Saturday, August 1, 2020

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 20 শিক্ষা বিস্তারকল্পে শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ


“নহি জ্ঞানেন সদৃশ পবিত্রমিহ বিদ্যতে “
—গীতা
অনুন্নত – জাতি যত এ বঙ্গ মাঝারে।
শিক্ষাশূন্য ছিল সবে ঘোর অন্ধকারে।।
অশিক্ষার অন্ধকারে সবে মহা দুঃখী।
মূঢ় জেনে দুষ্টগণে দেয় সবে ফাঁকি।।
জমিদার মহাজন সবে উত্তমর্ণ।
কু – হিসেবে কষ্ট পায় যত অধমর্ণ।।
কর দিতে জমিদার গৃহে কেহ যায়।
সাতে পাঁচে কুড়ি বলি ত্রিশ টাকা লয়।।
কেনা – খতে টিপসহি বৃদ্ধাঙ্গুলী দিয়া।
ঋণ শোধ করে শেষে সম্পত্তি বেচিয়া।।
অজানা এ অত্যাচার বুঝিতে না পারে।
জানা – শোনা এ অত্যাচার করে ঘরে ঘরে।।
কর দিতে দেরী হলে আর রক্ষা নাই।
প্যাদা গিয়ে বাড়ি পরে করে ‘তাগাদাই ‘।।
“ওরে দুষ্ট এত কষ্ট তোর তরে সই।
এত হাটাহাটি করি খাজনাটা কই ?”
সর্ব্ব – হারা জান্তে – মরা প্রজা কেন্দে কয়।
“দয়া করে শোন কথা “প্যাদা মহাশয়।।
ধান পাট কিছু কিছু পাইয়াছি বটে।
বেচা কেনা করি নাই গিয়া কোন হাটে।।
আগ হাটে বেচাকিনি সে সব করিব।
সুদাসল সব টাকা শোধ ক’রে দিব।।
কত দুঃখে দেখ তুমি কাল যে কাটাই।
ঘরে চা ‘ল চালে খর কিছু মাত্র নাই।।
রোগ ভোগ আছে কত কেবা তাহা দেখে।
অযন্তে মরেছে খোকা ভাঙ্গা ঘরে থেকে।।
দয়া করে এই ধর তোমার নজর।
সিকি খানা ছিল ঘরে শেষ কড়ি মোর।।
হাকিয়া ডাকিয়া তবে বলিছে পেয়াদা।
‘সিকি নিয়ে সাধা সাধি আমি কিরে গাধা ?
দুই টাকা নজরানা পার যদি দিতে।
আজিকার মতে তবে পারিব ছাড়িতে।।’
অর্থ – হীন অন্ন -হীন বস্ত্র – হীন দীন।
দুঃখ ভারে অসময়ে সেজেছে প্রাচীন।।
‘ক্ষমা করো’ ‘ ক্ষমা করো’ বলি পদ ধরে।

ঘাড় ধরে প্যাদা তারে নেয় জোর করে।।


পথ মধ্যে গুতা দিতে করেনা কসুর।


দেশোয়ালী প্যাদা যেন দেখিতে অসুর।।


নায়েবের কাছে এনে উপস্থিত করে।


অযুক্তি কটূক্তি কত করে তারপরে।।


ক্ষীণ – কন্ঠে প্রজা যদি কোন কথা বলে।


পেয়াদা -গর্জনে তাহা যায় রসাতলে।।


নায়েব মশায় সাজে “ক্ষুদে জমিদার “।


“বলে চৌদ্দ পোয়া কর পা দুটো উহার”।।


দেখিয়া কৌতুক করে প্রজা দুঃখে কান্দে।


পৃষ্ঠ – মোড়া দিয়ে তার দুই হস্তে বান্ধে।।


চাবুক লাগায় পিঠে আর মলে কান।


কেন্দে কেন্দে প্রজা ডাকে কোথা ভগবান!


কত জনমের পাপী আমি নীচ ঘরে।


পশু হতে হীন জীব মোরে গণ্য করে।।


বান্ধব নাহি ‘ক কেহ অবনী মাঝারে।


গরীবের মনোদুঃখ বুঝিবার তরে”।।


নয়নের জলে তার বক্ষ ভেসে যায়।


তাই দেখি হাসি বলে নায়েব মশায়।।


“মনে মনে অভিশাপ করিতেছে বেটা।


ওরে প্যাদা আচ্ছা করে কর জুতাপেটা”।।


অসহায় মৃগ ‘পরে যথা সিংহ পড়ে।


প্যাদা হতজ্ঞান করে প্রজা এক চড়ে।।


হতজ্ঞান দেখি প্রজা নায়েবের ভয়।


জলে তেলে সুস্থ করি তাহারে বসায়।।


বলে ‘ওরে শঠ্ বেটা টাকা দিবি কবে ?


সাত দিনে নাহি দিলে টের পাবি তবে’।।


আজি কালি ও কাহিনী স্বপ্ন মনে হয়।


বর্ণে বর্ণে সত্য সব ছিল সে সময়।।


অশিক্ষা যাহারে রাখে ঢাকিয়া আঁধারে।


হিতাহিত জ্ঞান বল পাবে কি প্রকারে ?


জ্ঞানাঞ্জন বিদ্যা তাই আলোকেতে ভরা।


অজ্ঞান – বিনাশী তাহা সর্ব্ব দুঃখ -হরা।।


তাই বলিয়াছি বঙ্গে অনুন্নত যত।


অবিদ্যার অন্ধকারে ছিল জ্ঞানাহত।।


দুঃখ – যন্ত্রনায় সবে কাঁদে উভরায়।


‘ত্রাণ কর, দুঃখ হর ‘ কোথা দয়াময়!


কাঙ্গালের সে কান্নায় দয়াময় হরি।


অবতীর্ণ বঙ্গ দেশে সফলা নগরী।।


যশোবন্ত ঘরে জন্মে হরিদাস নাম।


রত্ন পেয়ে দীনগণ পূর্ণ – মনোস্কাম।।


শ্রী হরি ঠাকুর বলি হ’ল পরিচয়।


চন্দ্র তুল্য কান্তি হেরি “হরিচাঁদ “কয়।।


কাঙ্গালে তারিতে প্রভু নর দেহ – ধারী।


অপরূপ রূপে তাঁর ভোলে নর নারী।।


এই হরিচাঁদ দেখ করূণা করিয়া।


দীন জনে উদ্ধারিল প্রেম ভক্তি দিয়া।।


“হরিলীলামৃত “নামে মহা গ্রন্থ খানি।


শ্রী তারক চন্দ্র লেখে অপূর্ব্ব কাহিনী।।


অভূত অপূর্ব্ব লীলা হরিচাঁদ করে।


তাঁর লীলা কেবা কত বলিবারে পারে ?


স্থুল কথা গ্রান্থাকারে প্রেমের ভাষায়।


সে তারক সুপরাগ গ্রন্থ লিখে যায়।।


প্রমাণ রয়েছে তা’তে প্রাঞ্জল ভাষায়।


যবে হরিচাঁদ নরদেহ ছেড়ে যায়।।


উত্তর সাধক হ’ল শ্রী গুরুচরণ।


তাঁর কাছে বলে যত ছিল আকিঞ্চন।।


অনুন্নত জাতি মাঝে শিক্ষা প্রচারিতে।


আজ্ঞা করে হরিচাঁদ তারে বিধিমতে।।


পিতার আজ্ঞাতে প্রভু পালে ব্রহ্মচর্য।


নিরলস নিদ্রাহীন এমনি আশ্চর্য।।


দৃঢ় ভিত্তি পরে নিজ জীবন গড়িল।


মহা উদ্ধারণ – শক্তি প্রাণেতে জাগিল।।


গৃহীজনে দিতে মুক্তি দীনের করুণা।


আজীবন গুরুচাঁদ করিল সাধনা।।

অর্থ হয় মহাশক্তি গৃহী পক্ষে মূল।


অর্থকে অনর্থ বলা কত বড় ভুল।।


যথা – অর্থ তথা – লক্ষ্মী তথা নারায়ণ।


আপন জীবনে করে এই আচরণ।।


অর্থ হীন গৃহীজনে শিখায় কৌশল।


ঋণ দায়ে ডোবে যেই তারে দেয় বল।।


এ আদর্শ শিক্ষা দিয়ে গুরুচাঁদ কয়।


“বিদ্যাশূন্য গৃহে কিন্তু অর্থ বৃথা যায়।।


পুরাণ – প্রবাদ বাক্য শুনিয়াছ তাই।


লক্ষ্মী সরস্বতী দোহে থাকে ভিন্ন ঠাঁই।।


আমি বলি ইহা ভুল সত্য ইথে নাই।


শ্রী বিষ্ণুর দুই পত্নী শাস্ত্র গ্রন্থে পাই।।


বিদ্যা – দেবী সরস্বতী ধন – দেবী লক্ষ্মী।


দোহে বিষ্ণুর সেবা করে শাস্ত্রে দেয় সাক্ষী।।


দোহে সতী প্রাণপতি বিনা নাহি জানে।


সতী নারী বিসম্বাদ করে কা’র সনে ?


ধনরূপে লক্ষ্মী দেবী ঐশ্বর্য দেখায়।


জ্ঞান রূপে সরস্বতী উজ্জ্বল করয়।।


দোহে এক স্বামী ভজে হয়ে এক মন।


বাদ বিসম্বাদ তারা করে না কখন।।


এই দুই শক্তি যদি নমঃশূদ্রে পায়।


জগত চিনিবে তারা কহিনু নিশ্চয়।।


আদর্শ দেখা’তে প্রভু নিজে কর্ম্ম করে।


পাঠশালে দেয় পুত্র বিদ্যা শিক্ষা তরে।।


প্রভুর প্রথম পুত্র শ্রী শশি ভূষণ।


দ্বিতীয় পুত্রের নাম সুধন্য সুজন।।


তৃতীয় উপেন্দ্র নাথ কামজিনি কান্তি।


চতুর্থ সুরেন্দ্র নাথ দরশনে শান্তি।।


পাঠশালে না থাকিলে কোথা শিক্ষা পাবে।


পাঠশালা করে প্রভু ইহা মনে ভেবে।।


নিজগৃহ পরে প্রভু করে পাঠশালা।


দেশবাসী ছাত্র আসি করিল জটলা।।


ইহা পূর্বে ঘৃতকান্দী গ্রামে স্কুল ছিল।


যতেক কায়স্ত জুটি সে স্কুল গড়িল।।


গঙ্গারাম সরকার নামেতে পণ্ডিত।


স্বজাতি কায়স্ত গণে করে যত হিত।।


প্রবল আগ্রহে তবে প্রভু সেই খানে।


শ্রী শশিভূষণে দিল শিক্ষার কারণে।।


জ্ঞান ঋষি তত্ত্বমসি যাঁহার লক্ষণ।


সেই ‘ পরামর্ষি ‘ হয় শ্রী শশিভূষণ।।


বিস্তৃত জীবন তাঁর করেছি লিখন।


এই গ্রন্থে শেষ ভাগে হ’বে সংযোজন।।


এই ভাবে শশি পড়ে ঘৃত কান্দী গাঁয়।


স্বদেশে করিতে স্কুল মনে ভাব হয়।।


দেশবাসী সবে ডাকি প্রভু বলে বাণী।


“আমার বচন শুন জ্ঞানী,গুণী, ধনী।।


শিক্ষা যদি নাহি পায় মোদের সন্তান।


শিক্ষা ছাড়া এ জাতির না হবে কল্যাণ।।


অতএব পাঠশালা করিবারে চাই।


অনুমতি করি দেহ বান্ধব সবাই “।।


প্রভুর বচন শুনি সবার আনন্দ।


সবে বলে “ধন্য তুমি প্রভু গুরুচন্দ্র।।


পতিত – তারক ছিল প্রভু হরিশ্চন্দ্র।


উপযুক্ত পুত্র তাঁর তুমি গুরুচন্দ্র।।


বিদ্যাহীন এ সমাজ পিছে আছে পড়ি।


তরাও তাহারে তুমি অকুল কাণ্ডারী “।।


সবে মিলে বসি শেষে হ’ল পরামিশে।


পাঠশালা হবে গুরুচাঁদের আবাসে।।


শুভ দিনে পাঠশালা স্থাপিত হইল।


দলে দলে ছাত্র আসি তথায় জুটিল।।


কিছুদিন পরে সবে সেই পাঠশালা।


চৌধুরী গৃহেতে রাখে বাঁধি একচালা।।


সুবিজ্ঞ পণ্ডিত নইলে শিক্ষা বৃথা হয়।


সুশিক্ষা দিবার তরে সু শিক্ষক চায়।।


স্বজাতির মধ্যেতে নাহি মিলে হেন জন।


শিক্ষকের চিন্তা করি দুঃখেতে মগন।।


অন্য জাতী শিক্ষা দেয় শুধু অর্থ জন্য।


নমঃশূদ্র গণে করে মূর্খ – মধ্যে গণ্য।।


নিরুপায় হয়ে তায় সবে ক্ষুন্নমন।


পাঠশালে দৃষ্টি নাহি করে কোনজন।।


দিনে দিনে পাঠশালা সবে দিল ছাড়ি।


সবে মিলি উপনীত ঠাকুরের বাড়ী।।


বিনয় বচনে সবে করে নিবেদন।


“বড়কর্ত্তা শুন বার্ত্তা যা ‘বলি এখন।।


শূণ্য গৃহ ভাল বলি দুষ্ট গরু – ছাড়া।


স্বজাতি বিহনে শিক্ষা চাহিনা আমরা।।


স্বজাতি শিক্ষক যদি মিলে কোন দিনে।


তাঁর হাতে শিক্ষা দিব আপন সন্তানে।।


বিহিত বিধান তার চাহি তব ঠাঁই।


স্বজাতি শিক্ষক মোরা সবে মিলি চাই”।।


বার্ত্তা শুনি গুরুচাঁদ মৌন হয়ে রয়।


কিছুকাল পরে প্রভু হাসি হাসি কয়।।


“শুনসবে দেশবাসী আমার বচন।


শিক্ষকের লাগি চিন্তা না কর এখন।।


এবে ভাদ্র মাস দেখ বরষার কাল।


দুই মাস গতে বাঞ্ছা হইবে সফল।।


দুই মাস পরে পাবে স্বজাতি পণ্ডিত।


তেঁহ হতে নমঃশূদ্রে পাবে বহু হিত”।।


কথা শুনি মহানন্দে সবে গৃহে যায়।


এদিকেতে হ’ল ক্রমে অঘ্রাণ উদয়।।


ইচ্ছাময় প্রভু মোর যাহা ইচ্ছা করে।


ইচ্ছামাত্র পূর্ণ হয় মুহূর্ত্ত ভিতরে।।


পরম পণ্ডিত রঘুনাথ সরকার।


দৈবক্রমে উপনীত ওড়াকান্দী ‘ পর।।


নমঃশূদ্র কুলে জন্ম অতি মহাশয়।


স্বজাতি উন্নতি লাগি ঘুরিয়া বেড়ায়।।


ওড়াকান্দী গুরুচাঁদ নমঃশূদ্র – পতি।


ফরিদপুরেতে আসি জানিলা সম্প্রতি।।


যার কাছে প্রশ্ন করে সেই বলে হেসে।


“কুলপতি গুরুচাঁদ “আছে এই দেশে।।


বহু মান বহু ব্যাখ্যা শুনিলেন তিনি।


দেখিবারে গুরুচাঁদে চায় গুণমণি।।


মনে ভাবি কতকাল ভ্রমি কত দেশে।


মনের বাসনা পূর্ণ হল হেথা এসে।।


ঠাকুরের গুণগাঁথা শুনে সর্ব্ব ঠাঁই।


মনে ভাবি আরোপূর্ব্বে কেন আসি নাই।।


ভাবিতে ভাবিতে চলে সেই মহাশয়।


কোন পথে ওড়াকান্দী জানা নাহি রয়।।


হেন কালে পথিমাঝে করে দরশন।


দীর্ঘ -শ্মশ্রু দীর্ঘ -কেশ এক মহাজন।।


দিব্য – কান্তি মনোহর সুহাস বদন।


ধীরপদে করিতেছে গজেন্দ্র গমন।।


মূরতি দেখিলে শির পদে নত হয়।


উজলিত দশ দিশি রূপের প্রভায়।।


দেবতুল্য মূর্ত্তি দেখি সেই রঘুনাথ।


শির নত করি পদে করে দণ্ডবৎ।।


সেই মহাজন তবে বলিল হাসিয়া।


“প্রণাম করিলে বাপ। কিসের লাগিয়া?


আভূমি প্রণাম করে” মতুয়া “সুজন।


তোমা মধ্যে দেখি না ত সে সব লক্ষণ।।


মহাজন – বাক্য শুনি বলে রঘুনাথ।


“এই প্রণামের মধ্যে নাহি মোর হাত।।


তব মূর্ত্তি দেখি প্রভু মন ভুলে গেল।


প্রণাম করিনা আমি কে যেন করা’ল।।


এক নিবেদন প্রভু করি তব পায়।


মতুয়া বলিলে যাঁরে সে জন কোথায় “।।


সে মহাপুরুষ তবে বলে হাসি হাসি।


দশন মুকুরে যেন চন্দ্র পড়ে খসি।।


‘শুনহে পথিক! তুমি বলো পরিচয়।


যেই জন হরি ভক্ত তারে মতো ‘ কয়।।


ওড়াকান্দী পুণ্যধামে হরি অবতার।


তাঁর যত ভক্ত আছে পৃথিবী ভিতর।।


‘মতুয়া ‘বলিয়া তাঁরা খ্যাতি পাইয়াছে।


আভূমি প্রণাম তাঁরা সবে শিখা ‘য়েছে।।


যাহা হ’ক এবে দাও তব পরিচয়।


কোথা ঘর কেন তুমি এসেছ হেথায় ?


সবিনয় রঘুনাথ বলে তাঁর ঠাঁই।


“শিক্ষকতা “কার্য লাগি ঘুরিয়া বেড়াই।।


নমঃশূদ্র কুলে জন্ম আমি লভিয়াছি।


বহু কষ্টে কিছু বিদ্যা শিক্ষা করিয়াছি।।


স্বজাতির ঘরে মোর বিদ্যা নাহি চিনে।


স্বজাতি বিদ্বান করি ভাবি মনে মনে।।


যেই যেই দেশে যাই স্বজাতি ভিতর।


বিদ্যা অবহেলা করে বোঝে না আদর।।


সবে মনে ভাবে “বিদ্যা আমাদের ঘরে।


আসিতে পারেনা কভু কোনদিন তরে।।


ব্রাহ্মণাদি উচ্চ বর্ণ যত এই দেশে।


তাঁরা বিদ্যা শিক্ষা করে বিশেষ বিশেষে।।


বিধাতা করেছে সবে কৃষি – ব্যবসাই।


বিদ্যা শিক্ষা এই ভাগ্যে লেখা জোকা নাই।।


মনোদুঃখে বহু দেশে আমি ভ্রমিয়াছি।


মনোমত কথা প্রভু কথা কভু না শুনেছি।।


শান্তি নাই কোথা যাই মনোদুঃখে কান্দি।


হেনকালে শুনিলাম নাম ওড়াকান্দী।।


পতিতে তারিতে নাকি হ’ল অবতার।


ভাবিলাম গেলে সেথা যাবে মনোভার।।


হেথা আসি শুনিলাম হরিচাঁদ নাই।


তস্য পুত্র গুরুচাঁদ হয়েছে গোঁসাই “।।


জনে জনে জিজ্ঞাসিয়ে বুঝিলাম সার।


পিতার সুযোগ্য পুত্র শ্রী হরি কুমার।।


তাঁর কাছে মনোব্যথা জানাবার তরে।


ওড়াকান্দী মনে ভাবি চলিয়াছি ধীরে।।


কোন্ পথে যেতে হবে কিছু নাহি জানি।


ভাবিয়াছি পথে মোরে নেবে সেথা টানি।।


আপনাকে দেখে পথে করেছি ধারণা।


পথ বলি দেবে তুমি করিয়া করুণা “।।


পুনঃ জিজ্ঞাসিল তাঁরে করিয়া মিনতি।


“কিবা নাম কোথা ধাম কোথায় বসতি ? “


সেই মহাজন তবে হাসি হাসি কয়।


“বাসুদেব “ নাম মোর শুন পরিচয়।।


শান্তিপুর ঘর মোর প্রেমবাড়ী থানা।


সব থেকে কিছু নাই এমনি ঘটনা।।


ঘর -ভরা আছে মোর সন্তান সন্ততি।


মোর বাক্য মানিবারে নাহি কা’র মতি।।


মনোদুঃখে ঘর ছাড়ি আসিয়াছি পথে।


দীন দুঃখী পেলে যাই তার সাথে সাথে।।


দীনে ভালবাসি দিয়ে সারা প্রাণ টুক্।


ধনী ছেড়ে দীনে নিয়ে তাই মোর সুখ।।


ওড়াকান্দী গাঁয়ে দুই বৈষ্ণব – বৈষ্ণবী।


পরম পবিত্র দোঁহে করুণায় ছবি।।


নমঃশূদ্র কুলে জন্ম আচারে বৈষ্ণব।


কৃষ্ণ ধ্যান কৃষ্ণ জ্ঞান দোঁহার স্বভাব।।


অন্তরে কাঙ্গাল দোঁহে বাহিরে ঐশ্বর্য।


অহরহ পান করে প্রেমের মাধুর্য।।


মম গুরুদেব যিনি পরম উদার।


তাঁর সাথে সেই গৃহে যাই একবার।।


পতি সনে সাধ্বী দেয় উত্তম আহার।


ভক্তি দেখি মনে পাই আনন্দ অপার।।


অমৃত – অধিক লাগে অন্নাদি ব্যঞ্জন।


মনোসাধে প্রাণভরে করিনু ভোজন।।


আমার আনন্দ দেখি গুরুজীর সুখ।


বলে “বাসো! এতদিনে জুড়ালি রে বুক।।

সাথে সাথে নিয়ে তোরে ঘুরি যেথা সেথা।


এই খানে খে’লি অন্ন করিয়া মমতা।।


মোর সাথে থাকি বাছা কত কষ্ট পাও।


দিন কত ‘ এই গৃহে পুত্র হয়ে রও।।


অন্নপূর্ণা মাতা তোরে বাসিয়াছে ভাল।


পতি যশোবন্ত দেখ প্রেমের কাঙ্গাল “।।


গুরুজীর কথা শুনি সেই সতী কান্দে।


ইচ্ছা করে, বাধিলাম তার প্রেম ফাঁদে।।


পুত্র সাজি সেই ঘরে খেলিলাম কত!


সম্বন্ধ করিল সাথে অন্তরঙ্গ যত।।


হরিচাঁদ নাম যাঁর শুনিয়াছ কানে।


অভেদাত্মা মোরা দোঁহে ছিনু সর্ব্বক্ষণে।।


যেই “বাসো “সেই হরি কহিত সকলে।


নাচিতাম অন্নপূর্ণা জননীর কোলে।।


হরিপুত্র “গুরুচাঁদ “জানে সর্ব্বজনে।


নিজ -পিতা সম তেঁহ সদা মোরে মানে।।


সেই হরিচাঁদ যবে লীলা করে শেষ।


তেঁহ সঙ্গে আমি তবে ছেড়েছি সে দেশ।।


তবে এক মায়া মোর আজো কাটে নাই।


বড় ভালবাসে মোরে গুরুচাঁদ সাঁই।।


মনে হয় তাঁর মধ্যে আমি সদা আছি।


মম – আত্মা হরিচাঁদ তাঁহাতে পেয়েছি।।


প্রত্যক্ষ সাক্ষাতে মোর নাহি লয় মন।


অদেখার মাঝে তাঁরে দেখি সর্ব্বক্ষণ “।।


মুরজ মুরলী যথা কান্দে নিরালায়।


সে মহাজনের বাণী তথা শোনা যায়।।


বিস্মৃতির প্রায় শুনে সেই রঘুনাথ।


অগোচরে তাঁর কত হয় অশ্রুপাত।।


মহাজন প্রতি চাহি কহিছে কাতরে।


“কোন পথে ওড়াকান্দী বল দয়া করে।।


আপনার কথা শুনে প্রাণে এই বলে।


দিবানিশি থাকি পড়ে চরণ – কমলে।।


তবু মনে হয় যেন কেন ওড়াকান্দী।


আমার পাগল মন করিয়াছে বন্ধী।।


কিবা করি কোথা যাই নাহি পাই দিশে।


মতিচ্ছন্ন হ’ল বুঝি এসে এই দেশে।।


দয়া করে বল মোরে কোন পথে যাই।


কত দূরে ওড়াকান্দী বল শুনি তাই”।।


রঘুনাথ বলে যদি এহেন বচন।


হাসি হাসি বলে তাঁরে সেই মহাজন।।


“এবে সন্ধা হ’ল তুমি দেখ রঘুনাথ।


সাহসেতে ভর করি রাত্রে চল পথ।।


যতদূর গেলে হবে নিদ্রার আবেশ।


নিশ্চয় জানিও সেই ওড়াকান্দী দেশ।।


দক্ষিণ দিকেতে এবে তুমি চল হাঁটি।


তব ঠাঁই এবে আমি লইলাম ছুটি।।


গুরুচাঁদ ঠাকুরের সাথে দেখা পাবে।


দেখা পেয়ে মোর কথা তাহাকে জানাবে।।


সে তোমা’ রাখিবে দেশে দিতে পাঠশালা।


শিখা’বে বালক গণে করিওনা হেলা।।”


এত বলি দ্রুতগতি হ’ল অন্তর্দ্ধান।


বাতাসে মিশিয়া গেল হয় হেন জ্ঞান।।


আশ্চর্য মানিয়া রঘু রহে দাঁড়াইয়া।


কেবা এল কেবা গেল ভাবিছে বসিয়া।।


আশ্চর্য ঘটনা দেখি প্রেমে পুলকিত।


রঘুনাথ পথে তবে চলিল ত্বরিত।।


মনে ভাবে গুরুচাঁদে পেয়ে দরশন।


তাঁর কাছে জানাইবে সব বিবরণ।।


অবোধ্য প্রভুর খেলা খেলার চুড়ান্ত।


ধ্যানে জ্ঞানে নাহি বুঝে পেল সে অনন্ত।।


মনে ভাবে রঘুনাথ এ কেমন কথা।


এক রাতে ওড়াকান্দী যেতে চাওয়া বৃথা।।


হেথা হতে ওড়াকান্দী রহে বহুদূর।


তাহা ছাড়া আমি অদ্য কাতর প্রচুর।।

নিদ্রাবেশ অল্প পরে চোখে হবে মোর।


হারে মন অকারণ রাত্রে চলা তোর।।


পুনঃ ভাবে এই চিন্তা কেন হল মনে।


অবিশ্বাস কেন করি সেই মহাজনে।।


এই কথা মনে হলে প্রাণে এল বল।


রঘুনাথ চলে পথে চক্ষে বহে জল।।


যে জন বাতাসে মিশে অন্তর্দ্ধান হয়।


দৈবশক্তি ধারী নর হবে সে নিশ্চয়।।


এত ভাবি রঘুনাথ কিছু পথ চলে।


মনে হল এক ক্রোশ চলে অবহেলে।।


আশ্চর্য প্রভুর চক্র দেবে অগোচর।


নিদ্রা আসি রঘুনাথে করিল কাতর।।


ঘুম ঘোরে পদক্রমে অসার হইল।


বট বৃক্ষ মূলে পড়ি নিদ্রামগ্ন হ’ল।।


কোন্ ভাবে রাত্রি কাটে কেহ নাহি জানে।


জাগিল ঊষার আলো প্রভাত আঙ্গিণে।।


নয়ন মেলিয়া দেখে সেই রঘুনাথ।


কাটিয়া গিয়াছে রাত্রি এসেছে প্রভাত।।


বৃক্ষ তল ছাড়ি তবে চলে দ্রুত গতি।


একা যায় নাহি আর সাথে কোন সাথী।।


কিছুদূরে পেল দেখা এক পথিকেরে।


“ওড়াকান্দী কতদূরে “জিজ্ঞাসে তাঁহারে।।


বিস্মিত নয়নে পান্থ চাহে তার পানে।


ক্ষণকাল স্তব্ধ রহি কহিছে তখনে।।


“অনুমানে জ্ঞান হয় তুমি ভিন্ – দেশী।


নৈলে কোথা ওড়াকান্দী বল হেথা আসি।।


ওড়াকান্দী কোন বাড়ী তুমি যেতে চাও।


এই ত সে ওড়াকান্দী কোথা যাবে যাও।।


অকস্মাৎ রঘুনাথ চমকিয়া ওঠে।


মহা পুরুষের বাণী সত্য হল বটে।।


মনে ভাবিয়াছি যাহা তাহা সব ভুল।


ওহোরে অভাগা আমি শিমুলের ফুল।।


সাশ্রুনেত্রে রঘুনাথ চাহে তার পানে।


ধীরে ধীরে বলে তারে মধুর বচনে।।


“বহু দেশ ছাড়ি আমি এসেছি এ দেশে।


হরি পুত্র গুরুচাঁদ দেখিবার আশে।।


নমঃশূদ্র কুলে জন্ম নাম রঘুনাথ।


পরম সৌভাগ্য মোর আজি সু – প্রভাত।।


প্রাণের বাসনা মোর আছে বহুতর।


ইচ্ছা আছে গুরুচাঁদে জানাতে সত্ত্বর।।


কোন্ ঘরে গুরুচাঁদ করিছে বসতি ?


দয়া করি বল ভাই আমাকে সম্প্রতি।।”


পথিক ডাকিয়া বলে “শুন মহাশয়।


রজত – ধবল সম অই দেখা যায়।।


“ঠাকুরের বাড়ী “ উহা পরম পবিত্র।


শ্রী হরিচাঁদের পীঠ পুণ্যতীর্থ ক্ষেত্র।।


টিনে – ঘেরা ঘর বাড়ী দেখিতে সুন্দর।


গুরুচাঁদ আছে বসি উহার ভিতর।।


অপলকে চেয়ে দেখে সুধী রঘুনাথ।


সসম্ভ্রমে করজোড়ে করে প্রণিপাত।।


ত্রস্ত – ব্যস্ত রঘুনাথ উঠে বাড়ী ‘পরে।


অপরূপ শোভা দেখে গৃহের ভিতরে।।


মহাপ্রভু গুরুচাঁদ আছে উপবিষ্ট।


কথা কয় হাসি হাসি মনে হয়ে হৃষ্ট।।


ধীরে ধীরে রঘুনাথ নিকটেতে যায়।


ভক্তি ভরে দণ্ডবৎ করে রাঙ্গা পায়।।


সুদৃষ্টে চাহিয়া তারে মহাপ্রভু কয়।


“কে আপনি কোথা ঘর দিন পরিচয়।।


কিবা হেতু দণ্ডবৎ করিলেন মোরে।


কি উদ্দ্যেশ্যে আগমন হল হেথাকারে ?


আসন গ্রহণ করি বলুন সকল।


আপনার দরশনে চিত্তে এল বল।।


শ্রী মুখের মধুবাণী শুনি রঘুনাথ।


আসন গ্রহণ করে জুড়ি দুই হাত।।


পথি মধ্যে মহাজনে যাহা বলিয়াছে।


ধীরে ধীরে সব কথা মনে জাগিয়াছে।।


বিপুল বিনয়ে তবে রঘুনাথ কয়।


“করিতেছি নিবেদন তব রাঙ্গা পায়।।


নমঃশূদ্র কুলে জন্ম ভিন্ন দেশে ঘর।


বিভিন্ন কারণে দেখা চাহি আপনার।।


ঈশ্বরের কৃপাক্রমে আমি নিজ দেশে।


বিদ্যালাভ করি কিছু নিজ ঘরে বসে।।


শিক্ষা শেষে এই ভাব এসেছে অন্তরে।


বিদ্যার সমান বন্ধু নাহিক সংসারে।।


এই নমঃশূদ্র জাতি বিদ্যাহীন দোষে।


দলিত ঘৃণিত হয়ে আছে বঙ্গ দেশে।।


মনে মনে আমি তাই করিলাম ঠিক্।


যদি কিছু পেয়ে থাকি স্বজাতি তা’ নিক্।।


উদ্দেশ্য সাধিতে আমি বহু দেশে ঘুরি।


স্বজাতি বোঝেনা তাহা এই দুঃখে মরি।।


ঘুরিতে ঘুরিতে আসি সেই ফরিদপুরে।


তব নাম শুনিলাম প্রতি ঘরে ঘরে।।


সবে বলে এই নাকি আপনার পণ।


‘নমঃশূদ্র ঘরে ঘরে দিবে বিদ্যা ধন’।।


এই কথা শুনি প্রাণে আনন্দ হইল।


ভাবিলাম মনোবাঞ্ছা আজ পূর্ণ হল।।


শুভক্ষণে ওড়াকান্দী বলে যাত্রা করি।


আশ্চর্য দেখেছি কত সারা পথ ভরি।।


বাসুদেব নামধারী এক মহাজন।


তব পিতৃ – বন্ধু বলি করিল কীর্ত্তন।।


হরি – হর অভেদাত্মা যেমন প্রকার।


তব পিতৃসনে সেই ভাব ছিল তাঁর।।


যেদিন শ্রী হরি করে লীলা সম্বরণ।


সেই হ’তে এই দেশে না দেয় দর্শন।।


সাধক দম্পতি ছিল এই ওড়াকান্দী।


গুরু তার রাখে তাঁরে সেই ঘরে বন্ধী।।


নিজ পুত্র সম তোমা করে দরশন।


তব ঠাঁই আসিবারে বলে সেই জন।।


আশ্চর্য শক্তি তাঁর বুঝিবারে নারি।


পলকে অদৃশ্য হ ‘ল বায়ু – ভর করি।।


মোরে বলে চিন্তা নাই নিশি গত হ’লে।


ওড়াকান্দী উপনীত হবে অবহেলে।।


প্রথমে বিশ্বাস নাহি হয় সেই কথা।


এবে দেখি তাহা ঠিক মোর চিন্তা বৃথা।।


অসম্ভব কার্য এই কেমনে ঘটিল।


এক রাতে এত পথ মোরে সে আনিল।।


এই নিবেদন মোর বলি তব ঠাঁই।


আপনার উপদেশ আমি এবে চাই”।।


সে রঘুনাথের বাক্য যবে শেষ হ ‘ল।


‘হায়’ ‘হায়’ বলি প্রভু কান্দিয়া উঠিল।।


বলে “ধন্য মহাশয়! তুমি ভাগ্যবান।


নিজ চোখে দেখিয়াছ স্বয়ং ভগবান।।


দণ্ডবৎ করি তোমা সরল – পরাণ।


নিজে দেখা দিল তোমা, প্রভু হরিচাঁন।।


পিতামহ পিতামহী দুই জন মোর।


অবিরত কৃষ্ণ প্রেমে ছিল দোঁহে ভোর।।


“রামকান্ত “ নামে সাধু মহিমা অপার।


বাসুদেব ‘ মুর্ত্তি সেবা সাধনা তাঁহার।।


অকপট ভক্তিগুণে সাধক দম্পতী।


রামকান্তে করে ভক্তি দোঁহে নিতি নিতি।।


তাঁহে তুষ্ট রামকান্ত দিল সিদ্ধ বর।


জন্ম নিবে বাসুদেব ঘরেতে তোমার।।


হরিচাঁদ রূপে বাসুদেব জন্ম নিল।


তাঁর আগমনে ধরা পবিত্র হইল।।


দয়া করে তাঁর ঘরে জন্ম দিল মোরে।


তোমাকে বলেছে কথা শুধু ভাবান্তরে।।


দুই মাস পূর্ব্বে পিতা স্বপ্ন ঘোরে বলে।


পণ্ডিত আসিবে দেশে দুই মাস গেলে।।


সেই দুই মাস আজি উতরিয়া যায়।


মনে ভাবি পিতৃবাক্য কিসে রক্ষা হয়।।


তাঁর কাজ তাঁরে সাজে তাই তিনি করে।


তোমাকে আনিয়া দিল আমার গোচরে।।


তুমি ধন্য কর ধন্য বিদ্যা – শুন্য জাতি।


দয়া করে ওড়াকান্দী কর তুমি স্থিতি।।


শ্রী গুরুর মুখে শুনি সব বিবরণ।


কেন্দে বলে রঘুনাথ “ আমি অভাজন।।


পেয়ে ধন হারা হই এমন যে অন্ধ।


বুঝিলাম কৃপা বিনে ঘুচে না’ক সন্দ।।


তাঁর সব কথা আমি এবে বুঝিয়াছি।


যাহা ইচ্ছা কর প্রভু শরণ নিয়াছি।।”


এই ভাবে রঘুনাথ পণ্ডিত সুজন।


ওড়াকান্দী স্থিতি কৈল আনন্দিত মন।।


বারশ ‘ সাতাশী সনে অঘ্রাণ মাসেতে।


পাঠশালা হল সৃষ্টি চৌধুরী বাটীতে।।


একেত পণ্ডিত সাধু রঘুনাথ নাম।


তাহে শক্তি দিল গুরুচাঁদ গুণধাম।।


দলে দলে ছাত্র আসি সকলে জুটীল।


অন্ধকার মাঝে যেন আলোক ফুটিল।।


শ্রী শশিভূষণ যিনি প্রভু জ্যেষ্ঠ – পুত্র।


সেই পাঠশালে পড়ে বলি সেই সূত্র।।


ফাল্গুন মাসেতে সবে করিলেন মন।


অন্যস্থানে পাঠশালা করিতে স্থাপন।।


গৃহস্থের গৃহ পরে ‘ পাঠশালা -ঘর।


উচিৎ না হয় মনে বুঝে অতঃপর।।


গ্রাম্য মধ্যস্থল দেখি একটি ভিটায়।


পাঠশালা গৃহখানি নির্মাণ করয়।।


দীর্ঘ এক ঘর তাতে বাঁধি পোতাখান।


টিনের ছাউনি করি করিল নির্ম্মাণ।।


আসবাব পত্র যত তৈরী করিল।


শুভ দিনে স্কুল গৃহে সবে প্রবেশিল।।


প্রভু গুরুচাঁদ করে দ্বার উদঘাটন।


জয় ধ্বনি করে জুটি দেশবাশী গণ।।


জয় হরিচাঁদ কী গুরুচাঁদ কী জয়।


জয়ের হুঙ্কারে যেন ধরা ফেটে যায়।।


গুরুচাঁদ বলে “শুন ভাই যত সব।


জাতির উন্নতি কিন্তু এই সূত্রপাত।।


যাক্ ধন যাক্ মান তা’তে ক্ষতি নাই।


সব দিয়ে এই দেশে স্কুল রাখা চাই।।


স্ব – জাতি শিক্ষক এবে পাইয়াছি মোরা।


আর কিসে ভয় করি কিসে দুঃখ করা?


মোর পিতা হরিচাঁদ বলে গেছে মোরে।


বিদ্যা শিক্ষা স্বজাতিকে দিতে ঘরে ঘরে।।


বিদ্যা বিনা সব বৃথা দেখ মনে ভেবে।


বিদ্যা পেলে ধন মান সব কিছু পাবে।।


শুন স্বজাতির গণ সবে মনোকথা।


বিদ্যা শূন্য ধন মান সব জানো বৃথা।।


নমঃশূদ্র জাতি যদি বাঁচিবারে চাও।


যাক্ প্রাণ সেও ভাল বিদ্যা শিখে লও।।


আমি বলি বিদ্যা শূন্য রবে যেই জন।


নমঃশূদ্র বলি তারে বলনা কখন।।


বিদ্যাবান যেই জন তাঁরে মান্য দাও।


বিদ্যার ভিত্তিতে সবে সমাজ গড়াও।।


যেই জন বিদ্যাবান পরম পণ্ডিত।


সমাজের পতি তারে মানিবে নিশ্চিত।।


বিদ্যা ছাড়া কথা নাই বিদ্যা কর সার।


বিদ্যা ধর্ম্ম, বিদ্যা কর্ম্ম,অন্য সব ছার।।


বাঁচ বা না বাঁচ প্রাণে, বিদ্যাশিক্ষা চাই।


বিদ্যাহীন হ’লে বড় তার মূল্য নাই।।


বারে বারে বলি তাই স্বজাতির গণ।


শেখ বিদ্যা রাখ বিদ্যা করে প্রাণপণ “।।


এত যদি বলে প্রভু সভার ভিতর।


জনে জনে সবে মিলি করে অঙ্গীকার।।

“আজ হ’তে সবে মোরা অঙ্গীকার করি।


বিদ্যা ঘরে নিব তাতে বাঁচি কিবা মরি।।


ঘরে ঘরে জনে জনে করে আলোচনা।


প্রাণ দিয়ে কর সবে বিদ্যার সাধনা।।


প্রভুর চরণে করি এই নিবেদন।


মো ‘ সবার থাকে যেন সদা এই মন।।


দিনে দিনে মোরা সবে এই বুঝিয়াছি।


‘হরিচাঁদে ‘ঘরে পেয়ে ধন্য হইয়াছি।।


তাঁর ঘরে মহারত্ন গুরুচাঁদ তুমি।


পরম পবিত্র প্রভু তুমি অন্তর্যামী।।


ভয় নাই এ জাতির বুঝিয়াছি ঠিক।


যার যত মনে বলে ধন্য হয়ে নি’ক।।


জাতীয়তা পবিত্রতা একতার বাণী।


অন্ধকারে থেকে মোরা কিছু নাহি জানি।।


যেই শুভ দিনে এই জাতির ভিতর।


পরম দয়াল হরি হ’ল অবতার।।


সেই দিনে পুনর্জন্ম পেয়েছে এ জাতি।


দিনে দিনে হবে এর অবশ্য উন্নতি।।


ভাঙ্গা – বুকে এল আশা শূন্য-দেহে প্রাণ।


প্রাণ দাতা দয়াময় প্রভু হরিচান।।


ত্রেতা যুগে ক্ষাত্রজাতি সহেছিল কষ্ট।


কষ্ট দূর করেছিল রাম জগদিষ্ট।।


পরশুরামের হাতে ক্ষত্র নির্যাতিত।


দশরথ বাঁধা রয় প্রাণ ভয়ে ভীত।।


মান – দায় উভরায় কান্দে ক্ষত্রগণ।


সেই ঘরে জন্ম নিল রাম – নারায়ণ।।


পরশুরামের দর্প করিলেন চূর।


রামচন্দ্রে বলে ক্ষত্র প্রাণের ঠাকুর।।


দ্বাপরেতে জীবকুল কাঁদিয়া আকুল।


কৃষ্ণ রূপে করে লীলা যমুনার – কূল।।


বলদর্পী সবে হত কুরুক্ষেত্রে হল।


ধরা বলে ভার – হারী ধরাতে আসিল।।


যাহারে যে রক্ষা করে তাঁহারে সে ডাকে।


রাম নাম বিনা ক্ষত্র কিবা বলে থাকে?


‘শ্রীকৃষ্ণ ‘গৌরাঙ্গ ‘ আদি যত অবতার।


অন্য অন্য সম্প্রদায় করিল উদ্ধার।।


সরল কৃষক কুল সবে অবনত।


কোন অবতার নাহি করে দৃষ্টি পাত।।


এই সব অবতার বহু মহাজন।


বহুবিধ গ্রন্থ রাজি করেছে লিখন।।


ভক্ত বলি, সাধু বলি, বলি মুনি ঋষি।


বর্ণনা করেছে কত ভক্ত রাশি রাশি।।


পরিচয় সবাকার আছে সেই গ্রন্থে।


দলে দলে থরে থরে ফুল যথা বৃন্তে।।


আশ্চর্য ঘটনা সবে শুন দিয়া মন।


অবনত মধ্যে ভক্ত নাহি একজন।।


উচ্চকুলে জন্ম সবে ভক্ত পরিচয়।


নীচ কুলে জন্মে’ কেবা ভক্ত কবে হয়?


সত্য বটে হরিদাসে ভক্ত বলি বলে।


ব্রহ্ম অংশে জন্ম নাকি যবনের কোলে।।


উপাধি করিল তারে ব্রহ্ম – হরিদাস।


নীচ জন উদ্ধারের কি হল প্রকাশ ?


ঝড়ু ভুঁইমালী বলি আর এক জন।


চরিতামৃতের মধ্যে রয়েছে লিখন।।


যবনের শাখা – জাতি ভুঁইমালী কয়।


যবন দেশের রাজা ছিল সে সময়।।


রাজ শক্তি ধারী যারা কিসে তারা হীন।


উচ্চ,নীচ সবে থাকে রাজার অধীন।।


রাজভয়ে যবনেরে নীচ নাহি বলে।


যবন তরিলে তা’তে নীচ কিসে তরে ?


চৈতন্যের মতে দেখি যত ভক্ত জন।


কায়স্থ ব্রাহ্মণ বৈদ্য আছে নিরূপণ।।


হীন বলি নীচ বলি যে সব – জনেরে!


দূর করি দিয়াছিল বনের ভিতরে।।

সেই সব সর্ব্বহারা মানুষের দল।


অবতার এলে তাঁরা কিবা পেল ফল।।


আর এক যুক্তি উঠে মনের ভিতর।


যার জাতি তার সাথী আর সব পর।।


উচ্চ বর্ণ বলি যাঁরা করেছিল গর্ব্ব।


কালের বিধানে দেখ আজি তারা খর্ব্ব।।


ব্রাহ্মণাদি উচ্চ বর্ণে অবতার হয়।


যার যার ঘর সারি পরে ফাঁকি দেয়।।


যার জাতি তার সাথী তার যে আত্মীয়।


পর ঘর হ’তে হয় নিজ – ঘর প্রিয়।।


সকলে তারিতে যদি কেহ এসেছিল।


কিছু ধন্য হ’ল,অন্যে বাকি কেন র’ল?


অন্য ঘর ছিটে ফোঁটা নিজ ঘরে ঘড়া।


কেউ ধরে সুদর্শন কেউ সাজে নাড়া।।


যার যার তার তার পর – পাতে ছাই।


তারিতে সকল জনে কেহ আসে নাই।।


যেই উপকার করে তার দেয় দায়।


আপন নামের ডঙ্কা আপনি বাজায়।।


পিছনে পড়িয়া যাঁরা রয়েছে পতিত।


কেহ কভু করে নাই তাহাদের হিত।।


আর কত মনে পড়ে যুক্তি মিথ্যা নয়।


ব্যথিত না হ’লে সে কি ব্যথা বোঝে হায়!


ব্যথিতের ঘরে যদি আসে কোন জন।


সেইত বুঝিবে ব্যথা ব্যথিত কেমন।।


ব্যথিতের ঘরে এল শ্রী হরি ঠাকুর।


কৃপা করি ব্যথিতের ব্যথা কৈল দূর।।


ব্যথিতের হেন বন্ধু আর কেহ নাই।


প্রাণের – ঠাকুর তাই হরিচাঁদ সাঁই।।


ঘরে ঘরে জনে জনে কত কি বলেছে।


তাঁর শক্তি পেয়ে জাতি জাগিয়া উঠেছে।।


তরি ‘বা না তরি ‘তা’তে দুঃখ কিছু নাই।


শ্রী হরি – চরণ সার কর সবে ভাই।।


ঘরে ঘরে সভা করি সবারে জানাও।


এসেছ দয়াল মাঝি তরী খুলে দাও।।


সবে মিলি পরামর্শ করিল সভায়।


ঘরে ঘরে এই বার্ত্তা দিতে যেতে হয়।।


প্রতি জেলা প্রতি ঘরে জাগাও চেতনা।


ঘরে ঘরে এই বাণী করহে রটনা।।


স্থির হল সভা হবে খুলনা জেলায়।


দত্তডাঙ্গা নামে গ্রামে ঈশ্বর আলয়।।


শ্রাদ্ধ কার্যে জ্ঞাতি ভোজ বৃহৎ আকারে।


ঈশ্বর গাইন নামে সেই ব্যক্তি করে।।


দেশে বা বিদেশে যত নেতৃবর্গ ছিল।


সেই বাটি হতে পত্র সবাকে পাঠাল।।


প্রথম ‘জাতীয় সভা ‘ সেই বাড়ী হল।


ক্রমে ক্রমে সেই বার্ত্তা কহিব সকল।।


জাতি ছিল দুঃখে – জারা বন্ধু নাহি ছিল।


‘গুরুচাঁদ’ বন্ধু হয়ে সে ঘরে আসিল।।


চাঁদের কিরণ লাগে সকলের গায়।


মহানন্দ অন্ধকারে বসে অন্ধ রয়।।



গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 19 লগ্নী কারবার


 

“অর্থে জান ‘ মহাশক্তি লক্ষ্মীর বাহন।


যথা লক্ষ্মী তাঁর সাথে আছে নারায়ণ “।।


অবিরত গুরুচাঁদ এই বাণী কয়।


জনে জনে সর্ব্বক্ষণে এ নীতি শিখায়।।


অর্থ লাভে কোন কালে অলস না হবে।


পেলে ধন হীন স্থানে কুড়ায়ে তা লবে।।


পরম পবিত্র অর্থ লক্ষ্মীর আশ্রয়।


সৎ পথে সেই ধন লইবে সদায়।।


যথা তথা হতে ধন আন নিজ ঘরে।


সাধু – শ্রমে আন তারে বিবিধ প্রকারে।।


এমন কি ধন যদি হীন স্থানে পাও।


সাধু ভাবে এনে তাহা সংসার চালাও।।


এই ধন চুরি করি কভু না আনিবে।


চোরা ধন এলে ঘরে লক্ষ্মী দূরে যাবে।।


লক্ষ্মী – ছাড়া ধন হয় মৃত্যুর কারণ।


সেই ধন আন যাহা লক্ষ্মীর বাহন।।


সাধু ধন ভর করে লক্ষ্মী আসে ঘরে।


সৎভাবে যদি তারে উপার্জ্জন করে।।


অশুচি না হয় ধন পাত্রাপাত্র ভেদে।


পবিত্রতা নষ্ট তার শুধু অপরাধে।।


সৎ ভাবে যদি তারে তুমি তুলে লও।


অর্থের সহিত ঘরে লক্ষ্মী মাতা পাও।।


বাণিজ্য সাধুর কর্ম্ম মহাজনে কয়।


মহাজন হলে তার মহামন হয়।।


মহাজন সাজি করে দুষ্ট ব্যবসায়।


ইহকাল পরকাল সব নষ্ট হয়।।


“ব্যবসায়ে লক্ষ্মী লাভ সত্য বটে কথা।


তার মধ্যে রাখা চাই শুদ্ধ পবিত্রতা।।


দীনে যদি চাহ ‘ ধন কর ব্যবসায়।


ধন পাবে সৎ পথে থাকিলে নিশ্চয়।।


ব্যবসায় কা’রে বলে শুনহে সকলে।


শুধু দ্রব্য কেনা -বেচা নহে কোন কালে।।


টাকা কড়ি লেন্ দেন্ যে যে ভাবে হয়।


বিনিময় হলে অর্থ ব্যবসায় কয়।।


লগ্নী কারবার তা’তে হয় ব্যবসায়।


লগ্নী কারবারে প্রভু অর্থকে খাটায়।।


ব্যবসায়ী লোক কত আসে প্রভুুর ঠাঁই।


বলে “প্রভু কারবার লাগি অর্থ চাই।।


আপনার টাকা প্রতি সুদ কিছু দিব।


কারবার করি নিজে লাভবান হব।।


ঘরে ঘরে সবে যাহে ব্যবসায়ী হয়।


বাণিজ্য করিতে প্রভু তাই অর্থ দেয়।।


প্রভুর আদর্শ ধরি তাই দেশবাসী।


ব্যবসা করিয়া অর্থ পেল সবে বেশী।।


দীন হীন কতজনে অর্থের অভাবে।


করিত না কৃষি কর্ম্ম “পারিব না “ভেবে।।


সে সবে ডাকিয়া প্রভু কহে কৃপা করি।


“অর্থ নিয়ে কৃষি কর অলসতা ছাড়ি।।

 

 

কৃপাবাক্য শুনি তারা আনন্দ হৃদয়ে।


কৃষি কার্য করে সবে টাকা কর্জ্জ ল’য়ে।।


ফসলান্তে সবে আসি প্রভুর নিকটে।


সুদসহ টাকা দেয় সবে নিষ্কপটে।।


এ জগতে দেখি হায় মহাজন – নীতি!


দরিদ্র পিষিয়া তারা পায় মহা প্রীতি।।


মহাজন পদতলে পড়িলে কাঙ্গাল।


বাঁচা’ত দূরের কথা সব পয়মাল।।


তাহার প্রমাণ লিখে বিশ্ব কবি ‘রবি।

‘আঁকিয়াছে কাঙ্গালের ব্যথা-ভরা ছবি।।


“দুই বিঘা জমি “নামে গল্পের আকারে।


দেখা’য়েছে সেই চিত্র বিশ্বের মাঝারে।।

“এজগতে হায়, সেই বেশী চায়


যার আছে ভুরি ভুরি।


রাজার হস্ত, করে সমস্ত


কাঙ্গালের ধন চুরি।। “


— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কি আশ্চর্য দয়া ধৈর্য গুরুচাঁদে রয়।


গুণাতীত – গুণমণি গুনের আলয়।।


যেই অর্থ লয় আসি গুরুচাঁদ স্থানে।


ব্যবসায় কৃষি কর্ম্ম যে কোন কারণে।।


উভ লাভ হয় তা’তে নাহি লোকসান।


সুদ পায় লাভ হয় দ্বিগুণ প্রমাণ।।


ঠিক ভাবে নেয় অর্থ দেয় ঠিক ভাবে।


তারে নাহি ধরে কভু অর্থের অভাবে।।


আশ্চর্য গণিয়া তবে দেশবাসী বলে।


‘ধনপতি গুরুচাঁদ ‘ জন্মেছে এ কুলে।।


এমন আশ্চর্য মোরা কভু দেখি নাই।


নিয়া ধন দু’না দেই তবু দু’না পাই’।।


এ’ত নহে লগ্নী-করা এযে ধন-দান।


অসীম দয়ার গুণে করে গুরুচান।।


গুরুচাঁদ হতে যেবা লয় মূলধন।


অল্পদিনে সাজে সেই বড় মহাজন।।


দেখে সবে মনে ভাবে আশ্চর্য তো ভারী।


ধন লয়ে এল দেশে ধনের ভাণ্ডারী।।


কিসে কিসে অর্থ বাড়ে শ্রী গুরু শিখায়।


অর্থ-উপার্জ্জন-নীতি নমঃশূদ্রে পায়।।


লগ্নী কারবারে বাড়ে বহুমতে ধন।


জমি জমা বৃদ্ধি করে শ্রী গুরুচরণ।।


কত দয়া – ভরা তাহা কি দিব তুলনা।


ত্রিভুবনে হেন দয়া আর মিলিবে না।।


খাতকের যে দুর্দ্দশা মহাজনে করে।


‘কসায়ের ব্যবহার ‘ বলে সর্ব্ব নরে।।


আজি বটে গরীবের উদ্ধার কারণ।


‘খাতক আইন সৃষ্টি হয়েছে এখন।।


যেই দিনে গুরুচাঁদ দরিদ্র পালিল।


মহাজন যাহা করে সব জানি ভাল।।


পাঁচ টাকা কর্জ্জ করি কত অভাজন।


সুদের পাষাণ – তলে ছেড়েছে জীবন।।


জমি গেছে জমা গেছে গেছে অস্থাবর।


ঘর – হারা লক্ষ্মীছাড়া অবনী ভিতর।।


নীলাম-খড়্গের ধারে ডিক্রি যুপকাষ্ঠে।


কত দীন বলি হ’ল বাঁধা আষ্টেপৃষ্ঠে।।


কিন্তু গুরুচাঁদ মোর দীনের বান্ধব।


তাঁর পদাশ্রয়ে জীয়ে রহে দীন সব।।


কর্জ্জ- কড়ি সুদ বাড়ি হয়েছে প্রবল।


খাতকের জীর্ণ দেহ মনে নাই বল।।


দিবা রাত্রি চিন্তা জ্বরে বলিছে প্রলাপ।


ক্ষণে ক্ষণে অদৃষ্টেরে করে অভিশাপ।।


ডিক্রি হবে জমি যাবে হবে গৃহ -হারা।


দু’নয়নে বহে সদা শ্রাবণের ধারা।।


কেন্দে কেন্দে বলে ‘কোথা বিপদ-কাণ্ডারী!


দেনাদায় প্রাণ যায় উপায় কি করি ?

 

 

সেই জনে ডেকে বলে শ্রী গুরু দয়াল।


“ভয় নাই এ তুফানে ছাড়িস না হাল।।


ডোবা তরী তুলে দিতে আসিয়াছি আমি।


ঝড় দেখে ঝাপ দিতে যাস্ নারে থামি।।


শ্রী হরি ঠাকুর মোর পিতা দয়াময়।


আছে হরি রবে তরী নাহি ওরে ভয়।।


তোর ভার মো’রে দেরে তুই হ’রে মোর।


আমি নেবো তোরে ব’য়ে ভয় কিরে তোর।।”


দয়ালের বাণী শুনি দীন বলে কান্দি।


“দীনের বান্ধব মোর এল ওড়াকান্দী।।”


ঠাকুরের পদে করে দেনা – দরখাস্ত।


দয়াময় গুরুচাঁদ করে বন্দোবস্ত।।


জমি জমা গুরুচাঁদে করে সেই দান।


দেনা শোধ করে গুরুচাঁদ ভগবান।।


কবুলতি নিয়ে পুনঃ জমি ফিরে দেয়।


এক বিঘা বিনা – করে খাস করি লয়।।


ঋণ মুক্ত সে কাঙ্গাল প্রাণ ফিরে পায়।


প্রজা সাজি বিক্রি হয় শ্রী গুরুর পায়।।


এই মত শত শত ঋন – মুক্ত জন।


শ্রী গুরু – কৃপাতে ধন্য হয়েছে এখন।।


গৃহীজীবে বাঁচাইতে হরি অবতার।


গুরুচাঁদে দিয়া গেল অসমাপ্ত ভার।।


গৃহীকুল কুল পেল বাড়িল আনন্দ।


অন্ধকারে বদ্ধ থেকে নষ্ট মহানন্দ।।

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 18 হরিদাসপুরের কারবারী বাসা

 

আদর্শ গার্হস্থ্য নীতি পালে গুরুচাঁদ।


পতিত গার্হস্থ্য ক্ষেত্র করিতে আবাদ।।


বাল্য ও কৈশোরে করে বিদ্যা উপার্জ্জন।


যৌবনে করিল দৃঢ় সংযম সাধন।।


আজীবন ব্রহ্মচর্য রাখিলেন ঠিক্।


চিরকাল পিতৃধর্ম্মে রাখিল নিরিখ।।


প্রথম যৌবন কালে বিবাহ হইল।


বিবাহ জীবনে প্রভু পবিত্র রহিল।।


সংযমী সুধীর, শান্ত, অতি তেজোবন্ত।


অতল সিন্ধুর প্রায় নাহি মিলে অন্ত।।


গৃহী পক্ষে অর্থ হয় অতি মহাবল।


অর্থ উপার্জ্জনে হ’ল বাসনা প্রবল।।


নীলকান্ত,গীরিধর বন্ধু দুই জনা।


তা ‘দিগে খুলিয়া বলে মনের বাসনা।।


তিনে মিশি হরিচাঁদে করে নিবেদন।


তেঁহ আজ্ঞা দিল নৌকা গঠন কারণ।।


নৌকা চালানীতে করে আরম্ভ বানিজ্য।


কিছুকাল পরে করে সেই ভাব ত্যজ্য।।


বাসিন্দা দোকান করি বন্দরের পরে।


ব্যবসা করিতে প্রভু মনে ইচ্ছা করে।।


পিতৃপদে সেই ইচ্ছা প্রকাশ করিল।


ইচ্ছাময় মহাপ্রভু মতে মত দিল।।


হেন কালে হরিচাঁদ লীলা সম্বরিল।


কিছুকাল সে বাসনা স্থগিত রহিল।।


দুই বর্ষ গত হ’ল বিভিন্ন প্রকারে।


সংক্ষেপে বলিব তাহা গুরু কৃপা বরে।।


নড়াইল বাসী নাম শ্রীনাথ সরকার।


বন্দোবস্ত নিয়ে এল ওড়াকান্দী পর।।


তাহে প্রতিবাদী হ’ল প্রজা সব জন।


ভিন্ন জনে কর দিতে নাহি লয় মন।।


দরবার করে সবে জমিদার ঠাঁই।


খাস প্রজা সবে মোরা রহিবারে চাই।।


জমিদার বলে তবে ভাবিয়া দেখিব।


শ্রীনাথে ডাকিয়া সব খুলিয়া বলিব।।


কিছুকাল গত হয় দৈবে একদিন।


দখল লইতে আসে শ্রীনাথ প্রবীণ।।


প্রজা বুঝে জমিদার বঞ্চনা করিল।


ব’লে ক’য়ে শ্রীনাথেরে দেশে পাঠাইল।।


প্রজা বলে “শুন তুমি সরকার বাবু।


তুমি বলবান মোরা সবে দেখ কাবু।।


তব সাথে বিবাদ মোরা কভু না করিব।


জমিদার বাড়ী চল সেথা সব ক’ব।।


যদি জমিদার বলে দিতে তোমা কর।


আপত্তি রবে না কিছু তোমার উপর।।


শ্রীনাথ ভাবিল মনে কথা মন্দ নয়।


আপোষেতে যদি কার্য সুসমাধা হয়।।


তবে কেন গোলমাল করি আমি মিছে।


মিট্ যদি নাহি হয় দেখা যাবে পিছে।।

 

এত ভাবি দিল সায় সেই যে শ্রীনাথ।


কথা হ’ল প্রজা সবে যাবে তাঁর সাথ।।


দিন স্থির করি সবে গৃহেতে আসিল।


স্বদেশে শ্রীনাথ তবে প্রস্থান করিল।।


একে’ত কায়স্থ জাতি তাহে সরকার।


চতুরতা কার্যে বুদ্ধি অতিব প্রখর।।


মনে ভাবে জমিদার বড়ই দয়াল।


তাঁর কাছে গেলে সব হবে পয়মাল।।


অশিক্ষিত নমঃশূদ্র তাহাতে দরিদ্র।


আমরা কায়স্থ জাতি ধনে, মানে ভদ্র।।


আইনের কুটীনাটী সব মোরা জানি।


আইনের চাপে সব জব্দ ক’রে আনি।।


এত ভাবি কূটবুদ্ধি সেই মহাশয়।


মহাকুমা পানে চলে প্রফুল্ল হৃদয়।।


ফৌজদারি আদালতে করিল বর্ণনা।


“নমঃশূদ্র প্রজা মোরে দখল দিল না।।


অত্যাচার বহুতর করিয়াছে মোরে।


থালা,বাটী খাতাপত্র নি’ছে জোর করে।।


বড়ই দুর্দান্ত তারা আইন না মানে।


“খুন করা “ছাড়া তারা কিছুই না জানে।।


অল্প রাত্রি ছিল আমি পায়খানা যাই।


হেন কালে দল জুটে এসেছে সবাই।।


দ্বার খোলা ছিল ঘরে আলো ছিল জ্বালা।


খাতা পত্র সাথে নিল, ঘটী, বাটী, থালা।।


সোরাগোল শুনি আমি আসি গৃহ দ্বারে।


দশ জনে বর্শা নিয়ে মোরে তাড়া করে।।


প্রাণ ভয়ে আমি ছুটি ফেলে দিয়ে ঘড়া।


বস্ত্র ছিড়ে গেছে পড়ে চাবি দুই তোড়া।।


অতি কষ্টে প্রাণ নিয়ে আমি আসিয়াছি।


পুনরায় গেলে সেথা বাঁচি কিনা বাঁচি।। “


দুষ্টজনে ছল হয় প্রধান সহায়।


যাত্রাকালে গৃহ হতে ছিন্ন বস্ত্র লয়।।


সেই ছিন্ন বস্ত্র তুলি হাকিমে দেখায়।


হাকিম” সনাক্ত “ বলি তাহা লিখি লয়।।


প্রধান আসামী নাম শ্রীগুরুচরণ।


বিশ্বাস উপাধি বলে” ঠাকুর” এখন।।


শ্রী বিধু ভূষণ নামে দ্বিতীয় আসামী।


উপাধী চৌধুরী কহে শুনিয়াছি আমি।।


এই ভাবে ওড়াকান্দী যতেক প্রধান।


শ্রীনাথ করিল নাম হয়ে হতজ্ঞান।।


হাকিম জিজ্ঞাসা করে মোক্তারের ঠাঁই।


“শুনুন মোক্তার বাবু আমি জানতে চাই।।


দূর্দান্ত আসামী বলি হয়েছে বর্ণনা।


আসামীর নামে কিন্তু সে ভাব আসে না।।


প্রধান আসামী বলি হয়েছে যে নাম।


“ঠাকুর “উপাধি তাঁর আমি জানিলাম।।


ঠাকুর বলিয়া যার উপাধি হয়েছে।


সেই ব্যক্তি হেন কর্ম্ম কভু কি ক’রেছে।।


আপনি মোক্তার বাবু এই দেশে ঘর।


খুলিয়া বলুন দেখি সব সমাচার।।


কি কারণে এই ব্যক্তির উপাধি ঠাকুর।


সত্য কথা বলি মোর সন্দ কর দূর “।।


বিনয়ে মোক্তার বলে “জানাই হুজুর।


এই ব্যক্তির পিতা ছিল “শ্রী হরি ঠাকুর “।।


মহাসাধু সেই ব্যক্তি ছিল এই দেশে।


রোগী, ভোগী পে’ত শান্তি তাঁর কাছে এসে।।


অলৌকিক শক্তি তাঁর আছিল প্রচুর।


তাঁহাকে ডাকিত সবে শ্রী হরি ঠাকুর।।


তাঁর পুত্র হ’ন ইনি মহা ধনবান।


দেশ বাসী সবে তাঁরে করয় সন্মান।।


পিতৃতুল্য দৈবশক্তি আছে কিনা আছে।


সে সব জানিনা মোরা জানে যারা কাছে।।


সাধুর সন্তান তাহে সম্মান প্রচুর।


সেই জন্যে উপাধীতে হয়েছে ঠাকুর।।

 

কথা শুনি বিচারক হাসি হাসি বলে।


‘বড়ই সুন্দর ব্যাখ্যা এখানে করিলে।।


পিতা যার দেবতুল্য নিজে ভাগ্যবান।


এসব কর্ম্মের নাকি সে রাখে সন্ধান?


যা ‘ হক্ তা ‘ হক্ বাবু! কর্ত্তব্য আমার।


অভিযোগ পেলে করি বিচার তাহার।।


মনের সন্দেহ কিন্তু দূর নাহি হয়।


“মামলা তদন্ত হোক এই দিনু রায়”।।


পুলিশের হাতে দিল তদন্ত কারণ।


রায় শুনি শ্রী নাথের মলিন বদন।।


স্থানীয় সাক্ষী তা ‘তে প্রয়োজন ভারী।


শ্রী নাথ বসিয়া ভাবে উপায় কি করি।।


ইচ্ছা ছিল “ তলবেতে “ কাঠ গড়া এনে।


করিব বিষম জব্দ শহরেতে টেনে।


সে আশা নির্ম্মূল হল উপায় না দেখি।


হাতে নাতে ধরা পরে হতে হল মেকী।।


কিছুদিন পরে যবে তদন্তে আসিল।


শ্রীনাথ ঘটনাস্থলে কভু নাহি গেল।।


তদন্তে দারোগা জানে সব জুয়াচুরি।


রিপোর্ট লিখিয়া দিল “ফরেদি ফেরারী।।


নিষ্কলঙ্ক চন্দ্রসম আসামী খালাস।


শ্রীনাথ গেল না আর ওড়াকান্দী পাশ।।


এইভাবে মোকদ্দমা চূড়ান্ত হইল।


ভয়াকুল প্রজাকুল আনন্দ পাইল।।


বার’শ পঁচাশি সাল অঘ্রাণ মাসেতে।


শতটাকা ট্যাক্স ধার্য প্রভুর পরেতে।।


পরশ্রী কাতর যত দুষ্ট দূরাশয়।


রাজ সরকারে গিয়া বহু কথা কয়।।


শ্রী হরির পুত্র নাম শ্রী গুরুচরণ।


গাড়ী গাড়ী টাকা পায় তাহার কারণ।।


ব্যবসা বানিজ্য তিনি করে বহুতর।


সরকারে কভু নাহি নাহি দেয় কর।।


গুরুভার ট্যাক্স তার উচিত যে হয়।


এই সব কূটকথা সরকারে জানায়।।


ট্যাক্স ধার্য করিলেন রাজ কর্ম্মচারী।


নোটিশে জানায় কথা ঠাকুরের বাড়ী।।


ঘটনা জানিতে প্রভু হইলেন ব্যস্ত।


ট্যাক্সের বিরুদ্ধে দিল এক দরখাস্ত।।


বর্ণনা করিল প্রভু তাহার মধ্যেতে।


“এই ট্যাক্স দিতে মোর না হবে সাধ্যেতে।।


বিশেষতঃ এই কথা করি নিবেদন।


মম পিতা ছিল বটে সাধু মহাজন।।


তেঁহ অগ্রে রোগী ভোগী দিতে কত অর্থ।


সেই সবে নাহি মোর কিছু মাত্র স্বার্থ।।


ধর্ম্মজ্ঞানে যেই অর্থ সাধুজনে দেয়।


তদুপরি ট্যাক্স ধার্য উচিত না হয়।।


মহামান্যা মহারাণী করেছে ঘোষণা।


ধর্ম্ম কার্যে হস্তক্ষেপ রাজা করিবে না।।


ধর্ম্মের ব্যাপারে আমি সেই অর্থ পাই।


তার পরে ট্যাক্স ধার্য ‘রাজাইনে’ নাই।।


যুক্তি পূর্ণ দরখাস্ত করে গুরুচাঁদ।


রাজ কর্ম্মচারী তাতে ট্যাক্স দেয় বাদ”।।


ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করে উকিলের ঠাঁই।


“শুন হে উকিল বাবু আমি জানতে চাই।।


কি কারণে অর্থ সবে দেয় এই জনে।


শুধু শুধু অর্থ দিবে কিসের কারণে ?


আমি রাজ কর্ম্মচারী রাজশক্তি বলে।


বিচার করেছি কত অতি কুতূহলে।।


“রাজদণ্ড ভয়ে দেখ সবে করে ভয়।


শুধু শুধু তবু অর্থ কেহ নাহি দেয়।।


কোন শক্তি বলে বল এই ভাগ্যবান।


গৃহে বসি অর্থ পায় না করি সন্ধান।।”


উকিল হাকিমে বলে বিনয় বচনে।


“যে আজ্ঞা হুজুর সব বলিব এখনে।।

 

ইহার পিতার নাম শ্রী হরি ঠাকুর।


এই জিলা মধ্যে বাস সাধনা প্রচুর।।


ওড়াকান্দী গ্রামে তিনি করিলেন বাস।


শত শত নর নারী যেত তাঁর পাশ।।


অলৌকিক শক্তি বলে সেই মহাশয়।


রোগারোগ্য করিতেন মুখের কথায়।।


অন্ধজনে দৃষ্টি পে’ত দরিদ্রেতে ধন।


সবে পেত যেই যাহা করিত মনন।।


মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হত যখনি যাহার।


ইচ্ছামত দিত সবে অর্থ কি আহার।।


তাঁর বাড়ী সবে মানে তীর্থক্ষেত্র প্রায়।


অদ্যাবধি অর্থ আনি সবে সেথা দেয়।।


সেই অর্থ তাঁর পুত্র শ্রী গুরুচরণ।


পিতার নামেতে তাহা করেন গ্রহণ।।


এই ব্যক্তি সেই শক্তি ধরে কিনা ধরে।


সেই কথা বলি তবে যা আসে অন্তরে।।


কিছু শক্তি এই জন নাহি যদি পায়।


সবে কেন আসে তবে তাঁহার আলয়।।


মোরা সবে আছি হেথা বসিয়া শহরে।


সব কথা নাহি জানি বলি কি প্রকারে।।


তবে এক কথা মনে ওঠে যে হুজুর।


ব্রহ্ম শক্তি যাঁর আছে সে হয় ঠাকুর।।


যার আছে তাঁর কাছে ছুটে যে সকলি।


মধু শূন্য পুষ্পে কভু ধায় নাকি অলি ?


স্বনামে পুরুষ ধন্য উত্তম সে জন।


পিতৃধনে ধনী ভবে আছে কত জন।।


যে বাড়ায় তার হয় অগণিত ধন।


মূলধন ক্ষয় করি দীন কতজন।।


এ মহাপুরুষে জানি বহু বিত্তশালী।


দিন দিন বাড়িতেছে সে ধন সকলি।।


ইথে মম মনে লয় এই মহাজন।


শুধু ধনে নয় ইনি গুণে মহাজন।।


ধর্ম্ম পথ জানি সুক্ষ্ম নাহি কুটুম্বিতা।


ধনধান্য লক্ষ্মী থাকে ধর্ম্ম থাকে যেথা।।


নিশ্চয় জানিনু তা’তে ধার্ম্মিক এ জন।


শুধু পিতৃধনে নহে নিজে মহাজন।।


কথাশুনি বলে সেই রাজ – কর্ম্মচারী।


“শুনহে উকিল বাবু নিবেদন করি।।


যেই জন ধর্ম্ম রাখে ধর্ম্ম রাখে তারে।


পরম ধার্ম্মিক ইনি বুঝিনু অন্তরে।।


ধর্ম্মপথে যেই ধন পায় মহাশয়।


তদুপরি ট্যাক্স ধার্য উচিত না হয়।।


তবু এক কথা আমি বলিবারে চাই।


উচিৎ কি অনুচিত বুঝুন মশাই।।


রাজদ্বারে পরিচিত নহে যেই জন।


বৃথা তার জমিদারী যশ মান ধন।।


শুনিয়াছি ইনি সদা করিছে বানিজ্য।


বানিজ্যের ধনে ট্যাক্স দে’য়া কিন্তু ন্যায্য।।


এসব বিচার ইনি করুন আপনে।


ইচ্ছা হলে ট্যাক্স দিন রাজ সন্নিধানে।।


হাকিমের কথা শুনি গুরুচাঁদ হাসে।


হাসি কন্ “মোর মনে এই ভাব আসে।।


বানিজ্য করিয়া আমি যেই অর্থ পাই।


তার কিছু অংশ আমি ট্যাক্স দিতে চাই।।


রাজার আশ্রয়ে প্রজা রহে চিরসুখে।


রাজার সাহায্যে টাকা দে’য়া ভাল ঠেকে।।


বিশেষতঃ রাজদ্বারে এই অর্থ দিলে।


রাজ – পরিচিত হব আমরা সকলে।।


আর কথা গুরুচাঁদ ভাবে মনে মন।


নমঃশূদ্র ঘরে ধনী নাহি কোন জন।।


অন্য অন্য জাতি যত আছে বঙ্গ দেশে।


ধন জন মান আছে দেশে কি বিদেশে।।


রাজঘরে পরিচিত বিদ্যা বুদ্ধি ধনে।


উচ্চ জাতি বলি রাজা সে সকলে জানে।।

 

ধনহীন নমঃশূদ্র আছে পরিচয়।


এই ঘরে ‘আয়কর কেহ নাহি দেয়।।


যে জাতির ঘরে ধন নাহি পরিমিত।


দরিদ্র বলিয়া তারা বিশ্বে পরিচিত।।


দরিদ্রের মান নাই সবে কৃপা করে।


ভিক্ষুকের প্রায় ঘুরে দুয়ারে দুয়ারে।।


আমি অদ্য রাজদ্বারে যদি ট্যাক্স দেই।


কে বলিবে নমঃশূদ্র ঘরে ধনী নেই।।


জাতির কারণে মোর ট্যাক্স দেয়া ভাল।


ট্যাক্স দিলে একদিনে পা’ব তার ফল।।


এত ভাবি সবিনয়ে গুরুচাঁদ কয়।


“হুজুর আমার এই নিবেদন হয়।।


বানিজ্য করিয়া আমি যত অর্থ পাই।


তদুপরি কুড়ি টাকা ট্যাক্স দিতে চাই।।


শ্রীগুরুর বাক্য শুনি হাকিম বিস্মিত।


বলে “আমি তব ঠাঁই হই পরাজিত।।


স্বেচ্ছায় রাজাকে দান কেহ নাহি করে।


শ্রেষ্ঠ রাজভক্ত আমি দেখি আপনারে।।


রাজ – প্রতিনিধি কাছে দিব সব লিখি।


দেখি আপনার কিছু কর্ত্তে পারে নাকি ?


বহুত প্রশংসা করে সেই সে হেকিম।


পরবর্ত্তী কথা শুন, অথ ততঃ কিম্।।


অগ্রভাগে সে হাকিম সেলাম জানায়।


টাকা দিয়া মহাপ্রভু ঘরে ফিরে যায়।।


গৃহে আসি গুরুচাঁদ ভাবে মনে মন।


এ জাতির ঘরে বৃদ্ধি – করা চাই ধন।।


কিছু কিছু ব্যবসায় আমি করিয়াছি।


তাহাতে ধনের বৃদ্ধি ঠিক বুঝিয়াছি।।


মম পিতা হরিচাঁদ লীলা সাঙ্গ কালে।


এ জাতি উঠাতে আজ্ঞা করে কুতূহলে।।


তাঁর ইচ্ছা তাঁর কর্ম্ম করিবেন তিনি।


আমি তো নিমিত্ত মাত্র কিছু নাহি জানি।।


তাঁর আশির্বাদ আছে আমার উপরে।


করিব সে সব কর্ম্ম যা ‘ উঠে অন্তরে।।


যন্ত্রী তিনি যন্ত্র আমি তিনি বাদ্য করে।


সেই ভাবে গান গায় যে ভাব অন্তরে।।


এ জাতির মধ্যে আমি যে কর্ম্ম করিব।


পৃথিবীর জীব দ্বারা সে কর্ম্ম সাধিব।।


বারশ ছিয়াশি সালে জ্যৈষ্ঠের প্রথমে।


কুড়ি টাকা ট্যাক্স ধার্য শ্রী গুরুর নামে।।


আষাঢ় মাসের শেষে হরিদাস পুরে।


দোকান খুলিল প্রভু বাসা ঘর করে।।


বেথুরিয়া গ্রাম বাসী নাম যজ্ঞেশ্বর।


ধীর স্থির প্রাজ্ঞ তিনি স্বভাব সুন্দর।।


বিশ্বাস উপাধী ধারী জ্ঞানেতে প্রবীণ।


গুরুচাঁদে ভক্তি তিনি করে চিরদিন।।


রামতনু নামধারী অপর সুজন।


গোমস্তা সাজিয়া পেল প্রভুর চরণ।।


হরিদাসপুরে রয় দুই মহাশয়।


কর্ম্মচারী রাখি সেথা ব্যবসা চালায়।।


গুণে জ্ঞানে দুই জনে কেহ নহে হীন।


উভয়ের শ্রম লাভ বাড়ে দিনে দিন।।


এক দরে বেচা কেনা একই ওজন।


জুয়াচুরি বাটপাড়ী চলে না কখন।।


সকলে জানিল তবে এই শুভ বার্ত্তা।


হরি – পুত্র গুরুচাঁদ দোকানের কর্ত্তা।।


দলে দলে সে দোকানে ভিড়িল সবাই।


ইচ্ছামত কেনে দ্রব্য কোন ভয় নাই।।


ক্রমে ক্রমে ব্যবসায় অতি বড় হ’ল।


“বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ “আপনি ফলিল।।


সবে বলে “সাচ্চা মাল কর্ত্তার দোকানে।


ঠকিবার ভয় নাই যেই যাহা কিনে”।।


যেই দ্রব্য যেই জনে দোকানেতে চায়।


সর্ব্ববিধ দ্রব্য এক দোকানেতে পায়।।

 

“ক্ষীরোদ বিহারী হরি “ পিতা রূপে যাঁর।


শান্তি দেবী রূপে “লক্ষ্মী “ জননী যাঁহার।।


ব্যবসা দূরের কথা যেই কর্ম্ম করে।


সিদ্ধি নিয়ে শ্রী গণেশ সাথে সাথে ফিরে।।


আষাঢ় মাসেতে ঘরে দোকান বসিল।


দুই মাস মধ্যে ধন বহুৎ বাড়িল।।


বহুত বাড়িল ধন ব্যবসা কারণে।


লগ্নি কার্য লাগি বাঞ্ছা করিলেন মনে।।


সেই কথা ক্রমে ক্রমে করিব প্রচার।


এ পর্যন্ত করি ক্ষান্ত বাণিজ্য প্রকার।।


গুরুচাঁদ রূপে এল ভবারাধ্য ধন।


মহানন্দ না চিনিল অন্ধ যে নয়ন।।

গুরুচাঁদ চরিত পর্ব :- 17 শ্রী রাম ভরত মিশ্রের মহাপ্রস্থান

 

বার’শ পঁচাশি সালে জ্যৈষ্ঠের প্রথমে।


শ্রী রাম ভরত এল ওড়াকান্দী ধামে।।

 

হরিচাঁদ অদর্শনে ব্যাকুলিত মন।


তাঁরে শান্ত করি রাখে শ্রী গুরুচরণ।।


সেই সাধু তবে রহি ওড়াকান্দী ধামে।


অবিরাম প্রেম ভরে মত্ত হরিনামে।।


ক্ষণে ক্ষণে ছাড়ে হাই “ হরিচাঁদ “বলি।


তাঁর ভাব হেরি কাঁন্দে ভকত মণ্ডলী।।


গভীর নিশিথে সাধু বসি বৃক্ষ তলে।


গুরুচাঁদে ডাকি কত মনোকথা বলে।।


কি জানি কি তত্ত্ব কহে বসি দুই প্রভু।


কেহ না জনিতে পারে সেই তত্ত্ব কভু।।


ক্রমে ক্রমে গুরুচাঁদ সংসারে প্রবেশে।


শ্রী রাম ভরত তবে আঁখি জলে ভাসে।।


বাণিজ্য কারণে প্রভু সদা ব্যস্ত রয়।


দেশে দেশে গুরুচাঁদ তরণী পাঠায়।।


এবে মনে হ’ল আশা বন্দরের স্থানে।


করিবেন ব্যবসায় বাসিন্দা দোকানে।।


গৃহীর পরম বল অর্থ মহাশক্তি।


মহাশক্তি লভিবারে প্রভু করে যুক্তি।।


যাঁর ঘরে মহাশক্তি রহে লক্ষ্মীরুপে।


তাঁর কেন খোঁজাখুজি অর্থের পাদপে?


জীব শিক্ষা লাগি প্রভু করে যত কর্ম্ম।


যাহা করে প্রভু মানে জীবে সেই ধর্ম্ম।।


হরিচাঁদ রূপে প্রভু ক্ষেত্র বানাইল।


গুরুচাঁদ রূপে তাহে বীজ বুনাইল।।


প্রথম আবাদ কালে যত ভক্ত জন।


কর্ম্ম শেষ হল তাঁরা ভাবে মনে মন।।


তাই যবে হরিচাঁদ রূপ লুকাইল।


অগ্রে পরে সব ভক্ত বিদায় লইল।।


যার কর্ম্ম তার সাজে অন্য গণ্ডগোল।


শৃঙ্খলা রাখিয়া চলে ভক্ত সকল।।


হরিচাঁদ রূপ – ধ্যায়ী যত ভক্ত ছিল।


সেই রূপ চিন্তা করি সে রূপে মিশিল।।


শ্রী রাম ভরত তবে এক নিশিকালে।


ভকতি করিয়া কথা গুরুচাঁদে বলে।।


“চরণে বিদায় মাগি শুন বড় দাদা।


হরিচাঁদ-রূপ ভাবি মন কাঁন্দে সদা।।


যেই লীলা প্রকাশিতে তোমা ‘ রাখি পাছে।


পরম দয়াল মোর রূপ লুকায়েছে।।


সেই লীলা প্রকাশিতে জগৎ তরাও।


আমাকে করিয়া কৃপা চলে যেতে দাও।।


গৃহীজন আছে লয়ে গার্হস্থ্য জীবন।


সে জীবনে নাহি মজে আমার যে মন।।


উদাসী সাজিয়া আমি যাব দেশে দেশে।


দেখি হরিচাঁদ যদি দেখা দেয় এসে।।


গৃহ ত্যাগী দেখ মোর বাড়ী ঘর নাই।


পথসার করি এবে ঘুরিয়া বেড়াই।।


গৃহস্থ জনেরে দেখ গৃহস্থ সাজা ‘ য়ে।


মনে হলে এসে যাব তোমাকে দেখিয়ে।।


গৃহস্থজনের বন্ধু পরম দয়াল!


তব পাদস্পর্শে ধন্য হইবে কাঙ্গাল।।


প্রতি বৎসরে আসি শ্রী বারুণী দিনে।


অলক্ষ্যে থাকিয়া লীলা দেখিব নয়নে।।


গৃহস্থ জনের দেখ বহু ত্রুটি আছে।


আমি র’লে ক্ষমা নাহি পাবে মোর কাছে।।


গৃহস্থ আশ্রম ছাড়ি তাই দূরে থাকি।


তারহে গৃহস্থ জনে মোরা বসে দেখি।।


মম পক্ষে ঘর বাড়ী বড়ই জঞ্জাল।


জঞ্জালের মধ্যে থাকি কিবা পাব ফল।।


বিশ্ব ঘুরে দেখি কোথা কোন ভাবে হরি।


করেছে কেমন লীলা আপনা সম্বরি।।


তব আজ্ঞা বিনা মোর যেতে সাধ্য নাই।


তাই পদে মনোসাধে এই ভিক্ষা চাই।।


শ্রী রাম ভরত যদি এই কথা বলে।


আজ্ঞা দিল গুরুচাঁদ “ যাহ “ “যাহ “ বলে।।

 

অন্তর্যামী গুরুচাঁদ অন্ত নাহি যাঁর।


অন্তর বুঝিয়া চলে এই ভাব তাঁর।।


শ্রী রাম ভরতে ডাকি প্রভু বলে কথা।


প্রতি বারুণীতে এসো রহ যথা তথা।।


স্বীকার করিল সাধু পদতলে পড়ি।


“শ্রী হরি করিয়া অম্নি করিল “ শ্রী হরি “।।


মাঘী পূর্ণিমার তিথি উর্দ্ধে চন্দ্র হাসে।


শ্রী রাম ভরত ছাড়ি গেল বঙ্গ দেশে।।


স্থুল দেহে তাঁরে কেহ আর দেখে নাই।


“অমর হইয়া আছে প্রকাশে ‘ সবাই।।


সর্ব্ব আশ্রমের লোক রহে ওড়াকান্দী।


মহানন্দ গেল না রে হয়ে মায়া বন্ধী।।