Monday, June 29, 2020

প্রায়শই শুনে থাকি ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক সীমান্ত হত্যা

প্রায়শই শুনে থাকি ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক সীমান্ত হত্যা, মুসলিম নির্যাতন ইত্যাদি নানা খারাপ আচরণের কারণেই এদেশের মানুষের ইন্ডিয়া বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে।

তো এদেশের মেজরিটির ইন্ডিয়া বিদ্বেষ কবে ছিলো না?

পাকিস্তান আমলে? ইন্ডিয়া বিদ্বেষের বীজ বুনে এবং সার, পানি দিয়েই তো এদেশের মানুষকে পাকিস্তানিরা শত শোষনের পরেও ধরে রাখতে চেয়েছে বা দীর্ঘসময় সফলতাও পেয়েছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও তারা এদেশে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল।

১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও তো পাকিস্তানীদের প্রধান শ্লোগানই ছিল ইন্ডিয়ার চক্রান্তেই ষড়যন্ত্রকারীরা পেয়ারা পাকিস্তান ভাঙ্গতে চাচ্ছে।

৯ মাস যুদ্ধের সমস্ত অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, ১ কোটি শরণার্থীকে  ৯ মাস আশ্রয় ও খাদ্যের সংস্থান, সকল আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করে দেয়া, সরাসরি যুদ্ধে নেমে তাদের ৫০০০ সৈন্য মৃত্যু, এতকিছুর পরেও ১৯৭২ সালের সদ্য স্বাধীন দেশেও ইন্ডিয়ার প্রতি এদেশের জনতার কৃতজ্ঞতা ছিল? ছিল না।

তারা প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছিল, ইন্ডিয়া এদেশের সব লুট করে নিয়ে গেছে, সোনা, রূপা, কলকারখানা, অস্ত্র....। বটে। এত অস্ত্র, কলকারখানা কোত্থেকে এলো? ৯ মাস যুদ্ধ করলেন কার যোগাড় করে দেয়া অস্ত্র থেকে।

বলে, ইন্ডিয়া নিজের স্বার্থেই আমাদের সহযোগিতা করেছে। তো আপনি আল্লাহর ইবাদত ও তো করেন নিজের স্বার্থেই, নয় কি?

৭৫ থেকে ৯৬, দীর্ঘ ২১ বছর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির আশীর্বাদপুষ্ট, পাকিস্তানপন্থী জিয়া, এরশাদ, খালেদা এদেশে রাষ্ট্রক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছে শুধু ইন্ডিয়া জুজু কাজে লাগিয়ে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশ ইন্ডিয়া দখল করে নিবে, এদেশে আর মসজিদ থাকবে না, আজান থাকবে না, মসজিদে উলু ধ্বনি হবে, সকল জমি হিন্দুরা দখল করে নিবে, শেখ মুজিব হিন্দু, তার বাবা হিন্দু বা মা হিন্দু, ছোটবেলা থেকে এসব শুনে শুনেই তো বড় হয়েছি।

 ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের ভুখন্ডটি পাকিস্তানিদের কাছ থেকে স্বাধীন করেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামিলীগ।
আন্তর্জাতিক আদালতে আইনি লড়াই করে ভারতের কাছ থেকে ২৮,৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার ভুখন্ড ছিনিয়ে এনেছে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামিলীগ সরকার। মায়ানমারের কাছ থেকে ৭০,০০০ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্রসীমা অবমুক্ত করেছে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামিলীগ সরকার। ইন্ডিয়ার সাথে পানিচুক্তি করে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করেছে। হ্যাঁ, মমতার একগুঁয়েমির কারণে তিস্তা চুক্তি করা যায়নি। খালেদা জিয়া ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে দিল্লী গিয়ে পানির ন্যায্য হিস্যার কথা বলতেই ভুলে যেতেন। উলটা বিজেপি ক্ষমতায় আসলেই ফের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবেন, অমিত শা এর ফোন, মোদীকে প্রথম অভিনন্দন তারাই জানিয়েছিলেন।

 পাড়া প্রতিবেশী হাজার জনে একজনও পাইনি ইন্ডিয়া ক্রিকেটের সমর্থক। পাকিস্তানের খেলার দিন এদেশে ঈদ, পাকিস্তান জিতলে মিছিল হতে দেখেছি, গরু জবাই দিতে দেখেছি। গাল-মুখ-গ্যালারী ভরা চান তাঁরা পতাকায় ভরা দেখেছি।
ঢাকা ভার্সিটির হলে ২০০১ সালেও ১০০০ জনে ৮/১০ জন বাদে সব ছিল পাকিস্তানি সাপোর্টার। ম্যারি মী আফ্রিদি প্লাকার্ডে এদেশের তরুণীদের অর্গাজম দেখেছি।

ধীরে ধীরে পাকি ক্রিকেটের পতন, ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের উত্থান, এবং একই সাথে ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে ৯৭ সালে আইসিসি বিজয়, ৯৯ তে পাকিকে হার, জগমোহন ডালমিয়ার সহযোগিতায় ওডিআই ও টেস্ট মর্যাদা লাভ, এসব কারণে পাকি ক্রিকেট প্রীতি কিছুটা চাপা পড়ে বা সুপ্ত অবস্থায় দেখা গেছে দশক যাবত।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হওয়ার পর আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগা বাংপাকিরা কখনো এরদোগান, কখনো প্লেবয় ইমরানকে পীর মেনেছে। গে, লেসবিয়ান অধিকার আদায়ে সোচ্চার জাস্টিন ট্রুডো কিংবা  লিভ টুগেদার করা কুমারী মাতা জেসিন্ডা হচ্ছে তাদের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো।

পাকি ক্রিকেটের সাফল্যের সাথে এদেশে গোআজম ভক্ত বাংপাকিদের সফলতার হার সমানুপাতিক। 

পাক ক্রিকেটে নতুন করে উজ্জীবিত হতে না পারলেও ৭১ এ আমাদের স্বাধীনতা বিরোধী চীন চিরকালই বাংপাকিদের মুক্তির সুধা নিয়ে আসে। উইঘুর মুসলিমদের ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতনকারী, কুরআন পরিবর্তনের ঘোষনা দেয়া চিনকে কিছুদিন আগেও করোনা গজব দিয়ে শাস্তি দেয়া মুমিন ভাইয়েরা চিনকে নিয়ে নতুন করে আশায় বুক বাঁধছে। ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে ইসরাইল কিছু বললে এরা ইসরাইলের নেতানিয়াহুকে কদমবুচী দিবে। চিন ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে এদেশে ঘাটি গাড়ানোর প্রধান কারিগর। ওসব আমরা ভুলে যাই। ভুলে যাই পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে হাজার হাজার মুসলিম নিধন, সিরিয়া, ইয়েমেনের লাখ, লাখ মুসলিম হত্যাও আমাদের অনুভূতি জাগায় না।

আজীবন ইন্ডিয়া বিরোধীদের কাছে সীমান্ত হত্যা নিয়ে নতুন ঘৃনা সৃষ্টি হওয়া উছিলা মাত্র।
পৃথিবীর ৫ম দীর্ঘতম সীমান্ত হচ্ছে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া সীমান্ত। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ লোক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বৈধ পথে ওদেশে যায়, কেউ কখনো বিপদে পড়েছে শোনা যায়নি। প্রতিনিয়ত চুরি বা চোরাকারকাবীতে ঢোকাদের ধরে আইনী প্রক্রিয়ায় বিচার কাম্য। কিন্তু পলায়নপর চোরদের যখন গুলি করা হয়, এবং তারপরও চোরাকারবারী চলতেই থাকে তখন চোর সন্দেহে গণপিটুনীতে মেরে ফেলা বা নিয়মিত ক্রসফায়ারের মহাভক্ত জাতির চোরের মায়ের বড় গলা করতেও বিব্রত বোধ করা উচিৎ।

বৃহৎ গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ইন্ডিয়ায় গুজরাট রক্তমাখা মোদীর মেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের উত্থান হচ্ছে এটা সত্য। তবে মুসলিম প্রীতি আমাদের একটা উছিলা মাত্র।  ইন্ডিয়ায় গত কয়েক দশকে মুসলিমদের সংখ্যা বা অনুপাত কোনটিই কমেনি বরং বৃদ্ধি পেয়েছে, ওদেশের একটি মুসলিম পরিবারও চাকরি বা ব্যবসায়িক প্রয়োজন ছাড়া ওদেশ ছেড়ে প্রতিবেশী পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপে আশ্রয় নেয়নি। বরং বাংলাদেশ, পাকিস্তান থেকে সংখ্যালঘু ক্রমশ নাই হয়ে যাচ্ছে। ভারতে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি সহ বড় বড় পদাধিকারীরা সন্মান ও গৌরবের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। মনসুর আলী খান পতৌদি বা ৯ বছর আজহারউদ্দিন ছিলেন ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। আমাদের সৌম্য বা লিটন পূজার শুভেচ্ছা দিলেও বা সত্য সাহা বুয়েটের ভিসি নিয়োগ পেলেও যে পরিমাণ অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালির সম্মুখীন হয় তা কল্পনাতীত।

এরশাদ আমলে যে প্রাইমারিতে পড়েছি সেখানেও দেখেছি ৪ জন শিক্ষকের ৩ জনই হিন্দু, নিজ যোগ্যতায়ই নিয়োগ পেয়েছেন এবং ভালো পড়াচ্ছেন। হাইস্কুলগুলোতে দেখেছি অংক, বিজ্ঞান, ইংরেজির অধিকাংশ ভালো শিক্ষক হিন্দু। এখনো দেখি গ্রাম পর্যায়ের ডিগ্রি কলেজ গুলোতেও হিন্দু মেয়েরা তুলনামূলক বেশি পড়ালেখা করছে। এমনকি অনার্স পর্যায়েও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মুসলিম মেয়ে বিয়ে শাদী, ঘর সংসারে ঝরে গেলেও হিন্দু মেয়েরা পড়ালেখা শেষ করে চাকরিতে যায়। মুসলিম মেয়েয়া এত পর্দা করার পরেও স্বামীরা সাহস ও বিশ্বাস করে চাকরিতে দেয় না, গেলে সংসার ভাঙ্গতে চায়। হিন্দু মেয়েরা পিঠ খোলা শাড়ি পরলেও স্বামীরা তাদের বিশ্বাস করে, পড়ালেখা শেষ করিয়ে ক্যারিয়ার গঠনে সহায়তা করে থাকে।

সংখ্যালঘু নির্যাতন, সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্ফালন, ডানপন্থীদের উত্থান সারা পৃথিবী জুড়ে আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া বড় সমস্যা। ধর্মীয় বিভেদ আর ঘৃনা চর্চা আরো বড় সমস্যা। ইন্ডিয়ায় হিন্দু প্রধান না হয়ে ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ প্রধান হলেও আমরা একই ভাবে ঘৃনা করতাম। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, শুধুমাত্র আমরাই সেরা, একমাত্র আমরাই সঠিক, পৃথিবীর বাকি সব জাতি, গোষ্ঠী, ধর্মই মালাউন  বা অভিশপ্ত।

আমাদের মনে রাখা উচিৎ, ভুগোল চাপার জোর দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে অন্য কোথাও স্থানান্তর করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বাংলা ভাষাকে ভাগ করা যায় না। ঘৃনা বাদ দিয়ে জ্ঞান ও যোগ্যতা অর্জন করে, পরস্পরকে ভালোবেসে, ব্যক্তিত্ব নিয়ে আমাদের সমস্যা সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রে সকল প্রতিবেশি জনগণেরই ভালোবাসা দিয়ে দায়িত্বশীল হওয়ার শিক্ষা, মানসিকতা অর্জন করতে হবে।

আর ভারতেরও তার নিজের স্বার্থেই প্রতিবেশী জনগণের কাছে তার পজিটিভ ইমেজ গঠনের সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। নয় তার সেভেন সিস্টার রাজ্যসমূহের স্থিতিশীলতা, অখন্ডতা ও তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা কঠিন হয়ে যাবে।

লিখেছেন: Abdul Karim বাংলাদেশ 

No comments: