Tuesday, April 14, 2020

অনুকূলচন্দ্রকে ভগবান বললে আগম, নিগম, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, ভাগবত সবই অশুদ্ধ হয়।

যারা ধৈর্য নিয়ে পড়তে পারবেন তারাই পড়ুন।

লেখা- জীবনানন্দ গোস্বামী

একদা পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশের হিমাইতপুর পাবনা জিলার অধিবাসী অনুকূলচন্দ্র চক্রবর্ত্তী আজকাল ভগবান হিসাবে পরিচিত হচ্ছেন। শুধু তিনি নিজে নন, তাঁর বংশধরেরাও সবাই ভগবান। পাকিস্তানী মোল্লাদের ভয়ে নিজের বিয়ে করা বউ ফেলে পালানো এক অপদার্থকে আজকাল কয়েক কোটি লোকে ভগবান বলে বিশ্বাস করে। তিনি ভক্তদের রক্ষা করবেন এই আশায় নিয়মিত তাঁর বংশধরদের পয়সা দেয়। সম্প্রতি শুনছি এই অনুকূলচন্দ্র নাকি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, কালী, দূর্গা সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। নিজের পিতামাতাকেও তিনিই সৃষ্টি করেছেন এটাই শুধু শুনতে বাকি।
আজগুবি কথায় বিশ্বাস করার লোক দুনিয়াতে চিরকালই ছিল। কাজেই অনুকূলচন্দ্রকে কেউ ভগবান বলে বিশ্বাস করতেই পারে। অন্তত এখনকার শিক্ষিত হিন্দুদের মতে অনুকূলকে কেউ ভগবান বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়না। তাই ব্যাপারটা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই।

কিন্তু সত্যিই কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়না? যদি কেউ মহাভারত পড়ে দেখেন তাহলেই বুঝবেন অবশ্যই অশুদ্ধ হয়। কেবল মহাভারত বললে কম বলা হবে। অনুকূলচন্দ্রকে ভগবান বললে আগম, নিগম, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, ভাগবত সবই অশুদ্ধ হয়।

এই স্বঘোষিত ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সবচেয়ে দামী তত্বটা হচ্ছে মানুষ তৈরির তত্ব। যেভাবে আমরা জেনেটিক গুণাবলী বেছে উন্নত গরু-ছাগল-মুরগি তৈরি করি, অনুকূল সেইভাবে উন্নত মানুষ তৈরির ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। যে তত্বটার বাস্তব প্রয়োগ হচ্ছে উচ্চ জাতির পুরুষের সাথে নিম্ন জাতির কন্যাদের বিবাহ দিয়ে উন্নত সন্তানের জন্ম দেওয়া। এই তত্ব কিন্তু হিন্দুধর্মের অবিনাশী আত্মা এবং জন্মান্তর তত্বকে সরাসরি অস্বীকার করছে। জন্মান্তর তত্বমতে একটি মানব সন্তানের উন্নত হওয়া বা না-হওয়া নির্ভর করে সেই আত্মাটির পূর্বজন্মের সুকৃতি এবং আত্মশক্তির উপর। অনুকূলচন্দ্রের বিধান মোতাবেক পিতার চরিত্রের উপরে নয়। অন্যদিকে অনুকূল দাবী করেছেন যে জেনেটিক বাছাইয়ের মাধ্যমে মানুষকে মুরগির মতো বিবর্তন ঘটানো যায়। তাই প্রথমতঃ অনুকূলকে ভগবান মানলে জন্মান্তর তত্ব অশুদ্ধ হয়।

এবারে আসা যাক মহাভারতে। যারাই মহাভারত পড়েছেন তাঁরা জানেন যে কৌরব বংশটি আদতে লোপ পেতে বসায় ব্রাহ্মণসন্তান কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস এসে ক্ষত্রিয় রাজার দুই রাণীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু নামের দুই পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। অনুকূলের প্রতিলোম বিবাহের তত্ব অনুসারে এরা ক্ষত্রিয় না হয়ে ব্রাহ্মণ হবার কথা ছিল। কিন্তু মহাভারতের লেখক বরাবরই এদেরকে ক্ষত্রিয়ই বলে এলেন। দুর্যোধনও নিজেকে চিরকাল ক্ষত্রিয় বলেই গর্ব করে গেল। শুধু এটাই নয়, পান্ডুর বংশ পঞ্চপান্ডব সকলেই ছিলেন দেবতাদের সন্তান। সেই হিসাবে তাঁদের মধ্যে দেবগুণের সঞ্চার হওয়া এবং দেবতা হিসাবেই পরিচিত পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা আদৌ হয়নি। এমনকি মহাজ্ঞানী সত্যবাদী যুধিষ্ঠির নিজেকে ক্ষত্রিয় বলেই পরিচয় দিয়েছেন। তাই অনুকূলের তত্বটি মহাভারতের বিরুদ্ধে যায়। অনুকূলকে ভগবান মানলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়। একইভাবে গীতাও অশুদ্ধ হয়, কারণ গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বরাবরই অর্জুনকে ক্ষত্রিয় বলেছেন। একবারও পিতার নাম টেনে দেবতা বলেননি। দুর্যোধনদের একশত আর পান্ডবদের পঞ্চ ভ্রাতার কারোও মধ্যেই ব্রাহ্মণের গুণাবলী প্রকট ছিলোনা। তারা কেউ পিতার পরিচয়ে ব্রাহ্মণ বা দেবতা ছিল না। তারা সকলেই জেনেটিক মাতৃকূলের গুণই পেয়েছিল এবং সকলেই ক্ষত্রিয় ছিল।

মহাভারত গেল, গীতা গেল। এবারে রামায়ণে আসা যাক। রামায়ণ যারা পড়েছেন তাঁরা জানেন যে রাবণের গুষ্টির সবাই ছিল রাক্ষস। যদিও রাবণের পিতা ব্রাহ্মণ ছিলেন তবুও উচ্চ জাতির পিতার কারণে রাবণ ব্রাহ্মণ হয়নি, মাতৃকুলের পরিচয়ে রাক্ষসই হয়েছিল। যেটা অনুকূলের তত্বের পুরোপুরি বিরোধী। তাই অনুকূলকে ভগবান মানলে রামায়ণ অশুদ্ধ হয়।

আরো একটু প্রাচীন কথায় যাওয়া যাক। কশ্যপ ঋষির দুই পত্নী ছিলেন, দিতি আর অদিতি। এই একই পিতার সন্তানেরা কিন্তু আদৌ গুণাবলীতে এক ছিল না। দিতির সন্তানেরা দৈত্য আর অদিতির সন্তাদেরা আদিত্য নামে পরিচিত হয়েছিল। এই দিতিরই এক পুত্রের নাম হিরণ্যকষিপু, যার দৈত্যগিরি পুরাণে বিখ্যাত হয়ে আছে। মাতৃকূলের গুণাবলী লাভ করে তারা একেবারেই আলাদা স্বভাবের হয়েছিল। এই পৌরাণিক কাহিনী অনুকূলের তত্বের একেবারেই উলটো কথা বলছে। তাই অনুকূলকে ভগবান মানলে পুরাণ অশুদ্ধ হয়।

এবারে একেবারে আদিতে, অর্থাৎ বেদ এবং তন্ত্র। ব্রহ্মা রচিত বেদ এবং মহাদেব শিব রচিত তন্ত্রে খুবই পরিষ্কারভাবে জানানো আছে যে সন্তানের মধ্যে পিতা ও মাতা উভয় কূলেরই গুণ সঞ্চারিত হয়। এই দুই আদিশাস্ত্রও অনুকূলের তত্বের বিরুদ্ধে। অনুকূলকে ভগবান নামতে গেলে আগম-নিগম অশুদ্ধ হয়।
অবশেষে ঋষিবাক্য। পৃথু রাজার কাহিনীতে আছে, লোকপাল বেণ তাঁর মাতা সুনীতির কুলদোষে বেদবিদ্বেষী হয়েছিলেন। ঋষিগণ তাঁকে নরানাং মাতুলক্রমঃ বলে অভিহিত করেছেন। নরানাং মাতুলক্রমঃ অর্থাৎ মনুষ্যপুত্র তাহার মাতুলের অনুরূপ হইয়া থাকে, তাহার মধ্যে মাতুল-কুলের গুণই প্রকাশ পায়। এই ঋষিবাক্য সরাসরি দাবী করে যে নরের মধ্যে পিতামাতা উভয়ের গুণ থাকলেও মাতৃকুলের গুণই প্রকট হয়। যা কিনা অনুকূলের তত্বের একেবারে বিপরীত। অর্থাৎ অনুকূলকে ভগবান বললে ঋষিবাক্য অশুদ্ধ হয়।

অতএব আমরা দেখলাম যে অনুকূলকে সত্য বলে মানতে চাইলে সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি বলে যা পরিচিত সেই আগম, নিগম, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত এবং ঋষিবাক্য অশুদ্ধ হয়। সোজা কথায়, অনুকূলের কারণে পুরো সনাতন ধর্মই অশুদ্ধ হয়। আধুনিক জেনেটিক্স বিজ্ঞান যে অশুদ্ধ হয় সেটা আলাদা করে বলার দরকারই নেই।

অনেকের মনেই প্রশ্ন আসবে যে অনুকূল চক্রবর্ত্তী এইসব তত্বগুলি পেলেন কোথায়? এই ইউজেনিক্স তত্বটির মূল উৎস নিহিত আছে ভারতের বাইরে একদল বর্বর মরুদস্যুর আড্ডায়। যাদের আক্রমণে ভারতের সংস্কৃতি বারেবারে আহত হয়েছে। এমনিতেই বৌদ্ধ যুগে ভারতের বর্ণপ্রথা প্রায় মুছে যেতে বসেছিল। এরপর প্রথমে কুই-সাং জাতির (যাকে আমরা কুষাণ বলে ডাকি) এরপর হিউং-নূ বা হান (যাদের আমরা হূন বলে ডেকে থাকি) আক্রমণে ভারতের গোলমাল অবস্থা। সেই গোলমালে ব্রাহ্মণ সমর্থক গুপ্ত সম্রাটদের আমলেই একদল বামুন নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করা হয়, যাদের কাজ ছিল লুপ্ত সনাতনী শাস্ত্রকে পুনরুদ্ধার করা, আর এই কমিটির সভাপতি ছিলেন সুমতি ভার্গব। এনারা অনেক খাটাখাটি করে সারাদেশ ঘুরে গুরুদের কাছে স্মৃতির সাহায্য নিয়ে সনাতনী বিধানগুলি সংগ্রহ ও সংহত করেন, তারই নাম স্মৃতি-সংহিতা। যেমন মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি ইত্যাদি। এই সংহিতা লেখার সময়েই তাঁরা অষ্পৃষ্যতা সমর্থনে, নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে, বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে এবং বামুনদের সুবিধায় বেশকিছু লেখা এতে ঢুকিয়ে দেন। যেগুলোকে বর্তমানের গবেষকরা ভার্গব-প্রক্ষেপ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই গবেষকদের মধ্যে সুকুমারী ভট্টাচার্যের নাম করা যায়।
এই ইউজেনিক্স বা পিতার জিনের দ্বারা উচ্চজাতির সৃষ্টির তত্বটি আমদানি হয়েছিল সেইসব বর্বর দস্যুদের থেকে। এই মরুদস্যুদেরই বর্তমান শাখা হচ্ছে আব্রাহামিক ধর্মগুলো। মঙ্গোলিয়ার হূণ বা হান-রাই ইসলামের ছায়ায় এসে খান হিসাবে পরিচিত হয়। এই ইসলামী দস্যুদের ধর্মীয় বিধানই আছে কাফেরদের কোতল করে তাদের মেয়েগুলোকে বিয়ে করা আর সাচ্চা ইসলামী সন্তানের জন্ম দেওয়া। এইভাবে তাদের বিশ্বাসমতে উচ্চ জাতি মুসলিম ছাড়া আর সব জাতিকে লুপ্ত করে দেওয়াটাই ছিল তাদের চোখে উন্নত সমাজ গড়ার একমাত্র পথ। এই তত্বটা ইসলাম আসার বহু আগে থেকেই মরুদস্যুদের মধ্যে ছিল। হিটলারও এই তত্বটা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল তার আব্রাহামিক ঈশ্বরের নির্দেশে জার্মান ছাড়া আর সব ছোটোলোকের জাতকে লুপ্ত করে দিয়ে; অন্তত তার আত্মজীবনী মেইন ক্যাম্ফ পড়লে সেটাই পাওয়া যায়। সনাতনী শাস্ত্রে সব বর্ণকে নিয়েই সমাজ চালাতে বলা হয়েছে, কখনোই নিচু জাতের অবলুপ্তি ঘটিয়ে সমাজকে উন্নত করার বিধান দেওয়া হয়নি। এই তত্ব সনাতনের অংশ আদৌ নয় বরং বিদেশি মরুদস্যুদের তত্ব। যা এখন কোরানে পাওয়া যায়। নিজেকে রাসুল মহম্মদের অবতার দাবী করা অনুকূলচন্দ চক্রবর্ত্তী সেখান থেকেই এটা পেয়েছেন। এবং তাঁর খুবই পছন্দও হয়েছে। এই পছন্দের কারণটাও জেনেটিক তত্বের মধ্যে পাওয়া যাবে, তবে সেটা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। নিতান্তই কেউ জানতে চাইলে বোঝার চেষ্টা করবেন যে অনুকূলের বাচ্চারা নাহয় জেনেটিক নিয়মেই ভগবানের বাচ্চা ভগবান হয়েছে, কিন্তু অনুকূলের মধ্যে ভগবান এল কোন জেনেটিক নিয়মে? অনুকূলেরই তত্ব অনুসারে তো সাধারণ মানুষ শিবচন্দ্র চক্রবর্তীর জেনেটিক পুত্র অনুকূল ভগবান হতে পারেনা।

আমরা আলোচনা করব ভগবানের বংশ নিয়ে। সনাতনী ধর্মের কোনো অবতারেরই বংশধরদের ভগবান হিসাবে ধরা হয়না। রামের, কৃষ্ণের, বুদ্ধের সন্তানেরা কেউই ভগবান বা অবতার নয়। এই বংশগত অবতারের তত্বটাও আব্রাহামিক ধর্মের দান। বাইবেলের এবং কোরানেরও মধ্যে পাওয়া যাবে, আব্রাহামিক গড তাঁর প্রফেট ইশাক বা আইজ্যাককে বর দিয়েছেন যে ভবিষ্যতে যত প্রফেট বা পয়গম্বর জন্মাবে সবই তার বংশে জন্মাবে। এই কারণেই প্রফেট আইজ্যাকের বংশের মধ্যে প্রফেটের জিন ঢুকে গেছে।, যেমন অনুকূলের বাচ্চারা সবই জেনেটিক্যালি ভগবান।

No comments: