দীনদয়াল উপাধ্যায় ও অখণ্ড মানবতাবাদ''

আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক ও দার্শনিক চিন্তাজগতে দীনদয়াল উপাধ্যায় (১৯১৬–১৯৬৮) একটি বিশেষ ও স্বতন্ত্র নাম । তিনি ছিলেন একাধারে একজন আদর্শনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ, গভীর দার্শনিক চিন্তাবিদ এবং দক্ষ সংগঠক, যাঁর চিন্তাধারা পরবর্তীকালে ভারতীয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় । ভারতীয় জন সংঘের অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে তাঁর ভূমিকা যেমন উল্লেখযোগ্য, তেমনই তাঁর প্রবর্তিত ‘অখণ্ড মানবতাবাদ’ ভারতীয় রাজনৈতিক দর্শনে এক মৌলিক সংযোজন হিসেবে বিবেচিত । 

পাশ্চাত্য পুঁজিবাদ ও মার্ক্সবাদী চিন্তার একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে তিনি এমন এক সমন্বিত জীবনদর্শনের কথা বলেন, যেখানে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র, তিনটিরই সুষম ও নৈতিক বিকাশ নিশ্চিত হয় ।

দীনদয়াল উপাধ্যায়ের দার্শনিক চিন্তার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ‘অখণ্ড মানবতাবাদ’ । এই মতবাদে মানুষকে কেবল অর্থনৈতিক সত্তা বা শ্রেণিসংগ্রামের যন্ত্র হিসেবে দেখা হয় না, মানুষকে শরীর, মন, বুদ্ধি ও আত্মার সমন্বয়ে গঠিত একটি পূর্ণাঙ্গ সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয় । তাঁর মতে, সমাজব্যবস্থা তখনই সুস্থ ও উন্নত হতে পারে, যখন বস্তুগত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতিও সাধিত হয় । তিনি বিশ্বাস করতেন যে পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা মতবাদ ভারতীয় সমাজের বাস্তবতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাই ভারতের নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবনবোধের ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রচিন্তা গড়ে ওঠা উচিত ।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও দীনদয়াল উপাধ্যায়ের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ভারতীয় জন সংঘের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতি হিসেবে তিনি দলের ভিত মজবুত করেন, যা পরবর্তীকালে ভারতীয় জনতা পার্টির চিন্তাধারার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে । তিনি রাজনীতিকে কেবল ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখেননি, একে সমাজসেবার একটি নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করতেন । তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে রাষ্ট্র ছিল সমাজের কল্যাণসাধনের মাধ্যম, শাসনের যন্ত্র নয় । এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে সমকালীন অনেক রাজনীতিবিদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল ।

সংগঠক ও চিন্তাবিদ হিসেবেও দীনদয়াল উপাধ্যায় ছিলেন ব্যতিক্রমী । রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক তাঁকে শৃঙ্খলা, ত্যাগ ও সেবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে । তিনি ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ও ‘পঞ্চজন্য’-এর মতো পত্রিকার সম্পাদনার মাধ্যমে তাঁর চিন্তাধারা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন । গভীর পাণ্ডিত্য, সরল জীবনযাপন ও আদর্শে অবিচল থাকার কারণে তিনি ‘পণ্ডিতজি’ নামে পরিচিত হন, অনেকেই বলেন, যা তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধারই প্রতিফলন ।

জীবনদর্শনের দিক থেকে দীনদয়াল উপাধ্যায় ছিলেন বিকেন্দ্রীভূত ও স্বনির্ভর অর্থনীতির প্রবক্তা । তাঁর মতে, ভারতের প্রকৃত শক্তির উৎস গ্রামসমাজ, তাই গ্রামভিত্তিক অর্থনীতি, স্বদেশি উৎপাদন ও স্থানীয় উদ্যোগের বিকাশ ছাড়া প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয় । তিনি এমন এক রাষ্ট্রকাঠামোর কথা কল্পনা করেছিলেন, যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সামাজিক ন্যায় ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সংঘর্ষে না গিয়ে একে পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে ।

পরিশেষে বলা যায়, দীনদয়াল উপাধ্যায় ছিলেন এমন এক চিন্তাবিদ ও রাজনীতিক, যিনি ভারতের ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়াস করেছিলেন । তাঁর "অখণ্ড মানবতাবাদ" শুধু একটি রাজনৈতিক মতবাদ নয়, একটি সামগ্রিক জীবনদর্শন, যা ব্যক্তি থেকে সমাজ এবং সমাজ থেকে রাষ্ট্র, সব স্তরেই ভারসাম্য, নৈতিকতা ও কল্যাণের কথা বলে । এই কারণেই দীনদয়াল উপাধ্যায় আজও ভারতীয় রাজনৈতিক চিন্তাজগতে একজন প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণীয় ।

একেবারেই অজানা ইতিহাসটি পড়ে ভালো লাগলে অবশ্যই অবশ্যই একটা লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করে সকলের মধ্যেই ছড়িয়ে দেওয়ার আবেদন রইলো, যাতে ইতিহাসটি সকলেই জানতে পারেন । ধন্যবাদান্তে... 🙏🙏

✍️ Sufal Sarkar II 

Comments

Popular posts from this blog

বড়দিনকে হিন্দুয়ানায় বেঁধেছিলেন স্বামীজি, তুলসী-পূজনেও সে বাঁধন অটুট।

কাঁদে নিদারাবাদ