘বড় ক্ষিদে মাগো তুই খেতে দে আমায়।।


নিষ্ঠুরা জননী তুই দয়া মায়া-হীনা।


ক্ষিদে পেয়ে কান্দে ছেলে খেতে কি দিবিনা।।


বালকের প্রায় প্রভু করিছে কাকুতি।


তাহা শুনি কেন্দে ওঠে শ্রীকাঞ্চন সতী।।


দ্রুত গতি ধায় মাতা রন্ধন শালায়।


স্নান লাগি মহাপ্রভু রাহিরেতে যায়।।


ভক্তগণে জনে জনে স্নান করি আসে।


বিস্তৃত প্রাঙ্গণে সবে আহারেতে বসে।।


উত্তরের ঘরে বসে প্রভু দয়াময়।


স্বহস্তে কাঞ্চন দেবী অন্ন আনি দেয়।।


স্বয়ং লহ্মী করিয়াছে অন্নাদি রন্ধন।


তৃপ্তি সহকারে প্রভু করিল ভোজন।।


প্রসাদ বাঁটিয়া দিল সভার ভিতরে।


কেহ শিরে রাখে তাহা কেহ বক্ষে ধরে।।


এই ভাবে প্রেমানন্দে মহোৎসব হল।


মহাপ্রভু লহ্মীখালী রজনী বঞ্চিল।।


অবিরাম করে নাম ভকতের দল।


আনন্দে সবার চোখে ঝরিতেছে জল।।


গোপালের খুল্লতাত নাম জয়ধর।


সূহ্মজ্ঞানী ছিল তিনি বাক্যে তৎপর।।


গোপালের মামা যার নাম সোনারাম।


সেই মামা এই খুড়া তারা ছিল বাম।।


প্রভুকে দেখিয়া দোঁহে ভাবে মনে মন।


‘‘এমন মানুষ মোরা দেখিনি কখন।।


এতদিন গোপালেরে ভাবিয়াছি মন্দ।


ঠাকুরকে দেখিয়া দূর হল সব সন্দ।।

কুলের গৌরব পুত্র শ্রীগোপাল চন্দ্র।


মোরা ধন্য বংশে পেয়ে হেন কুল-চন্দ্র।।


পুত্র নহে পিতা অদ্য হয়েছে গোপাল।


কেটে গেছে নয়নের কুয়াসার জাল।।


উভয় বংশের ভার দিব যে গোপালে।


ধন্য হবে দুই বংশ গোপালে মানিলে।।


এই ভাবে আলাপন করি দুই জনে।


প্রণাম করিল আসি প্রভুর চরণে।।


প্রভু কয় ‘‘শুন বলি হালদার মশায়।


তোমার সঙ্গেতে পূর্ব্বে হল পরিচয়।।


হাওলাদার জয়ধর গোপালের খুঁড়া।


উভয়ে জ্ঞানেতে শ্রেষ্ঠ বয়সেতে বুড়া।।


ভেবে দেখ দিন বেশী নাহিক সম্মুখে।


সব ফেলে যেতে হবে যথন সে ডাকে।।


জনম ভরিয়া কত করিয়াছ খেলা।


কি কি করে বল দেখি কেটে গেল বেলা।।


শেষ খেয়া-ঘাটে যবে যাইবে দুজনে।


কিবা সাথে নিয়ে যাবে ভেবেছ কি মনে?


পারে যেতে কড়ি লাগে সেই কড়ি কই?


কিছু নিলে হবে নারে হরি নাম বই।।


সে-কড়ির কি-জোগাড় করেছ দুজনে?


কোন দিনে সেই কথা ভেবেছ কি মনে?


প্রভুর বচন শুনি উভয়ে অজ্ঞান।


কেন্দে বলে ‘‘রক্ষা কর ওহে ভগবান।।


মোহের আঁধারে চক্ষু ঢাকা এতদিনে।


দয়া করে জ্ঞান দানে বাঁচালে দুজনে।।


আমাদের কিছু বটে নাহিক সম্বল।


সম্বলের মধ্যে মাত্র আছে শ্রীগোপাল।।


মোরা ধন্য বংশ ধন্য গোপালের গুণে।


গোপালে ধরিয়া যদি পাই তোমা ধনে।।


তোমাকে গোপাল চেনে মোরা নাহি চিনি।


ভরসা গোপাল মাত্র ওহে গুণমণি।।’’


এত বলি উভয়ের চক্ষে ঝরে জল।


মহাপ্রভু বলে ‘‘কথা শুনহে গোপাল।।


তোমার মাতুল আর খুড়া মহাশয়।


উভয়েরে যত্ন করে রাখিও সদায়।।


উভয়েরে ডাকি পরে বলে দয়াময়।


আমার বচন শোন দুই মহাশয়।।


জীবনে গোপালে দোঁহে ছাড়িও না ভুলে।


গোপালের গুণে কুল পাইবে অকুলে।।


তদবধি জয়ধর সব ছেড়ে দিল।


গোপালের সঙ্গে আসি একত্র হইল।।


যাবৎ জীবিত ছিল ছিল একমনে।


গোপাল পালিল তাঁরে পরম যতনে।।


কাঞ্চন জননী দেবী নিজ-মাতা প্রায়।


নিজহস্তে জয়ধরে সেবাদি করয়।।


মহানন্দে জয়ধর সর্ব্বক্ষণে কয়।


‘‘মোর মত সুখী কেহ নাহি এ ধরায়।।


মাতা মোর পূর্ণলহ্মী কাঞ্চন জননী।


গোপাল আমার বাবা ভক্ত শিরোমণী।।


যাহাদের পায়ে আসি সকলে লোটায়।


তারা মোরে যত্ন করে নাওয়ায় খাওয়ায়।।


রাজা মহারাজা নহে আমা হতে ধন্য।


এসব হয়েছে শুধু গোপালের জন্য।।


আমি খুড়া নড়াবড়া কোন গুণ নাই।


তবু দেখ সর্ব্বক্ষণ কত শান্তি পাই।।


ক্ষণে ক্ষণে করি আমি দাদাকে স্মরণ।


ভাবি হায় দাদা যদি থাকিত এখন।।


সাজান বাগানে তার ফলিয়াছে ফল।


সেই ফল ভোগ করি একাই কেবল।।


চিরকাল একসঙ্গে সব করিয়াছি।


দাদা মোরে সব দেছে আমি কি দিয়াছি?’’


এত বলি কান্দিতেন সেই মহাশয়।


নরপতি সমসুখী জীবন সন্ধ্যায়।।

 

বিষয় সম্পত্তির তাঁর যাহা কিছু ছিল।


সনোসুখে সব ধরে গোপালকে দিল।।


পঞ্চদশ বর্ষ পরে সেই মহাশয়।


জীবলীলা সাঙ্গ করি স্বর্গে চলি যায়।।


সংক্ষেপে জীবনী তাঁর করিনু লিখন।


মূল সূত্রে আসি কথা বলিব এখন।।


দুই দিন রহে প্রভু লহ্মীখালী গাঁয়।


লক্ষ লক্ষ লোক এল গোপাল আলয়।।


রাজসুয় যজ্ঞ যথা করে যুধিষ্ঠির।


সেই মত কার্য্য করে গোপাল সুধীর।।


প্রভুর লাগিয়া আনে দ্রব্য সমুদয়।


গুরুর সেবার যোগ্য যাহা মনে লয়।।


বস্ত্র আনে ছত্র আনে থাল থাল বাটি।


বালিশ তোষক আনে শীতল যে পাটি।।


লেপ আনে মূল্যবান ছড়ি একখানি।


জোড়বস্ত্র সবই আনে জোড়ের উড়ানী।।


তৃতীয় দিবসে প্রভু গৃহে যেতে চায়।


গোপাল কান্দিয়া বলে যাহা ইচ্ছা হয়।।


তোমার ইচ্ছায় চলে ব্রহ্মান্ড সকল।


আমার ইচ্ছা যে প্রভু সকলি বিফল।।


দীনে যদি মহামূল্য রত্ন কভু পায়।


সে রত্ন ছাড়িতে কভু প্রাণে কি জুড়ায়।।


অসংখ্য রত্নের খনি আছে চরণে।


সেই প্রভু দয়া করে এসেছে এখানে।।


আমার ইচ্ছাতে প্রভু সব জান তুমি।


যাহা ইচ্ছা কর বাবা কি বলিব আমি।।


প্রভু কয় হে গোপাল মোর বাক্য ধর।


যাহা বলি সেই মত কার্য্য তুমি কর।।


এবাড়ী আমার বাড়ী সকলি আমার।


এসেছি, আসিব হেথা আর কতবার।।


আমি বলি এবাড়িতে আছি সর্ব্বক্ষণে।


বিশ্বাস রাখিলে তুমি দেখিবে নয়নে।।

আর এক কথা বলি রাখিও স্মরণে।


এক কার্য্য আজ আমি করিনু এখানে।।


ওড়াকান্দি এক খুটা আমি রাখিলাম।


অন্য খুটি লহ্মীখালী আমি পুতিলাম।।


প্রহরী সাজিয়া রক্ষা কর এই খুটা।


নিশ্চয় জানিও এই বাক্য নহে ঝুটা।।


প্রভুর বচন শুনি সাষ্টাঙ্গে গোপাল।


ধরায় লুটায়ে পড়ে চক্ষে ঝরে জল।।


কাঞ্চন দেবীরে তবে প্রভু বলে ডাকি।


কি গো মাতা কোন কথা তুমি বল নাকি।।


আমি যাহা বলি তাহা শোন মন দিয়ে।


এই কথা কোন দিনে যেওনাক ভুলে।।


মা বলে ডেকেছি তোমা শোন ঠাকুরাণী।


নারী জাতি আমি কিন্তু বেশী নাহি মানি।।


আমার জননী ছিল দেবী শান্তি মাতা।


তাঁর ছেলে মা মা বলে নহে তুচ্ছ কথা।।


আমার মায়ের মত থাকিও পবিত্র।


সাবধান ইহা নাহি ভুল ক্ষণ মাত্র।।


মাতা কয় ‘‘দয়াময় কিছু নাহি জানি।


কখন ভুলিনা যেন তোমার এ বাণী।।


মম পতি তব দাস যেন সদা রয়।


পতির চরণে যেন মোর মতি ধায়।।


পতি যেন সুখে থাকে হরিভক্ত হয়।


পতি চিন্তা থাকে যেন আমার হৃদয়।।


মাতার বচন শুনি প্রভু বলে ধন্য।


তোমাকে বলেছি মাতা শুধু এই জন্য।।


পতির মঙ্গল চিন্তা সতীর সাধনা।


পতি ভিন্ন সতী নারী কিছুত জানেনা।।


বড়ই আনন্দ হল শুনি তব কথা।


ধন্য সতী নিষ্ঠামতি অতি পতিব্রতা।।


এত বলি দয়াময় বিদায় মাগিল।


হুলুধ্বনি, জয়ধ্বনি সকলে করিল।।

বাড়ী ছাড়ি উঠে প্রভু নৌকার উপর।


গোপাল চলিল সঙ্গে প্রেমে থর থর।।


হেনকালে দেখ এক মধুর ঘটনা।


স্বমুখেতে প্রভু যাহা করিল রটনা।।


প্রভু লাগি যে যে দ্রব্য গোপাল আনিল।


ভক্তগণে বয়ে নিয়ে নৌকাতে রাখিল।।


সকল আনিল বটে রহিয়া সবাই।


তোষকাদি আনিবারে কার মনে নাই।।


কাঞ্চন জননী যবে আসিলেন ফিরে।


দেখিলেন তোষকাদি খাটের উপরে।।


ত্রস্তে-ব্যস্তে সে জননী আপনি তখন।


কক্ষ পরে তোষকাদি করিল গ্রহণ।।


দ্রুত গতি ঘাট প্রতি চলিছে জননী।


ঘাট হতে নৌকা তবে ছাড়িল তখনি।।


সকলে ঘাটের কাছে দাঁড়াইয়া রয়।


ধীরে ধীরে চলে তরী এমন সময়।।


দূর হতে ডাকে মাতা করিয়া মিনতি।


‘‘ক্ষণ মাত্র রাখ’’ নৌকা জগতের পতি।।


তোমার শয্যার সজ্জা সাথে করি লও।


দেয়া দ্রব্য দয়াময় কারে দিয়ে যাও।।


ভাবময় মহাপ্রভু ভাবে বাধ্য রয়।


দাঁড়ি গণে ডেকে বলে প্রভু এ সময়।।


‘‘কুলেতে ভিড়াও তরী কর কিছু দেরী।


দেখ দেখি কে আসিছে এত তাড়াতাড়ি।।


সোণার বরণ দেখি বনদেবী প্রায়।


দেখ দেখি কে আসিছে ছুটিয়া ত্বরায়।।’’


সকলে চাহিয়া তারে চিনিল অমনি।


তারা বলে ‘‘এ যে মাতা কাঞ্চন জননী।।’’


প্রভু কয় হায় হায় মাতা ছোটে কেন?


যাও যাও শীঘ্র শীঘ্র সেই তত্ত্ব জান।।


বলিতে বলিতে মাতা ঘাটেতে উদয়।


প্রচন্ড লেপের বোঝা কক্ষ পরে রয়।।


প্রভু বলে ‘‘কি গো মাতা এত ব্যস্ত কেন?’’


মাতা কয় দয়াময় সব তুমি জান।।’’


তোমার লেপের বোঝা পড়ে ছিল পাছে।


এসব আনিতে সবে ভুল করিয়াছে।।


তোমার লেপের বোঝা আনিয়াছি বয়ে।


দয়া করে এই সব যাও তুমি নিয়ে।।


প্রভু বলে ধন্য ধন্য তুমি সতী মেয়ে।


ভক্তি গুণে তুমি মোরে রাখিলে বান্ধিয়ে।।


দাঁড়ি যারা দ্রুত তারা তোষকাদি নিল।


জয়ধ্বনি করি তবে তরণী ছাড়িল।।


ভোলা নদী ধরি গেল বাদার নিকটে।


পশ্চিমে চলিল নৌকা তারপরে বটে।।


গভীর বনের বাজ্য নদীর কিনারে।


প্রভুর তরণী চলে মধ্যনদী ধরে।।


খড়মা নদীর বুকে তরী চলি যায়।


বামে তরী বাদাবন বটে ঢাকা রয়।।


কিবা সে বাদার শোভা অতি মনোরম।


গাছে গাছে ডালে ডালে নাহি ব্যতিক্রম।।


অনন্ত গাছের সারি মিশেছে অনন্তে।


কে যেন সৃজিল সব বসিয়া একান্তে।।


এক এক জাতি বৃক্ষ রহে এক ঠাঁই।


বৃক্ষতল পরিষ্কার জঙ্গলাদি নাই।।


নদীর কিনারে ঝোঁপ জঙ্গলাদি রয়।


নদী চরে গোলপাতা বিচিত্র শোভায়।।


সুন্দর কিনারে ঝোঁপে গা ঢাকিয়া রয়।


জীবমাত্র নদীতীরে উপস্থিত হয়।।


লষ্ফ দিয়ে ধরে তারে ব্যঘ্র মহাশয়।।


ডাঙ্গায় বাঘের বাসা জলেতে কুমীর।


কোন প্রাণী বাদা মধ্যে নহেক সুস্থির।।


নির্ভয়ে চড়ায় উঠি কুম্ভীর মশায়।


আপন পাষাণ-দেহ রোদ্রেতে শুকায়।।


সবে মিলে এক সাথে করে দরবার।


‘‘দয়া করে দয়াময় চল আর বার।।


শ্রীযাদব ঢালী আর যাদব মল্লিক।


দুই জনে মনে মনে করে এক ঠিক।।


দয়া করে পাতলায় যদি প্রভু যায়।


তথা হতে নিতে তারা পারে নিজালয়।।


ভাবগ্রাহী গুরুচাঁদ ভাব বুঝে মনে।


স্বীকার করিল কথা প্রভু ততক্ষণে।।


যেই কালে এই সব কথাবার্ত্তা হল।


গোপাল বিপিন দোঁহে উপস্থিত ছিল।।


সকলেরে ডাকি প্রভু বলিল তখন।


‘‘পাতলা আসিও সবে শুন ভক্তগন।।


যেই ভাবে ধনঞ্জয় করিয়াছে মন।


মনে হয় রাজসূয় যজ্ঞ আয়োজন।।’’


ভক্তগণে চলি গেল যার যার দেশে।


কয় দিন পরে সেই ধনঞ্জয় আসে।।


যাদব মল্লিক আর শ্রীযাদব ঢালী।


ওড়াকান্দী উপস্থিত হয়ে কুতুহলী।।


প্রভু কয় ‘‘ভাল হ’ল এক সঙ্গে চল।


সবে মিলে পথে পথে কৃষ্ণকথা চল।।’’


যাত্রা করিলেন প্রভু পারিষদ সহ।


আদিত্য সঙ্গেতে তাঁর থাকে অহরহ।।


আদিত্যের পরিচয় সংক্ষেপেতে বলি।


ঘৃতকান্দী জন্ম তাঁর ভক্তি বলে বলী।।


ওড়াকান্দী শ্রীগোপাল করে যাতায়াত।


ঘৃতকান্দী গ্রাম দিয়া আছে তাঁর পথ।।


এই ঘৃতকান্দীবাসী সবে একদিন।


ঠাকুরে না চিনে ছিল অজ্ঞানে মলিন।।


ইহার তুলনা দিব আলোকের সাথে।


দূরেতে আলোর রেখা জ্বলে ভালমতে।।


প্রদীপের তলে দেখ অন্ধকার থাকে।


তলে থেকে কোন ভাবে প্রদীপেরে দেখে?


দ্বিতীয় আলোকে যদি কাছে আন’ তার।


দূর হয় প্রদীপের তলের আন্ধার।।


তল-বাসী সেইকালে দেখে প্রদীপেরে।


ইহা ভিন্ন প্রদীপেরে দেখে কি প্রকারে?


দূর হতে দূরে চলে ঠাকুরের খেলা।


দলে দলে আসে লোকে নামে প্রেমে ভোলা।।


তাহাদের ভাব দেখি ঘৃতকান্দীবাসী।


ক্রমে ক্রমে সেই দলে গেল সব মিশি।।


বিশেষ গোপাল সাধু মহিমা অপার।


নর নারী যায় ভুলে ভাব দেখে তাঁর।।


তিনি আসি ঘৃতকান্দী করিলেন থানা।


তাঁরে দেখে মাতে সব এই আছে জানা।।


শ্রীমধুসূদন নামে বিশ্বাস মশায়।


পরম ভকত তিনি সাধু অতিশয়।।


সাথী তাঁর মজুমদার শ্রীকুঞ্জবিহারী।


এক সঙ্গে যায় আসে ঠাকুরের বাড়ী।।


গুরুচাঁদে বাসে ভাল যায় তাঁর কাছে।


একেবারে মতো নয় মতো ভাবে আছে।।


একদিন গুরুচাঁদ ডাক দিয়া কয়।


‘‘শোন মধু! শোন কুঞ্জ’’ যাহা মনে হয়।।


লতা পাতা বৃক্ষাদিতে গুণ আছে বটে।


চর্ম্ম চক্ষে দেখা তাহা নাহি যায় মোটে।।


স্বাদ মিলে কিছু কিছু হয় পরিচয়।


কিন্তু কতগুণ আছে বোঝা নাহি যায়।।


বৈদ্য যারা দেখ তারা সব গুণ জানে।


ঔষধি বানায় কত বহুৎ বিধানে।।


‘‘মৃত সঞ্জীবনী সুধা’’ করে তাই দিয়ে।


শত শত ব্যাধি দেয় সহজে সারিয়ে।।


বৃক্ষের কি গুণ আছে বৈদ্য তাহা জানে।


বৃক্ষতলে সবে মর্ম্ম বুঝিবে কেমনে?


ভবব্যাধি নিরবধি করিতেছে ক্ষয়।


কেমনে পাইবে রক্ষা উপায় কোথায়?

 

 

ব্যাধি-নাশী বৃক্ষ বটে আছে এই দেশে।


শুধু কি দেখিলে তারে রোগ শোক নাশে?


তাতে যে যে গুণ আছে কর ব্যবহার।


সঞ্জীবনী সুধা কিছু করগে আহার।।


সন্ধান বলিয়া আমি দিব তোমাদেরে।


বেঁচে যাবে ফল পাবে সে-মানুষে ধরে।।


এই যে গোপাল সাধু লহ্মীখালী বাস।


আমি বলি গোপালেরে কারণে বিশ্বাস।।


ভবব্যাধি সারিবারে যে ঔষধ লাগে।


গোপাল রেখেছে তাহা গাঢ় অনুরাগে।।


আমি বলি এক সাথে দোঁহে চলি যাও।


মানুষ ধরিয়া দোঁহে মহাশান্তি পাও।।’’


সেই হতে দুই জন গোপালে ধরিল।


গোপালে ধরিয়া গুরুচাঁদকে চিনিল।।


সুধন্য বাইন ধন্য অতি মহাশয়।


বারুনীতে মতুয়ারা সেই বাড়ী খায়।।


গোপালচাঁদের অতি প্রিয় মহাজন।


তাঁর গৃহে শ্রীগোপাল যায় ঘন ঘন।।


সরল সহজ সাধু রাধানাথ নাম।


উপাধি মজুমদার অতি গুণ ধাম।।


কুমুদ মনোরঞ্জন দুটি পুত্র তাঁর।


ভ্রাতৃপ্রেমে বব্ধ তারা আছে পরস্পর।।


কুমুদের কীর্ত্তি যত বলা হবে পাছে।


গোপালচাঁদের কাছে সে কুমুদ আছে।।


এই ঘৃতকান্দী গ্রামে আদিত্য জন্মিল।


ভাগ্যগুণে গুরুচাঁদের চরণ বন্দিল।।


কৈশোর বয়সে তারে ধরে মহাজ্বরে।


কোনরূপে সেই ব্যাধি সারিতে না পারে।।


গোপালচাঁদের কীর্ত্তি হল জানাজানি।


তাঁর কাছে আদিত্যের এনে ফেলে টানি।।


পিতামাতা তার পরে দাবী ছেড়ে দিল।


তাহা শুনে শ্রীগোপাল আদিত্যে কহিল।।


মরিবি ত আদিত্য রে! একেবারে মর।


বাবা গুরুচাঁদে গিয়ে ওড়াকান্দী ধর।।


সেই আজ্ঞা অনুসারে আদিত্য তখন।


ওড়াকান্দী গিয়ে ধরে প্রভুর চরণ।।


পরম দয়াল প্রভু রাখিলেন তারে।


সেই হতে সে আদিত্য তাঁর সেবা করে।।


প্রভুর সঙ্গেতে এই আদিত্য চলিল।


মহাজ্ঞানী যজ্ঞেশ্বর সঙ্গেতে থাকিল।।


মাধবেন্দ্র বাবুরাম অশ্বিনী গোঁসাই।


যষ্ঠীবাবু সনাতন কেদার, কানাই।।


বালা শ্রীবিপিনচন্দ্র কৃষ্ণপুর বাসী।


রাজকুমারের সঙ্গে উপনীত আসি।।


খুসী মন বিচরণ উঠিল নৌকায়।


যাদব বিশ্বাস মিশি সেই সঙ্গে যায়।।


পাতলা আসিয়া সবে উপনীত হল।


দলে দলে ভক্ত আসি চরণ বন্দিল।।


গোপাল বিপিন আসে আর নিবারণ।


তাহাদের সঙ্গে ভক্ত এল অগণন।।


বাজসূয় যজ্ঞ প্রায় হল আয়োজন।


দ্রব্য আনে ধনঞ্জয় যত তার মন।।


ত্রিশ মন চাউলের অন্ন রাঁধা হল।


প্রেমানন্দে মতুয়ারা ভোজন করিল।।


নামগান কীর্ত্তনাদি হল বিধিমতে।


অশ্বিনী করিল গান প্রভুর স্বাক্ষাতে।।


পরম নৈষ্ঠিক সাধু শ্রীযাদব ঢালী।


ধনঞ্জয়ে পরামর্শ দিয়াছেন বলি।।


তামা ও প্রভুর জন্যে বহু মূল্যবান।


দুই জোড়া বস্ত্র আনি করিলেন দান।।


ষাট টাকা দাম তার ধূতি ও চাদর।


পরিধান করে প্রভু মানিয়া আদর।।


প্রধান মতুয়া যত উপস্থিত ছিল।


জনে জনে বস্ত্র আনি ধনঞ্জয় দিল।।

প্রভু বলে ‘‘ধনঞ্জয়! সবে যদি পায়।


আমার আদিত্য যেন বাদ নাহি যায়।।’’


এইভাবে মহাযঞ্জ হল সমাপন।


গোস্বামী যাদব তবে ভাবে মনে মন।।


লোহারগাতীর পথে প্রভুকে লইব।


পদস্পর্শে মোর দেশ ধন্য করি লব।।


যাদব মল্লিকে ডাকি মনোকথা কয়।


এক সঙ্গে দুই জনে করিলেন সায়।।


যাদবের পত্নী পুত্র সবে এসেছিল।


এক সঙ্গে সবে মিলে ঠাকুরে কহিল।।


‘‘দয়া করে চল বাবা আমাদের বাড়ী।


লোহারগাতীর পথে চল দয়া করি।।’’


প্রভু কয় ‘‘এই কার্য্যে নাহি মোর হাত।


আমি আসিয়াছি হেথা যাদবের সাথ।।


আমারে যেখানে নিবে যাদব বিশ্বাস।


সেইখানে যাব আমি মনে করি আশ।।’’


প্রভু যদি এই কথা বলিলেন হেসে।


উভয় যাদব গেল যাদবের পাশে।।


যাদব মল্লিক ধরে যাদবের পায়।


বলে ‘‘দয়া কর তুমি বিশ্বাস মশায়।।


তুমি যদি বল প্রভু যাবে এই পথে।


আমাদের বাঞ্ছাপূর্ণ হইবে তাহাতে।।’’


যাদব বিশ্বাস তাতে বেশী সুখী নয়।


দো-মনা ভাবের ভাবে তাই কতা কয়।।


তিনি কন ‘‘প্রভু যদি যেতে ইচ্ছা করে।


আমি কি রাখিতে কভু পারি তাঁরে ধরে।।


বিশ্বাস না কর চল তাঁর কাছে যাই।


আমার যা বলার আমি কব তাঁর ঠাঁই।।


এই ভাবে সবে গেল ঠাকুরের কাছে।


যাদব বিশ্বাস ধীরে কথা বলিতেছে।।


বলে তিনি গুণমনি করি নিবেদন।


নিজালয় যাওয়া ভাবি উচিত এখন।।


প্রভু কয় ‘সুনিশ্চিয় যাদব সুজন।


কোন পথে কোন কালে করিব গমন?’


প্রভুর প্রাণের ইচ্ছা লোহারগাতী যায়।


‘কোন পথে যাব’ তাই যাদবেরে কয়।।


প্রকারে যাদব বলে দুই-মনা ভাবে।


‘‘ঢালী মহাশয় নাকি আপনারে লবে।।


সেই পথে গেলে কিছু হবে ঘোরাঘুরি।


বাড়ী যেতে হতে পারে কিছুদিন দেরী।।’’


প্রভু কয় ‘‘তবে থাক গিয়ে কার্য্য নাই।


এই খান হতে সবে চল বাড়ী যাই।।’’


যাদবে ডাকিয়া বলে ‘শুনহে যাদব।


এই কার্য্যে তুমি যেন নাহি কর ক্ষোভ।।


পরে কোন দিনে যাব লোহারগাতী বাড়ী।


এই বারে বাবা তুমি মোরে দেও ছাড়ি।।’


যাদব মল্লিক তবে বলে করজোড়ে।


‘বহু দ্রব্য এ যাদব কিনিয়াছে ঘরে।।


আপনি না গেলে তার কি উপায় হবে।


সগোষ্ঠী যাদব তাতে বড় ব্যথা পাবে?’’


প্রভু কয় সব দ্রব্য ওড়াকান্দী লও।


মা-ঠাকুরাণীকে নিয়ে শীঘ্র বাড়ী যাও।।


এইবারে কোনখানে আমি নাহি যাব।


অদ্যকার রাত্রি মাত্র এইখানে রব।।


নিরুপায় সে যাদব মরমে মরিয়া।


পত্নী পুত্রগণে গৃহে দিল পাঠাইয়া।।


বিদেশ হইতে যত ভক্ত এসছিল।


সকলেরে ডাকি প্রভু বিদায় করিল।।


পুনরায় যাদবেরে ডাকিয়া নিকটে।


বলে ‘হে যাদব! দুঃখ করিও না মোটে।।


দুইজনে এক সঙ্গে নিয়ে এক নাও।


শীঘ্র করি যার যার বাড়ী চলে যাও।।


ভাবের ভাবুক প্রভু মহাভাবময়।


কোন ভাবে কিবা করে কেবা বুঝে হায়!

প্রণাম করিয়া তবে যাদব চলিল।


এবে শুন কি ঘটনা তারপরে হল।।


কিভাবে কি করে প্রভু বুঝিতে না পারে।


বুঝে সুঝে কাজ কর বল হরি হরি।।

 



No comments: