Monday, August 31, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 66 ১৯১৪ খ্রষ্টাব্দ ও মহাসমর

ইউরোপ মহাদেশে আছে বহু জাতি।


জার্ম্মাণ তাহার মধ্যে দুর্দ্দান্ত যে অতি।।


পূর্ব্বেতে জার্ম্মাণ দেশে বহু রাজ্য ছিল।


প্রুশিয়া তাহার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লভিল।।


এই রাজ্যে বিসমার্ক নামে একজন।


শুভক্ষণে করিলেন জনম গ্রহণ।।


তাঁহার চেষ্টার বলে ক্ষুদ্র রাজ্য যত।


বৃহত্তর জার্ম্মাণীতে হ’ল পরিচয়।


‘জার্ম্মাণ সাম্রাজ্য’ বলি হ’ল পরিচয়।


প্রুশিয়া রাজ্যের রাজা “কাইজার” হয়।।


“কাইজার” কল্পনা করে পৃথিবী বিজয়।


তলে তলে যুদ্ধ-অস্ত্র গোপনে সাজায়।।


সলা পরামর্শ তেঁহ করে বিধিমতে।


কোন মতে নাহি পারে যুদ্ধকে বাধাতে।।


মনে মনে তার অঅর পূর্ব্ব দুঃখ ছিল।


ফরাসী জাতির হাতে জার্ম্মাণী হারিল।।


“আলসেস লোরেণ” নামে দুইটি প্রদেশ।


ফরাসীরা করে নিল তাহাদের দেশ।


অন্য বহু দুঃখ মনে জার্ম্মাণীর ছিল।


“পৃথিবীর রাজা” হবে বাসনা করিল।।


সেই লোভে ক্রমে ক্রমে যুদ্ধ সজ্জা করে।


কেমনে বাধাবে যুদ্ধ ভাবিছে অন্তরে।।


হেনকালে অষ্ট্রিয়ার যুবরাজ যিনি।


সারভিয়া রাজ্য মধ্যে চলিলেন তিনি।।


দৈবের নির্ব্বান্ধ যাহা তাহাই ঘটিল।


যুবরাজ সেই রাজ্যে নিহত হইল।।


রাজরকতে কলঙ্কিত হল সরাভিয়া।


যুদ্ধের দামামা ধ্বনি উঠিল বাজিয়া।।


জার্ম্মাণী বুঝিয়া দেখে এই ত সুযোগ।


অষ্ট্রিয়াকে ক্ষেপাইয়া যুদ্ধে দিল যোগ।।


বেলজিয়াম হল্যান্ড দুটি ক্ষুদ্র দেশ।


দুর্দ্দান্ত জার্ম্মানী দোহে করে দিল শেষ।।


দুর্ব্বলের বন্ধুরূপে আসিল ইংরাজ।


দুর্ব্বলে বাঁচাতে তাই পরে যুদ্ধ-সাজ।।

 

জার্ম্মাণী ইটালী আর প্রচন্ড রাশিয়া।


অষ্ট্রিয়া তুরস্ক সব গেল এক হইয়া।।


এদিকে ফরাসী আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য।


“মৃত্যু কিংবা যুদ্ধ জয়” করিলেন ধার্য্য।।


কানাডা ভারতবর্ষ আর অষ্ট্রেলিয়া।


আফ্রিকা উপনিবেশ মিশিল আসিয়া।।


আরব পারস্য দোঁহে ক্রমে যোগ দিল।


বুলগেরিয়া রুমানিয়া পূর্ব্বাহ্নে মরিল।।


সার্ভিয়া মুছে গেল কোন চিহ্ন নাই।


সমস্ত পৃথিবীব্যাপী বাধিল লড়াই।।


তিন বর্ষ যুদ্ধ চলে ভীষণ আকার।


জার্ম্মাণীর তবু নাহি ভাঙ্গে অহঙ্কার।।


শেষ বর্ষে যুক্তরাষ্ট্র আমেরিতা খন্ডে।


নামিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে অতীব প্রচন্ডে।।


একে ইংরাজ আর ফরাসী জুটিয়া।


জার্ম্মাণীর রক্ত সব নিয়াছে শুষিয়া।।


রক্তশূণ্য দেহে মারে মার্কিন আঘাত।


মৃতপ্রায় জার্ম্মাণেরা হ’ল ভূমিস্মাৎ।।


ভার্সাই নগরে পরে সন্ধিপত্র হ’ল।


অহঙ্কারী ‘কারজাই’ দেশ ছেড়ে গেল।।


এই যুদ্ধে ভারতের যত নরনারী।


রাজার সাহায্য করে প্রাণ তুচ্ছ করি।।


কেহ বা সৈনিক সাজে বীরত্বে নির্ভিক।


বাঙ্গালী পাঞ্জাবী গুর্খা আর কত শিখ।।


অর্থ দেয় স্বার্থ দেয় মজুর জোগায়।


দেশ ছেড়ে কতজন গেল বসরায়।।


মহাযুদ্ধে গুরুচাঁদ রাজার কল্যাণে।


বহু নমঃশূদ্রে দিল যুদ্ধের কারণে।।


বিভিন্ন বিভাগে তারা করিল চাকুরী।


কেহ কেহ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ গেল মরি।।


উৎসাহ দেখিয়া তাঁর মীড ডাকি কয়।


“উপর্যুক্ত কাজ এই হ’ল মহাশয়।।


রাজভক্ত নমঃশূদ্র জানিবেন রাজা।


দিনে দিনে নমঃশূদ্র হবে মহাতেজা।।


দলিত পীড়িত জাতি বঙ্গে যত আছে।


তারা সবে শিক্ষা পাবে নমঃশূদ্র কাছে।।


তোমার কার্যের ধারা আমি দেখিয়াছি।


তরাবে পতিত জনে ভাবে বুঝিয়াছি।।


যে বীজ রোপণ আজি করিলে ঠাকুর।


ইহার শিকড় যাবে দূর হতে দূর।।


এই বীজ যেই বৃক্ষ উঠিবে জাগিয়া।


পতিত বাঙ্গালী তাতে যাইবে তরিয়া।।”


যে বাণী বলিল মীড তাহা দেখি পরে।


সকলি হইল সত্য অক্ষরে অক্ষরে।।


যুদ্ধ শেষে বঙ্গবাসী নব শক্তি পায়।


পীড়িত জাতির হল নব অভ্যুদয়।।


দেশের ‘আইন-সভা’ বিস্তৃত হইল।


বঙ্গদেশে বহুজনে ভোটাধিকার পেল।।


অনুন্নত বলি যত জাতি বঙ্গে ছিল।


ভোট দিয়া কাউন্সিলে মেম্বর পাঠাল।।


ভীষ্মদেব দাস আর নীরোদ বিহারী।


কাউন্সিলে সভ্য হ’ল বহু চেষ্টা করি।।


প্রথম আইন গৃহে ইহারা দু’জন।


নমঃশূদ্র পক্ষ হতে করে আগমন।।


ভীষ্মদেব দাস হয় ওড়াকান্দী বাসী।


প্রথমে তাঁদের বিদ্যা শিখাইল শশী।।


কাউন্সিলে পশিবারে তেঁহ ইচ্ছা করে।


মহাপ্রভু গুরুচাঁদে বলে ভক্তিভরে।।


“আপনার দয়া ভিক্ষা এই কার্যে চাই।


চিরদিন তব ঠাঁই আমি কৃপা পাই।।


আশীর্ব্বাদ চাই আমি জাতির কারণে।


ক্ষুদ্র হয়ে কিবা ফল জাতির কারণে।।


তাঁর বাক্য শুনি প্রভু বড়ই সন্তোষ।


বলে “ভীষ্ম করিও না বৃথা আপশোষ।।

অবশ্য সাহায্য আমি করিব তোমারে।


নিশ্চয় মেম্বর তুমি হবে এই বারে।।


প্রভুর অমোঘ বাণী হল পরিপূর্ণ।


মনোনীত-সভ্যরূপে ভীষ্ম হল ধন্য।।


বরিশাল জিলা পক্ষে নীরোদ বিহারী।


কাউন্সিলে সভ্য হন বহু চেষ্টা করি।।


বিখ্যাত মল্লিক বংশে জনম তাঁহার।


কুমুদের হন তিনি চতুর্থ সোদর।।


তথাকার ভক্তগণে প্রভু ডাকি বলে।


“নীরোদ বাবুকে ভোট দিও এক দলে।।”


যেই দেশে হতে যে ভক্ত কাছে আসে।


“কাউন্সিলে কে দাঁড়াল” তাঁহারে জিজ্ঞাসে।।


অনুন্নত জাতি হয়ে যাতে সভ্য যায়।


সেই মত উপদেশ সকলেরে কয়।


বিস্তৃত আকারে তাহা বলিব যে পরে।


এবে বলি সব কথা মূল-সূত্র ধরে।।


দলিত জাতির এই নব অভ্যুদয়।


রাজাকে সাহায্য-করা তার মূলে রয়।।


সেই কা্র্যে মূলে দেখি গুরুচাঁদ প্রভু।


তাঁরে ভিন্ন পতিতেরা উঠে নাই কভু।।


মহাযুদ্ধে বিশ্বে এল মহাজাগরণ।


সর্ব্বক্ষেত্রে আবিষ্কার হইল নূতন।।


আকাশে উড়িল নর জলেতে ডুবিল।


পৌরাণিক কথা সত্যে পরিণত হল।।


কিবা রাজ্যে কি বাণিজ্যে নবযুগ।


“সকলে স্বাধীন হ’ব” উঠিল হুজুগ।।


সেই আন্দোলন কথা পরে বলা হবে।


এবে শুন মহাপ্রভু কি করিলা তবে।।


“খৃষ্টান হইবে” বলি প্রভু দিল ভীর।


ঐশ্বর্য্যের ভক্তিধারী ছিল যাঁরা যাঁরা।


ভক্তিগুণে গুরুচাঁদে পাইলেন ধরা।।


যাহা ইচ্ছা হয় মনে প্রভু করে তাই।


এদিকে ছাড়িল দেহ তারক গোঁসাই।।


সে কাহিনী অতঃপরে বলিবার চাই।


কহি কহে গেল দিন আর বেলা নাই।।

 

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 65 চক্রীয় চক্র ও ভক্তগণের অগ্নি পরীক্ষা

প্রভুর ইচ্ছায় বাধা কেবা দিতে পারে?


জাতির মঙ্গল তবে আনিল মীডেরে।।


মীড যাহা বলে প্রভু সেই কাজ করে।


ভাব যেন প্রভু করে আজ্ঞা অনুসারে।।


আপনার কাজ প্রভু মীডে দিয়া।


নর নারী কেহ তাহা পারেনা বুঝিয়া।।


ওড়াকান্দী হা্ইস্কুল হইল গঠন।


পরীক্ষার আজ্ঞা তথা পেল ছাত্রগণ।।


দাতব্য চিকিৎসা হয় মীডের আবাসে।


দলে দলে দীন দুঃখী তাঁর কাছে আসে।।


মীডের ঔষধে গুণ সবে জানে তাই।


স্নানাহার বন্ধ হলে আর রক্ষা নাই।।


রোগ ব্যাধি দেশ মধ্যে যত কিছু হয়।


প্রায়শঃ মীডের কাছে সবে ছুটে যায়।।


মীডের ঔষধে যার রোগ সারে নাই।


সবে বলে “তোর আর রক্ষা নাই ভাই।।”


আশাহীন- সেই দীন আর কোথা যায়?


শেষ-আশা গুরুচাঁদ, পড়ে তাঁর পায়।।”

 

 

 

 

পরম দয়াল বলে ‘কিবা তোর ভয়?”


শ্রীমুখের আজ্ঞা মাত্রে রোগ সেরে যায়।।


এবে শুন এক কথা সত্য পরিচয়।


“টিকাদার” বংশ আছে ওড়াকান্দী গাঁয়।।


সেই বংশে এক ব্যক্তি রোগে কষ্ট পায়।


রোগ মুক্তি তরে গেল ডাক্তার খানায়।।


বহু দিন ঔষধাদি করিল সেবন।


কিছুতে সে রোগ নাহি হইল মোচন।।


দিনে দিনে তনু ক্ষীণ খর্ব্ব হল বল।


রোগ যন্ত্রনায় ক্রমে হইল অচল।।


আত্মীয় স্বজন সবে ছেড়ে দিল আশা।


গলা হবে রক্ত পড়ে ক্ষত কর্ণ, নাসা।।


আজি মরে কালি মরে সবে ভাবে মনে।


হেন কালে শুন কথা দৈবের ঘটনে।।


মৃত্যু-যাত্রী এক প্রাতেঃ কহে সবাকারে।


আমাকে লইয়া চল বড়-কর্তা-ধারে।।


জীবনের আশা বটে মোর কছিু নাই।


একবার গুরুচাঁদে দেখিবার চাই।।


শুনেছি তাঁহার নামে কত মরা বাঁচে।


এ-মরা সকলে ফেল নিয়ে তাঁর কাছে।।


ডুবু-তরী যদি রক্ষা গুরুচাঁদ করে।


চিরকাল রব বন্ধী চরণ নখরে।।


এই কথা তার মুখে শুনিয়া সকলে।


অতি কষ্টে ধরাধরি করে নিয়া চলে।।


মনে হয় পথিমধ্যে যাইবে পরাণ।


বেঁচে মাত্র রহিল সে দয়ার কারণ।।


কতক্ষণে উপনীত ঠাকুরের স্থান।


রাগিয়া ঠাকুর বলে “এ নাকি শ্মশান?


টানা টানি করে কেন মরা আন’ হেথা?


এক দেশে বাস বলে এক কি শত্রুতা?


যার যার মরা তার বাড়ী নিয়া রাখ।


মরা যে বাঁচাতে পারে তারে গিয়া ডাক।।


কৌশলে আমার বাড়ী এ মরা ফেলিবে।


একেবারে মরে গেলে মামলা বাধাবে।।


এ সব ভঞ্ঝাটে বাপু কোন কার্য্য নাই।


মরা নিয়ে বাড়ী যাও আমি তাই চাই।।”


এতেক বলিলা যদি প্রভু গুরুচন্দ্র।


তারা বলে “মোরা নাহি বুঝি কোন মর্ম্ম।।


সত্য বটে বাস করি এই ওড়াকান্দী।


তুমি যে কে কোন দিন করি নাই সন্ধি।।


ইহা সত্য জানি যদি ভাল না বাসিবে।


তবে কেন ওড়াকান্দী আপনি আসিবে?


এ-মরা তোমার মরা দিলাম তোমায়।


মার কাট যাহা ইচ্ছা কর দয়াময়।।


ভক্তি শক্তি কোন কিচু আমাদের নাই।


এক দেশে বাস করি বল মাত্র তাই।।


বিনামূল্যে ওড়াকান্দী বাসিয়াছ ভাল।


ওড়াকান্দী বাসী জানে সেই মহাবল।।


দয়া যদি হল মনে বাঁচাও মরারে।


যা হোক তা হোক মরা দিলাম তোমারে।।”


দাবী করে কথা কয় সঙ্গীসাথী যারা।


দাবী শুনে হাসে প্রবু সর্ব্ব-দুঃখ-হারা।।


তাদের ডাকিয়া বলে “ওড়াকান্দী বাসী!


আমি বুঝি দায়-ঠেকা এই দেশে আসি।।


দায় ঠেকে আমি বুঝি বাঁচাব মরারে।


এই কথা কোন দুষ্ট বলেছে তোমারে?


ওড়াকান্দী বাসী বলে কেন এত গর্ব্ব।


এক দিনে ওড়াকান্দী হতে পারে খর্ব্ব।।


যাক যাক সে কতায় কাজ কিছু নাই।


তোমাদের জিৎ হোক আমি ঠকে যাই।।


এত বলি প্রভু দিল রোগের ব্যবস্থা।


এক দিনে ফিরে গেলে রোগের ব্যবস্থা।।


‘কাঁচা লঙ্কা পান্তভাত তেলে জলে স্নান।


দিবারাতি বসে কর হরি নাম গান।।

সপ্তাহ মধ্যেতে রোগী আরোগ্য হইল।


মীড সেই কথা শুনি আশ্চর্য্য মানিল।।


এই ভাবে যত মরা গুরুচাঁদে ধরে।


দয়াময় রক্ষা করে শুধু দয়া করে।।


কঠিন কর্ম্মের বর্ম্মে প্রভু ঢাকা রয়।


ফল্গু সম ধর্ম্ম-ধারা তলে তলে বয়।।


ঐশ্বর্য্যের ভক্ত তাতে পড়ে গেল ভুলে।


তারা সবে ক্রমে ক্রমে দুরে গেল চলে।।


কেবলার-রীতি মানে সেই ভক্ত গণ।


তাঁরা হ’লাগ্রসর বীরের মতন।।


সংক্ষেপে বিস্তার তাই করিব এখন।


কোন ভাবে প্রভু কিবা করিল তখন?


পূর্ব্ব ভাগে করিয়াছি সে সব বর্ণণ।


দশভূজা পূজারম্ভ হল কি কারণ।।


কিছু কাল ওড়াকান্দী দূর্গা পূজা হল।


হেন কালে মীড আসি সেথা দেখা দিল।।


কোন ভাবে কি কি কথা মীড বলেছিল।


পূর্ব্ব ভাগে সেই সব বর্ণনা হইল।।


মীড ভাবে গুরু চাঁদে নিব নিজ দলে।


গুরু চাঁদ ইচ্ছে কার্য করাব কৌশলে।।


মীডের আজ্ঞায় যেন সব কাজ করি।


এই ভাবে ভান করে বাঞ্ছাপূর্ণকারী।।


তাতে মীড মহোল্লাসে সব কাজ করে।


মাঝে মাঝে বলে কথা প্রভুর গোচরে।।


খৃষ্ট ধর্ম্ম মহাত্মাদি বলে বারে বার।


প্রভু বলে “এই ধর্ম্ম বড়ই সুন্দর।।


মীডে বলে “তবে কেন করণা গ্রহণ।


প্রভু বলে “আগে জানি সব বিবরণ।।


কথা শুনি মীড তবে ভাবে মনে মন।


‘সবুরে মেওয়া ফলে জ্ঞানীর বচন।।


কিছু দিন দেরী করে ভাব বুঝে লব।


পরে যা করিতে হয় তাহাই করিব।।

 

ইতি উতি গতি তাঁর কিছুতে না যায়।
দ্বিধাযুক্ত করে কাজ চিন্তা অতিশয়।।
র্প্রভু দেখে মনে মনে মীডের সন্দেহ।
বিশেষতঃ খৃষ্টধর্ম্ম নাহি লয় কেহ।।
চক্রধর চক্রজাল করিল বিস্তার।
চক্রজালে কেহ নাহি পাইল নিস্তার।।
যত ধাতু অগ্নি মাঝে সকলি ফেলিল।
স্বর্ণ ভিন্ন অন্য সব পুড়ে ছাই হল।।
বিশুদ্ধ স্বর্ণেতে বাড়ে বহু উজ্জ্বলতা।
এবে শুন বলি তবে সেই সব কথা।।
দশভূজা মূর্ত্তি পূজা হত ওড়াকান্দী।
বন্ধ করে প্রভু তাহা করে অভিসন্ধি।।
সকলেরে ডাকি বলে শোন সর্ব্বজন।
“মুর্ত্তি পূজা করা দেখি শুধু অকারণ।।
ডক্টর মীডের কথা কিছু মিত্যা নয়।
মেটে-মুর্ত্তি পূজা করা বড়ই অন্যায়।।
আরো আমি দিনে দিনে বুঝিতেছি সার।
খৃষ্টধর্ম্ম তুল্য ধর্ম্ম নাহি কিছু আর।।
হিন্দু থেকে এত কষ্ট বৃথা কেন সই।
মনে বলে খৃষ্টধর্ম্মে আমি দীক্ষা লই।।
এতদিন এই কার্য্য করিতাম শেষ।
শশীর অপেক্ষা মাত্র জানিও বিশেষ।।
এই কথা যবে করিল প্রচার।
দেশবাসী লোক সবে লাগে চমৎকার।।
কাণাকাণি জানাজানি হল ঘরে ঘরে।
জনে জনে বলাবলি করে পরস্পরে।।
“হেন কথা বড়কর্তা কেমনে কহিল?
যদি সত্য হয় তবে নমঃশূদ্র ম’ল।।
ক্রমে কথা শুনিলেন শ্রীবিধু চৌধুরী।
তিনি বুঝে প্রভু শুধু করিছে চাতুরী।।

ক্রমে ক্রমে দলে দলে নরনারী গণে।


সকলে উল্লেখ করে যার যাহা মনে।।

এদিকে ডক্টর মীড মনেতে উল্লাস।


পূজা-বন্ধ দেখি মনে করিল বিশ্বাস।।


দিবারাত্রি যাতায়াত করে প্রভু-স্থলে।


তাঁর মনোমত কথা প্রভু সদা বলে।।


ধর্ম্ম আলোচনা প্রভু কবে এক মনে।


তাহা দেখি আশা হ’র সে মীডের মনে।।


মাঝে মাঝে বলে প্রভু সে মীডের ঠাঁই।


‘জাতি-শুদ্ধ আমি খৃষ্ট ধর্ম্ম নিতে চাই।।”


এই ভাবে প্রভু তাঁরে করিলেন জয়।


মীড করে সেই কাজ প্রভু যাহা কয়।।


স্কুল হ’ল দূরে গেল চন্ডালত্ব গালি।


নমঃশূদ্র ক্রমে হল প্রতিপত্তিশালী।।


সব কাজ করে মীড মাঝে মাঝে কয়।


“কতকাল বড়কর্তা কাটা’বে সময়।।


প্রভু কহে জান মীড শশী বাড়ী নাই।


তার কাঝে মতামত আমি নিতে চাই।।


অবশ্য তাহারে তুমি জান ভালমতে।


বাধা নাহি দিতে পারে আমার এ-মতে।।


হেন কালে হল এক দুরন্ত ঘটনা।


খৃষ্টধর্ম্মে গেল তবে নমঃ কয়জনা।।


এতকাল চুপ ছিল শ্রীবিধু চৌধুরী।


এই কান্ড দেখে মনে দুঃখ হল ভারী।।


অবিলম্বে উপস্থিত ঠাকুরের ঠাঁই।


বলে কর্তা এই কার্য্যে কৈফিয়ৎ চাই।।


প্রভু হেসে বলে বিধু হইলে পাগল।


আমাকে বকিয়া বল পাবে কোন ফল?


সাধারণে যাহা বুঝে তাহা বুঝে থাক।


শুনিয়া তোমার কথা আমি যে অবাক।।


শোন বিধু শুধু শুধু করিও না গোল।


ইচ্ছা হয় হাটে হাটে দেও গিয়ে ঢোল।।


শ্রীহরির পুত্র আমি কিছু ভুলি নাই।


কিবা করি চুপ করে বসে দেখ তাই।।


মনো কথা সব আজি বলিব না খুলে।


কথাতে কি হবে বাপু কাজে সব পেলে।।


প্রভুর বচনে বিধু উত্তর না দেয়।।


মনে মনে হল তার বিষম সংশয়।।


বিদেশেতে শশী বাবু করিছে চাকুরি।।


তাঁহারে লিখিল চিঠি শ্রীবিধু চৌধুরী।।


শশীবাবু গৃহে এসে কোন কার্য করে।


বলিব সে সব কথা কিছুকাল পরে।।


এবে শুন ভক্তগণ কোন ভাবে চলে।


প্রভুর মননে তারা কেবা কি কি বলে।।


দেবীচাঁদ, মহানন্দ গেছে পরাপারে।


শ্রীতারক আছে বটে জীর্ণ-দেহ ধরে।।


নির্ব্বিকার-চিত্ত তাঁর স্তুব্ধ-সিন্ধু প্রায়।


কভু নাহি অন্যভাবে প্রভুর কথায়।।


প্রভুর মঙ্গল-ইচ্ছা হইবে মঙ্গল।


যাহা বলে তাহা করে নাহি কোন গোল।।


সবভাবে ওড়াকা্ন্দী করে যাতায়াত।


সমভাবে প্রভুপদে করে প্রণিপাত।।


সমভাবে চোখে তাঁর বহে বারিধারা।


এক প্রাণ একটান নহে কিছু হারা।।


মহাসিন্ধু পূর্ণ যথা রহে চির দিন।


সিন্ধু নহে জোয়ার-ভাটা খেলার অধীন।।


সেই মত রসরাজ একভাবে চলে।


“প্রভুর মঙ্গল ইচ্ছা” সবাকারে বলে।।


ঐশ্বর্য্যের লোভে যত ভক্ত এসেছিল।


প্রভুর মনন শুনি বহুত কহিল।।


কেহ বলে “এই কার্য মন্দ অতিশয়।


হিন্দু হয়ে শেষে যাব খৃষ্টের আলয়?


যাবে যাক উনি একা মোরা কেন যাব?


ভক্ত হলে ঘরে বসে হরিচাঁন্দ পাব।।


আভাষ অবশ্য মোরা পূর্ব্বে বুঝিয়াছি।


বিধবার বিয়া দিয়া সব দেখিয়াছি।।

এ সব খৃষ্টানী-কর্ম্ম করা ভাল নয়।


যা করে করুক উনি যাহা মনে লয়।।


মনে বুঝে দেখি বৃথা আসি ওড়াকান্দী।


ঠাকুর পেতেছে সব জাত-মারা ফন্দী।।”


এ সব বলিয়া তারা বিদায় হইল।


ভাব জেনে মনে মনে প্রভুজী হাসিল।।


সেই সব ভক্ত যারা বিদ্রোহ করিল।


দেশে গিয়ে নিজ নিজ দল গড়ে নিল।।


ওড়াকান্দী নাহি আসে না দেয় হাজত।


ব্যাভিচারে মত্ত হয়ে ডুবাল জগত।।


মায়াচক্রে সে প্রকৃতি পিষে জীব দলে।


সবে চুর্ণ হয় পড়ে মায়া-চক্র তলে।।


চতুর যে জন রহে কীলক ধরিয়া।


সেই মাত্র রক্ষা পায় মরে না পিযিয়া।।


যে জন কীলক ছাড়ে তার রক্ষা নাই।


এই সব দুষ্ট-ভক্তে ঘটিলও তাই।।


তাহাদের নাম দিয়ে কোন কার্য্য নাই।


দেশবাসী জনে জনে জানিবে সবাই।।


প্রকৃতি-নিয়মে এই আছে শুদ্ধ ধারা।


সর্ব্বদা সকল স্থান রহিবেক ভরা।।


শূণ্য বলে কোন কিছু প্রকৃতিতে নাই।


একে গেলে অন্যে এস পূর্ণ করে তাই।।


বিদ্রোহ করিয়া কত ভক্ত চলে গেল।


শূণ্য স্থান পূরাইতে অন্য দল এল।।


এ সব প্রভুর ইচ্ছা বুঝিলাম সার।


কল্যাণের পথ প্রভু করে পরিস্কার।।


কর্ম্ম অনুসারে হয় শক্তি ব্যবহার।


শক্তি অনুসারে লোকে পায় কর্ম্ম ভার।।


যতটুকু যাকে দিয়া হয় প্রয়োজন।


সে কাজ করায় তারে শ্রীমধুসুদন।।


সকলি প্রভুর ইচ্ছা তিনি ইচ্ছাময়।


রশি ধরি যেন সব পুতুল নাচায়।।


আদি পর্ব্বে যেই সব ভক্ত দল ছিল।


প্রেম-ভক্তি নিয়ে তাঁরা শুধু কেন্দে গেল।।


কঠিন মরুর মত জীবের হৃদয়।


ভক্ত অশ্রুবারি পেয়ে দ্রবীভুত হয়।।


সরস হইল ক্ষেত্রে কৃষি উপযুক্ত।


জ্ঞান-কর্ম্ম সম্মিলনে সৃষ্ট হল ভক্ত।।


ভক্তি রসে ক্ষেত্রে যারা সিক্ত করেছিল।


এইখানে তাঁহাদের কার্য শেষ হল।।


কৃষিকর্ম্মে সুনিপুণ আসে সেই দল।


যাঁহাদের দেহে মনে অবিনাশী বল।।


ত্রিবেণী-সঙ্গমে যথা মিশে তিন ধারা।


ওড়াকান্দী মিশে তিন ভক্তের ফোয়ারা।।


মহানন্দ দেবী চাঁদ আর শ্রীতারক।


তিন শক্তি মাতাইল বিশ্ববাসী লোক।।


ওড়াকান্দী এবে যারা করে যাতায়াত।


আদি মূল এই তিন প্রধান মহৎ।।


ইহাদের শক্তি প্রাণে পেয়েছিল যারা।


বিশ্ববাসী জীবগণে উদ্ধারিছে তাঁরা।।


ত্রিশক্তি করিল পূজা প্রভুগুরুচাঁদে।


অর্ঘ্য ছলে ভক্ত দলে দিল তাঁর পদে।।


মহাহৃষ্ট জগদিষ্ট হাতে ধরি লয়।


অপূর্ব্ব ভাবের খেলা জগতে খেলায়।।


তারকের অর্ঘ্য হল যাদব নকুল।


হরিবল মনোহর প্রেমেতে আকুল।।


রমণী নামেতে এক মহাশক্তিশালী।।


গুরুচাঁদ পদে তাঁর এ সব অঞ্জলি।।


মহানন্দ প্রেমানন্দ নাচিয়া বেড়ায়।


তারকের একযোগে পদে অর্ঘ্য দেয়।।


অশ্বিনী গোঁসাই যিনি সঙ্গীত-আচার্য্য।


মহানন্দে গুরুপদে করিলেন ধার্য্য।।


তাঁরে আশীর্ব্বাদ করে তারক রসনা।


গীত রচি পূরাইল মনের বাসনা।।

সেই ভাবে হরিবর পেল আশীর্ব্বাদ।


এক সঙ্গে শিরে ধরে দোঁহাকার পদ।।


দেবীচাঁদ আনে অর্ঘ্য বহুদূর হতে।


পবিত্র কুসুম কাটী আনে এক সাথে।।


গোপাল বিপিন আর নেপাল গোঁসাই।


মাধব তপস্বীরাম সবে ভাই ভাই।।


ত্রিশক্তির অর্ঘ্য মধ্যে আছিল যাঁহারা।


‘মতুয়া সঙ্ঘের স্তম্ভ” সকলি তাঁহারা।।


পূর্ব্বের বৃত্তান্তে এবে আসিলাম ফিরে।


প্রভুর মনন জানি ইহারা কি কর?


এক বাক্যে এই সব ভক্ত দলে কয়।


“যাহা কর তাতে মোরা আছি দয়াময়।।


জাতি মান ধন জন দেহ প্রাণ মন।


রাঙ্গা পায় করিয়াছি সব মমর্পণ।।


তোমারে চিনি না মোরা এই জানি সার।


অক্ষয় মঙ্গলে ভরা ইচ্ছা যে তোমার।।


তুমি যাহা আজ্ঞা কর মোরা তাই করি।


জাতি মান সব তুমি বাঞ্ছাপূর্ণকারী।।”


একনিষ্ঠ এই সব ভক্ত আসি মিলে।


আপনারে ধরা প্রভু দেয় কুতুহলে।।


পরীক্ষা করিয়া প্রবু ভক্ত বাছি নিল।


আপনার ভাবে প্রভু আপনি ফিরিল।।


ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ সর্ব্ববিধ নীতি।


দেখাইল গুরুচাঁদ সত্যভামা-পতি।।


ক্রমে ক্রমে সেই ভাব করিব লিখন।


গুরুচাঁদ প্রীতে হরি বল সর্ব্বজন।।

 



গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 64 গোস্বামী দেবীচাঁদের মতুয়া–ধর্ম্ম–বিস্তার

শক্তি দিল গুরুচাঁদ শক্তিমন্ত দেবীচাঁদ


প্রেমোন্মাদ হয়ে এল দেশে।


যারে দেখে তারে কয় আয় সবে ছুটে আয়


করিস কি তোরা সবে বসে?


ওড়াকান্দী এল হরি ভক্তচাঞ্ছা-পূর্ণকারী


চল সবে যাই তাঁর কাছে।


এমন রতন ফেলে গৃহে রস কেন ভুলে


ভুলে ভুলে দিন গেল মিছে।।”


জনে জনে ঘরে ঘরে বলে সবে পরস্পরে


“এ মানুষ হয়েছে পাগল।


ছাড়িয়াছে ধন মান নাহি যেন বাহ্য-জ্ঞান


মুখে শুধু বলে হরিবোল।।


আগে মাথা ছিল ঠিক জ্ঞান ছিল দিগিদিক


এবে দেখ বেহালের বেশ।


ছাড়িয়াছে সে চাকুরী তুচ্ছ কহে টাকা কড়ি


মুখে দাড়ি শিরে রাখে কেশ।।”

কেহ বলে “শুন ভাই কিছু নাহি দিশে পাই


কিবা গুণ ওড়াকান্দী আছে।


ওড়াকান্দী গেলে পরে যেন কোন রোগে ধরে


শুধু শুধু হরি বলে নাচে।।


ছোঁয়াচে রোগের মত এই ভাব ক্রমে দ্রুত


চলিতেছে দেশে-দেশান্তরে।


কি যেন কপালে আছে হয়ত বা আমি পাছে


মতো হব সেই মতো ধরে।।”


এই সব কাণাকাণি হ’ল ক্রমে জানাজানি


টানাটানি হ’ল নানাভাবে।


কেহ ভাল কেহ মন্দ তর্কাতর্কি বাক্য-দ্বন্দ্ব


করে সবে জ্ঞানের অভাবে।।


নিন্দা কিংবা বন্দনায় দেবী নাহি কণা দেয়


নিজ-মনে বলে হরিবোল।


কেহ করে গালাগালি কেহ গায়ে দেয় ধুলি


ঘরে ঘরে উঠে কলরোল।।


বিধির নির্ব্বন্ধ যাহা কে খন্ডাবে বল তাহা


মহামারী এল সেই দেশে।


নর-নারী অগণন মরিতেছে ঘন ঘন


ভয়াকুল রহে সবে বসে।।


ঘরে ঘরে কান্নারোল পুত্র-ছাড়া মাতৃকোল


স্বামীহারা কান্দে নারী দুঃখে।


সতীহারা কান্দে পতি ভ্রাতা ভাগ্নী সখা সখী


ঘরে ঘরে কান্দে সবে শোকে।।


আনে বৈদ্য-কবিরাজ তাতে নাহি দেয় কাজ


ঔষধেতে বাড়ায় বিষাদ।


হায় হায় নিরুপায় কেবা কহে সদুপায়


দেশবাসী গণিল প্রমাদ।।


কিন্তু কি আশ্চর্য্য কান্ড এক দিন এক দন্ড


দেবীচাঁদ না হল বিমর্ষ।


নিয়ে ডঙ্কা নিয়ে খোল বলে শুধু হরিবোল


প্রেমানন্দে-মগ্ন মহাহর্ষ।।


তাঁর ঘরে রোগ নাই হরি বলে ছাড়ে হাই


আপদ বালাই দুরে যায়।


কোন কোন দুঃখী জনে তাইভাবে মনে মনে


‘দেবী’ পারে করিতে উপায়।।


উপায় না দেখি চোখে সাহস করিয়া বুকে


পড়ে গিয়া দেবীর চরণে।


দেবী কহে ‘একি দায় পড় কেন মোর পায়


কোন ভাব নিয়ে এল মনে।।


যারা কান্দে তারা কয় “এ বিপদে কি উপায়


দয়া করি করহে গোঁসাই।


ভুল করে এত দিন চিনি নাই তোমা ধনে


কর রক্ষা পদে ভিক্ষা চাই।।”


শুনিয়া সে সব কথা ক্ষণিক নোয়ায়ে মাথা


ডাক দিয়া দেবীচাঁদ কয়।


‘আমি কিছু নাহি জানি শুধু এই কথা মানি


হরি নামে শঙ্কা দূরে যায়।।


সবে যদি রক্ষা চাও ঠাকুরের মান্য দাও


হরি নাম কর ঘরে ঘরে।


যদি প্রভু দয়া করে সব রোগ যাবে সেরে


অনায়াসে যাবে ভব পারে।।”


দুঃখী যারা এসেছিল দেবী চাঁদে সঙ্গে নিল


গৃহে আসি করে হরি নাম।


সারারাত্রি সবে মিলে এক মনে হরি বলে


প্রাতেঃ রোগ হইল আরাম।।


পাঁচ সিকা মান্য দিয়া পদে দন্ডবৎ হৈয়া


কেন্দে বলে সেই কাঙ্গালেরা।


‘বিপদে কান্ডারী তুমি স্বর্গ হতে এলে নামি


দুঃখী জনে দিলে আজি ধরা।।


দেবীচাঁদ ক্রোধে কয় ওরে ওরে দুরাশয়


কার পূজা কারে তুই দিলি।


গুরুচাঁদ সর্ব্বমূল ডাল ধর ছেড়ে মূল


এই ভুলে নিশ্চয় মরিলি।।

 

গুরুচাঁদ সব করে ডাকিস ত ডাক তাঁরে


তিনি বিনে বন্ধু কেহ নাই।


বিপদের বন্ধু তিনি আমি মনে তাই জানি


তিনি অগ্নি আমি মাত্র ছাই।।


এই ভাবে আলাপন করিলেন সমাপন


পরে গেল নিজ গৃহ বাসে।


ঘরে ঘরে এই কথা ব্যাপ্ত হল যথাতথা


দলে দলে লোক এল শেষে।।


সবার ভাঙ্গিল ভুল অকূলে মিলিল কূল


তারা সবে মতুয়া হইল।


বানেরী সামর্থগাতী আর কত ইতি উতি


দেবীচাঁদে গুরুত্বে বরিল।।


সন্ধ্যাকালে উতরোল ঘরে ঘরে হরিবোল


ধ্বনি উঠে আকাশ ভেদিয়া।


রোগে মুক্তি শোকে শান্তি দূর হয় মনোভ্রান্তি


হরি বলে দু’বাহু তুলিয়া।।


এই ভাবে করে ঘর নাম হল সুপ্রচার


বহু ভক্ত মত্ত হল নামে।


কেনুভাঙ্গা টুঙ্গীপাড়া সব খানে পড়ে সাড়া


রাজনগরাদি ক্রমে ক্রমে।


বালা শ্রীতপস্বীরাম টুঙ্গীপাড়া যার ধাম


শুণবান অতি মহাশয়।


দেহ মোটা দেল মোটা মোটা তাঁর প্রেমচ্ছটা


সাহসেতে মোটা অতিশয়।।


দেবীচাঁদে করে গুরু কাজ করে দেল-পুরু


দুরু দুরু না কাঁপে হিয়ায়।


যাহা বলে দেবীচান তাই করে দিয়ে প্রাণ


মানামান কোন চিন্তা নাই।


পুত্র তার মল আগে তাতে দুঃখ নাহি লাগে


সদা কহে ‘ভক্তি না হারাই।।”


পরে দিন পরিচয় বিয়া দিতে বিধবায়


আজ্ঞা যবে দিলেন ঠাকুর।


দেবী চাঁদ সহযোগে যাহা কিছু করা লাগে


শ্রীতপস্বী করিল প্রচুর।।


গুরুচাঁদ আজ্ঞাক্রমে গড়িলেন নিজ ধামে


যথাযোগ্য শ্রীহরি মন্দির।


শ্রীতপস্বী মরে নাই শ্রীহরি মন্দির তাই


সাক্ষ্য দেয় দাঁড়াইয়া স্থির।।


জহুরী সে দেবী চান ‘জহরীতে ছিল জ্ঞান


রাশী রাশী আনিল জহর।


ছুয়েছিল দেবী যাঁরে সেই পুনঃ ঘুরে ঘুরে


সাজাইল সাধুর বহর।।


তাহার প্রমাণ যত বলিতেছি সাধ্য মত


মোর সাধ্যে কত বা কুলায়?


দাদু মোর দেবী চান করে যদি শক্তি দান


বলি কিছু সে যাহা বলায়।।


নামেতে বিপিন চন্দ্র ফুল্ল যেন পূর্ণ চন্দ্র


কেনুভাঙ্গা গ্রামে অধিষ্ঠান।


রূপ গুলে দেবোপম বলি ক্রমে সেই ক্রম


মাতুল সম্পর্কে দেবী চান।।


শৈশবে করিল শিক্ষা যৌবনে চরিত্র রক্ষা


মন্ত্র-দীক্ষা না করে গ্রহণ।


যা্ত্রাগানে অনুরক্তি অভিনয়ে মহাশক্তি


সবে বলে নয়ন-রঞ্জন।।


এই ভাবে কাল যায় দেবী চান তাঁরে কয়


“ওরে ভোলা কত কি খেলিবি?


কত কাজ আছে বাকী তোরে তার লাগি ডাকি


গেলে দিন শেষে কি করিবি?”


এই কথা শোনা মাত্র কেঁপে উঠে তাঁর গাত্র


ছিন্ন-পত্রসম ভূমে পড়ে।


কেন্দে কয় ‘দয়াময় এত দিন কেহ হায়


অভাগারে নিলে না’ক ধরে?

 

 

 

খেলা ধূলা ছাই মাটি আজ বুঝিয়াছি খাঁটি


পরিপাটি শুধু হরিনাম।


সাজ ফেলে পরি সাজ সে সাজ পরালে আজ


সেই সাজে আমি সাজিলাম।।


জীবনের ভার লহ কোন পথে চলি কহ


তুমি নহ কভু মোর পর।


নৌকিক সম্বন্ধ ছাড়ি গুরু বলে মান্য করি


দিব পাড়ি অকুল সাগর।।”


কথা শুনি দেবী কয় ‘বিপিন রে! নাহি ভয়


অকুলের আছে যে-কান্ডারী।


কুলহারা কুল পাবে মরিবেনা কেহ ডুবে


হরি এল ওড়াকান্দী বাড়ী।।


মোর সাথে চল চল বসে থেকে কিবা ফল


কল্প বৃক্ষ ফল নিয়ে সাথে।


আহা রে! দুর্ভাগা জীব হরি হ’ল সদাশিব


চিনলি না কোন অপরাধে।।


তোরা যে সন্তান তাঁর সবারে করিতে পার


কর্ণধার সেজেছে সে নিজে।


যদি পারে বাঞ্ছা হয় ওঠে গিয়ে তাঁর নায়


পড় তাঁর চরণ-সরোজে।।”


এই ভাবে করে খেদ বিপিনের বক্ষ-ভেদ


হ’ল শুনি সাধুর কাকুতি।


কেন্দে পড়ে তার পায় বলে ‘গুরু দয়াময়!


দয়া করে কর মোরে সাথী।”


এইভাবে সে বিপিন মত্ত হ’ল দিনে দিন


দেবীচাঁদ দিল শক্তি তাঁরে।


শক্তিবলে সুমহান কার্য করে মতিমান


সে কাহিনী বলা হবে পরে।।


সেই হতে সর্ব্বদায় বানিয়ারী গ্রামে যায়


আয় যায় ধাম ওড়াকান্দী।


দেবী চাঁদ যাহা বলে সদা সেই মত চলে


ভক্তিগুণে তাঁরে করে বন্দী।।


শক্তিমান মহাসাধু শ্রীহরি নামের মধু


বিলাইল দেশে কি বিদেশ।


কি কব গুণের কথা রোগে শোকে শান্তিদাতা


প্রাণহারা প্রাণ পেয়ে হাসে।।


সে কীর্তি কাহিনী যত ঘটিতেছে অবিরত


পরে তাহা করিব বর্ণনা।


সংক্ষেপেতেঃ বলি এই গোস্বামীর মৃত্যু নেই


অমরত্ব করেছে সাধনা।।


রাজনগরেতে বাস নামে নেপাল বিশ্বাস


গণেশ নামেতে অন্যজন।


দেবী চাঁদে করে মান্য তাঁহার আদেশ ভিন্ন


কোন কর্ম্ম না করে মনন।।


এইভাবে পরচার করে দেবী ঘরে ঘর


সমাচার শোনে প্রভু কাণে।


একদিন যবে দেবী নিষ্কলঙ্ক-পূর্ণ ছবি


প্রণমিল প্রভুর চরণে।।


প্রভু ডেকে তারে কয় ‘শোন দেবী এ সময়


দক্ষিণেতে করহে গমন।


উঠেছে আমার মনে মনে হয় বাদাবনে


ভক্ত সেথা আছে বহুজন।।


তুমি মোর কথা লও শীঘ্র করি চলি যাও


বাদা বনে করগে প্রচার।।”


দেবী কহে “গুণনিধি এত ইচ্ছা হ’ল যদি


পূর্ণ হোক যে-ইচ্ছা তোমার।।”


গৃহে আসি অতঃপরে ডাকি কহে গণেশেরে


‘মোর বাক্য শুনহে গণেশ।


ঠাকুরের আজ্ঞা রয় একবার এ সময়


ঘুরে এস সে-দক্ষিণ দেশ।।”


আজ্ঞামতে সে গণেশ চলিল দক্ষিণ দেশ


খুলনা জেলায় উপস্থিত।


বাগেরহাট মহকুমা বাদা যার শেষ সীমা


সেই দিকে চলিল ত্বরিত।।

ডেউয়াতলা নামে গ্রাম তথা বসি করে নাম


‘হরিচাঁদ’ বলে ছাড়ে হাই।


মতুয়ার গান গায় দুই চক্ষে ধারা বয়


ভাব দেখে অবাক সবাই।।


সেই রাত্রি সেইখানে উপস্থিত দুইজনে


নাম জানি গোপাল, গণেশ


মামা আর ভাগিনেয় ধনে মানে নহে হেয়


মনে নাহি নিরানন্দ লেশ।।


গান শোনে সে গোপাল দুই চক্ষে ঝরে জল


পুরাতন কথা জাগে প্রাণে।


সুধামাখা এ সঙ্গিত গেয়ে ছিল সুললিত


বিবাহের দিন একজনে।।


ভস্মে যথা অগ্নি-ঢাকা এ সঙ্গীত মধুমাখা


ছিল ঢাকা বিষয়-ঝঞ্ছাটে।


বহু দিন পরে দেখা আর কিরে যায় থাকা


কি যে লেখা ছিল রে ললাটে।


ঢাকা যাহা ছিল বুকে বে’র হল ভক্ত মুখে


মনোসুখে কান্দিল গোপাল।


কেন্দে কয় “হে গোঁসাই! আর কোন কথা নাই


ধন্য মানি আমার কপাল।।


মম গৃহে চল তুমি সব কথা শুনি আমি


এই গান পেলে কার ঠাঁই?


যার গান সে কোথায়? আমার যে মন চায়


সেই মানুষের দেশে যাই।।


যেতে নাহি কর বাধা ভেঙ্গে ফেল সব দ্বিধা


এক কথা পড়ে মোর মনে।


আমার ভাগ্নের নাম শোন বলি গুণধাম


নামে নামে সম তব সনে।।


দুই জনে হও মিত্র এই পরিচয় সূত্র


বাঞ্ছা মাত্র কহি তব ঠাঁই।


তুমি যদি চল সাথে বড়ই আনন্দ তাতে


মনে আমি বড় শান্তি পাই।।”


গোপালের সে কথায় গণেশের শান্তি হয়


আনন্দে চলিল তাঁর সাথে।


গিয়ে গোপালের বাড়ী ফিরে এল তাড়াতাড়ি


কথা বলে বহুবিধ মতে।।


ওড়াকান্দী গুণ গান শুনিলেন মতিমান


আর শোনে দেবীচাঁদ কথা।


সকল শুনিয়া কানে গাঁথি নিল মনে প্রাণে


শ্রদ্ধাভরে নোয়াইল মাথা।।


দেবী চাঁদ দেখিবারে বাসনা হ’ল অন্তরে


বানীয়ারী যেতে হ’ল মন।


মাধব মামা’ত ভাই তাহারে জানা’ল তাই


একা ছিল হ’ল দুই জন।।


মাধবের পরিচয় বল কিছু এ সময়


বেতকাটা বাড়ী হ’ল তাঁর।


চারি ভাই শুদ্ধ শান্ত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা লহ্মীকান্ত


রাধাকান্ত অনুজ তাঁহার।।


তৃতীয় মাধবচন্দ্র ছোট ভাই রতিকান্ত


পিতা হ’ল নামে নীলমণি।।


নীলমণি সোনা রাম দুই ভ্রাতা অনুপম


গোপালের মামা এরা জানি।।


এই দীন গ্রন্থকার এই বংশে জন্মতার


পিতা তার সাধু রাধাকান্ত।


মাধবের ভ্রতুষ্পুত্র কাজে নহে নামে মাত্র


কর্ম্মদোষে আছে পথভ্রান্ত।।


মাধব আর গোপাল বাঁধিলেন একদল


শ্রীনাথ মিশিল তার সাথে।


তিনজনে চলি যায় বানেরী হয় উদয়


দেবীচাঁদ পাইল দেখিতে।।


মন সঁপে তাঁর পায় দেবী লহ্মীখালী যায়


আর গেল বেতকাটা গ্রামে।


দেবী গেল যেইখানে মহাভাব সেইখানে


সবে মত্ত হল’ হরিনামে।।

 

এইভাবে বাদা বনে দেখা গেল এতদিনে


ঠাকুরের ভক্ত কত আছে।


গোপালের কীর্তি যাহা অনন্ত অসীম তাহা


সেই কীর্তি গাহিব যে পাছে।।


এখানে সংক্ষেপে বলি গোপালের পদধূলি


পেতে ইচ্ছা করে দেবতায়।।


মহা-দেহে প্রেল প্রাণ পাপী তাপী হল ত্রাণ


গোপালের অসীম দয়ায়।।


দেবীচাঁদ কি যে দিল পরশে পরশ হ’ল


সে-পরশ মেলে ভাগ্য গুণে।


গোপাল সাধুর নাম দিতে পারে মোক্ষধাম


রক্ষা পায় রণে কিংবা বনে।।


দেবীচাঁদ কোনভাবে গোপালে আনিল ভাবে


কোনভাবে দেখা’ল ঠাকুর।


সেই সব পুণ্যবাণী অমৃত রসের খনি


পরে আমি গাহিব প্রচুর।।


এবে শুন কোন কার্য্য দেবীচাঁদ করে ধার্য্য


কিমাশ্চর্য্য দয়া ধৈর্য্য রয়।


গোপালের ভক্তিগুণে দেবী চড় সুখী মনে


মাঝে মাঝে লহ্মীখালী যায়।।


গ্রামেতে বিরোধী যারা বোঝেনা কর্ম্মের ধারা


ক্রোধ করি শাস্তি দিতে চায়।


ছল করি গোস্বামীরে ইচ্ছা করে মারিবারে


গোপাল জানিতে তাহা পায়।।


গুরুকে রাখিয়া ঘরে একা চলে রাজদ্বারে


নিজ শিরে বহে অপমান।


মনে ক্ষুদ্ধ হয়ে অতি গৃহে ফিরে মন্দগতি


দেবীচাঁদ পথে আগুয়ান।।


গোপালের মুখ দেখি বুঝিতে থাকে না বাকী


বলে ‘দুঃখ না ভাবিও মনে।


যাহা করে হরি করে দোষ নাহি দিও কারে


করে সব মঙ্গল কারণে।।


আমাদের নিষ্ঠা কত হরি তাহা দেখিবে ত


কত শত কষ্ট আছে পাছে।


শোন বলি হে গোপাল এক মাঘে শীতকাল


গত নহে আরো মাঘ আছে।।


মনে ক্রোধ নাহি কর আমার বচন ধর


নিষ্ঠা রাখ গুরুচাঁদ পদে।


বসুমতী কত সয় জগন্মাতা তাতে কয়


সৃষ্টি রক্ষা করিছে বসুধে।।”


এ ভাবে প্রবোধ দেয় গোপালের শান্তি হয়


বলে “কর্তা তোমার দয়ায়।


দুষ্টগণে রক্ষা পায় তা’ না হ’লে এ নিশ্চয়


জনে জনে করিতাম ক্ষয়।।


গোপালের কাছে আসি দেবীচাঁদ কহে হাসি


‘হে গোপাল! এ বড় অন্যায়।


ক্ষমাই সাধুর ধর্ম্ম সাধনার মূলমর্ম্ম


ক্ষমা ছাড়া উচিত না হয়।।”


এ ভাবে সান্ত্বনা করে দেবীচাঁদ গেল ঘরে


ক্রমে ঘটে অপূর্ব্ব ঘটনা।


সেই সব পরিচয় মনে মোর এ আশায়


শেষ ভাবে করিব বর্ণনা।।


দেবীচাঁদ বোঝে প্রাণে গোপালেল ভাব জেনে


মহাশক্তি ধারী সেই জন।


তাঁর গুণে একদিন ত্রাণ পাবে বিশ্বজনে


নাম হবে মহা-উদ্ধারণ।।


তাই ইচ্ছা করে মনে শিষ্যগণে জনে জনে


গুরুচাঁদে করিতে অপূর্ণ।


কি ভাবে সে সব হল কোন ভাবে কারে দিল


পশ্চাদ্শাগে করিব বর্ণণ।।


এবে শুন আরো কথা সে দেবীর তেজস্বিতা


গুরু শিক্ষা জোর কতখানি।


জাতির মঙ্গল তরে মীড যে প্রস্তাব করে


প্রভু তাহা লইলেন মানি।।

বিধবার বিয়া দিতে প্রভু রাজী হ’ল তাতে


ভক্তগণে জানা’ল সে কথা।


সেই আজ্ঞা শুনি কানে চিন্তা হ’ল ভক্তগণে


কার কার ঘুরে গেল মাথা।।


কোন হয় এ প্রকার করেছি মীমাংসা তার


বিধবা বিবাহ প্রস্তাবনে।


এখনে বলিব মাত্র ধরি দেবীচাঁদ সূত্র


কিবা করে সেই মহাজনে।।


সবে চুপ করি রয় কেহ নাহি কথা কয়


চিন্তা হ’ল ভকত সমাজে।


বীর-মূর্ত্তি দেবী চান হয়ে এল আগুয়ান


কর জোড়ে কহে গুরু-রাজে।।


“পদে এই নিবেদন শুন পতিত পাবন


মঙ্গলামঙ্গল নাহি জানি।


তুমি যা’তে সুখী হও তুমি তাহা বলে দেও


শুধু মাত্র সেই কথা মানি।।


বিধবা বিবাহ তুচ্ছ ইহা হ’তে আর উচ্চ


যদ্যপি কঠিন কিছু কহ।


দেহে যদি প্রাণ রয় বলি আমি সুনিশ্চয়


দিব তাহা তুমি যাহা চাহ।।”


শুনিয়া তেজের বাণী গুরুচাঁদ গুণমনি


বলে “ধ্য দেবী চাঁদ সাধু।


তোমার কর্ম্মেতে তুষ্ট হইবেন জগদিষ্ট


তুষ্ট আমি একা নহি শুধু।।”


এই কথা যবে কয় গুরুচাঁদ দয়াময়


আর দেবীচাঁদ যাহা বলে।


দ্বিধা ভাব ফেলে দূরে অন্য সবে বলে পরে


“বিয়া মোরা দিব কুতুহলে।।”


দেবীচাঁদ মহাশয় অতঃপর গৃহে যায়


বিবাহের জন্য ভারী ব্যস্ত।


ডাকি বলে ভক্তগণে “তোমাদের জনে জনে


এই কার্য্য করিলাম ন্যস্ত।।”


দেবীর সে আজ্ঞা পেলে ভক্তগণে চলে ধেয়ে


অবিলম্বে হ’ল আয়োজন।


বিধবার বিয়া হল সেই সব পরিচয়


পূর্ব্বভাগে করেছি বর্ণণা।।


এই কার্য্য শেষ করি মুখে বলি হরি হরি


দেবীচাঁদ ওড়াকান্দী যায়।


গোপাল চলিল সাথে দেবীচাঁদ সুখী তাতে


মনোগত ভাব নাহি কয়।।


গুরুচাঁদ দরশনে অতি আনন্দিত মনে


দেবীচাঁদ কহিছে ভারতী।


“তব দয়া গুণে নাথ তব যাহা মনোগত


সেই কার্য্য করেছি সম্প্রতি।।


গুরুচাঁদ শুনি কথা মীডেরে ডাকিয়া তথা


বলে “মীড শুভ সমাচার।


বিধবার বিয়া দিল দেবী চরণ মন্ডল


এই জন শিষ্য যে আমার।।”


মীড কহে ‘বড় কর্তা বড় শুভ এই বার্তা


ধন্যবাদ করি এই জনে।


এ লোকের ছবি চাই পাঠাব রাজার ঠাই


যাতে রাজা এই জনে চেনে।।”


গুরুচাঁদ দিল সায় মীড ছবি তুলি লয়


সেই ছবি গেল রাজদ্বারে।


সবে বলে ‘ধন্য ধন্য দেবী চাঁদ হ’ল মান্য


নাম তাঁর গেল ঘরে ঘরে।।


কার্য্য তাঁর হ’ল শেষ ইচ্ছিলেন হৃষিকেশ


নিতে তাঁর আপনার লোক।


দেবী চাঁদ বোঝে তাই মনে তাতে দুঃখ নাই


গোপালেরে নিজ কাছে ডাকে।।


নিজ হাতে ধরি তাঁরে গুরু চাঁদ দান করে


গুরু পদে সে তার দক্ষিণা।


অন্তয্যামী দয়াময় নিজ হাতে ধরি লয়


গোপালেরে করিল করুণা।।

ঢালিয়া অসীম স্নেহ গড়িয়া একটি দেহ


গুরু চাঁদে দেবী করে দান।


নেহারী অমৃত দৃষ্টি গুরুচাঁদ করে সৃষ্টি


শ্রীগোপাল সাধুর প্রধান।।


দান দিয়ে ধন্য হয় দেবী ভাবে আর নয়


এ যাত্রায় খেলা করি শেষ।


অস্তে যাবে দেবীচন্দ্র কহে দীন মহানন্দ


হরি বল ছেড়ে হিংসা দ্বেষ।।




গোস্বামী দেবীচাঁদের মহাপ্রস্থান

বিধবার বিয়া হ’ল বিভিন্ন জেলায়।


প্রভু বলে “থাক দেবী! আর বেশীয় নয়।।


যা হল হয়েছে ভাল আর কার্য নাই।


উদ্দেশ্য সফল হ’ল আর নাহি চাই।।


“যথা আজ্ঞা” বলি দেবী গৃহেতে আসিল।


“চন্ডাল” মোক্ষণ হল সংবাদ শুনিল।।


আনন্দে নাচিয়া সাধু বলে “হরি বোল!


জন্ম জন্মান্তরে আজি কেটে গেল গোল।।


আহা রে! অজ্ঞান জাতি! চক্ষু না মেলিল।


দেখ এসে অনায়াসে কিবা ধন পেল।।


দেশে দেশে এই বার্তা করে পরচার।


দৈব ক্রমে দেহে তাঁর হল কালা জ্বর।।


জ্বর মাত্রে দেখা দিল গোস্বামী কহিল।


এস সবে মোর ঠাঁই সময় আসিল।।”


কেহ কান্দে কেহ কেহ সাহসের বাণী।


গোস্বামী বলেন “ওরে সব আমি জানি।।”


আমার যে যেতে হবে তাতে ভুল নাই।


পবিত্র চরিত্র রক্ষা করিও সবাই।।


ওড়াকান্দী যাতায়াত করিও সকলে।


প্রাণপণে করো যাহাগুরু চাঁদ বলে।।


গুরুচাঁদ জেন নহে কিছুতে মানুষ।


পতিত পাবন তিনি পরম পুরুষ।।


সেই পদে করো সবে আত্ম সমর্পণ।


নিজালয় এসে আমি করিব গমন।।”


এতেক বলিয়া সাধু মুদিল নয়ন।


‘হা’ গুরু, হা’ গুরু, বলোন্দে ভক্তগণ।।


শোকের পাথারে ফেলে দেবী চাঁদ গেল।


দেবী চাঁদ প্রীতে সবে হরি হরি বল।।




 

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 63 বীর সাধক মহাত্মা দেবীচাঁদ গোস্বামীর জীবন কথা প্রণতি

প্রণাম চরণে দেব দেবীচাঁদ স্বামী।


জ্ঞানে কর্ম্মে ধর্ম্মে সদা ভক্ত-শ্রেষ্ঠ তুমি।।


মম গুরু শ্রীগোপাল তুমি তস্য গুরু।


মম পক্ষে তাই তুমি বাঞ্ছা-কল্পতরু।।


বালক বয়সে তোমা হেরেছি নয়নে।


আজি কিন্তু দাদু তাহা নাহি মোর মনে।।


পুত্র হতে পৌত্র নাকি হয় প্রিয়তর।


তাই নিবেদন পদে রহিল আমার।।


গুণ নাই জ্ঞান নাই নাহি ভক্তি লেশ।


তবোপরে তবু মোর দাবী নহে শেষ।।


এসোহে দয়াল দাদু! হৃদয় কন্দরে।


গাহ হরি-গুণ-গীতি মধুময় স্বরে।।


সেই ধ্বনি বিশ্বজনে করিব বন্টন।


তব পরিচয় মোর সফল জীবন।।


সুপুত্রের গুণে পিতা হয় পরিচিত।


সকলে সুপুত্র তব ভুবন-বিদিত।।


গোপাল বিপিন আর শ্রীতপস্বী রাম।


নেপাল মাধব এরা সবে গুণধাম।।


রত্নের আকর ছিল তোমার হৃদয়।


তাই বিশ্বে দিয়ে গেলে রতন নিশ্চয়।।


জহুরী সাজিয়া তুমি আনিলে জহর।


শুদ্ধ শান্ত শক্তিমন্ত সাধুর বহর।।


গুরুচাঁদ-রূপালোকে পতঙ্গের প্রায়।


ঝাঁপ দিয়ে গুণনিধি ত্যজি সমুদয়।।


আলোকের কণা তুমি তথা হতে নিলে।


দাবানল সম তাহা সর্ব্বত্র ছড়ালে।।


পাপ তাপ মায়া মোহ পুড়ে হল ছাই।


গলিত-কাঞ্চন সম বহু ভক্ত পাই।।


পতিত তরাতে ইচ্ছা গুরুচাঁদ করে।


তাঁর ইচ্ছা পূরাইলে অন্তরে বাহিরে।।


সবার বিরুদ্ধে-কর্ম্ম নিজ তেজোগুণে


হে বীর! করিলে তুমি শঙ্ক-হীন মনে।।


জ্ঞা কর্ম্ম সম্মিলনে তোমাতে হইল।


যতেক পতিত জাতি তাহাতে তরিল।।

 

বিধির বিধান বুঝি বুঝেছিলে মনে।


তাই গেলে নিজ-লোকে কর্ম্ম অবসানে।।


পুত্রগণে দিয়া গেলে নিজ কর্ম্ম ভার।


তাহাদের মধ্যে হেরি প্রকাশ তোমার।।


তোমার অসীম লীলা চাই লিখিবারে।


আপনা আপনি লীলা লেখ দয়া করে।।


মহাশান্ত বীর্য্যবন্ত সহজ সরল।


প্রেম-গঙ্গা হৃদি-মধ্যে করে টলমল।।


পবিত্র চরিত্র রক্ষা যাহে সবে করে।


বারে বারে শতবারে দন্তিতে সবারে।।


অগ্নি-মন্ত্রী হে তপস্বী! এসো পুনরায়।


দলিত পতিত নয় তোমাকেই চায়।।


প্রিয়তম দাদু মোর আজিকে কোথায়?


তোমার স্নেহের ছোঁয়া মহানন্দ চায়।।


পরম দয়অল তুমি এই জানি মনে।


দয়া করে এসো দাদু! মম হৃদাসনে।।


কল্পলোকে গল্প গুলি ভাসিয়া বেড়ায়।


প্রেম ডোরে বন্ধে এসে শুনাবে আমায়।।


তোমার রচিত গাঁথা তোমারে শুনাই।


তোমারে চিনুক সবে এই মাত্র চাই।।


তোমার চরণ তলে রাখিলাম শির।


হাসাও কান্দাও দাদু! ভক্ত-শ্রেষ্ঠ বীর।।”


পরিচয়

শ্রীদেবী চরণ নামে মন্ডল উপাধী।


ধর্ম্মবীর কর্ম্মবীর বহু গুণ নিধি।।


আদি বাস ছিল ফরিদপুর জেলায়।


গোপালগঞ্জ থানা মচন্দপুর গাঁয়।।


পরে বাস করিলেন বাণীয়ারী গ্রাম।


বরিশাল জিলা মধ্যে নয়নাভিরাম।।


পাটগাতী গ্রামে ধনী সম্মানিত অতি।


মন্ডল উপাধিধারী করেন বসতি।।


গাতিদার সেই বংশ বড়ই সম্মান।


নমঃশূদ্র কুলে জন্ম বংশেতে প্রধান।।


সেই ঘরে দেবী চাঁদ করিত চাকুরী।।


কাজ কর্ম্মে ছিল তেঁই বিচক্ষণ ভারী।।


অষ্ট-ধাতু-দিয়ে-গড়া সুন্দর পুরুষ।


সাবধানী সর্ব্বকর্ম্মে ছিল তাঁর হুষ।।


দুষ্ট প্রজা যদি কেহ কর নাহি দেয়।


দেবীকে দেখিলে কর তখনি জোগায়।।


কি মোহিনী ছিল তার দুইটি নয়নে।


ভয়ে ভয়ে কেন নাহি চাহে তার পানে।।


এমন তেজস্বী ছিল সে দেবীচরণ।


অন্তরে কোমল যেন ফুলের মতন।।


দুঃখী যদি ভাগ্য ক্রমে পড়ে তাঁর আগে।


তাঁর দুঃখ দূর করে যত কিছু লাগে।।


দেখিতে কঠিন বটে অন্তরে দয়াল।


ঠিক যেন বৃক্ষোপরে নারিকেল ফল।।


এই ভাবে কাজ করে সেই মহামতি।


এবে শুন কোন পথে গেল তাঁর গতি।।


প্রতিবর্ষে শারদীয়া উৎসব-কালে।


শ্রীতারক গান করে সেই গৃহ-স্থলে।।


গান করে রসরাজ রসের সাগর।


প্রেমানন্দে শোনে সবে নিস্তব্ধ আসর।।


দেবীচরণের ‘পরে সকলি নির্ভর।


দেখা শুনা করে তেঁহ প্রত্যেক বছর।।


তারকে দেখিয়া দেবী ভাবে মনে মন।


কবি গান কর্তা বটে আছে বহু জন।


কিন্তু এই ব্যক্তি যেন সেই দলে নয়।


এ ব্যক্তির মধ্যে যেন অন্য কিছু রয়।।


হরিনাম শুনা মাত্র চক্ষে বহে জল।


এই কোন ভাব আমি বুঝিনা সকল।।

 

 

সন্দেহ জাগিল মনে স্থির নহে মন।


তারকেরে জিজ্ঞাসিল যেই মহাজন।।


অভয় যদ্যপি আমি পাই তব ঠাঁই।


“এক কথা তব পাশে জিজ্ঞাসিতে চাই।।”


তারক হাসিয়া বলে “গোমস্তা মশায়।


করহ জিজ্ঞাসা মোরে যাহা মনে লয়।।”


সাহসে করিয়া ভর সে দেবীচরণ।


তারকের ঠাঁই তবে করে নিবেদন।।


“কোন গুণ বল তব চোখে ভরে জল।


দিবানিশি বল কেন বল হরি বল?”


হরিচাঁদ! গুরুচাঁদ! বল অবিরত।


আমাকে সকল কহ করিয়া নিশ্চিত।।”


দেবীর বচনে সাধু হইল আকুল।


শ্রীহরি স্মরণে প্রাণ হইল ব্যকুল।।


অবিরল ঝরে জল নয়নের কোণে।


ক্ষণ কাল পরে বলে চাহি দেবী-পানে।।


“শুন শুন মহাশয়! সত্য বিবরণ।


হরি বলে কভু মোর ভরেনা নয়ন।।


শ্লেষ্মা বৃদ্ধি ধামু মোর তাই ঝরে জল।


ভাণ করে মাঝে মাঝে বলি হরি বল।।


কান্না কাটি যত দেখা তাহা কিছু নয়।


তবে এক কথা আজি বলিব তোমায়।।


হরি চাঁদ, গুরুচাঁদ শুনিয়াছ মুখে।


যাহা করে তাঁরা করে আমি করার কে?


কলি শেষে ওড়াকাকান্দী হল অবতার।


নমঃশূদ্র কুলে আসি করিল উদ্ধার।।


পিতাপুত্র অভিন্নাত্মা পূর্ণ অবতার।


যাহা কিছু দেখ বাপু সব গুণ তাঁর।।”


এতেক বলিয়া সাধু বহুত কান্দিল।


মনে মনে দেবী তাঁর চরণ বন্দিল।।


প্রকাশ্যে কহিল তঁরে করিয়া বিনয়।


ওড়াকান্দী যেতে কিন্তু মোর ইচ্ছা হয়।।”


শুনিয়া তারক বলে “শুভ সমাচার।


বারুণীর কালে দেখা পাইবে আমার।।


মম সঙ্গে যদি তুমি ওড়াকাদন্দী যাও।


ব্রহ্মার-বঞ্চিত ধন অনায়াসে পাও।।


এত বলি শ্রীতারক গেল নিজ দেশে।


এ দিকে দেবীচরণ শুধু ভাবে বসে।।


দেহ মধ্যে প্রাণ যেন আর বান্ধা নাই।


উদাস হয়েছে মন সদা ছাড়ে হাই।।


মনে ভাবে কবে যাবো ধাম ওড়াকান্দী।


মিছামিছি মায়াজালে রহিয়াছি বন্ধী।।


ক্রমে দিন গত হল বসন্ত আসিল।


তারকের কথা ভাবি ব্যাকুল হইল।।


হেন কালে একদিন প্রভাত বেলায়।


কবি রসরাজ সেই পথ ধরি যায়।।


দুই জনে নৌকা বাহে গোস্বামী আসীন।


দেবীচাঁদ এল ঘাটে অন্তরে মলিন।।


তাকে দেখিয়া চিত্ত হইল নির্ম্মল।


আপনা ভুলিয়া বলে “বল হরি বল।।”


সহজ প্রাণের ঢেউ তাহে প্রেম-বারি।


তারকের চিত্তে হ’ল প্রেমানন্দ ভারী।।


‘হরি বোল’ বলি সাধু তরণী ভিড়ায়।


শ্রীদেবী প্রণাম করে গোস্বামীর পায়।।


আনন্দে তারক তাঁরে ধরে দিল কোল।


প্রেমানন্দে দেবী বলে “বল হরি বোল।।”


কোলাকুলি করে দোঁহে প্রেমে মত্ত হয়ে।


দুই সাধু পড়ে পরে ভুমিতে লোটায়ে।।


উভয়ের চক্ষে বহে প্রেম-বারি-ধারা।


উভে কান্দে ধরি যেন জ্ঞান-হারা।।


এই ভাবে কিছু কাল কাটিল সময়।


শ্রীতারক দেবীচাঁদ ডাক দিয়া কয়।।


“এখন কি ওড়াকান্দী মন যেতে চায়।


দেবী বলে “আর মোর নাহিক সংশয়।।

 

ঠিক হল বারুনীতে দেবীচাঁদ যাবে।


তারক তাঁহাকে গুরু-চাঁদকে দেখাবে।।


এই ভাবে দুই সাধু বিদায় হইল।


তারকের তরী তবে বাহিয়া চলিল।।


বারুণী আসিতে দেরী দশ বার দিন।


চিন্তাতে শ্রীদেবী চাঁদ হতেছে মলিন।।


দেহ আছে পাটগাতী মন ওড়াকান্দী।


ক্ষণে ক্ষণে সাধু উঠে ফুকারিয়া কান্দি।।


ভাব দেখে মন্ডলেরা কানাকানি করে।


এত কাল পরে বুঝি দেবী যাবে ছেড়ে।।


কাজ কর্ম্মে মন নাই সদা উদাসীন।


এর দ্বারা কাজ করা বড়ই কঠিন।।


বহু উপকারী লোক কিবা বলি তাঁরে।


কিছু কাল দেখা যাক কি ভাবে কি করে।।


দেখিতে দেখিতে দিন আসিল নিকট।


দেবী যেন শর-বিদ্ধ করে ছটফট।।


আসিল বারুণী তিথি আকাশ নির্ম্মল।


হরি বলে ‘মতুয়া’ চলে দলে দল।।


এক সঙ্গ ধরে দেবী বেহালের বেশে।


উদয় হইল গিয়া ওড়াকান্দী বাসে।।


হরিবল, হরিবল, মুখে মাত্র ধ্বনি।


অবিরল চোখে জল পড়িছে অমনি।।


মতুয়ার সঙ্গে ধামে উপস্থিত হল।


কীর্ত্তনে মাতিয়া বলে বল হরিবল।।


হেনকালে শ্রীতারকে দেখিবারে পায়।


প্রেমে মত্ত মহাসাধু চরণে লোটায়।।


তারক টানিয়া তাঁরে লইলেন কোলে।


কোলে পড়ি কান্দে আর হরি হরি বলে।।


তারক কহিল তারে “শুন মহাশয়।।


চল এবে গুরুচাঁদে দেখাব তোমায়।।”


গুরুচাঁদ নাম শুনি সাধু কেন্দে কয়।


“আমার কি হবে বল সে ভাগ্য উদয়?


নয়নে দেখে না কিছু মন সব দেখে।


মনে যাঁরে লাগে ভাল মন তাঁরে রাখে।।


আমার অবোধ মন কাদা-মাটী-ভরা।


আমার কি হবে দেখা প্রভু মনোহরা?”


বিলাপ করিয়া সাধু কান্দে উভয়রায়।


শ্রীতারক বলে “সাধু নাহি কোন ভয়।।”


পরম দয়াল মোর এল এই কুলে।


তাঁর কৃপা দৃষ্টি আছে বেড়িয়া সকলে।।


সুবোধের জন্যে দয়া কিবা প্রয়োজন?


অবোধ অজ্ঞানে লাগে দয়ার কিরণ।।


অতএব চল এবে যাই তাঁর ঠাঁই।


দেখি সেই রাঙ্গা পদে স্থান যদি পাই।।


এত বলি দুই সাধু উঠিয়া চলিল।


গুরুচাঁদ সন্নিকটে উপস্থিত হল।।


আসনে বসিয়া প্রভু পরম দয়াল।


ভক্ত সঙ্গে কথা কহি হাসে খল খল।।


এমত সময় দেবী তারক সহিতে।


উপনীত হল গুরুচাঁদের সাক্ষাতে।।


চাহিয়া দেখিল যেন গলিত-কাঞ্চন।


নরমূর্তি ধরি করে প্রেম-আলাপন।।


কিবা সে চরণ-যুগ রক্তরাগ-মাখা।


উভপদে দেখা যায় দীর্ঘ উর্দ্ধরেখা।।


অঙ্গের গঠন নাহি বর্নিবারে পারি।


অঙ্গহতে জ্যোতিঃ যেন উড়ে সারি সারি।।


দীর্ঘ ভূজ করপদ্মে ঊদ্ধ-রেখা-আঁকা।


প্রশস্ত বুকের ছাতি স্বল্প লোমে ঢাকা।।


আলতা গুলিয়া যেন গুগ্ধের সহিত।


প্রভুর অঙ্গেতে বিধি করেছে মিশ্রত।।


সুকোমল ঢল ঢল চারুচন্দ্রানন।


চৌরাশ কপাল তাঁর অতি সুশোভন।।


নয়ন যুগল যেন সন্ধ্যাতারা প্রায়।


ব্যথিত জীবের প্রতি চাহে করুণায়।।

 

শির যেন সুমেরুর উচ্চ-শ্বেত-চুড়া।


সুঘন কেশের দলে চারিদিকে বেড়া।।


নিরিবিলি নিরজনে সে কোন ভাস্কর।


গঠিল এমন অঙ্গ যেন সুধাকর।।


পিক-কন্ঠ যিনি স্বর মধুর মধুর।


যেই শোনে সেই হয় প্রেমেতে আতুর।।


রূপ দেখে সুর শুনে দেবীচাঁদ নাই।


আপনা ভুলিয়া শুধু ছাড়ে ঘন হাই।।


কিছুকাল এইভাবে দাঁড়াইয়া ছিল।


অকস্মাৎ ভূমিতলে লুটায়ে পড়িল।।


তাহা দেখি গুরুচাঁদ ডাক দিয়া কয়।


“এ কারে আনিলে সাথে গোস্বামী মশায়?


চেহারায় মনে হয় জন্ম উচ্চ বংশে।


জ্ঞানে গুণে কম নাহি হবে কোন অংশে।।


বড়লোক বড়-মন বড় সমুদয়।


ওড়াকান্দী আসে এরা ঠেকে কোম দায়?


এ বাড়ী কাঙ্গালে চেনে কাঙ্গালী-নিবাস।


কাঙ্গালের বাড়ী এই তাদের বিশ্বাস।।


ধূলা বালি মেখে তারা হেথা সুখে রয়।


মিলেনা আহার তবু কথা নাহি কয়।।


দুঃখী যারা দুঃখ ছাড়া সুখ নাহি চিনে।


মিলাতে দুঃখীর মেলা আসে সে এখানে।।


বড় যারা সুখী তারা বল কোন গুণে।


দুঃখীর আলয়ে তারা আসিবে কেমনে?


যারা যারা আসে হেথা তারা ভাল জানে।


দুঃখ-ছাড়া সুখ কভু পাবে না এখানে।।


দুঃখলে পশরা তারা করে নিজ শিরে।


দুঃখের-বান্ধব-হরি সাথে সাথে ফিরে।।


সুখের পিয়াসী যারা তারা কেন আসে?


দুঃখী সুখী বল কবে এক সাথে বসে?


কাজ নাই সুখী নিয়ে দুঃখী মোর ভাল।


দুঃখী জনে বন্ধু জেনে করেছি সম্বল।।”


এতেক কহিলা যদি পতিত-পাবন।


করজোড়ে দাঁড়াইল সে দেবীচরণ।।


জলধারা বহে চক্ষে কম্পিত শরীর।


ঘন ঘন বহে শ্বাস চিত্ত নহে স্থির।।


কেন্দে কয় “দয়াময় কিবা কব আর?


পড়েছি অকুল নীরে কর মোরে পার।।


এ অকুলে ভূমন্ডলে বন্ধু কেহ নাই।


দয়া করে তোল মোরে ক্ষীরোদের সাঁই।।


করুণ নয়নে চাহ অগতির গতি।


গৌরবে ডুবেছি করে সুখর বসতি।।


সুখ বলি যারে বলি সে’ত সুখ নয়।


বাতুলতা মাত্র তাহা বুঝেছি নিশ্চয়।।


ধন জন মান যশ জীবে সদা চায়।


নশ্বর সকলি তাহা দু’দিনে ফুরায়।।


ধন-হারা হতে প্রভু না লাগে সময়।


স্বার্থ গেলে জনপ্রাণী সবাই দূরে যায়।।


মান যশ প্রতিষ্ঠাদি সকলি নশ্বর।


ধনে জনে বাধ্য কভু নহেন ঈশ্বর।।


এ-তত্ত্ব বুঝিল ভাল রূপ সনাতন।


তুচ্ছ ধন ফেলে নিল পরমার্থ ধন।।


সে কথা আমার বলা বাতুলতা মাত্র।


আমি পাপী তারা ছিল পরম পবিত্র।।


সুখেরে চাহিয়া প্রভু জীবন কাটিল।


যত চাই সুখ মোরে দেখা নাহি দিল।।


আলোয়ার পাশে যথা পথ-হারা ধায়।


অন্ধকারে মরে ঘুরে পথ নাহি পায়।।


এ ভব আন্ধার ঘোর আমি পথ-হারা।


সুখের আলোয় মোরে করিয়াছে সারা।।


ওহো রে! দুঃখের বন্ধু! যদি দিলে দেখা।


সুখের বসতি ভেঙ্গে কর মোরে একা।।


দুঃখের আকাশ তলে আমি বান্ধি ঘর।


দুঃখ হোক সখা, সাথী দুঃখ সহচর।।

দুঃখের আগুণ পুড়ে হবে আমি ছাই।


দুঃখের বান্ধব হরি তাকে যদি পাই।।


দুঃখের ভূষণে ঢাকা মহাশান্তি আছে।


দুঃখেরে ধরিল দুঃখ নেবে তার কাছে।।


দুঃখের মন্দিরে রাণী দেবী শান্তি মাতা।


দুয়ারে প্রহরী সুখ উঁচু করে মাথা।।


শান্তির মন্দিরে জীব যেতে যবে চায়।


সুখ আসি হাসি হাসি তাতে বাধা দেয়।।


মোহিনী মায়ায় সুখ নিয়ে যায় দূরে।


আলোয়ার পাছে যথা পথ-হারা ঘুরে।।


যে জন সুখেরে চেনে জানে সে-মোহিনী।


সে কি কভু শোনে প্রভু সে সব কাহিনী?


বীরের স্বভাব ধরি মন্দিরেতে যায়।


সুখ তারে কত মতে কত ভয় দেয়।।


সে সব করিয়া তুচ্ছ সোজা যেবা চলে।


দুঃখের মন্দিরে তার শান্তিময়ী মেলে।।


অতল সাগর তলে গাঢ় অন্ধকার।


মুক্ত-বুকে শুক্তি শুয়ে থাকে নিরন্তর।।


শুক্তি ত খোলস মাত্র মুক্ত কিন্তু সার।


মুক্ত লোভে শুক্তিবহে বিশ্ববাসী নর।।


দুঃখের বুকেতে তুমি দুঃখহারা-ধন।


দুঃখে বিনা তোমা নাহি মিলে কদাচন।।


দুঃখ বহে সে’ত শুক্তি কেবা তাহা চায়?


দুঃখ বহে মুক্তা রূপে তোমা ধনে পায়।।


ক্ষণিক সুখের বাসা ভেঙ্গ গেছে মোর।


চিরস্থায়ী দুঃখ দাও ওহে মনোচোর।।”


এত বলি পুনঃ সাধু ধরণী লোটায়।


তাহারে ধরিয়া পুনঃ তারক বসায়।।


মহাপ্রভু ততঃপর কহে তার প্রতি।


“শোন দেবী, শোন সবে আমার ভারতী।।


কোন কাজে নাহি দেখ আমাদের হাত।


সকল কর্ম্মের কর্তা প্রভু জগন্নাথ।।


ক্ষুদ্র দৃষ্টি ক্ষুদ্র চোখে কতটুকু দেখি।


যা দেখি সামান্য তাহা বেশী থাকে বাকী।।


আমি যে কি তাহা আমি নিজে নাহি জানি।


সব জানে সর্ব্বজ্ঞাতা সৃষ্টিকর্তা যিনি।।


আমি ভাবি এই পথে আমি যাব চলে।


পারি কিনা পারি নাহি জানি কোন কালে।।


আমার ইচ্ছায় কিংবা যত্ন পরিশ্রমে।


হত যদি কোন কিছু এই ধরাধামে।।


আমার মনের মত গড়ায়ে সংসারে।


আমি সেজে রহিতাম কর্তা চিরতরে।।


কিন্তু দেখ সেইখানে মোরা কেহ নই।


খেড়ুয়ার হাতে মোরা পুতুল যে হই।।


খেড়ু খেলে তার খেলা থাকিয়া আড়ালে।


লোকে বলে ‘কি সুন্দর! পুতুল নাচালে।।”


দেবী বলিয়াছে কথা কিছু মিথ্যা নয়।


রূপ সনাতন ছিল রাজার আশ্রয়।।


মহাধনী মহাসুখী অভাব না ছিল।


তারা বল কি অভাবে সন্ন্যাসী সাজিল?


তারা কি জানিত কভু সে-সুখের-ঘর।


ভেঙ্গে হবে ধুলিস্মাৎ এতই সত্বর।।


রাজ-মন্ত্রী দুই ভাই সুখের দুলাল।


তারা কেন সে-সুখের ভাবিল জঞ্জাল।।


তারা কভু তারে নাই তাদের ভাবাল।


ভাবের অভাবে তাই ফকির সাজিল।।


সার্ব্বভৌম পন্ডিতের জান বিবরণ।


এ সব ঘটায় প্রভু কমললোচন।।


রাজা হয়ে রাজ্য করে বহু মহাশয়।


কি রাজত্ব করে গেল শ্রীঅশোক রায়।।


নাম যায় ‘চন্ডাশোক’ পাষন্ড-হৃদয়।


কোন গুণে বল পরে ‘ধর্ম্মাশোক কয়?


অপ্রিয় কার্য্যেতে যার রত ছিল মন।


তাঁরে কেন পরে বলে ‘শ্রীপ্রিয়-দর্শণ।।”

তাই বলি কে যে কেটা কেবা তাহা জানে।


পর ত দুরের কথা নিজেই জানিনে।।


যারে দিয়ে যেই কার্য প্রভু ইচ্ছা করে।


সে কার্য করাবে তারে রাখিয়া সংসারে।।


তাঁর ইচ্ছা হলে তাতে বাধা কিছু নাই।


অবাধ তাঁহার ইচ্ছা জানিবে সদাই।।


এই যে দেবীচরণ মন্ডল মশায়।


ওড়াকান্দি এল বল ঠেকে কোন দায়?


বাড়ী আছে ঘর আছে আছে ধন জন।


এ কেন ধূলায় পড়ে করিছে রোদন।।


অবশ্য প্রভুর মনে কোন ইচ্ছা আছে।


সে-ইচ্ছা পুরাতে তাই উহারে এনেছে।।


সে ইচ্ছায় দেবী যদি দিতে পারে তাল।


ধন্য হবে নাম ওর রবে চিরকাল।।


তাই বলি দেবীচাঁদ শোন বাছাধন।


এসেছিস ত আয় তুই জম্মের মতন।।


আর কোথা কিবা পাবি সব খানে ছাই।


ওড়াকান্দী এলে তার জন্ম-মৃত্যু নাই।।


এলে শুধু হবে না রে খাঁটি আসা চাই।


সব ছেড়ে এসেছ যে তার শঙ্কা নাই।।


তোরে বলি দেবী তুই আয় একবারে।


বিশ্ব বাসী নাম তোর ল’বে ঘরে ঘরে।।


এতেক বহিলা যদি পতিত পাবন।


দেবীর চক্ষেতে যেন নামিল শ্রাবণ।।


কেন্দে কয় “দয়াময়, ধন্য তব দয়া।


হীন জনে কৃপা দানে দিলে পদ ছায়া।।


তুমি ত বলেছ প্রভু’ প্রভুর ইচ্ছায়।


সকলি হতেছে বিশ্বে কহিনু নিশ্চয়।।


মো’ সব পতিত দিয়ে যদি কিছু হয়।


ইচ্ছা হলে কর তাহা ওগো দয়াময়।।”


প্রভু কহে “দেবী তোর চিন্তা নাহি আর।


ঘরে ঘরে হরিনাম করগে প্রচার।।


শুধু এক দেশে নয় দেশ দেশান্তরে।


হরি নামে ডঙ্কা মেরে বেড়া’ তুই ঘুরে।।


তোর সাথী আমি আছি কোন ভয় নাই।


ডঙ্কা মেরে বেড়া ঘুরে আমি তাই চাই।।”


হস্ত নাচইয়া প্রভু বলে এ্ই বাণী।


শক্তি পে’ল দেবীচাঁদ পরাণে তখনি।।


মুহুর্ত্তে প্রাণেতে তাঁর এল মহাবল।


মহানন্দে নৃত্য করে বলে “হরি বল।।”


এই ভাবে দেবী চাঁদ মতুয়া হইল।


দেখা মাত্র গুরুচাঁদ তাঁর শক্তি দিল।।


সেই-বলে দেবী ঘুরে দেশে কি বিদেশে।


অতঃপর কি করিল বলিব বিশেষে।।


শ্রীগুরুচাঁদের গুণে অন্ত কিছু নাই।


গেল দিন কহে হীন হরি বল ভাই।।