একজন হিন্দু মেয়ে মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করার আগে যা জানা দরকার:

ভারতে আন্তঃধর্মীয় বিবাহ (Inter-faith marriage) এখন বেশ সাধারণ হয়ে উঠছে। কিন্তু এমন বিয়েতে উভয় পক্ষের, বিশেষ করে মেয়েটির, নিজের অধিকার, আইনি পরিণতি, এবং ভবিষ্যতে সম্পত্তি উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলি আগে থেকেই জানা খুব জরুরি।

সম্প্রতি, গুজরাটের এক ৩০ বছরের কাছাকাছি বয়সী জৈন মেয়ে (ধরুন নাম নিত্যা, এমবিএ ইন ফাইনান্স) আমার কাছে একটি ব্যক্তিগত বিষয়ে পরামর্শ নিতে এসেছিল। সে বলল, সে তার এক মুসলিম সহকর্মী (সুন্নি)-এর সঙ্গে “গম্ভীর সম্পর্কে” আছে এবং দু’জনেই বিয়ের কথা ভাবছে। নিত্যার পরিবার রক্ষণশীল, তারা এই বিয়েতে রাজি নয়, কিন্তু নিত্যা বিশ্বাস করে বিয়ের পর সবাই মেনে নেবে।

ছেলেটির পরিবার রাজি, তবে তাদের শর্ত, নিত্যাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে হবে এবং বিয়েটা নিকাহ মারফত হতে হবে, যাতে আত্মীয়-স্বজনদের আপত্তি না থাকে। নিত্যা জানতে চাইল, আইন অনুযায়ী তার কী কী অধিকার থাকবে, বিয়ে ভেঙে গেলে কী হবে, এবং কোন পথে তার স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে।

আমি বললাম, “আমি একজন আইনজীবী হিসেবে তোমাকে আইন বুঝিয়ে বলব, লাভ-ক্ষতি দুটো দিকই জানিয়ে দেব।”
এই আলোচনা যেহেতু অনেকের উপকারে আসতে পারে, আমি প্রশ্ন-উত্তরের আকারে আমাদের কথোপকথনটি লিখে রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম, যাতে মানুষ ভুল তথ্যের শিকার না হয়।
এই লেখার উদ্দেশ্য কারও ধর্মকে আঘাত করা নয়, বরং সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করা।

নিত্যা: আমার অবস্থায় আমি কোন কোনভাবে বিয়ে করতে পারি?
উত্তর ১: তিনটি উপায়ে তোমার বিয়ে হতে পারে, নিত্যা।

1. স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট (Special Marriage Act) – এখানে কারও ধর্ম পরিবর্তন করতে হয় না, এবং উভয় পক্ষ সমান অধিকার পায়।

2. মুসলিম আইনে (নিকাহ) – এখানে তোমাকে আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে, কারণ নিকাহ শুধুমাত্র মুসলমানদের মধ্যে বৈধ। ধর্ম পরিবর্তনের সঙ্গে তোমার নামও বদলাতে হবে, যদিও সামাজিকভাবে তুমি আগের নাম ব্যবহার করতে পারো (যেমন, অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর ধর্মান্তরিত হয়ে “আয়েশা বেগম” হলেও নাম ব্যবহার করেন শর্মিলা ঠাকুর)।

3. হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট (Hindu Marriage Act) – যদি তোমার প্রেমিক ইসলাম ত্যাগ করে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে, তাহলে তোমাদের বিয়ে এই আইনে হতে পারে।

নিত্যা: আমি যদি ইসলাম গ্রহণ করি, তাহলে কোন আইন আমার উপর প্রযোজ্য হবে? উত্তর ২: মুসলিম পার্সোনাল ল (শরিয়ত) তোমার উপর প্রযোজ্য হবে, যা Muslim Personal Law (Shariat) Application Act, 1937-এর অধীনে কার্যকর।

নিত্যা: মুসলিম পার্সোনাল ল-এর অধীনে আমার ও আমার স্বামীর অধিকার কী হবে? উত্তর ৩: এই আইনে বহুবিবাহ অনুমোদিত। অর্থাৎ, তোমার স্বামী চারজন স্ত্রী রাখতে পারেন, তোমার কোনও আইনগত আপত্তির অধিকার থাকবে না।

বিয়েটি চুক্তি (Contract)-র ভিত্তিতে হয়, এবং তার শর্তসমূহ নির্ধারিত থাকে নিকাহনামা (Nikanama)-তে, যা আজও শরিয়তে একভাবে সংজ্ঞায়িত নয়।

নিত্যা: শরিয়ত বলতে কী বোঝায়? উত্তর ৪: শরিয়ত (Shariah) মানে ইসলামি আইনব্যবস্থা, যা এককভাবে কোডিফায়েড নয় এবং বিভিন্ন ইসলামি সম্প্রদায় অনুযায়ী এর ব্যাখ্যা আলাদা। বিভিন্ন মাওলানা বা মুফতি সময়ে সময়ে “হুকুম” ও “ফতোয়া” প্রদান করেন, যা এর অংশ হিসেবে ধরা হয়।

নিত্যা: নিকাহনামা কী? এর মধ্যে কী থাকে? উত্তর ৫: নিকাহনামার কোনও নির্দিষ্ট ফরম্যাট নেই। সাধারণত এটি ছেলেপক্ষের পক্ষে সুবিধাজনকভাবে মোল্লা বা কাজিরা প্রস্তুত করে। এতে “দেওর” বা মেহের (Mehr)-এর পরিমাণ, তালাকের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ, উত্তরাধিকার ইত্যাদি শর্ত উল্লেখ থাকে।
নিত্যা: যদি আমরা হিন্দু বা স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করি, তাহলে আমার স্বামী একাধিক বিয়ে করতে পারবেন?
উত্তর ৬: না। হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট বা স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে একাধিক বিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনি। দ্বিতীয় বিয়ে করলে সেটি অবৈধ (void) হবে এবং প্রথম স্ত্রীর অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে। দ্বিতীয় স্ত্রী উত্তরাধিকার পাবেন না।

নিত্যা: হিন্দু আইন বা স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে তালাকের নিয়ম কী? উত্তর ৭: এই আইনে শুধুমাত্র Family Court-এর মাধ্যমে তালাক নেওয়া যায়। আদালত উভয়ের আয়-ব্যয়ের ভিত্তিতে অ্যালিমনি ও মেইনটেন্যান্স নির্ধারণ করে। উভয় পক্ষ সমান অধিকার ভোগ করে।

নিত্যা: মুসলিম আইনে তালাকের নিয়ম কী? উত্তর ৮: The Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939 অনুযায়ী, স্ত্রীর জন্য নির্দিষ্ট কিছু অবস্থায় আদালতের মাধ্যমে তালাক নেওয়া যায়। কিন্তু স্বামী নিজে থেকেই তালাক উচ্চারণ করে বিয়ে ভাঙতে পারেন, যদিও “ইনস্ট্যান্ট ট্রিপল তালাক” এখন বেআইনি।

নিত্যা: স্বামী কীভাবে তালাক দিতে পারেন? উত্তর ৯: স্বামী তিনটি ঋতুচক্রের (ইদ্দত) মধ্যে তিনবার তালাক উচ্চারণ করলে বিবাহ শেষ হয়ে যায়। স্ত্রী গর্ভবতী হলে সন্তান জন্ম পর্যন্ত সময় গোনা হয়। তালাকের পর মেহের প্রদান করতে হয় যা নিকাহনামায় পূর্বনির্ধারিত থাকে।

নিত্যা: তালাকের পর আমার ও সন্তানের কী হবে? উত্তর ১০: Muslim Women (Protection of Rights on Divorce) Act, 1986 অনুসারে স্বামীকে শুধুমাত্র ইদ্দত (৯০ দিন) পর্যন্ত ভরণপোষণ দিতে হয়। এর পর দায়িত্ব পড়ে পিতৃগৃহের ওপর বা সন্তানের ওপর। যদি কেউ সাহায্য না করতে পারে, আদালত ওয়াকফ বোর্ড-কে নির্দেশ দিতে পারে।

নিত্যা: হিন্দু আইন ও স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে তালাক হলে কী হয়? উত্তর ১১: এখানে উভয় পক্ষের সমান অধিকার। Section 13 (Hindu Marriage Act, 1955) বা Section 27, 28 (Special Marriage Act, 1954) অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী উভয়েই তালাকের আবেদন করতে পারেন।

নিত্যা: আমি যদি ইসলাম গ্রহণ করি, উত্তরাধিকার আইনে আমার অধিকার কী হবে? উত্তর ১২: স্ত্রী হিসেবে স্বামীর সম্পত্তির ১/৮ অংশ পাবে (সন্তান থাকলে), না থাকলে ১/৪।
মেয়ে সন্তান পায় ছেলের অর্ধেক। স্বামী স্ত্রী’র সম্পত্তির ১/৪ পায় (সন্তান থাকলে), না থাকলে অর্ধেক। মা পুত্রের সম্পত্তির ১/৬ বা ১/৩ পেতে পারেন, পরিস্থিতি অনুযায়ী। মুসলিম ব্যক্তি মৃত্যুর আগে তার সম্পত্তির সর্বাধিক ১/৩ অংশ উইল করতে পারেন।

যদি কোনও হিন্দু মহিলা ইসলাম গ্রহণ না করে মুসলিম পুরুষকে বিয়ে করেন, সেই বিয়ে অবৈধ (irregular) ধরা হয়। স্ত্রী মেহের পাবেন, কিন্তু স্বামীর সম্পত্তিতে কোনও অধিকার থাকবে না।
সাম্প্রতিক সুপ্রিম কোর্ট রায়ে বলা হয়েছে, মুসলিম পুরুষের সঙ্গে “অমুসলিম” মহিলার বিয়ে বৈধ নয়; সন্তান উত্তরাধিকার পাবে, কিন্তু স্ত্রী পাবে না।

নিত্যা: যদি ছেলেটি হিন্দু হয়ে আমাকে বিয়ে করে? উত্তর ১৩: হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে স্ত্রী স্বামীর সমান অংশীদার। সন্তান না থাকলে পুরো সম্পত্তি স্ত্রীর নামে যেতে পারে। স্ত্রী নিজস্ব সম্পত্তিরও পূর্ণ মালিক। তালাকের পর স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তিতে আর কোনও অধিকার রাখে না। যদি স্বামী তালাক না দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে, সেই বিয়ে অবৈধ, এবং প্রথম স্ত্রীর অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে।

নিত্যা: যদি আমরা স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করি? উত্তর ১৪: স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করলে ধর্ম অনুযায়ী উত্তরাধিকার আর প্রযোজ্য হয় না। সম্পত্তি উত্তরাধিকার হয় Indian Succession Act, 1925 অনুযায়ী, ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী সবাই সমানভাবে উত্তরাধিকারী হয়।

নিত্যা: “হালালা” বলতে কী বোঝায়? উত্তর ১৫: ইসলামি আইনে, যদি স্বামী স্ত্রীকে তিনবার তালাক দেয় এবং পরে আবার একই স্ত্রীকে বিয়ে করতে চায়, তাহলে স্ত্রীকে আগে অন্য এক পুরুষকে বিয়ে করতে হবে, সেই বিয়েতে শারীরিক সম্পর্ক ঘটাতে হবে, তারপর তালাক নিয়ে তবেই আগের স্বামীকে আবার বিয়ে করা যাবে। একে বলে নিকাহ হালালা (Nikah Halala)।

নিত্যা: এখন তুমি বলো, আমার জন্য কোনটা ভালো হবে? উত্তর ১৬: তোমার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ ও ন্যায্য উপায় হচ্ছে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করা। কারণ মুসলিম পার্সোনাল ল অনুযায়ী বিয়ে করতে গেলে তোমাকে ধর্মান্তরিত হতে হবে, এবং তখন তুমি শরিয়তের অধীনে যাবে যেখানে নারীর অধিকার তুলনামূলকভাবে সীমিত … 

নিত্যা: স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করলে কী সমস্যা হতে পারে? উত্তর ১৭: যদিও এটি আইনি দিক থেকে সেরা বিকল্প, তবুও সামাজিক চাপ অনেক থাকবে। পরিবার থেকে ধর্মান্তরের জন্য চাপ আসতে পারে। আজ হয়তো সালিম খুব আধুনিক চিন্তাভাবনার মানুষ, কিন্তু সমাজ ও পরিবার অনেক সময় মানুষকে প্রভাবিত করে। তুমি ভবিষ্যতের ১০-২০-৩০ বছরের জীবন কল্পনা করো— যদি সব ঠিকঠাক না চলে, তখন কী করবে? সন্তানদের অবস্থা কী হবে? বেশিরভাগ আন্তঃধর্মীয় বিয়েতে দেখা যায় মেয়েটি পরে ফেঁসে যায়, কারণ বাবা-মা তখন আর বেঁচে থাকেন না।

এই কথোপকথনের শেষে নিত্যা ভাববে বলে জানায়। কয়েকদিন পর জানায়, সে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার বাবা-মাও সম্মত।

কিন্তু এরপর গল্পে মোচড় আসে, নিত্যা যখন এই নোটটি তার প্রেমিক সালিমকে পড়তে দেয়, সে রাজি হয় না। বলে, “তোমার আমার মধ্যে যদি বিশ্বাস থাকে, তবে এভাবে সন্দেহ কেন?”
সে প্রস্তাব দেয়, “তুমি শুধু নামেই ইসলাম গ্রহণ করো, ধর্মাচরণে বাধা দেব না। নিকাহনামাও তোমার মতো করে লিখব।” কিন্তু বিয়ে নিকাহ-তেই করতে হবে।

নিত্যা কেঁদে ফোন করে জানায়, সে বিয়ে ভেঙে দিচ্ছে। আমার উত্তর ছিল, “আজ কেঁদে নেওয়া ভালো, কাল সারাজীবন কাঁদার চেয়ে।”

Comments

Popular posts from this blog

কাঁদে নিদারাবাদ

🕉ঈশ্বর ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না!!🕉

বর্ন প্রথা