কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো, 1946 নোয়াখালী।
তখন সন্ধ্যা নামছিল। সূর্যটা দিকচক্রবালে হঠাৎ শান্তশিষ্ট হয়ে একটা লালচে বলের মত হয়ে শরতের ছড়ানো ছিটানো সাদা মেঘেদের লাল করে দিচ্ছিল। আসন্ন শীতের আভাস পেয়েই হয়তো ঠান্ডা হাওয়া বইছিল। কেউ যদি খুব ভালোভাবে লক্ষ করত তাহলে টের পেত সেদিনের সেই হাওয়ায় একটা চাপা শিরশিরানি ছিল। কখনো কখনো হঠাৎ আনমনে কারো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু এমন তো কত সময়েই হয় বলে এড়িয়ে যাচ্ছিল সকলে...কিন্তু তারা জানত না শকুনের সেই হলুদ দুটো চোখের কথা...
সে বাতাসে গন্ধ পেয়েছিল বহুদুর থেকে অনেক আগেই।
উড়াল দিয়েছিল সে, তার শক্ত সবল কালো ডানা, শিবের কন্ঠে জড়ানো আশীবিষের মত সাদা গলা, বাঁকানো শক্তিশালী ঠোঁট তাকে আকাশে সাধারণের দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখতে সক্ষম হত ততক্ষণ, যতক্ষণ না সে নিজের শিকার নির্দিষ্ট করত। এখন সে নির্দিষ্ট করেছিল শিকার...সে চোখ রেখেছিল সময়সারণিতে...
তার বাঁকানো তীক্ষ্ণ ঠোঁট এবং দুপায়ের নখ তৎপর হয়ে উঠল আগামীর আঘ্রাণ পেয়ে...
এবার...
সে মৃত্যুছায়ার মত অনুসরণ করে যাবে তার শিকারকে...
একটি বিরাট উঁচু তালগাছের উপর এসে বসল সে। দু ধারে ডানা ছড়িয়ে দিয়ে নিজের টেলিস্কোপিক নজর ফেলল গালব দাসের বাড়ির উপরে...
...মাধবীদের বাড়িতে আজ লক্ষ্মীপুজো। গত বছরও গেছে আলতাফ। কিন্তু এবছর যাবেনা। মিঞার ফৌজের লোকজন এসে তাকে বলেছেন মূর্তিপুজাই সবচেয়ে বড়ো গুনাহ। আলতাফের প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। সে তো ছোটোবেলা থেকেই এসব দেখেছে। হিন্দু প্রতিবেশীই তো বেশি ছিল। তাই ওই কথা শুনে সে ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছিল আর জানতে পেরেছিল এযাবৎ তার বহু গুনাহ্ হয়েছে। তবে যেহেতু সে জেনেবুঝে গুনাহ্ করেনি এবং যেহেতু আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অতএব তওবা করলে এবং আর ওসব মুশরিকিতে না যোগদান করলে পরকালে আগের বিষয়গুলোর একটা হিল্লে হয়ে যাবে। আলতাফ তওবা করেছে। ফলে এবার সে যেতে পারবেনা।
...আলতাফ দুপুরেই খবর পেয়েছে, ওখানে মিঞার ফৌজ ঢুকেছে আজকে। মিঞার ফৌজ ঢোকার মানে বাইরের দুনিয়া এখনো না জানলেও আলতাফ জানে ভালোভাবেই। ফৌজে তার আত্মীয়ও রয়েছে। সেই আত্মীয়ই তাকে বলেছে, "কলকাতায় মুসলমানগো উপ্রে ওই হালার মালাউনের বাচ্চারা যে অপমানডাই করসে রে ভাইজান, তার আমরা চুখে দেখিনাই বটে, কিন্তু সারোয়ার সাহেব সকলই কইসেন। ওগো বদলা না লইতে পারলে মুসলমান রক্ত নাই রে ভাই আমাগো।"
...করবীর "শাহজাদা তুমি আইসো.." শুনেই আলতাফ বুঝে ফেলেছে গোটা ঘটনা।
তাছাড়া গালবের মেয়ের সাথে রফিকের ছেলের সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষোও যে চলছিল তা সে শুনেছে কুলসুমার মুখে।
কিন্তু তার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল যখন সে দেখল সেই শাহজাদাই লুঙ্গির গিঁট খুলে লাফিয়ে পড়ল করবীর ওপর, আর করবী থেকে থেকে যন্ত্রণার চিৎকার ছাড়া আর কিছুই করছেনা।
তৃপ্ত শাহজাদা করবীর গোঙাতে থাকা শরীরটার উপর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে লুঙ্গি বাঁধতে বাঁধতে বাকিদের বলল, "যা মজা মারবার তাড়াতাড়ি মাইরা নে। কামে লাগতে হইব। ফৌজ আইসা পড়সে।"
তারপর একখানা শাবলের মত কিছু তার এক সাগরেদের হাতে দিয়ে বলল, "সবার কাম হইয়া গেলেও মাগি যদি না মরে তাইলে এইডা হান্দায়া দিস মাগির পোঙায়। আজ ডান্ডিগো এমন শিক্ষা দিমু মোসলমানের লগে কুনোদিন মুখ তুইলা কথা কবে না। আমি একটু আগায়া দেখি ফৌজ কুন্দিকে গেল।"
...উঠানে আসতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়েছিল গালবের। পূর্ণিমার জোছনায় ছোপানো এই রাতে যেন জোনাকির মিছিল। গ্রামের পুবদিক বরাবর সেই জোনাকিরা সারি বেঁধে... তখনই বীভৎস্য ভাবনাটা ঝলসে উঠেছিল গালবের মাথার ভিতরে.... ওরা জোনাকি নয়... আগুন...মশাল।
সাহাপুর বাজারের ঘটনা সে জানে। নারায়নপুরের ঘটনাও। সেখানেও একই ঢঙে আগুন দেওয়া হয়েছে। আর গ্রামের পূবদিকে হিন্দু বসতি বেশি...ওরা কি পশ্চিমদিককেও ছাড়বে? সেই মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছিল বছর চল্লিশের গালব। মেয়েটা ওদের হাতে পড়েনি তো? কী করবে সে? মেয়েকে খুঁজবে নাকি পালাবে? পালালে কীভাবে পালাবে? যদি মিঞার ফৌজ এসে থাকে সাঁকো নিশ্চয়ই ওরা অরক্ষিত রাখবে না.. পদ্মায় এখন তো জোয়ার....
(Diptarup Samyadarshiর লেখা "বেড়াল শকুন ও অন্যরা" বই থেকে টুকরো টুকরো অংশ)
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো, 1946 নোয়াখালী।
Comments