বড়দিনকে হিন্দুয়ানায় বেঁধেছিলেন স্বামীজি, তুলসী-পূজনেও সে বাঁধন অটুট।

অভিসার যাত্রা। ১৮৯২ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর; আকাশের এক তারা এসেছেন মত্যসাগরের ত্রিকোণ প্রেমের জলধারায় নীলকর দিয়ে। সুনীল জলধি থেকে সন্তানসম ভারতবর্ষের আবির্ভাব; মহাকালের সেই মহান অধ্যায় দেখতে এসেছেন সপ্তর্ষিমণ্ডলের এক আশ্চর্য নক্ষত্র; তার অতীত আর ভবিষ্যৎ মেলাবেন সমাধিতে বসে। পাশেই সমুদ্র-তনয়া কন্যাকুমারী। বড়দিন-ই বটে, তার প্রাক্কালে পায়ে হেঁটে কন্যাকুমারী পৌঁছেছেন স্বামী বিবেকানন্দ, তারপর মূল ভূখণ্ড থেকে সাগর-সঙ্গমে ৫০০ মিটার সাঁতরে ভারতীয় পাহাড়ের শেষ বিন্দুতে পৌঁছলেন তিনি; দেখলেন অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন, তারপর অতুল্য কিন্তু অভুক্ত ভারতের জন্য গ্রহণ করলেন এক অধ্যাত্মিক সংকল্প। ধ্যানের শঙ্খনাদে একাদিক্রমে তিনদিন কাটলো — ২৫,২৬,২৭ শে ডিসেম্বর।

যে খ্রীস্টান ধর্ম মানুষকে ‘পাপী’ বলে, সেই ধর্মের প্রতিবাদ কেবল স্বামীজিই করেন নি, করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণও। মানুষ দেবতা, মানুষ ব্রহ্ম; সে পাপী হবে কীভাবে? সে অমৃতের সন্তান, সে পবিত্র, সে পূর্ণ; পূর্ণতা প্রাপ্তির সব যোগই তার মধ্যে আছে। শুধু তাই নয়, ব্রাহ্মসমাজের শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিন্দু বিধবা আশ্রমের জন্য তিনি বিদেশে বক্তৃতা দিয়ে টাকা তুলে পাঠিয়েছেন কেবল খ্রিস্টান ধর্মান্তরিত ভারতীয় বিদূষী মহিলা রামাবাইয়ের তৈরি বিধবা আশ্রমকে ঔচিত্য দেখানোর জন্য। কারণ এই মহিলাসহ অন্যান্য খ্রীস্ট-ধর্মাবলম্বী ও মিশনারিরা গলা মিলিয়ে ভারতীয় বিধবাদের দুঃখের অতিরঞ্জন করতেন, স্বামীজির তা না-পসন্দ ছিল।
হিন্দু ধর্মের প্রচারে আনুকূল্য পাবার জন্য যতটুকু যীশু-ভজনা দরকার স্বামীজি তাই করেছেন, তিনি জানতেন একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ প্রচার ধারায় ভারতসহ প্লাবিত হবে বিশ্বের নানান অংশ, তাই বড়দিনের মত দিনটির মধ্যে হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য কীর্তনের বীজ বপন করে দিলেন তিনি। এটা কলোনিয়াল প্রভাবমুক্তিরই সাধনা, সাধনা ২৫ শে ডিসেম্বরকে অতিক্রমের।

এই দিনে বরং বেশী করে শ্রীরামকৃষ্ণের ও স্বামী বিবেকানন্দের স্মরণ-মনন ও পূজন জরুরী। জরুরী শ্রীরামকৃষ্ণ-স্বামীজি যুগলবন্দীর আরাধনা। খ্রীস্টের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণকে না দেখে শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই যীশুখ্রীস্টকে আবিষ্কার করার সাধনা হিন্দুদের শুরু করা উচিত। সম্প্রীতির বার্তা দিতে বরং খ্রীস্টানরা প্রভু যীশুর মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণকে খুঁজে নিক।

ভারতবাসীর অন্তরে প্রশ্ন জেগেছিল, সজ্জিত নির্জীব ‘ক্রিসমাস ট্রি’-র চাইতে জীবন্ত বীরুৎ-প্রাণ তুলসী কেন আমাদের আরাধ্য হবে না! তার সুবাস, তার নির্যাস, তার বাতাস কেবল অতি পবিত্র নয়, অতীব ভেষজগুণ-সম্পন্ন। করোনা পরিস্থিতিতে তুলসীর গুণ আমাদের বুঝিয়ে দিতে হয় নি, সারা দেশে এক ধাক্কায় তুলসীর ব্যবহার বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল, তা থেকে প্রস্তুত ক্বাথ, বটিকার বেচাকেনা হয়েছে বিস্তর। আজ তাই তুলসীর ভেষজ মূল্যকে ভারতবাসীর ধন্যবাদ জানানোর দিন। ভারতবাসী অন্যান্য বছরের তুলনায় আরও অধিক ঐশী সমারোহে তুলসী-পূজন দিবস পালন করবেন ২৫ শে ডিসেম্বর। কারণ ভারতবাসীর বৃক্ষপূজার ধারণা নতুন নয়, উদ্ভিদের মধ্যেকার চৈতন্যও নতুন নয়। শীতের ঝকমকে রোদে যখন তুলসীমঞ্চ আলো করে পুষ্পমঞ্জরী পেকে ওঠে, বীজ পুষ্ট হয়, তখন তার বীজ সংগ্রহ করে রাখতেন গৃহস্থ পরিবার। ক’দিন সুপ্তির পর বসন্ত এলেই তা থেকে বেরিয়ে আসতো নতুন চারা। মন্দিরের এক চিলতে জমিতে ‘তুলসীতে তুলসীতে বৃন্দাবন’ হয়ে যেতো। তারই শুভসূচনা ২৫ শে ডিসেম্বর। ভারতবাসীর কাছে তুলসী মাহাত্ম্যে ‘বড়দিন’-ই বটে। শরতের দিনে যে চারা বড় হয়ে উঠতো, মাটির মন্ডে শিকড় সমেত তা এদিন স্বজন-বান্ধব, প্রতিবেশীকে বিতরণ করা ছিল পবিত্র কর্তব্য। আর পরিবেশিত হত নলেন গুড়ে শালিধান্যে রাঁধা পরমান্ন। কোনো কেক-পেস্ট্রি স্বাদে গন্ধে তা অতিক্রম করতে পারে নি। অনতিক্রম্য এক দিবস – তুলসী-পূজন।

Comments

Popular posts from this blog

কাঁদে নিদারাবাদ

জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো শক্তিশালী একটি লেখা।