"যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি মারাঠাদের অস্তিত্ব শেষ করে দেবো... ততক্ষণ না আমি মুকুট পরবো আর না শান্তির নিঃশ্বাস নেবো।"

"যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি মারাঠাদের অস্তিত্ব শেষ করে দেবো... ততক্ষণ না আমি মুকুট পরবো আর না শান্তির নিঃশ্বাস নেবো।"

​ওদিকে মারাঠারা প্রতিজ্ঞা নিলো – ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজের বীরত্ব আর বলিদান বিফলে যাবে না... আমরা মুঘল সাম্রাজ্য আর ঔরঙ্গজেবের কবর এই মাটিতেই খুঁড়ে দেবো......হর হর মহাদেব ।

​একদিকে মুঘল সেনা লাখের সংখ্যায়... ঔরঙ্গজেব মারাঠাদের অস্তিত্ব শেষ করে দেওয়ার জন্য আরও বেশি শক্তি জোগাড় করছিলো, আর অপরদিকে একজন ১৯ বছরের ছেলে আর ২০ হাজারের একটা ছোটো সৈনিক সংঘ কোনো দিক থেকেই মোগল সেনার সামনে টেকার ক্ষমতা রাখে না।

​ঔরঙ্গজেব কি সফল হবে 'নিজের মনের ইচ্ছায়' না মারাঠারা নেবে নিজেদের প্রতিশোধ?

​যখন ধর্মবীর ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজ হিন্দু স্বরাজের জন্য নিজের প্রাণ ত্যাগ করলেন, তখন পুরো মারাঠা সাম্রাজ্য গভীর শোকে ডুবে গেলো।
​ঔরঙ্গজেব আর মুঘল সাম্রাজ্য, যেটা মারাঠাদের বিনাশ মনে করছিলো, সেটা আসলে মুঘল সাম্রাজ্যের বিনাশের শুরু ছিলো আর সূর্যোদয় ছিলো মারাঠা সাম্রাজ্যের।
​কারণ যেখানে ঔরঙ্গজেব আর মুকাররব খান জিতের আনন্দে ডুবে ছিলো, সেখানে মারাঠা সাম্রাজ্য ঔরঙ্গজেব আর মুকাররবের প্রতারণা আর অত্যাচারের প্রতিশোধের প্রস্তুতি করছিলো। এই শোক শীঘ্রই ক্রোধ আর প্রতিশোধে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিলো।
​মারাঠারা প্রতিজ্ঞা নিলো – ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজের বলিদান বিফলে যাবে না...

​ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ আর মহারানী সাইবাইয়ের পুত্র, ধর্মবীর ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজ, যিনি আগামী দিনে মুঘল সাম্রাজ্যের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি নিজের বীরত্ব আর পরাক্রমের ওপর নির্ভর করে পুরো মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসলীলা শুরু করে দিলেন।

​ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজের বারবার ভয়ানক আক্রমণে ঔরঙ্গজেবের রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিলো। এই জন্য ক্লান্ত, হেরে যাওয়া ঔরঙ্গজেব এই কথা ভালোভাবে জানতো যে ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজকে সামনে থেকে যুদ্ধে হারানো মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। কিন্তু নিজের লোকেদেরই প্রতারণার গ্রহণ সম্ভাজী মহারাজেরও লাগলো।
​কেননা এই দেশ অনেক পুরোনো সময় থেকেই নিজের এখানে জয়চাঁদদের পালন করার দিব্যি খেয়ে রেখেছে।
​এই জন্য মুঘল সর্দার মুকাররব খানের হাজার সেনা সম্ভাজী মহারাজকে প্রতারণা করে বন্দি বানিয়ে নিলেন আর ঔরঙ্গজেবের সামনে নিয়ে এলেন।

​ঔরঙ্গজেব যখন ভরা দরবারের সামনে তাকে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য আর নিজের প্রাণের রক্ষার জন্য ভিক্ষা চাইতে বললো, তখন ঔরঙ্গজেবের দরবারেই তিনি ঔরঙ্গজেবের সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিলেন।
​নিজের দরবারে, নিজের লোকের সামনে হওয়া অপমান ঔরঙ্গজেব সহ্য করতে পারলো না আর রাগে পাগল হয়ে গেলো। তার আদেশে ধীরে ধীরে ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজের গায়ের চামড়াকে কেটে আলাদা করা হলো... যন্ত্রণা যাতে বেশি হয় তাই ওনার ক্ষতস্থানে নুন, লঙ্কা গুঁড়ো ছিটিয়ে দেওয়া হলো।
​চোখে লঙ্কা দেওয়া হলো আর মাথার চুল টেনে ছেঁড়া শুরু হলো... তারপর শরীরের মাংস কেটে ওনার সামনেই কুকুরদের খাওয়ানো হলো। আঙুল কাটা হলো, হাত কাটা হলো, গরম লোহার শিক চোখে ভরে দেওয়া হলো, জিভ কাটা হলো। প্রতিদিন ওনার শরীর থেকে একটা একটা অঙ্গকে কাটা হতো... এইভাবে ৪০ দিন ওনাকে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা দেওয়া হলো আর শেষে ক্লান্ত আর হেরে গিয়ে ১১ মার্চ ১৬৮৯-এ ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে দেওয়া হয়েছিলো।

​যে বা যে সব লোক ঔরঙ্গজেবের সুনাম নিয়ে গল্প বানায় আর তাকে নিজেদের বাপ, দাদু মনে করে, তাদের এই ব্যাপারে অবশ্যই পড়া উচিত যে তাদের বাপ, দাদু কতটা নিষ্ঠুর আর কতটা অমানবিক আর কোন ধরণের হত্যাকারী ছিলো আর কী করে তারা ওই সময়েও লোকদের Convert (ধর্মান্তরিত) করার চেষ্টা করেছিলো। বেশিরভাগ লোক যারা আজও ভারতে থাকে আর ঔরঙ্গজেবকে নিজেদের বাপ মনে করে, তারা Forced fully Converted (জোর করে ধর্মান্তরিত) লোকই।

​এটুকুতেও ঔরঙ্গজেব থামেনি। তার আদেশে মুঘল সর্দার জুলফিকার খান 'রায়গড়' কেল্লাতে আক্রমণ করে সম্ভাজী মহারাজের স্ত্রী রানী ইয়েসুবাই আর ওনার ৭ বছরের পুত্র 'শাহু' মহারাজকে বন্দি করে নিলো। কিন্তু এই আক্রমণ থেকে ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজের ছোটো ভাই রাজা রাম মহারাজ বেঁচে গিয়েছিলেন।

​ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজের মৃত্যুতে পুরো মারাঠা সাম্রাজ্যে অন্ধকার ছেয়ে গেলো। একদিকে ঔরঙ্গজেবের ৯ লাখের বিশাল সেনা আর অপরদিকে দক্ষিণে মারাঠা ছিলো, যাদের কাছে ২০ হাজারের সেনা ছিলো। এই খারাপ পরিস্থিতিতে মারাঠা সাম্রাজ্যের দড়ি সামলাচ্ছিলেন ১৯ বছরের ছত্রপতি রাজা রাম মহারাজ, যিনি সম্ভাজী মহারাজের ছোটো ভাই ছিলেন।
​তখনই প্রবেশকার্য হলো দুজন বীর মারাঠার, যাদের নাম ছিল সান্তাজি ঘোরপাড়ে (Santaji Ghorpade) আর ধনজি যাদব (Dhanaji Jadhava)। যারা ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজের হিন্দু স্বরাজের প্রেরণা নিয়ে রাজা রাম মহারাজের ঢাল (কবজ) হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

​ঔরঙ্গজেব পুরো হিন্দুস্থানকে নিজের দখলে নিতে চাইতো। এই জন্য সে একের পর এক শক্তিশালী সর্দারকে জমা করল আর তাদের সাথে বেরিয়ে পড়ল মারাঠাদের অস্তিত্ব শেষ করতে। ওদিকে মারাঠারাও আহত সিংহের মতো নিজেদের অশান্ত করে রেখেছিলো 'নিজের রাজার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য।

​তখনই মারাঠাদের কাছে খবর এলো ঔরঙ্গজেব লাখের সেনা নিয়ে মহারাষ্ট্রের তুলাপুর জায়গাতে ডেরা গেড়ে বসেছে। এখানেই ঔরঙ্গজেব ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলো। পরের দিন বীর মারাঠা যোদ্ধা সান্তাজি ঘোরপাড়ে আর কিছু সৈনিক ওনার সাথে বেরিয়ে পড়লেন। ২ হাজার মাওলে ঔরঙ্গজেবের লক্ষ সেনার আগে হিংস্র সিংহের মতো দাঁড়িয়েছিলো। মারাঠাদের হঠাৎ আক্রমণে মুঘল ছাউনিতে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেলো। মারাঠারা মুঘল ছাউনিতে ঢুকে যে প্রকার তাণ্ডব শুরু করলো, তা দেখে ঔরঙ্গজেবকে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে কুকুরের মতো পালাতে হলো।

​যারা সর্বদা ছল করে আক্রমণ করে এসেছে, আজ প্রথমবার তাদের ওপর এভাবে আক্রমণ হয়েছিলো। এটাকে গোড়িলা যুদ্ধ বলা হয়, আর প্রথম বারেই ঔরঙ্গজেবকে পালাতে হয়েছিলো। এই আক্রমণে ঔরঙ্গজেবের প্রাণ বেঁচে গেলেও মোগলদের নাক কেটে গিয়েছিলো।

​যখন মারাঠারা ফিরে গেলো, তার দুদিন পর আবার মারাঠাদের তাণ্ডব সোজা রায়গড় কেল্লাতে গিয়ে শুরু হলো। কিন্তু রায়গড় কেল্লাকে আগেই মুঘল সর্দার জুলফিকার খান ঘেরাও করে কেল্লা বন্দি করে রেখেছিলো।

​সান্তাজি ঘোরপাড়ে আর তার সঙ্গীরা মুঘলদের এই ঘেরাকে ভেঙে রায়গড় কেল্লাতেও তাণ্ডব শুরু করে দিলো আর মুঘলদের দামি ধন-রত্ন, ঘোড়া আর পাঁচটা হাতি নিজেদের সঙ্গে বালহলা (নিয়ে) এলো। এইভাবে মারাঠারা যখনই সুযোগ পেতো মুঘল সেনাদের বাহাত্তর হুরের কাছে পাঠিয়ে দিতো।

​যে মুকাররব খান ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজকে ছল আর প্রতারণা করে বন্দি করেছিলো, তাকে ঔরঙ্গজেব ৫০ হাজার টাকা নগদ দিয়ে মহারাষ্ট্রের কোলহাপুরের সুবেদার নিযুক্ত করেছিলো। মারাঠারা এই প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিলো, যা কিছুই হয়ে যাক কিন্তু ওই মুকাররব খানকে জ্যান্ত ছাড়া যাবে না। ডিসেম্বর ১৬৮৯-এ মুকাররব খানের বিশাল সেনাকে ঘিরে... হর হর মহাদেবের ধ্বনি করতে করতে কাটতে শুরু করলো।

​এই ঘনঘোর যুদ্ধে এবার সান্তাজি ঘোরপাড়ে মুকাররব খানকে এমন মেরেছিলেন যে রক্তরঞ্জিত হয়ে পড়ে থাকা মুকাররব খানের দুর্দশা দেখে মুঘল সেনা তাকে জঙ্গলে নিয়ে পালিয়ে গেলো। কিন্তু মারাঠারা মুকাররব খানকে এমন গুছিয়ে মেরেছিলো যে সে চটপট করে মরেছিলো। এইভাবে ওই মুকাররব খানকে মেরে মারাঠারা ছত্রপতি সম্ভাজী মহারাজের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেন।
​সান্তাজি ঘোরপাড়ের সাহস আর বীরত্বে প্রসন্ন হয়ে ১৬৯১-এ ছত্রপতি রাজা রাম মহারাজ ওনাকে মারাঠা সাম্রাজ্যের সর্ব সেনাপতি ঘোষণা করেন।

​সর্ব সেনাপতি হবার পরেই সান্তাজি নিজের প্রথম লক্ষ্য মুঘল সাম্রাজ্যকে বানালেন আর নিজের সঙ্গে ১৫ থেকে ২০ হাজার মারাঠা লশকর নিয়ে ঔরঙ্গজেবের মুঘল সাম্রাজ্যেতে ভয়ঙ্কর তাণ্ডব শুরু করে দিলেন।
​এরপর বুরহানপুর, নন্দুরবার, সাতারা, কৃষ্ণা নদী পার করে কর্ণাটকের মতো একটার পর একটা মুঘল রাজ্যে মারাঠা সাম্রাজ্যের জিতের ডঙ্কা বাজতে লাগলো।
​ঔরঙ্গজেবের দরবারের ইতিহাসকার 'কাফি খান' সান্তাজি ঘোরপাড়ের ব্যাপারে বলেন, যে মুঘল সৈনিকদের সঙ্গেই সান্তাজি ঘোরপাড়ের যুদ্ধে সামনা-সামনি হতো, তো সেটাতে শুধু দুটোই পরিণাম বেরিয়ে আসতো... প্রথমত তারা যুদ্ধে মারা যেতো না হলে মারাঠাদের কাছে বন্দি হয়ে যেতো।

​একটাও মুঘল সর্দার সান্তাজি ঘোরপাড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সান্তাজি ঘোরপাড়ে আর ধনজি যাদব যুদ্ধ অভিযানের সময় যে মুঘল ক্ষেত্রেই যেতেন, ওখানের শহর পুরো শেষ করে দিতেন।
​কাবুল, গান্ধার থেকে শুরু করে দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত পুরো ভারতবর্ষ যে ঔরঙ্গজেবকে ভয় পেতো... যে ঔরঙ্গজেবের ডঙ্কা বাজতো... সেই ঔরঙ্গজেব মারাঠাদের ভয়ে সাহাদ্রি পর্বতে এদিকে ওদিকে পালিয়ে বেরোতো। এতবড় মুঘল বাদশার লাগাম মারাঠাদের কাছে ছিল। লাগাতার ২৭ বছর মারাঠারা ঔরঙ্গজেবকে এতটা ছুটালো যে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে গেলো... শেষে মারাঠাদের হাতে বারবার মুঘলদের পরাজয়ে ওই শয়তান ঔরঙ্গজেব যন্ত্রণা পেয়ে পেয়ে ওখানেই মরে গেলো।

​মারাঠারা তাকে কোনোদিন দিল্লী ফিরে আসতে দেয়নি। এই মহারাষ্ট্রের মাটিতে তাকে পোঁতা হলো আর ভারতবর্ষ জেতার তার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেলো।
​আপনারা কোনো দিন ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু পত্র অবশ্যই পড়বেন... সেখানে শুধু একটাই হিন্দু রাজার নাম লেখা আছে... যেটা হলো ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের মারাঠা সাম্রাজ্য।

​এতো বড়ো মুঘল সাম্রাজ্যের চিহ্ন মুছে দেওয়া সর সেনাপতি সান্তাজি ঘোরপাড়ের পরে কী হয়েছিলো, যদি সেটা আপনারা জানতে চান তো কমেন্টে আপনাদের মতামত অবশ্যই দিন, যাতে আমি আপনাদের ওনার কাহিনী লেখার জন্য পড়া শুরু করি।

​ভারতবর্ষের বীরদের আসলো আর সত্য ইতিহাস যদি জানতে চান তাহলে আমাদের পেইজকে বেশি বেশি শেয়ার করুন... কারণ আমাদের সঠিক ইতিহাস জানার জন্য নানা জায়গায় যেতে হয় আর নানা রকম বই পড়তে হয়।

কেউ ফালতু কমেন্ট করার আগে নিচে পড়ে নেবেন নিচে উল্লেখ করে দিয়েছি কোন বই থেকে এই তথ্য গুলো পাবেন। 

Source
1. কাফি খানের লেখা 'মুনতাখাব-উল-লুবাব' (Muntakhab-ul-Lubab)
2. ​জি. এস. সরদেসাই (G. S. Sardesai)-এর 'নিউ হিস্টোরি অফ দ্য মরাঠাস' (New History of the Marathas)

Comments

Popular posts from this blog

কাঁদে নিদারাবাদ

জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো শক্তিশালী একটি লেখা।

China is not making plays on the whole world?चीन पूरी दुनिया पर नाटक नहीं बना रहा है?গোটা বিশ্বটাকে নিয়ে চীন নাটক করছে না তো?